লিখেছেন: বেলায়াত হোসেন মামুন
চলচ্চিত্র ঘুড্ডি যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, তখন এই চলচ্চিত্রের নির্মাতাকে আমার জানা ছিল না। মনে আছে, প্রথমবার ঘুড্ডি দেখেছি ভিএইচএস ফরম্যাটে যদিও, তবু তা ছিল ‘বড় পর্দা’রই প্রদর্শনী। ছবিটি দেখেছিলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চলচ্চিত্রচক্রের একটি আয়োজনে। ঘুড্ডির আগে ঘুড্ডির মতো এবং ঘুড্ডি নির্মাণের আজ প্রায় ৪৩ বছর পর বলতে পারি, ঘুড্ডির মতো আর কোনো চলচ্চিত্র বাংলাদেশে হয়নি। ঘুড্ডির চেয়ে নিখুঁত চলচ্চিত্র বাংলাদেশে হয়েছে, এমনকি ঘুড্ডির আগেই হয়েছে, এবং পরে তো আরও হয়েছে; ঘুড্ডি তবু অনন্য একটি চলচ্চিত্র।
কেন?
কারণ, ঘুড্ডি বাংলাদেশের এমন একটি চলচ্চিত্র যা নির্মাণ প্রকরণের দিক থেকে ফরাসি নবতরঙ্গের মেজাজকে সঙ্গী করেছে, কিন্তু হয়ে উঠেছে শতভাগ দেশীয় চলচ্চিত্র। ছবিটি সমকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রবণতাগুলোকে চিন্তাশীলভাবে ধারণ করেছে; অথচ ছবিটি ক্লান্ত করে না। ‘বিনোদন’ দেয় এবং সবাইকে মুগ্ধ করে।
ঘুড্ডির আগে বাংলাদেশের এমন কোনো চলচ্চিত্রের নাম আমরা করতে পারব না, যে চলচ্চিত্র এতটা সফলভাবে চলচ্চিত্রের ভাষা ও ভঙ্গির এমন নিরীক্ষাপ্রবণ মেজাজ ধারণ করেছে। আশ্চর্য হলো, ঘুড্ডির নির্মাতা এই নিরীক্ষার পথে পরবর্তীকালে আর হাঁটেননি। যে নির্মাতার সক্ষমতা ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে নতুন ভাষা ও ভঙ্গির পথে নেতৃত্ব দেওয়ার, কোনো এক অজানা কারণে পরবর্তীকালে তিনি সেই পথের নির্মাতা আর হলেন না; তিনি হলেন অনেক কিছু এবং হলেন শিক্ষক।
…
তাঁর
ছাত্ররাও
কেউই ঘুড্ডির
নির্মাতার প্রকরণে
কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি
…
আজ সেই নির্মাতা ও শিক্ষকের আকস্মিক প্রয়াণের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বলছি, তাঁর ছাত্ররা বাংলাদেশে নতুন এক ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এটি সত্য। কিন্তু তাঁরাও, অর্থাৎ তাঁর ছাত্ররাও কেউই ঘুড্ডির নির্মাতার প্রকরণে কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি। ফলে, ইতিহাসে ঘুড্ডি আজও উড়ছে, একা!

১.
