লিখেছেন: সায়ন্তন দত্ত
তরুণ মজুমদার চলে গেলেন মাসখানেক হলো। বেঁচে থাকাকালীন বাঙালির তাকে বিশেষ মনে ছিল কি না জানা নেই, কিন্তু মৃত্যুর পর যেকোনো মৃত শিল্পীর মতোই তাকে নিয়ে অজস্র লেখালেখি, মন্তব্য, ভিডিওতে ইন্টারনেট/পত্রপত্রিকা ভেসে যাচ্ছে। সেসব লেখালেখি, স্মৃতিচারণা, অবিচুয়ারির দিকে সামান্য নজর দিলেই তাদের সাধারণ সুরটা ধরা যায়– আহা বাংলা সিনেমা, আহা বাঙালির রুচি, আহা বাংলার গ্রাম, আহা বাঙালির বামপন্থা ইত্যাদি।

শেষ বয়সে তরুণবাবু অত্যন্ত সুলিখিত গদ্যে তার স্মৃতিকথা লিখে গেছেন, সেটাও প্রায় বৈঠকী মেজাজে আড্ডা মারতে মারতে গল্পের ছলে বর্ণনা; সুতরাং ভয়ে ভয়ে আশা করাই যায়, তাকে নিয়েও ঋত্বিক–সত্যজিৎ–মৃণালের মতো নতুন কোনো চলচ্চিত্র নেমে গেল বলে! অতএব একদিকে একের পর এক প্রশংসায় ভেসে যাওয়া নস্টালজিয়া আক্রান্ত লেখার বহর, ইংরেজি ভাষায় যাকে বলে ‘হেগিওগ্রাফি’, তার সলতে পাকানো; অন্যদিকে ধুঁকতে থাকা বাংলা ফিল্মের ইন্ডাস্ট্রি, ‘শিল্প’ শব্দের দুই অর্থেই যার অবস্থা তথৈবচ, ‘আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি’ স্টাইলে যাদের সারাক্ষণ পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে চলতে হয়– বলতে দ্বিধা নেই, এরা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
…
তিনি
শুরু থেকেই
খুব সচেতনভাবে
মূলধারায় স্থিত থেকে,
সমস্ত ধরনের দর্শকের
জন্য ছবি বানানোর
চেষ্টা করে
গেছেন
…
কিন্তু এই দৈত্যকুলে যারা এখনো সিনেমা, বা যেকোনো শিল্পমাধ্যমকেই আগ্রহভরে পড়তে চান, নতুন ছবি বানাতে চান, তারা এই বর্ষীয়ান চলচ্চিত্রকারের ছবি নিয়ে কীভাবে ভাববেন? চলচ্চিত্রে প্রথাগত অর্থে শিল্প হিসেবে স্বস্বীকৃত যে গোত্রের ছবি, যেমন ধরা যাক এককালের ইউরোপিয়ান আর্ট ফিল্ম (অধুনা যাকে গ্লোবাল আর্ট ফিল্ম বলা হচ্ছে) কিংবা একালে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তৈরি হওয়া অত্যন্ত উচ্চমানের ছবি, সেই জাতীয় ছবির মধ্যে তরুণ মজুমদারের ছবি পড়ে না। তিনি শুরু থেকেই খুব সচেতনভাবে মূলধারায় স্থিত থেকে, সমস্ত ধরনের দর্শকের জন্য ছবি বানানোর চেষ্টা করে গেছেন।
চলচ্চিত্র জন্ম থেকেই ব্যয়বহুল শিল্প– প্রচুর কর্মীর সমাবেশ ছাড়া প্রথাগত অর্থে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা কার্যত অসম্ভব। তাই যেখানে প্রচুর টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়, সেখানে টাকা তুলে আনাটা অত্যন্ত জরুরি– নইলে একটা কাজ করেই পাততাড়ি গুটিয়ে বাড়ি চলে যেতে হবে। কিন্তু এখানেও একটা জরুরি প্রশ্ন থেকে যায়– বিনিয়োগ করে তো যেকোনোভাবেই টাকা তুলে আনা যায়, কিন্তু চলচ্চিত্রের মতো অত্যন্ত শক্তিশালী এই মাধ্যমে যারা কাজ করছেন, তাদের কী ন্যূনতম দায়িত্ব থাকে না নিজের কাজের প্রতি, খুব প্রাথমিক স্তরেই, সৎ থাকার? সৎ শব্দটা ঠিক নৈতিক অর্থে ব্যবহার করতে চাইছি না– বরং যে নিষ্ঠায়, যে দক্ষতায় একজন মৃৎশিল্পী কোনো নিঁখুত প্রতিমা গড়ে তোলেন, যে দক্ষতায় কোনো কাঠের মিস্ত্রী নিঁখুত খাট-পালঙ্ক নির্মাণ করেন, সেই দক্ষতার সঙ্গে, সেই সততার সঙ্গেই চলচ্চিত্রের নির্মাতারাও তাদের কাজটুকু করে যাবেন– এইটুকু প্রশ্ন পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যেকোনো মূলধারার চলচ্চিত্র সম্পর্কেই অবান্তর নয়।

বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রতাত্ত্বিক আন্দ্রে বাঁজা তার এক বিখ্যাত লেখায় তিরিশ/চল্লিশ/পঞ্চাশের দশকের হলিউড (যাকে ক্লাসিকাল হলিউড বলে ডাকা হয়) ছবির গুণাগুণ বিচার করতে গিয়ে তর্ক করেছিলেন, এ কোনো একক ব্যক্তির শিল্পচর্চার পারদর্শিতার ফল নয়, বরং গোটা ব্যবস্থাটাই সেখানে উন্নতমানের কাজের জন্য নিজেকে তৈরি করেছে, তার সাফল্যের মূলে রয়েছে, ‘জিনিয়াস অফ দ্য সিস্টেম’। পঞ্চাশের দশকে বাংলা ছবিতে যখন তরুণ মজুমদার কাজ করতে এসেছিলেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে স্টুডিওর প্রভাব একটু একটু করে ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে। তা সত্ত্বেও বলা যায়, সেই সময়ের বাংলা ছবির সাফল্যের কারণ একক কোনো শিল্পী কিংবা উত্তম-সুচিত্রা জুটির নিজস্ব আবেদনই শুধুমাত্র নয়– বরং একসাথে অনেক কাজ জানা মানুষ যখন একত্রে কোনো সিস্টেমে নিজেদের শ্রেষ্ঠ দক্ষতা দিয়ে কাজ করেন, যখন ক্যামেরা, সাউন্ড, লাইট, কস্টিউম, এডিটিং, সংগীতসহ চলচ্চিত্র নির্মাণের সমস্ত দিকেই দক্ষ কারিগরদের সমন্বয় ঘটে, তখনই মূলধারায় সার্থক ছবি নির্মাণ সম্ভব হয়। অজয় কর থেকে অসিত সেন, অগ্রদূত (বিভূতি লাহা পরিচালিত গোষ্ঠী) থেকে যাত্রিক (তরুণ মজুমদার, দিলীপ মুখোপাধ্যায় আর শচীন মুখোপাধ্যায়ের সম্মিলিত পরিচালক গোষ্ঠী)– প্রত্যেক শিল্পীদের কাজই সেই অর্থে বৃহত্তর অর্থে উন্নতমানের সিস্টেম কাজ করার ফসল।
…
উন্নতমানের ছবি হয়ে ওঠার
শর্ত কোনোদিনই খুব
গুরুগম্ভীর বিষয়
এবং সেই
সংক্রান্ত
ভনিতার ওপর নির্ভর করে না
…
এই প্রসঙ্গেই আমাদের যে কথা মনে রাখা দরকার, ভালো ছবি, উন্নতমানের ছবি হয়ে ওঠার শর্ত কোনোদিনই খুব গুরুগম্ভীর বিষয় এবং সেই সংক্রান্ত ভনিতার ওপর নির্ভর করে না। ক্লাসিকাল হলিউড সিনেমা সম্পর্কে পড়তে গেলে একটা কথা বারবার ঘুরে ফিরে আসে, সেই স্থান ও কালের সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিখ্যাত পরিচালক, যেমন জন ফোর্ড, আলফ্রেড হিচকক কিংবা বিলি ওয়াইল্ডার– তারা নিজেদেরকে ‘আর্টিস্ট’ (শিল্পী) শব্দটার চেয়েও ‘ক্রাফটসম্যান’ (কারিগর) শব্দে পরিচয় দিতে বেশি ভালোবাসতেন। মূলধারার শিল্পীরা দক্ষ কারিগর হয়ে ওঠার মাধ্যমেই তাদের কাজের ভাঁজে ভাঁজে শিল্পবোধ লুকিয়ে রাখতে পারতেন, তার জন্য অধুনার বাংলা ছবির স্বঘোষিত প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় স্থানাধিকারীদের মতো নিজেদের ভণিতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে হতো না।

