লিখেছেন: সৌরনীল ঘোষ
“It is not the office of art to spotlight alternatives, but to resist by its form alone the course of the world, which permanently puts a pistol to men’s heads.’’
–Theodor Adorno”

বিনোদন আর জনতোষণের অর্গলবন্ধন থেকে যে কজন পরিচালকের হাত ধরে বিংশ শতকে চলচ্চিত্র নামক শিল্পমাধ্যমটির মুক্তি ঘটেছিল, বুনুয়েল তাদের মধ্যে অন্যতম কারিগর। লুই বুনুয়েল নামটি উচ্চারিত হওয়ামাত্রই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভয়াবহ সেই দৃশ্য, যেখানে ব্লেড দিয়ে একজনের আইবল চিড়ে দেওয়া হচ্ছে বা একটি হাতের তালুতে কিলবিল করছে কতশত পিঁপড়ে। এই সমস্ত দৃশ্যই বন্ধু দালির সঙ্গে নির্মিত তার প্রথম ছবি আন সিয়েন আন্দালু [Un Chien Andalou] বা আন্দালুসিয়ান ডগ-এর অন্তর্গত। ১৬ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য এই ছবির সূত্রেই সিনেমার জগতে বুনুয়েলের আত্মপ্রকাশ।
প্যারিসে ১৯২৯ সালে মুক্তির আলো দেখামাত্রই আভঁ-গার্দ মহলে বিপুল শোরগোল ফেলে দিয়েছিল এই ছবি। কারণটা সহজেই অনুমেয়, বস্তুত বুনুয়েল ও দালির উদ্দেশ্যই ছিল প্রচলিত চলচ্চিত্র ভাবনা ও আঙ্গিকের বাইরে গিয়ে এমন কিছু একটা সৃষ্টি করা যা চিরাচরিত বা কনভেনশনাল শিল্পের বুর্জোয়া স্থিতাবস্থাকে কাঁপিয়ে দেবে। আর ছিল সিনেমার ফর্মকে হলিউডি বাণিজ্যিক ছবির রীতিনীতির আধিপত্য থেকে মুক্ত করে একটা নতুন মাত্ৰা দেওয়ার প্রচেষ্টা।
বুনুয়েল তার আত্মজীবনী My Last Sighতে স্বীকার করে নিয়েছেন, এই ছবি নির্মাণকালে খুব সচেতনভাবেই এমন কোনো দৃশ্য বা শট যার কোনো সুনির্দিষ্ট মানে বা ব্যাখ্যা থাকতে পরে তাকে পরিহার করা হয়। শোনা যায় ছবিটি যখন প্যারিসের একটি থিয়েটারে প্রদর্শিত হচ্ছিল, বুনুয়েল পকেট ভর্তি করে নুড়ি পাথর নিয়ে পর্দার আড়ালে এক কোনে দাঁড়িয়ে দর্শকদের ওপর সমানে নজর রাখছিলেন। ছবির প্রচণ্ড ধাক্কায় কারও বেয়াদবি বা অশিষ্টতা চোখে পড়লেই পটাপট ঢিল ছুঁড়বেন– এই অভিসন্ধি নিয়ে! সৌভাগ্যবশত কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেনি অন্তত সেবারের মতো; দর্শকমন্ডলি হতচকিত হলেও এই ছবির ভাবনা ও নির্মাণশৈলীকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।
…
ছবির প্রত্যেকটি দৃশ্যই নাকি
বুনুয়েল বা দালির বিভিন্ন
সময়ে দেখা কোনো
না কোনো স্বপ্নের
চলচ্চিত্রায়ন
…
আগেই লিখেছি প্যারিসের তরুণ আভঁ-গার্দরা লুফে নিয়েছিল এই ছবি, স্বয়ং আন্দ্রে ব্রেতোঁ ছবিটি দেখে বলেছিলেন, ‘একটি নিখুঁত পরাবাস্তববাদী ছবি।’ এর দরুণ খুব সহজেই সুররিয়ালিস্ট বা পরাবাস্তববাদীদের দলে বুনুয়েলের পাকাপোক্ত জায়গা হয়ে গেল। ম্যাক্স আর্নস্ট, মার্সেল ডুচাম্প, লুই আরাগোঁ, সালভাদোর দালি প্রমুখদের মাঝে। বুনুয়েলের লেখা থেকে আমরা আরও জানতে পারি, ছবির প্রত্যেকটি দৃশ্যই নাকি বুনুয়েল বা দালির বিভিন্ন সময়ে দেখা কোনো না কোনো স্বপ্নের চলচ্চিত্রায়ন।