ঘুড্ডি দেখার এবং ঘুড্ডি নিয়ে উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনার প্রায় ১০ বছর পর আমার সুযোগ হয় ঘুড্ডির নির্মাতা সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীর মুখোমুখি হওয়ার। আর এই সংযোগ যিনি তৈরি করেছিলেন, তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আরেকজন কিংবদন্তি, চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান।
সময়টি ২০০৯ সাল। আমরা ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির একটি ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স আয়োজন করছিলাম তখন। সেই কোর্স উদ্বোধন করার জন্য তখন বাদল ভাইকে অনুরোধ করি। বাদল ভাই বলেন, ‘আমি একা কেন? জাকীকেও বলো।’
কিন্তু আমি তখন জানতাম জাকী ভাই দেশে নেই। তিনি ২০০১ সালে কানাডায় চলে গিয়েছিলেন। দেশে ফিরেছেন– এ খবর তখনো আমার জানা ছিল না। এটা বাদল ভাইকে বলার পর তিনি বললেন, ‘দাঁড়াও, আমিই কল করে তোমার সাথে কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’
এভাবে ঘুড্ডির স্রষ্টা সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী ভাইয়ের সাথে সরাসরি পরিচয় হলো আমার। জাকী ভাই এরপর আমাদের সহযোদ্ধা হয়ে উঠলেন; আমাদেরকেও করে নিলেন তাঁর যুদ্ধপ্রকরণের প্রকল্পে। হয়ে উঠলেন ম্যুভিয়ানার একজন অভিভাবক। আর এ বিষয়টি আমাদের জন্য ছিল শক্তির, সাহসের এবং অনুপ্রেরণার। পরিচয়ের পর থেকে প্রয়াণের পূর্বের দিনটি পর্যন্ত আমাদের সকল কোর্স, কর্মশালা, চলচ্চিত্র উৎসব, সেমিনারসহ সকল আয়োজনে তিনি আমাদের মাঝে উপস্থিত থেকেছেন। যেমনটি আমাদের সাথে ছিলেন চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান।
বাদল ভাই ২০১০-এর জুন মাসে চলে গেলেন। রেখে গেলেন জাকী ভাইকে। বাদল ভাই চলে যাওয়ার ১৩ বছর পর জাকী ভাইও চলে গেলেন। এর মাঝে চলে গেছেন আলোকচিত্রশিল্পী ও সিনেমাটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেন। বাংলাদেশের প্রথম তিনজন চলচ্চিত্র শিক্ষার্থী, যাঁরা তাদের তৎকালীন ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা ও ক্যারিয়ারকে লাথি মেরে চলচ্চিত্রকে ভালোবেসেছিলেন, স্কলারশিপ নিয়ে গিয়েছিলেন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে; তাঁরাই ছিলেন প্রথম, সূচনাবিন্দুর মতো শক্তিধর। আজ তাঁরা তিনজনই আজ অন্যলোকের বাসিন্দা হয়েছেন। বাদল রহমান, সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী এবং আনোয়ার হোসেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এই তিন দিকপালের অবদান কেবল চলচ্চিত্র নির্মাণে নয়, দেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতি বিকাশে ও নির্মাণে তাদের অবদানকে গভীরভাবে না জানলে তাদের সম্পর্কে আদতে কিছুই জানা হবে না।

২.
কর্ম ও কীর্তির বিচারে সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী একজন সফল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। ‘সাংস্কৃতিক’ ব্যক্তিত্ব; কারণ, সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি এমন এক কালপর্বে এমন সব উদ্যোগ ও প্রয়াসে নিয়োজিত ছিলেন যা আমাদের সাংস্কৃতিক মণীষা বিকাশে বিপুল প্রভাব রেখেছে। প্রভাব রেখেছে সামাজ রূপান্তরে ও রাজনৈতিক চিন্তা ও চেতনায়। সময়কে এভাবে প্রভাবিত করবার ক্ষমতা কেবলমাত্র সময়ের নায়কদেরই থাকে। সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম নায়ক।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকের তুখোড় লিটলম্যাগ সম্পাদক, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সমর্থনে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের চাকরিতে ইস্তফা দেওয়া, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফিল্ম সোসাইটি ‘সিনে আর্ট সার্কেল’ প্রতিষ্ঠা এবং ঢাকা থিয়েটার-এর জন্মে নেতৃত্ব প্রদানসহ বহুবিধ উদ্যোগে তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন।
ঢাকা শহরে কাক ও কবির সংখ্যার আনুপাতিক হার নিয়ে তৈরি যে ব্যঙ্গবিদ্রূপ, সেই ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপের জন্ম যে লিটলম্যাগকে ঘিরে, সেই লিটলম্যাগ কাক-এর সম্পাদক যে সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী, এ তথ্য চলচ্চিত্রকার সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীর নামের আড়ালে যেন বিস্মরণের শিকার। একইভাবে কবি ও গল্পকার সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীও কিন্তু লুপ্ত হয়েছেন।
একজন মানুষের যখন বহুদিক একইরকমভাবে প্রতিভার আলোয় উদ্ভাসিত হয়, তখন সেই মানুষের চারপাশে থাকা জনতা বিভ্রান্ত হয়; বুঝতে পারে না তাকে কি অভিধায় চেনা যায়, আর তখন ওই প্রতিভাবান ব্যক্তির কোনো একটি পরিচয় শক্তিশালী হয়ে সামনে এলে ওই পরিচয়ের বাইরে থাকা ব্যক্তির অপরাপর গুণসকল হারিয়ে যায়, মানুষের কাছে আর-সব পরিচয় মুছে যায়। কখনো কখনো খোঁদ ওই ব্যক্তিরও তা হয়। যেমন জাকী ভাইও প্রায় ভুলতে বসেছিলেন, লেখাটা তাঁর একটি বড় গুণ ও ক্ষমতা। বহু বছর তিনি লেখালেখির বাইরেই ছিলেন একপ্রকার। নানাভাবে উসকে দিয়ে, তাতিয়ে, খুঁচিয়ে, গত কয়েক বছরে তাঁকে দিয়ে কিছু কিছু লেখা লিখিয়ে নিয়েছি, লিখতে উৎসাহিত করেছি। কারণ আমি জাকী ভাইয়ের লেখার একজন মুগ্ধ পাঠক।
…
বহু প্রতিভাবান মানুষ
সবচেয়ে বেশি
অবহেলা
করেন
খোঁদ নিজেকেই
…
আমার ধারণা, জাকী ভাই শুধু যদি লিখতেন, তাহলে তাঁর সক্ষমতার অন্য আরেক পরিচয় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখতাম। এও এক আশ্চর্য ব্যাপার বটে, বহু প্রতিভাবান মানুষ সবচেয়ে বেশি অবহেলা করেন খোঁদ নিজেকেই। জাকী ভাইও বিভিন্নভাবে তা করেছেন।
৩.
