হাওয়ায় হাওয়ায় মিথের খেলা, কিছু অমিমাংসিত বয়ান এবং নতুন বোঝাপড়া

487
হাওয়া

লিখেছেন: তানিয়া সুলতানা

হাওয়া
ফিল্মমেকার: মেজবাউর রহমান সুমন
স্ক্রিনরাইটার: জাহিন ফারুক আমিন, সুকর্ণ শাহেদ ধীমান
এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার: শিমুল চন্দ্র বিশ্বাস
সিনেমাটোগ্রাফার: কামরুল হাসান খসরু
মিউজিক স্কোর: রাশিদ শরীফ শোয়েব
এডিটর: সজল অলোক
কাস্ট: চঞ্চল চৌধুরী, নাজিফা তুষি, শরিফুল রাজ, সুমন আনোয়ার, সোহেল মন্ডল
রানিংটাইম: ২ ঘণ্টা
ভাষা: বাংলা
দেশ: বাংলাদেশ
রিলিজ: ২৯ জুলাই ২০২২


এ সময়ের আলোড়ন তোলা চলচ্চিত্র হাওয়ায় দেখা মিলবে এ দেশে প্রচলিত নানান মিথ আর মিথের ভিন্নতর ব্যাখ্যার ভিজ্যুয়াল উপস্থাপন। মিথকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র এ দেশে নতুন নয়, তবে নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন যে কায়দায় গল্প বলেছেন, চরিত্রগুলো নির্মাণ করেছেন, সেটা বেশ নতুন। ঠিক এক ধাক্কায় চরিত্রগুলোকে যেন পাঠ করা যায় না।

হাওয়া যেভাবে শুরু কিংবা শেষ হয়, সেই জায়গা দুটো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শুরুর দৃশ্য দর্শককে বলে দেবে, ছবিটা দেখার চোখ কী রকমের হতে হবে, আবার শেষ দৃশ্য নিশ্চিতভাবে বুঝিয়ে দেবে চরিত্রগুলোকে নিয়ে একবার, দুইবার, তিনবার ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। ছবির গল্প কিংবা চরিত্রগুলো মিথ থেকে সরাসরি এসে হাজির হয়নি।কাহিনিতে যেমন প্রচুর ভিন্নতা আছে, তেমনি চরিত্রগুলোকে যেন ছাঁচে ফেলা মুশকিল।

সিনেমার শুরুতেই নির্মাতা চাতুর্যতার সাথে দর্শককে গাইড করে দেন। আমরা সাগর সৈকতে একজন ক্যানভাসারকে বলতে শুনি বিশ্বাসের কী গুণ! বিশ্বাস করে বিষ খেলে যে তা মধু হয়ে যায় আর মধু হয়ে যেতে পারে বিষ– বিশ্বাস হারিয়ে ফেললেই। ফলে এই চলচ্চিত্রে এরপর যা যা দেখানো হবে, আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে, শুধুমাত্র তাহলেই দর্শক মধুর স্বাদ আস্বাদন করতে পারবেন।

এরপর ক্যামেরা, এডিটিং আর শব্দের সংঘাতে ও সংযোজনে আমরা চলে যাই মেজবাউর রহমান সুমনের নয়নতারায়, এর প্রধান চাঁন মাঝি যার অধীন সাতজন পুরুষ (জেলে, পাচক এবং মিস্ত্রি)। গল্প এগোলে আমরা দেখব যে এই চাঁন মাঝির সাথে গুলতির দ্বৈরথ। এই দ্বৈরথ মনে করিয়ে দেবে সপ্তডিঙা মধুকরের চাঁদ সওদাগরের সাথে দেবী মনসার কিসসার কথা।

হাওয়া
হাওয়া। ফিল্মমেকার: মেজবাউর রহমান সুমন

নদীমাতৃক দেশে কি হিন্দুর ঘর কি মসুলমানের ঘর, এ আমাদের নিজস্ব মিথ, সবাই জানি শিবের পূজারী চাঁদ সওদাগর কোনোভাবেই মনসাকে পূজা দেবে না। সেই পূজা না পেলে আবার মা মনসা স্বর্গে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না। মা মনসা একে একে হত্যা করেন চাঁদ সওদাগরের সাত পুত্রকে। কিন্তু আমাদের হৃদয় ভেঙে যায় লোহার বাসর ঘরে লখিন্দরের মৃত্যুতে, বেহুলা বিধবা হলে। এরপর শুরু হয় মৃত স্বামী নিয়ে ভেলায় চরে বেহুলার অভিযান।