এর পরের ছবি L’Age d’Or বা ইংরেজিতে দ্য গোল্ডেন এজ [সোনালী যুগ]। এই ছবির নির্মাণকালেই সেই বিখ্যাত মতানৈক্য যার দরুণ বুনুয়েল ও দালির বন্ধুত্বে চিরকালের মতো ফাটল ধরে যায়। এই ছবির পর্যালোচনায় ঢোকার আগে আসুন একটু গোড়ার কথায় ফিরে যাওয়া যাক। আসলে বিংশ শতকের প্রথমার্ধ্ব ইতিহাসে এক অদ্ভুত সময় হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকবে। আর কোনো কাল এত অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখেনি, এবং এই সময়কালের মধ্যেই শিল্পের দুনিয়ায় ঘটে গিয়েছিল একের পর এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। পুরোনো কনভেনশানাল আর্টের প্রচলিত রীতি থেকে বেরিয়ে একদল তরুণ শিল্পী আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে নানা রকমের পরীক্ষামূলক আঁভা-গার্দ কিছু রীতির জন্ম দিয়েছিলেন। গোটা ইউরোপ জুড়ে গড়ে উঠছিল নানা রকমের শিল্প-আন্দোলন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভার্জিনিয়া উলফ, জেমস জয়েস, টমাস মান প্রমুখ ঔপন্যাসিকরা যেমন ‘স্ট্রিম অব কনসাসনেস’ স্টাইলের প্রয়োগে একটি নতুন সাহিত্য রীতির জন্ম দিলেন, যেখানে বাইরের ঘটনার চাইতে চরিত্রের মনের নানা রকমের স্তর, ক্রিয়া-বিক্রিয়া, ভাবনা, জটিলতা হয়ে উঠছিল গুরুত্বপূর্ণ– ঠিক তেমনই আর্টের ক্ষেত্রে কিউবিজম, দাদাইজম, এক্সপ্রেশনিজম, ফিউচারিজম, সুররিয়ালিজম ইত্যাদি আঙ্গিকের বৈপ্লবাত্মক প্রয়োগ তোলপাড় করে দিয়েছিল শিল্পের জগৎ।
এ ক্ষেত্রে বলে রাখা প্রয়োজন, বিশ্বযুদ্ধের তীব্র মর্মান্তিক অভিঘাতের পাশাপাশি বিজ্ঞানের জগতে কিছু আবিষ্কার সমানভাবে প্রভাবিত করেছিল এই সমস্ত শিল্প-শৈলীর উদ্ভাবনে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব যেমন সময় সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণাকে সপাটে আঘাত করেছিল, এর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য ১৯০০ সালে প্রকাশিত সেই বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের দ্য ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস, যা অচিরেই হয়ে উঠবে সুররিয়ালিস্টদের বাইবেল।

আসলে ফ্রয়েডের আবিষ্কার দেখাল, আমাদের অস্তিত্বের মূলে চেতন মনের চাইতে অবচেতনের গুরুত্ব অনেক বেশি। আমাদের অবচেতন বা আনকনশাসের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা নানা রকমের ইমপালস, যেমন লিবিডো, থ্যানাটোস প্রভৃতি শক্তিই আমাদের চেতন মনে নেওয়া সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। এবং এই আনকনশাস কোনো যুক্তি, বা রেশনালিটিকে তোয়াক্কা করে না।
ভেবে দেখুন, বিশ্বযুদ্ধের যে বিরাট ধ্বংসলীলা, বিপুল ক্ষয়ক্ষতি, মানুষের তার স্বজাতির ওপর করা বর্বরোচিত অত্যাচার, প্রায় কয়েক কোটি মানুষের মৃত্যু, শুধু কয়েক ইঞ্চি জমির জন্য– একে কি যুক্তি দিয়ে কোনোভাবে জাস্টিফাই করতে পারবেন? কিন্তু ফ্রয়েড বলবেন, এতে অবাক হবার কিছু নেই, অ্যানিম্যাল ইনস্টিনক্ট বা ধ্বংস করার প্রবণতা যা ইডে থাকা থ্যানাটোসের অনুবর্তী, মানুষের কিছু আদিম সহজাত প্রবৃত্তির ন্যায় আমাদের আনকনশাসের অতলে এখনো রয়ে গিয়েছে।