পঞ্চাশ বছর আগে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির হাল অত্যন্ত বাজে অবস্থায় ছিল। চলচ্চিত্র যে অত্যন্ত সিরিয়াস একটি মিডিয়াম– এ কথা আমাদের কর্তৃত্ববাদী সরকার ও সরকারের আমলাদের বাইরে খুব অল্প মানুষই জানত এবং বিশ্বাস করত। আমাদের এই দেশে চলচ্চিত্র কেবল কাঁচা টাকার ‘বিনোদন’, অথবা মজা, অথবা ছিল রগরগে উত্তেজনার একটা বিষয় মাত্র। চিন্তাশীল চলচ্চিত্র এই দেশে প্রায় অসম্ভব ছিল; চলচ্চিত্রের চিন্তাশীল তৎপরতাও প্রায় অসম্ভব ছিল। আজকে আমাদের সমাজে চলচ্চিত্রের যে বহুমুখী গ্রহণযোগ্যতা, তার পেছনে এই দেশের বহু মানুষের ষাট বছরের লড়াই আছে, আর সেই লড়াইয়ের নাম– চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীর ভূমিকা অন্যতম পুরোধার এবং অভিভাবকের। পঞ্চাশ বছরেরও অধিকাকাল ধরে সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী এই দেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে তাঁর প্রাণের সম্পর্ক জারি রেখে গেছেন। সেই সম্পর্ক গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকে আর নবায়িত হবে না।
কিন্তু এই যে তাঁর পঞ্চাশ বছরের চলচ্চিত্র সংস্কৃতি বিকাশের যাত্রা, এই যাত্রায় তিনি এবং তাঁরা কী কী অবদান রাখতে পারলেন?

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। দেশের বহু সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রকে ‘পড়ানো’ হচ্ছে, এটা তার এবং তাদের আন্দোলনের অবদান। দেশে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৭৩ সালেই পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেছেন বাদল রহমান এবং সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী। যদি সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী এবং বাদল রহমান পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়তে না যেতেন, তাহলে হয়তো আমাদের দেশে আজও ফিল্ম আর্কাইভের প্রতিষ্ঠাই হতো না। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে হাজির ছিলেন সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী।
আলমগীর কবির, বাদল রহমান এবং সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী হলেন স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী এমন তিনজন চলচ্চিত্রকার, যাঁরা ইন্ডাস্ট্রির ভেতরেও ছিলেন সরব, আবার ইন্ডাস্ট্রির বাইরেও ছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায়। ইন্ডাস্ট্রির থাবা তাদের নষ্ট করতে পারেনি। তাঁরা তিনজন দীর্ঘ সময়জুড়ে চলচ্চিত্র আন্দোলনে যুক্ত তরুণদের এমনভাবে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাদের ছাত্ররাই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গতিমুখ বদলে দিতে সফল হয়েছেন। এই তিনজনই দেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী চলচ্চিত্র সংসদসমূহের ফেডারেটিভ বডি ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সভাপতি হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন।
৪.
সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী ঘুড্ডি ছাড়াও নির্মাণ করেছেন আরও দুটি চলচ্চিত্র। আয়না বিবির পালা এবং লাল বেনারসি। শেষের ছবি দুটি নিয়ে তিনি নিজেই অসন্তুষ্ট ছিলেন। সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীর সক্ষমতার ছাপ ঘুড্ডিতেই আমরা পাই। ঘুড্ডি দেখার পর অপর চলচ্চিত্র দুটি দেখলে হতাশ হতে হয়। এ কারণে আমি মনে করি জাকী ভাইয়ের অপর ছবি দুটি না দেখলেও কারো কোনো কিছু মিস হবে না। এক ঘুড্ডিই একজন সালাহউদ্দীন জাকীকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথেষ্ট।
কিন্তু একজন সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীর গুরুত্ব কি কেবল ঘুড্ডির নির্মাতা হিসেবেই? অথবা, একজন সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীকে আমরা আজ বিচার করতে বসে কেবল কি তাঁর ‘চলচ্চিত্রকার’ পরিচয়কেই মুখ্য করে রাখব?
আমি মনে করি, আমাদের এই শিশুরাষ্ট্রের জন্ম ও বিকাশপর্বে এই অনন্য মানুষেরা একটি দেশ শুধু নয়, একটি জাতিগঠনের দায়ভার গ্রহণ করেছিলেন। তাদের জীবনে তাই ব্যক্তিগত সাফল্য ততটা মাইনে রাখেনি, যতটা রেখেছে সামাজিক ও সামষ্টিক সাফল্যের মাইনে। একজন সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী অথবা বাদল রহমান অথবা আলমগীর কবির নির্মাতা হিসেবে যতটা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের দাবি রাখেন, তারচেয়ে বহুগুণ অধিক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন হওয়া উচিত তাদের চিন্তাশীল তৎপর জীবনের সামষ্টিক ইমপেক্ট নিয়ে। আর সে মূল্যায়ন আমাদের সময় ও সমাজ, এমনকি রাষ্ট্র এখনো করে উঠতে পারেনি।
৫.
সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী চলে গেছেন। ওনার আকস্মিক মৃত্যুতে আমি দুঃখ পেয়েছি। জাকী ভাইয়ের এই চলে যাওয়াটা আমার জন্য এমন যে, আমার উদ্যম ও উৎসাহ যেন অনেকটা চলে গেছে ওনার সাথে।
এই শহর, এই দেশ এখন ভীষণ হতাশাজনক অবস্থায় আছে। আমি এই শহরে খুব একটা আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু দেখতে পাই না। নৈতিকতা বলে একটি শব্দ আছে এখনো আমাদের ভাষায়। কিন্তু এই শব্দটি বর্তমানে কোনো অর্থবহন করে না। ঢাকা এখন এমন একটি শহর, যাকে আমার পুরোপুরি অনৈতিক ও মূল্যবোধহীন এক নিষ্পেষণযন্ত্র মনে হয়। এই শহরে খুব সামান্য কয়েকজন মানুষের উপস্থিতি আমাকে এখনো সজীব রেখেছে। কিছুটা উদ্যম এখনো যে আছে, তা এই কয়েকজন মানুষের জন্যেই। সেই কয়েকজন মানুষের একজন সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী চলে গেলেন। এই শহরে শ্রদ্ধা করার মতো মানুষ আর কয়জন-ই-বা থাকলেন!
জাকী ভাইয়ের চলে যাওয়াটা আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। এই বাক্যটি কথার কথা নয়। সত্য। কেমন সত্য? সত্য হলো এই, বিগত বছরগুলোতে আমি চলচ্চিত্রে আগ্রহী বহু বহু তরুণকে বিভিন্ন কর্মশালা, কোর্স, পাঠচক্র, মাস্টারক্লাসে একত্রিত করে জাকী ভাইকে জোর করে হলেও হাজির করতাম এই তরুণদের সামনে। জাকী ভাই অনেক সময় বলতেন, ‘কী পড়াব?’ আমি বলতাম, ‘কিচ্ছু পড়াতে হবে না। আপনি শুধু আপনার গল্প করবেন। চলচ্চিত্রের খুঁটিনাটির তথ্য তো সহজেই পেয়ে যাবে বিভিন্ন সোর্স থেকে। কিন্তু আপনার উপস্থিতি আর আপনার গল্প থেকে ওরা যে শক্তি, সাহস ও স্বপ্ন পাবে, তা কোনো বইয়ে পাবে না।’ জাকী ভাই হেসে বলতেন, ‘ওকে, ক্যাপ্টেন!’

৬.
