কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন: আমেরিকান ইতিহাসের বীভৎস রূপ

100
কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন

লিখেছেন: আবির্ভাব মৈত্র

কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন

কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন
[Killers of the Flower Moon]
ফিল্মমেকার: মার্টিন স্করসেজি
উৎস-গ্রন্থ: কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন/ ডেভিড গ্র্যান
স্ক্রিনরাইটার: এরিক রথ, মার্টিন স্করসেজি
সিনেমাটোগ্রাফার: রদ্রিগো প্রিয়েতো
এডিটর: থেলমা স্কুনমেকার
মিউজিক: রবি রবার্টসন
কাস্ট [ক্যারেক্টার]: লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও [আর্নেস্ট বার্কহার্ট], রবার্ট ডি নিরো [উইলিয়াম কিং হেল], লিলি গ্ল্যাডস্টোন [মলি কাইল]
রানিংটাইম: ২০৬ মিনিট
ভাষা: ইংরেজি, ওসেজ
দেশ: যুক্তরাষ্ট্র
রিলিজ: ২০ অক্টোবর ২০২৩


রুশ সাহিত্যিক ফিওদর দস্তোয়েভস্কি তার স্বদেশি মহাকবি পুশকিন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘পুশকিন তার কবরে অনেক রহস্য নিয়ে চলে গেছেন। আমাদের কাজ সেই রহস্যগুলোকে মাটি খুঁড়ে বের করে সবার সামনে উপস্থাপিত করা।’ সম্প্রতি প্রেক্ষাগৃহ থেকে কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন দেখে বেরোবার সময় বারবার এটাই মনে হচ্ছিল, যে সকল মানুষের জীবনের (প্রকৃত অর্থে মৃত্যুর) ওপর ভিত্তি করে এই ছবি নির্মিত (অথবা বৃহত্তর রাজনৈতিক অর্থে একটি গোটা রাষ্ট্র নির্মিত), তারা সবাই এভাবেই অনেক রহস্য নিয়ে নিজেদের কবরে চলে গেছেন, বা পরোক্ষভাবে তাদের নিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। সেই রহস্যে মিশে আছে এক চরম বিশ্বাসঘাতকতা বা একটি গোটা জাতির গণহত্যার চক্রান্ত, আর তাই শতাব্দি পেরিয়েও কোনো আমেরিকানই সাহস দেখাতে পারেনি এই রহস্য উন্মচন করে সরবসমক্ষে উপস্থাপন করতে, পাছে কোনো তিক্ত সত্যের সম্মুখীন হয়ে তাদের অতীত অপরাধবোধ ফিরে আসুক সেই ভয়ে। আধুনিক আমেরিকার অন্যতম মাস্টার ফিল্মমেকার মার্টিন স্করসেজি সেই সাহস দেখিয়েছেন, সরবসমকক্ষে তুলে ধরেছেন শতাব্দি ধরে মাটি চাপা পড়ে থাকা তিক্ত সত্যকে।

আমেরিকান লেখক ডেভিড গ্র্যান রচিত কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন– দ্য ওসেজ মার্ডারস অ্যান্ড দ্য বার্থ অব এফবিআই-এর ওপর ভিত্তি করে নির্মিত এই ছবির গঠন মূলত একটি ট্র্যাজেডির সমরূপ। বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধ্বে আমেরিকার ওকলাহোমা রাজ্যের ফেয়ারফ্যাক্স নামক ছোট এক শহরে তেল আবিস্কার হয়। কিন্তু বিত্তবান ও আধুনিক সাদা আমেরিকানদের দম্ভে চিড় ধরিয়ে দেখা যায়, যে জমিগুলোতে তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলো সবই আদিবাসী আমেরিকানদের নামে নথিভুক্ত। এইসব তেলের মালিকানা পাওয়ার লোভে বিভিন্ন সাদা আমেরিকান এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে এবং বিশেষত তারা বিভিন্ন আদিবাসী নারীদের সঙ্গে বিয়ের ফাঁদ পাতে। এই আসবর্ণ বিয়ের ফলে তেলের মালিকানা মূলত এইসব সাদা আমেরিকানদের হাতে চলে আসে, এবং এরপর শুরু হয় সেই নারকীয় গণহত্যা– যেখানে একের পর এক আদিবাসী নারী-পুরুষ রহস্যজনকভাবে মারা যেতে থাকে।

কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন। ফিল্মমেকার: মার্টিন স্করসেজি

কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন-এর গল্পটি মূলত বয়ে চলে এই সকল ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিন চরিত্রকে কেন্দ্র করে– মলি, আর্নেস্ট ও উইলিয়াম হেল। তেলের মালিকানা পাওয়ার লোভে ভাইপো আর্নেস্টকে ওসেজ নারী মলিকে বিয়ে করার পরামর্শ দেন কাকা উইলিয়াম হেল। অতঃপর, এই তিনজনের (মূলত মলির) জীবনে ঘটে চলে নানা আস্বাভাবিক ঘটনা। মলির বিভিন্ন আত্মীয় একের পর এক আস্বাভাবিকভাবে মারা যেতে থাকে। অতঃপর, একটি সময় আসে যখন আর্নেস্ট ক্রমাগত বিষক্রিয়ার মাধ্যমে মলিকেই হত্যা করতে চায়। এই সবকিছুই ঘটে চলে কাকা উইলিয়াম ‘কিং’ হেলের সুপরিকল্পিত ছকে। যদিও এত পরিকল্পনা সত্ত্বেও সর্বশেষে এরা সবাই ধরা পড়ে পুলিশের হাতে।