মনের গভীরে থাকা এই ইরাশ্যানাল ডিমেনশনের বহিঃপ্রকাশই হয়ে উঠল সুররিয়ালিস্টদের অন্বিষ্ট। ফ্রয়েড লিখেছিলেন, ‘স্বপ্নই হচ্ছে সেই অবচেতনে প্রবেশ করার রাজপথ।’
একদিকে রেনেসাঁ প্রবর্তিত এনলাইটেনমেন্ট, যেখানে সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে যুক্তির জয়গান গাওয়া হয়েছে, মনে করে দেখুন কান্টের সেই বিখ্যাত প্রবন্ধ– হোয়াট ইজ এনলাইটমেন্ট?, আর তার বিপ্রতীপে সুররিয়ালিস্টদের স্বঘোষিত বিপ্লব– যুক্তি নয়, অযৌক্তিকতাই রয়েছে আমাদের অস্তিত্বের মূলে।
…
সত্যিই তো
বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যে
অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবী তাতে
অন্তরের গহনে উঁকি মেরে
দেখাই বোধহয় বেশি
জরুরি
ছিল
…
আন্দ্রে ব্রেতোঁ ১৯২৪ সালে লিখলেন সেই বিখ্যাত ইস্তাহার যা সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো হিসেবে পরিচিত। বাস্তবের ওপরের স্তরে আঁচড় না কেটে– প্রতিরুপায়নের বাস্তবকে একেবারে সরাসরি আক্রমণ করলেন সুরিয়ালিস্টরা। স্বপ্নের মায়াবী জগৎ ফুটে উঠল ক্যানভাসে। রঙতুলির সহযোগে অবলোকনের জন্য উন্মোচিত হলো অবচেতনের অন্ধকার। এ যেন রবীন্দ্রনাথের সেই অমোঘ উচ্চারণকে মনে করায়, ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে, অন্তরে আজ দেখবো যখন আলোক নাহি রে।’ সত্যিই তো বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যে অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবী তাতে অন্তরের গহনে উঁকি মেরে দেখাই বোধহয় বেশি জরুরি ছিল; সমস্ত কিছুর মূল বোধহয় ওখানেই লুকিয়ে।
আসলে এত কিছুর অবতারণা করার কারণ, ১৯১৭ সালে জারাগোজার জেসুইট স্কুল ছেড়ে বুনুয়েল যখন প্রথমবারের মতো স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের রেসিদেন্সিয়া দে এস্তুিদিয়ান্তেসে এ পড়তে এলেন, তার সামনে এক সম্পূর্ণ অন্য জগৎ উন্মোচিত হলো, যার পরিণাম হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। বলা ভালো, বুনুয়েল শিল্পীসত্তার প্রথম উন্মেষ ঘটেছিল এখানেই। এখানেই তার গার্সিয়া লোরকা ও সালভাদর দালির সাথে বন্ধুত্বের সূত্রপাত। মাদ্রিদ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য কাফেতে বসত সান্ধ্য আড্ডা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সেইসব আড্ডার মূল বিষয়বস্তুই ছিল পূর্বে উল্লিখিত আভঁ-গার্দ শিল্প ভাবনা। ইতোমধ্যেই আরেক স্প্যানিয়ার্ড, তার বিখ্যাত লে দ্যমোয়াজেল দা’ভিয়ঁ এঁকে ফেলেছেন ১৯০৭ সালে। প্যারিসের মতোই স্পেনের ক্যাফে ও পানশালায় পিকাসো ছিল এক বহুচর্চিত নাম। ইউরোপ জুড়ে ঘটতে থাকা এইসব আঁভা-গার্দ শিল্প রীতির সংস্পর্শে আসা বুনুয়েল যে অচিরেই তার প্রথম ছবির বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক হিসেবে পরীক্ষামূলক স্টাইলকেই বেছে নেবেন, এতে আর অবাক হবার কী আছে!