ভণিতা সর্বদাই শিল্পের পরিপন্থী– তাই আমরা যারা সিনেপ্রেমী, শিল্পচর্চা করতে চাই, তাদেরও আশু কর্তব্য মূলধারার ছবির নান্দনিক অর্জনকে যোগ্য মর্যাদায় গ্রহণ করতে শেখা। বার্গম্যান–তারকোভস্কির ছবিতে শিল্প কোথায় আছে, সে তো এক অর্থে যে কেউ দেখেই বলতে পারেন; কিন্তু তথাকথিত রগরগে থ্রিলার কিংবা অতি সাধারণ প্রেমের গল্পের মোড়কে যখন আলফ্রেড হিচকক বা বিলি ওয়াইল্ডারের ছবি পরিবেশিত হয়, তখন সেই গল্পের আড়ালে কোথায় সিনেমার নান্দনিকতা লুকিয়ে আছে, তা ধরতে পারাই জহুরির চোখ। বাংলা ভাষার ছবির সাপেক্ষে তরুণ মজুমদারদের প্রাপ্য সেই চোখের দর্শক খুঁজে পাওয়া।
লেখার বাকি অংশে আমর সংক্ষিপ্ত আকারে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক, গল্পের আড়ালে লুকিয়ে রাখা নান্দনিকতা বলতে আমরা ঠিক কী বলতে চাইছি। ধরা যাক তরুণবাবুদের নির্মিত প্রথম ছবি, যাত্রিক পরিচালিত চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯)। ফ্রাঙ্ক কাপরা পরিচালিত ১৯৩৪ সালের হলিউড ছবি ইট হ্যাপেনড ওয়ান নাইট ছবিটির আধারে চাওয়া পাওয়া নির্মিত; কিন্তু শুরুতেই যা বলছিলাম, প্রচলিত অর্থে রিমেক বা টুকে দেওয়া বলতে আমরা যা বুঝি, দুটি ছবি পরপর দেখলেই বোঝা যায় এ ক্ষেত্রে ঘটনাটি একেবারেই তা নয়।১

এই লেখার সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই দিকে আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই, তবে তরুণবাবুর অনেক বিখ্যাত ছবির উদাহরণ থাকতেও চাওয়া পাওয়া কেন বেছে নেওয়া হলো, তার সামান্য ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। মৃত্যুর পরে তরুণবাবুর ছবির গুণাগুণ বিচার করতে গিয়ে যে যে দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে, অর্থাৎ গ্রামবাংলা, স্টারদের বাইরে অন্য অভিনেতাদের নেওয়া, তার ‘স্ববিরোধী রোম্যান্টিক কমিউনিজম’ (পশ্চিমবঙ্গের এক বিখ্যাত পত্রিকায় ততধিক বিখ্যাত সমালোচক এই অভিধায় ভূষিত করে তরুণবাবুর প্রশস্তিগাঁথা রচনা করেছেন) ইত্যাদি– চাওয়া পাওয়া ছবিতে এর কিছুই নেই।
ইউটিউবে লব্ধ ছবিটি যে কেউ দেখে নিতে পারেন– বড়লোক বাবার চাপে হাঁসফাঁস করতে থাকা এক তরুণীকে জোর করে বিয়ে দিতে গেলে সে স্রেফ পালিয়ে যায়; পথে হঠাৎই দেখা হয়ে যায় তরুণ এক সাংবাদিকের সঙ্গে। পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে তাদের স্বামী-স্ত্রী সেজে লুকিয়ে বেড়ানো, এবং সাংবাদিক ছেলেটির তরুণীকে লুকিয়ে তার বাবার কাছে পৌঁছে দিয়ে দশ হাজার টাকার পুরস্কার নেওয়ার সুপ্ত পরিকল্পনাই ছবিটির মূল গল্পাংশ। বলা বাহুল্য, এই তরুণী সুচিত্রা সেন এবং সাংবাদিক উত্তম কুমার– সঙ্গে নানা চরিত্রে ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্ত্তী প্রমুখ শিল্পীদের জমজমাট জোরালো পারফরমেন্সে ঋদ্ধ এই ছবি।