গত প্রায় ১৪ বছরে জাকী ভাইয়ের সাথে স্মৃতির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কারণ এই ১৪ বছর জাকী ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগ, সম্পর্ক, কাজ এত সক্রিয়তার মধ্যে ছিল, তা আমার নিজের জীবনের জন্য এক অমূল্য অভিজ্ঞান হয়ে থাকবে। আজ এই পরিসরে শোকের ভার খুব বেশি, তাই লিখবার ফুরসত কম। জাকী ভাইকে নিয়ে লেখার বহু কিছু আছে, লিখতে হবে। আজ এই লেখাটি শেষ করার আগে আর মাত্র দুটি কথা বলব।
জাকী ভাই প্রায়ই বলতেন, ‘আমলাদের আমলে নেবে না। কারণ, তাদের কাজই হলো বাধাদান। সহযোগিতা করা তাদের কাজ নয়।’ তিনি বলতেন, চলচ্চিত্রাচার্য আলমগীর কবির তাঁকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে সচিবালয়ে আমলাদের কক্ষে ঢুকতে হয়। আর সেটা হলো, আমলাদের কক্ষে ঢুকতে হয় হাত দিয়ে দরজা খুলে নয়, ডান কাঁধে দরজায় ধাক্কা দিয়ে। বলতেন, ‘শিল্পীকে কারো সামনে হাত কচলাতে নেই।’
এই সব জাকী ভাই বলতেন। আর বলতেন, নিজেরই আমলা হয়ে দীর্ঘসময় এফডিসি, বিটিভির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনের নামে নিজের ‘সময়’ অপচয়ের কথা। তাঁর সৃজনশীল সামর্থ্যের যে খুব সামান্যই তিনি কাজে লাগাতে পেরেছেন, তা তিনি অনুভব করতেন। এ নিয়ে আফসোস করতেন।
আমলাগিরির চাকরির মোহ ত্যাগ করতে না পারাতে তিনি যে নিজের কাছে নিজে পরাজিত হয়েছেন, তা বেশ স্পষ্টভাবেই স্বীকার করতেন। এও এক বিরল ব্যাপারই বটে। কারণ তাঁর চাকরিগুলো সবই ছিল উচ্চপদের। কিন্তু তিনি এই উচ্চপদগুলোকে কখনো তাঁর সৃজনশীল আকাঙ্ক্ষার উপরে স্থান দেননি।
…
সেই
শূন্যতা
কেবল হারানোতেই
সীমিত
নয়
…
জাকী ভাইয়ের মা ছিলেন একজন কবি ও চিত্রশিল্পী। বাবা ছিলেন অধ্যাপক। সেই পিতা-মাতার সন্তান সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী, যিনি তাঁর শিক্ষাজীবনে কখনো প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হননি। পাণ্ডিত্য, ব্যক্তিত্ব ও রুচিতে যিনি নিজের সময়ের সবচেয়ে উজ্জ্বল মানুষ। সেই মানুষটির প্রয়াণে এই দেশ, এই শহর এবং আমরা তো শূন্য হলামই। আর সেই শূন্যতা কেবল হারানোতেই সীমিত নয়। জাকী ভাইয়ের প্রয়াণে কেবলই মনে হচ্ছে, আমার প্রিয়জনদের মধ্যে থাকা বাদল রহমান, তারেক মাসুদ, আনোয়ার হোসেনের পর জাকী ভাইও চলে গেলেন।
আমার আগামীর একটি নতুন চিন্তা, একটি নতুন চলচ্চিত্র, একটি নতুন লেখা, একটি নতুন বই প্রকাশিত হলে আর কাকেই বা আগ্রহ নিয়ে বলব, ‘জাকী ভাই একটু দেখুন, শুনুন, পড়ে বলুন না কেমন হলো?’
এই শহরে এমন মানুষের সংখ্যা অগণন, যাদের শ্রদ্ধা করি না। তাদের কাছ থেকে পাওয়া উপহারের বর্ষাও ততটা কাম্য নয়, যতটা মহার্ঘ্য ছিল আমার এই প্রিয়জনদের একটি বাহবা, একটি অভিনন্দন অথবা একটি পরামর্শের গুরুত্ব। জাকী ভাইয়ের প্রয়াণে এই শহর থেকে আশীর্বাদ ও উৎসাহের ছায়া দেওয়ার বিশাল বৃক্ষ হারিয়ে গেল। এই বেদনার ভার, আর এই শূন্যস্থান আমরা কি দিয়ে ভরব!
এই রচনা ঈষৎ সংক্ষেপিত রূপে 'ঢাকা পোস্ট'-এ প্রকাশিত হয়েছে। সম্পূর্ণ লেখাটি লেখকের সম্মতিতে এখানে প্রকাশ পেল। --ফিল্মফ্রি