আসুন ফেরা যাক বুনুয়েলের দ্বিতীয় ছবি L’Age d’Or প্রসঙ্গে। এই ছবির ভাগ্য কিন্তু প্রথম ছবির ন্যায় অত মসৃণ ছিল না। মুক্তি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ছবিটি প্যারিসের একটি দক্ষিণপন্থী দল ‘লিগ অব প্যাট্রিয়টস’-এর রোষানলে পরে, এমনকি ছবি চলাকালীন ক্ষিপ্ত জনতা পর্দায় কালি ছুঁড়ে মেরেছিল। শুধু তাই নয়, সালভাদোর দালি, হোয়ান মিরো, ম্যান রে, ইভাস ত্যাঙ্গুই প্রমুখ শিল্পী, যারা এই ছবির নির্মাণের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিলেন, লবিতে ঢুকে তাদের আর্টওয়ার্ক নষ্ট করে দেওয়া হয়। স্বভাবতই উন্মত্ত উশৃঙ্খল জনতার দক্ষিণপন্থীদের প্ররোচনায় এই তান্ডবের পর, প্যারিস পুলিশের প্রিফেক্ট জঁ-চিয়াপ্পে (Jean Chiappe ) ১০ ডিসেম্বর ১৯৩০-এ এই ছবির প্রদর্শনী বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন সেন্সরের হস্তক্ষেপের পর।
কী এমন ছিল ছবিতে যা প্ররোচিত করে জনতাকে এই তীব্র প্রতিক্রিয়ার দিকে? আসলে বুনুয়েল বুর্জোয়া সমাজের মূল্যবোধ, রক্ষণশীলতা, নৈতিক অবস্থান, বিশেষ করে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও যৌনতার বিষয়ে এবং রোমান ক্যাথলিক চার্চের রিগ্রেসিভ প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী আচরণকে শাণিত আক্রমণ করেন। ছবির বিষয়বস্তু একটি প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল। কিন্তু এই যুগল নিভৃতে যখনই অন্তরঙ্গ হতে যায়, তখনই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় গির্জা, রক্ষণশীল পরিবার এবং তাদের প্রতিপালিত মান্ধাতা আমলের গোঁড়া মূল্যবোধ, সমাজ ইত্যাদি।
চার্চ ও বুর্জোয়া সমাজের দ্বারা ব্যক্তির স্বাভাবিক প্রবৃত্তির যেমন যৌনচাহিদা বা লিবিডো কীভাবে অবদমিত হয়, এবং সেই অবদমিত কাম, যা ফ্রয়েডের ভাষায় ‘রিপ্রেসড লিবিডো’ স্থানচ্যূত বা ডিসপ্লেসড হয়ে কীভাবে জিঘাংসা সৃষ্টি করে, ছবির সেটাই অন্বিষ্ট। উদারীকরণ অর্থনীতির ধ্বজাধারীরা যে আসলে একটি সংকীর্ণ স্থবির সমাজ প্রসব করতে চায় যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতার চাইতে প্রতিষ্ঠান বড়, এবং ব্যক্তিকে এসকল প্রতিষ্ঠানের অধীনস্থ রেখে দিতে চিরপ্রতিজ্ঞ তারা, এইটেই বুনুয়েলের ছবি উন্মোচন করে দর্শকদের নিকট।
(বুনুয়েলের এই ব্লাসফেমাস ছবিটি প্রায় দীর্ঘ চার দশক জনসমক্ষের অন্তরালে অন্ধকারে পরে থাকার পর সত্তরের দশকে একটি রিস্টোরড ভার্সন ব্রিটিশ টেলিভিশন খ্যাত চ্যানেল ফোরে টেলিকাস্ট করা হয়। অবিশ্যি তার মাঝে টেমস দিয়ে অনেক স্রোত বয়ে গিয়েছে।)
এর পর স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় রিপাবলিকান পক্ষের হয়ে বিদেশ মন্ত্রকের অধীনে কিছু কাল যাবৎ কাজ, মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রক্কালে সস্ত্রীক আমেরিকা পাড়ি।
হলিউডে দাগ কাটতে ব্যর্থ এবং নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে নাৎসিবিরোধী প্রোপাগান্ডা ফিল্মে এডিটরের কাজ থেকে শিগগিরই বিতাড়িত হয়ে বুনুয়েলের ঠাঁই হয় মেক্সিকোতে।