যা নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম: সেই লুকিয়ে রাখা নান্দনিকতা। মনে রাখতে হবে আমরা কথা বলছি ১৯৫৯ সালের একটি ছবি নিয়ে, অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগে বাংলা ছবি তখন রোম্যান্টিক মেলোড্রামার২ এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি রপ্ত করে ফেলেছে। চাওয়া পাওয়া হয়তো যাত্রিক গোষ্ঠীর প্রথম ছবি, কিন্তু বৃহত্তর অর্থে এই সময়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলা ছবির গুণগুলো এ ছবিতে শুরু থেকেই বিদ্যমান, অর্থাৎ সাড়ে চুয়াত্তর [নির্মল দে; ১৯৫৩], সবার উপরে [অগ্রদূত; ১৯৫৫], হারানো সুর [অজয় কর; ১৯৫৭] ইত্যাদি ছবির সঙ্গে চাওয়া পাওয়া শৈল্পিক-নান্দনিক ধারাবাহিকতায় রয়েছে। তারই প্রমাণ এর অতি যত্নশীল সিনেমাটোগ্রাফি, ছন্দোবদ্ধ সম্পাদনা কিংবা সুলিখিত চিত্রনাট্য। কিন্তু যে নান্দনিকতার কথা আমরা শুরু থেকে বলছি, তার জন্য এই ছবিরই বিশেষ একটি দৃশ্যের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
ছবির প্রায় শেষ অংশে, যখন উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত চরিত্রযুগলের প্রেমের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি করে ধরা পড়ছে, অথচ নানা কারণে তা হয়ে উঠছে না, ছবির শিরোনাম চাওয়া এবং পাওয়া– এই দুই শব্দের গুরুত্ব সম্পর্কে দর্শককে অবগত করে তোলা হচ্ছে, তখনই একটি বিশেষ শট আসে। একটি ঘরে উত্তম ও সুচিত্রা কথা বলছেন, সাধারণ টু-শটে তাদের দেখতে দেখতে ক্যামেরা হঠাৎ জানালার বাইরে চলে যায়। পর্দাজুড়ে সারিবদ্ধ সমান্তরাল জানলার গ্রিল দেখি আমরা, পেছনে উত্তম দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, কয়েক মুহূর্ত পরে সুচিত্রা সেন আসবেন।
দুই ইচ্ছুক প্রেমাস্পদের প্রেম করতে না পারার নাছোড় কাব্যিকতায় মোড়া এই দৃশ্য দেখলে রসিক দর্শকের মনে পড়তেই পারে এক বছর পরেই গুরু দত্ত নির্মিত স্পেকট্যাকুলার হিন্দি ছবি, কাগজ কে ফুল-এর এক দৃশ্য– সেখানেও ওয়াহিদা রহমান অভিনীত চরিত্রকে বাধ্য হয়ে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় গুরু দত্ত অভিনীত চরিত্রের সংলাপ দৃশ্য নির্মিত হয়েছিল এরকম এক জানালার সামনে। চাওয়া পাওয়া ছবিতে এই জায়গায় শিল্পীরা একটি তুরূপের তাস খেলেন– সংলাপ, কবিতা, মিউজিক ইত্যাদির মাঝে জানালার সামনে একটি ধূপ রেখে দেওয়া হয়– যার ধোঁয়া ইমেজের মিঁজসিনে আশ্চর্য এক কাব্যিক মাত্রা নিয়ে আসে।

শুধুমাত্র এইটুকু নয়, আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি আরেকটি বিশেষ দিকে। একটু মন দিয়ে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, স্থির হয়ে থাকা ক্যামেরায় এই একটি শটের দৈর্ঘ্য দুই মিনিটেরও খানিক বেশি। অর্থাৎ প্রচলিত পরিভাষায় যাকে বলে লং-টেক, শটটি ঠিক তা-ই। এখানে একটু বলে নেওয়া দরকার, ইদানীংকালের স্লো সিনেমা (ধীর গতির ছবি, আন্তর্জাতিক আঙিনায় ফিলিপিন্সের লাভ ডায়াজ বা হাঙ্গেরির বেলা তার-সহ অজস্র শিল্পী যে ধরনের ছবি করেন) ছাড়া সাধারণত ছবিতে শটের গড় দৈর্ঘ্য চল্লিশ সেকেন্ড থেকে এক মিনিটের মধ্যেই থাকে।