গল্পের শুরুতে গুলতিকে মৎস্যকন্যা কিংবা মনসার আদল দেওয়া হলেও, একদম শেষ দৃশ্য আপনাকে চমকে দেবে। গুলতি কি নিছকই এক মৎস্যকন্যা কিংবা মনসা দেবীর প্রতীক? শেষ দৃশ্যে মৃত ইবাকে নিয়ে গুলতির যে অনন্তযাত্রার ইঙ্গিত, সেটা বেহুলা লখিন্দরের ভেলা ভাসানোর কথা মনে করিয়ে দেয়। তাই এই শেষ ইঙ্গিতটুকু পুরো চলচ্চিত্রটিকে একেবারে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি করে।


ত্রিভুজ
সম্পর্কের
টানাপোড়েন
রচনার মধ্য দিয়ে
হাওয়া মিথের অনুগামী
হয়েও এক আশ্চর্য
মৌলিকত্ব নিয়ে
হাজির
হয়

গুলতি বেদের মেয়ে, দেবী মনসার আশীর্বাদপুষ্ট। তার মাথায় চাঁন মাঝির রক্তে দরিয়ায় পানি লাল করার প্রতিশোধ। কিন্তু আমরা দেখি গল্পে ইবার সাথে গুলতির কিভাবে-কিভাবে প্রেম হয়ে যায়। মিথের একটা দিক ছিল মনসা ও চাঁদ সওদাগরের দ্বন্দ্ব আরেকটা দিক ছিল বেহুলা-লখিন্দরের যুগল যাত্রা, বড় চারটা চরিত্র। কিন্তু চলচ্চিত্রে ত্রিভুজ সম্পর্কের টানাপোড়েন রচনার মধ্য দিয়ে হাওয়া মিথের অনুগামী হয়েও এক আশ্চর্য মৌলিকত্ব নিয়ে হাজির হয়।

হাওয়ার মূল সুর ছিল প্রতিশোধের। চাঁন মাঝির বিপরীতে গুলতির প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠা গল্পের প্রাণ। এটা গল্পের একটা দিক। কিন্তু গল্পের আরেকটা দিক হলো খোদ মনসাকে বেহুলার অবস্থানে টেনে আনা। সেই একই দুঃখ, সেই একই বেদনায় বিপর্যস্ত করে তোলার সুযোগ মেজবাউর রহমান সুমন ছাড়েননি। মৃত স্বামীকে নিয়ে বেহুলার যে নিরন্তর ভেসে চলা দুরন্ত দরিয়ায়, সেই একই দৃশ্য আমরা দেখি ক্যামেরার টপ অ্যাঙ্গেল থেকে। এভাবে একই চরিত্রে আমরা মিথের দুই বিপরীতমুখী চরিত্রকে দেখতে পাই।

হাওয়া
হাওয়া। ফিল্মমেকার: মেজবাউর রহমান সুমন

হাওয়া তাই নানা অর্থে অদলবদল কিংবা ট্রান্সফরমেশনের ছবি, কিংবা চরিত্রগুলো যেন ভালোয়-মন্দে দ্রবীভূত হয়ে যায়। মনসার বেহুলা হয়ে ওঠার গল্প হাওয়া। একের পর এক অঘটনের পরম্পরায় চাঁন মাঝি আর নাগুর চরম অবিশ্বাস নিয়ে সহাবস্থানের গল্প হাওয়া। মিথের আত্মবিশ্বাসী অহংকারী চাঁদ বনিক যে কিনা একে একে সব সন্তান হারিয়েও বাঁ হাতে পূজা দেয় দেবী মনসাকে, সেই আত্মবিশ্বাস আর অহমকে আমরা একটু একটু করে লুটিয়ে পরতে দেখি চাঁন মাঝির মধ্য দিয়ে। মিথে চাঁদ বণিকের মৃত্যু হয় না, কাহিনির পরতে পরতে দেবীর প্রতি চাঁদের উন্যাসিকতা কটূবাক্য চরম অপমান– তার শেষ আসলে পূজার মধ্য দিয়ে হয়নি। এটা ছিল একটা অসম্পূর্ণ দিক, যাকে সম্পূর্ণ হতে দেখার সুযোগ তৈরি হয় একটু একটু করে চাঁন মাঝির মনে ভয় ভীতি এবং চরম নৈরাশ্য উৎপাদনের মধ্য দিয়ে।