এই মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে বুনুয়েলকে যে চাকরি খোয়াতে হলো, তার অন্যতম কারণ কিন্তু পুরোনো বন্ধু দালি। সন ১৯৪২-এ প্রকাশিত তার আত্মজীবনী দ্য সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর দালি বইটিতে বুনুয়েলকে একজন পাঁড় কমিউনিস্ট ও নাস্তিক হিসেবে অভিহিত করেন। আর কমিউনিস্টদের সহিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্কের কথা তো সর্বজনবিদিত। অতএব বুনুয়েল বিতাড়িত হলেন।
বলা বাহুল্য, দালিকে বুনুয়েল কোনোদিন ক্ষমা করেননি এবং এর কারণ স্বরূপ আত্মজীবনীতে বুনুয়েল জানিয়েছেন, ‘ওর (দালির) ইগো, আত্মম্ভরিতা, নিজেকে জাহির করার প্রবণতা এবং সর্বোপরি জেনারেল ফ্রান্সিস্কো ফ্রাঙ্কোকে করা নিঃশর্ত সমর্থন অন্যতম কারণ।’ অনুমান করা যায়, এই দ্বেষ বা বৈরিতার প্রকাশে কতটা রুষ্ট হয়েছিলেন বুনুয়েল।
স্পেনে তখন ঘোর অন্ধকার। চার বছর ব্যাপী বিধ্বংসী গৃহযুদ্ধের পর হিটলারের সহায়তায় তখন মসনদে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী জেনারেল ফ্রাঙ্কো। এবং ফ্রাঙ্কোর শাসনে বুর্জোয়া শ্রেণি ও ক্যাথলিক চার্চের যে সমর্থন ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সালটা ১৯৪৬, বুনুয়েল এসে পৌঁছলেন মেক্সিকোতে। শুরুর প্রথম দুটি ছবির সাফল্যের পর মাঝে অনেকগুলি বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। সেইভাবে কোনো নজরকাড়া ছবি বুনুয়েল করে উঠতে পারেননি। বুনুয়েল মেক্সিকোতে গিয়েই দুটি ছবি নির্মাণ করলেন– Gran Casino [‘ম্যাগনিফিসেন্ট ক্যাসিনো’] ও El Gran Calavera [‘দ্য গ্রেট ম্যাডক্যাপ’]। দুটো ছবিই বাণিজ্যিকভাবে চূড়ান্ত ব্যর্থ। সমালোচক মহলেও বিশেষ পাত্তা পায়নি। কিন্তু ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সনের মধ্যে বুনুয়েল মেক্সিকোতে কুড়িটির মতো ছবি তুলেছিলেন, যার মধ্যে কয়েকটি নিঃসন্দেহে কালজয়ী সৃষ্টি– তাদের শিল্পশৈলী, নির্মাণ ও বিষয়বস্তুর জন্য।
বহু বছর ক্যামেরার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার দরুণ, এবং মেক্সিকোর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির চাপিয়ে দেওয়া শর্ত অনুযায়ী কাজ করতে হচ্ছিল বলে বুনুয়েলের প্রথম প্রথম ভীষণ অসুবিধে হচ্ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পাদক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং হলিউড ছবিকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বুনুয়েল অনেক কিছু আহরণ করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে অনেক কাজে লেগেছিল।
…
মেক্সিকোর
বাণিজ্যিক ছবির
জগতে প্রায়শই বুনুয়েল
বাধ্য হতেন অল্প বাজেটে, মাত্র
কয়েক সপ্তাহর শুটিংয়ে
নিম্নমানের জনপ্ৰিয়
ছবি নির্মাণ
করতে
…
Un Chien Andalou, L’Age d’Or বা Lus Hurdes [‘ল্যান্ড উইথাউট ব্রেড’] জাতীয় ছবি করার সময় বুনুয়েল ইচ্ছেমতো তার ছবির বিষয়বস্তু নির্বাচন করতে পারতেন। কিন্তু মেক্সিকোর বাণিজ্যিক ছবির জগতে প্রায়শই বুনুয়েল বাধ্য হতেন অল্প বাজেটে, মাত্র কয়েক সপ্তাহর শুটিংয়ে নিম্নমানের জনপ্ৰিয় ছবি নির্মাণ করতে।
যেমনটি পিটার ইভান্স দেখিয়েছেন চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকে বেশিরভাগ মেক্সিকান ছবির বিষয়বস্তুই ছিল ফ্যামিলি মেলোড্রামা, হলিউড ওয়েস্টার্নধর্মী এবং কমেডি।