গল্পের এই সারাংশ থেকে মনে হতে পারে, এটি একটি খুব মাখোমাখো ইনভেস্টিগেটিভ থ্রিলারের গল্প। বস্তুত, ডেভিড গ্র্যানের বইটিও এই ইনভেস্টিগেটিভ দৃষ্টিকোণের দিকে বেশি গুরুত্ব পোষণ করে। কিন্তু স্করসেজির কাছে এই ইনভেস্টিগেশনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর মনস্তত্ত্ব। তাই কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন একটি জনেরিক ছবি না হয়ে, হয়ে ওঠে চরিত্রগুলোর গভীর ও ভয়াবহ বাসনার এক মানবতাবাদী মনস্তাত্ত্বিক নিরীক্ষণ।


মার্টিন
স্করসেজি
আমেরিকার
শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন
হওয়ার কণ্টককীর্ণ রাস্তায় যে
হিংস্রতার সমাহার, তাকে বেফাঁসভাবে
সবার সামনে
উপস্থাপন
করেছেন

স্করসেজি দেখতে চান মানুষের সেই পাশবিক দম্ভকে– যা কি না এত বড় গণহত্যা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। তিনি এই মনস্তাত্ত্বিক নিরীক্ষণের মাধ্যমে একভাবে বুঝতে চান গোটা আমেরিকার স্বরূপকে। আজ একবিংশ শতাব্দিতে দাঁড়িয়ে যে দেশ নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে অথচ সেই দেশেই সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার দিন দিন বেড়ে চলেছে, সেখানে এই ছবি অতীতের চোখে বর্তমানকে পর্যালোচনার এক বিশেষ দ্যোতনা বহন করে চলে। মিশায়েল হানেকে ঠিক যেমন তার দ্য হোয়াইট রিবন ছবিতে অতীতকে নিরীক্ষণের মাধ্যমে দেখাতে চান ‘অশুভের জন্মবৃত্তান্ত’, ঠিক একইভাবে মার্টিন স্করসেজি আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন হওয়ার কণ্টককীর্ণ রাস্তায় যে হিংস্রতার সমাহার, তাকে বেফাঁসভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করেছেন। তাই ছবিটিতে আর্নেস্টের অপরাধবোধ মূলত আমেরিকার অপরাধবোধেরই স্বরূপ হয়ে ফুটে ওঠে।

কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন

নিজের অপরাধবোধে পুষ্ট হয়ে যখন সে মলিকে দেওয়া বিষটি নিজেও কিছুটা পান করে, তখন স্করসেজি যেন বলতে চান, এই গরল সকল আমেরিকানদের জন্য। তারা সবাই পাপী, ইতিহাসের কাছে, এইসব সংখ্যালঘু মানুষদের কাছে। কারণ তাদের আজকের এই শ্রেষ্ঠত্ব এইসব আজস্র মানুষের বলিদানের পর স্থাপিত। যে বলিদান অন্যায্য; যে বলিদান মানুষের লোভ, লালসার ফল।


এই ইতিহাস কি শুধু
একটি গল্প হয়েই
থেকে যাবে?

কিন্তু এত কিছু করে স্করসেজি একজন সৎ শিল্পী হিসেবে অতীতের শুদ্ধিকরণের চেষ্টা করেন না। বরং তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করেন তার এই ছবি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে। শেষ দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই একটি আমেরিকান রেডিও শোয়ের মঞ্চ, যেখানে মূল চরিত্রগুলোর অন্তিম পরিণতি বিভিন্ন অভিনেতা অভিনয় করে দেখান, যা মূলত কিছুটা ব্যঙ্গাত্মক ও কৌতুকআশ্রিত। সচরাচর সিনেমার শেষে চরিত্রদের পরিণতি ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে বিভিন্ন লিখিত টাইটেলের মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রে এই নতুন পন্থা সত্যিই মৌলিক। কিন্তু আমার মতে, এইরূপ টেকনিক ব্যবহারের মাধ্যমে স্করসেজি আমাদের এই গোটা সিনেমা বানানোর প্রক্রিয়া নিয়েই একটি প্রশ্ন ছুড়ে দেন। তিনি প্রশ্ন করেন, এই ইতিহাস কি শুধু একটি গল্প হয়েই থেকে যাবে? নাকি সত্যিই সময় এসেছে নিজের অতীত ভুলের জন্য নিজেকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজের মননকে প্রশ্ন করার?

কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন

শেষ দৃশ্যে নিজে ফ্রেমে উপস্থিত হয়ে তিনি যেন এই কাজটাই করেন। নিজের মননকে প্রশ্ন করে, তিনি এই পরিণতিতে আসেন যে, তার হাতেও রক্তের দাগ লেগে আছে; আর পাঁচটা আমেরিকানের মতো তিনিও সমানভাবে পাপে দুষ্ট।

সব মিলিয়ে কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন আমেরিকান ওয়েস্টার্ন ছবিতে বর্ণিত ‘ন্যাশনবিল্ডিং’-এর একটি প্রতিপ্রস্তাব। যে প্রতিপ্রস্তাব আমেরিকান ন্যাশনবিল্ডিংয়ের যাবতীয় মিথের ভঙ্গুরতাকে চোখে আঙুল দিয়ে চিহ্নিত করে, আমেরিকার অতীত হিংস্র ইতিহাসকে মাটির তলা থেকে উপড়ে বের করার মাধ্যমে।

Print Friendly, PDF & Email