প্রচলিত মিথে একে একে বাণিজ্য তরী ডুবে গেলে, পুত্র সন্তান হারালে চাঁদ বণিকের প্রতি আমাদের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। দেবী মনসাকে নিষ্ঠুর মনে হয়। ঠিক এমন একটা জায়গায় হাওয়া প্রশ্ন তোলে, এই যে চাঁদ বণিকের এত টাকা, ৪১টা নৌকা, এর উৎস কী? হাওয়ায় এক সময় আমরা গুলতির মুখে শুনি, এই চাঁন মাঝির অতীত ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস রক্তাক্ত, সেই ইতিহাস লুটের, অন্যের ভাগের সম্পদ নিজের কাছে এনেই সে উঁচু আসন নিয়েছে। এটা চাঁন মাঝির প্রতি মনসার চরম প্রতিশোধপরায়ণতার বৈধতা নিশ্চিত করে।


পিতৃত্বের নয়, বরং পিতৃতান্ত্রিকতার
যে কদর্যতা দেখি চাঁদ বণিকের
চরিত্রের ভেতর, তার চরম
বহিঃপ্রকাশ ঘটে শালিক
পাখিকে পুড়িয়ে
খাওয়ার
দৃশ্য তৈরির মধ্য দিয়ে

সন্তানের মৃত্যুতে এই যে চাঁদ বণিককে আমরা দুর্বল হতে দেখি; আকুল হতে দেখি না। এর মধ্য দিয়ে পিতৃত্বের নয়, বরং পিতৃতান্ত্রিকতার যে কদর্যতা দেখি চাঁদ বণিকের চরিত্রের ভেতর, তার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে শালিক পাখিকে পুড়িয়ে খাওয়ার দৃশ্য তৈরির মধ্য দিয়ে। চাঁদ বণিকের সাত পুত্র কেবল বংশ ও সম্পদের উত্তরাধিকারীই নয়, বরং তার বর্ধিত শক্তির প্রতীক। ফলে কিসসায় পুত্রহারা পিতার শোক ফুটে ওঠে না; বরং সওদাগরের ধন ও বল কমে যাচ্ছে, তেমন বয়ান তৈরি হয়। কারণ শোক পুরুষের জন্য নয়, বেহুলার মতন সতী নারীদের জন্য। তাই স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে বেহুলাকে যত রাজ্যের কাঠখড় পোড়াতে হয়; অন্যদিকে, শিবের পূজারী ভিন্নার্থে বলা যেতে পারে পৌরুষ প্রতীকের পূজারী চাঁদ মনসাকে– একে নারী, তারওপর তার এক চোখ অন্ধ– শেষতক বাঁহাতে পূজো দেয়।

মিথের এই অমিমাংসিত বয়ানে নতুন একটা দিক জুড়ে দেয় হাওয়া ।ছবির প্রায় শেষে তাই চাঁন মাঝির মৃত্যু ঘটে সাপের কামড়ে। ওদিকে আবার এই সাপকেই আমরা বেহুলা দশায় উপনীত হতে দেখি।

নয়নতারায় চাঁন মাঝির অধীন সাতজন পুরুষ, বিপরীতে তাতে একজন নারী চরিত্র গুলতি। জালে যখন গুলতি নিথর দেহ উঠে আসে, তখন সবাই ভেবেছিল সে মৃত। নারীনিষিদ্ধ নৌকার সব পুরুষদের চোখ তখন ঠিকরে বেরুচ্ছে। হাওয়া নামটা তখন আদম হাওয়া আর গন্দম ফলের কাহিনিকে যুক্ত করে দেয় আলগোছে। নৌকায় নারীর আগমন ঘটলে পুরুষেরা সচেতন হয়ে ওঠে; কাম ও প্রেমতাড়িত হতে দেখা যায় তাদের। সুন্দর জামা পরে সুন্দর হতে চায় কেউ কেউ। সবাই সবার দিকে নজর রাখা শুরু করে, পাছে গুলতি বেদখল না হয়ে যায়।

হাওয়া
হাওয়া। ফিল্মমেকার: মেজবাউর রহমান সুমন

পুরুষ প্রধান চলচ্চিত্রের ভীড়ে হাওয়ায় গুলতিকে বড় পরিসর দেওয়া হয়েছে। গুলতি জোরালো চরিত্র নিয়ে হাজির হয় যার নিজস্ব ইচ্ছা আছে, অনিচ্ছা আছে। আটজন পুরুষের মধ্য থেকে সে ইবাকে প্রেমিক হিসেবে বেছে নিয়েছে। সেই ইবা যখন ভাবে কিংবা বলে, সে না থাকলে গুলতিকে ধর্ষণের শিকারে পরিণত হতে হতো, তখন দেখা যায়, পুরুষসঙ্গী না থাকলে একাকী নারী অসহায়– সে ধারণাকে গুলতি চরিত্রটি প্রবলভাবে আঘাত করে এবং ভেঙে দেয়।