অবশ্যই ছবির ধরন অনুযায়ী (হলিউডের অ্যাকশন ছবি আর কোনো পরিবারকেন্দ্রিক ভারতীয় ছবির শটের গড় দৈর্ঘ্য কখনোই এক হবে না) সিনেমার ইতিহাসে বিভিন্ন সময় এই মান সতত পরিবর্তনশীল। কিন্তু যে স্থান ও কালের ছবি নিয়ে আমরা কথা বলছি– পঞ্চাশ-ষাটের দশকের বাংলা ছবি– সেখানেও দুই মিনিটের বেশি লং টেক রেখে দেওয়া খুব সহজ কথা নয়। চলচ্চিত্রের পর্দায় তিরিশ সেকেন্ডের বেশি একটানা নিশ্চল ক্যামেরা থাকলে যথেষ্ট মুন্সিয়ানায় তা ব্যবহার করতে না পারলে, দর্শকের ধৈর্য্যচুতি ঘটতে বাধ্য। সেখানে আদ্যন্ত মূলধারার একটি ছবিতে, জনপ্রিয়তম নায়ক নায়িকার সংলাপে অত্যন্ত টেনশনের মুহূর্তেও তরুণবাবুর ক্যামেরা স্থির, একটিবারও সে কোনো পাত্রপাত্রীর মুখের ক্লোজ শট, বা ধূপের ধোঁয়াকে আলাদা করে জোর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না। বদলে ধূপের ধোঁয়ার নিজস্ব গতিতে নিশ্চল ফ্রেমে ভিন্ন এক গতির সঞ্চার হলো– তৈরি হলো বিশেষ ধরনের ছন্দ যা সরাসরি ক্যামেরার নড়াচড়ার উপরে নির্ভর করে না।

এবং বলা বাহুল্য, এত কিছু হলো কোনোরকম অতিরিক্ত দৃষ্টি আকর্ষণ না করে, ছবির বাকি অংশের সাথে কোনোরকম অসঙ্গতি না রেখে, অযথা নান্দনিক গুরুত্বের দাবি না করে।
এই নান্দনিক পরিমিতিবোধ, এই সাযুজ্য, এই স্থৈর্য্য এবং স্থিতি– এবং অবশ্যই এই গুণগুলোর প্রতি অযথা দৃষ্টি আকর্ষণ না করে তাকে ছবির স্বাভাবিক নান্দনিকতায় আড়াল করে রাখা– ছবিটির সবচেয়ে জরুরি জায়গা এটাই। এবং শুরু থেকে আমরা যা বলে আসছি, মূলধারার বাংলা ছবি একসময় তার নান্দনিক অর্জন তুরূপের তাসের মতো লোক দেখানো কায়দায় জাহির করত না, বরং সার্থক শিল্পের মতোই তাকে ধারণ করতে জানত। বাংলা ছবির বর্তমান অবস্থান নিয়ে যারা চিন্তিত, যারা মনে করেন রাম-শ্যাম-যদু-মধু নির্মিত সমকালীন বাংলা ছবি সগর্বে সহাস্য পাঁকে ডুবে রয়েছে, তাদের সবার এই সময়ের ছবিকে ফিরে দেখা দরকার– নস্টালজিয়ায় ভারাক্রান্ত হতে নয়, বরং মূলধারার ছবিতে শিল্পের স্বাদ খুঁজে পেতে।
একমাত্র এই পথেই সমকালীন বাংলা ছবি নিয়ে আমরা আবার হয়তো স্বাধীনভাবে ভাবনা-চিন্তা শুরু করতে পারব।

টীকা:
১. যদিও তরুণবাবুর স্মৃতিকথা সিনেমাপাড়া দিয়ে বা এই ছবিটিকে নিয়ে উনি স্বয়ং যেখানে যেখানে আলোচনা করেছেন, কোথাও হলিউড ছবিটির কথা উল্লেখ নেই। স্মৃতিকথাতেও লেখা এইভাবে, যেন চিত্রনাট্যকার নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ মৌলিক গল্প হিসেবেই ভাবনাটি তৈরি করেছেন। যদি কোনো সহৃদয় পাঠক এর কারণ সম্পর্কে অবগত থাকেন, আমাকে জানালে আমি অত্যন্ত উপকৃত হবো।
২. মেলোড্রামা শব্দটি নঙার্থক উদ্দেশ্যে নয়, বরং জঁর বা ঘরানা বোঝাতে ব্যবহৃত (যেরকম থ্রিলার, গ্যাংস্টার, কমেডি ইত্যাদি)। এ বিষয়ে পরিসরের অভাবে এখানে বিশদে আলোচনা করা সম্ভব নয়।