বেহুলার মতন সিঁথির সিঁদুর বাঁচানোর দায় গুলতির নেই। স্বামী হারানোর পর সনাতন রীতি অনুযায়ী বৈধব্য জীবনের বাধ্যবাদকতাও নেই, তবু ইবার সাহচর্য পেতেই বেহুলা হয় সে। চরম পুরুষতান্ত্রিক একটা সিস্টেমে গুলতির সঙ্গী নির্বাচন এবং তার জন্য চরম ত্যাগ, মিথের বেহুলা চরিত্রটির পতিপ্রেমের এক নতুন সংস্করণ। যেখানে জাত-কূল-ধর্মের উর্ধ্বে গিয়ে নারী পুরুষের প্রেমের জয়গান গাওয়া হয়েছে।


গুলতির
শারীরিক ভাষা,
চাহনি কিংবা হাসি
পুরুষের দৃষ্টিকোণ
থেকেই
নির্মিত

তবে একে ঠিক নারীবাদী অ্যাপ্রোচ থেকে হয়তো দেখার সুযোগ মিলবে না। গুলতির শারীরিক ভাষা, চাহনি কিংবা হাসি পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকেই নির্মিত। সেই সাথে তারে উপস্থাপনে ভয়ারিস্টিক অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করা হয়েছে প্রবলভাবেই। আবার নারীর কর্তৃত্বকে যুগে যুগে পুরুষতন্ত্র কিভাবে ডেমোনাইজ করে আসছে, তার বয়ান মুগ্ধ করার মতো। নয়নতারায় পুরুষ বা পুরুষতন্ত্রই মূল চালিকাশক্তি। তা যেন আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রেরই আরেক রূপ। আর ঠিক সেখানে গুলতি ভয় ডরহীন আজব একটা মেয়ে, আজব তার চাহনি, শারীরিক ভাষা। গুলতি তাই বাংলা চলচ্চিত্রে তুলনাহীন এক রহস্যঘেরা চরিত্র হয়ে থেকে যাবে।

হাওয়া
হাওয়া। ফিল্মমেকার: মেজবাউর রহমান সুমন

একদিকে চাঁন মাঝি আর গুলতির দ্বৈরথ, অন্যদিকে ইবার সাথে গুলতির রসায়ন– এই ছবির দুইটা দিক। গুলতি মা মনসার আশীর্বাদপুষ্ট, তাই ইবা হয়তো লখিন্দরের মতো প্রাণ ফিরে পাবে। ইবার সাথে চাঁন মাঝির যে শত্রুতা গড়ে ওঠে, তা স্পষ্টত ন্যায়-অন্যায়ের। ইবার হন্তারক হয়ে উঠতে দেখা যায় চাঁন মাঝিকে। যে প্রক্রিয়ায় ইবাকে কষ্ট পেয়ে তিলে তিলে ক্ষয়ে যেতে দেখি, সেটা আমাদের যীশুর কথাই মনে করিয়ে দেয়। অন্য সবার মৃত্যু হয় দ্রুত সময়ের মধ্যে; কিন্তু ইবার বেলায় যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার মহিমা আরোপ করা হয়। লখিন্দরের প্রাণ ফিরে পাবার মিথের পালে ক্রুশবিদ্ধ হবার পর যীশুর পুনরুত্থান বা আবার ফিরে আসার প্রচলিত ধারণা হাওয়া দেয়। মুসলিমদের কাছে এই যীশুর আরেক নামই ইসা।

তবে একদম শেষে গিয়ে বলব, নয়নতারায় যা যা ঘটেছিল, তা আপনি এভাবে না ভেবে সংশয়ও প্রকাশ করতে পারেন। সে সুযোগ রেখে দিয়েছেন হাওয়ার নির্মাতা। গুলতিকে অন্য নৌকার লোকজন দেখেনি, সংগত কারণেই তারে লুকিয়ে রাখা হয়। তারে লুকিয়ে রাখা হয় মাছের ভারারে। ফলে মাছ আর গুলতিকে নিয়ে যা যা ঘটেছে তার সাক্ষী কেউ নাই, এমনকি শালিকটাও না।

মনে রাখবেন, ক্যানভাসার আমাদেরকে আগেই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দুইটা সুযোগ দিয়েছিল।

Print Friendly, PDF & Email