পপুলার ছবির ফর্মুলা মাফিক কাজ করলেও বুনুয়েল তার নিজস্ব কিছু সিগনেচার এই ছবিগুলিতে রেখে গিয়েছেন। বাণিজ্যিক ছবির থিমের মধ্যেও বুনুয়েল নিজের স্বকীয় ভঙ্গিতে– চরিত্রের মধ্যে নানা প্রকারের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, সামাজিক ইসু, ব্ল্যাক হিউমর, শ্লেষ ইত্যাদি বিষয়বস্তুর অনুপ্রবেশ ঘটান।
এই মেক্সিকো পর্বের উল্লেখযোগ্য ছবিগুলির মধ্যে প্রথমেই যেটার নাম করতে হয়, সেটা হলো– Los Olvidados [‘দ্য ফরগোটেন ওয়ানস’ ওরফে ‘দ্য ইয়ং অ্যান্ড দ্য ডেমড’]। কোনো রকমের ভণিতা ছাড়া বুনুয়েল সমাজের একেবারে নিম্নশ্রেণির মানুষদের পাপ, হিংসা, হত্যা, অপরাধ বেষ্টিত দুর্নীতিগ্রস্ত যে জগত, তার স্বরূপ উন্মোচিত করেন। ছবির বিষয়বস্তু সমাজের উচ্ছিষ্ট প্রান্তিক শ্রেণির মেক্সিকো বস্তির বাচ্চারা, তাদের শঠতা, হিংস্রতা এবং শেষ পরিণাম হিসেবে চরম দুর্ভাগ্য ও মৃত্যু।

বদলা নেবার জন্য বদ্ধ পরিকর রিফর্ম-স্কুল পলাতক এল জাইবো (El Jaibo), দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধোত্তর মেক্সিকোর বস্তিতে জেল থেকে ছাড়া পাবার পর ফিরে আসে। তার একমাত্র উদ্দেশ্য, যে ইনফরমার বাচ্চা ছেলেটির জন্য তাকে জেলে যেতে হয়েছিল, তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করা। একটি অপরাধী দলের রিং-লিডার এল এই কাজে নিয়োগ করে পেদ্রো নামক আরেকটি ছেলেকে। অচিরেই অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে, পেদ্রোর শৈশব ধ্বংস হয়ে যায়; সে চেষ্টা করলেও এই জাল ছিঁড়ে আর বেরিয়ে আসতে পারে না। অন্তিম পরিণতি হিসেবে এলের গুলিতেই পেদ্রোর মৃত্যু হয়, আর এলের মৃত্যু হয় পুলিশের গুলিতে। বুনুয়েল এই ছবি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে পরবর্তীকালে বলেছেন, তার উদ্দেশ্যই ছিল এটা দেখানো– ‘we are not living in the best of all possible worlds.’
বুনুয়েলের বহুদিনের সহকারী-চিত্রনাট্যকার জঁ ক্লুদ ক্যারিয়ের (Jean Claude Cariere) সূত্রে আমরা জানতে পারি, ভিত্তোরিও দি সিকার মিরাকল ইন মিলান ছবিটিকে বিশেষভাবে অপছন্দ করতেন বুনুয়েল। একটি প্রবণতা বিশেষভাবে সিনেমায় লক্ষ্য করা যায়– কেবল বিত্তশালী ব্যক্তিদের শঠতা, লালসা, জিঘাংসার বিপরীতে গরীবের উদারতা, দয়াপরায়ণ মনোভাবের মাধ্যমে দারিদ্র্যকে গ্ল্যামারাইজ করার প্রচেষ্টা। গরিবিকে মহিমান্বিত করার এই খ্রিস্টান অ্যাটিটিউড বুনুয়েল কখনোই সমর্থন করেননি। উপরোক্ত দি সিকার ছবিটিও বুনুয়েলের মতে একই দোষে অভিযুক্ত। বুনুয়েল বলতেন, দারিদ্রতা যদি এতই অত্যুত্তম ও বিস্ময়কর হয়, তবে তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা কেন? তার মতে, আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থা গরিব-বড়লোক নির্বিশেষে সবাইকেই বিষিয়ে দিয়ে হিংসায় প্ররোচিত করে।
Los Olvidados ছবিটি সম্পর্কে একটি কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, যদিও বুনুয়েল একটি টিপিকাল নিও-রিয়ালিস্ট ছবির সমস্ত উপাদান– ‘আউটডোর লোকেশন শুটিং’, ‘অপেশাদার অভিনেতা’, ‘সামান্য বাজেট’ এবং সর্বোপরি ওয়ার্কিং ক্লাসকে বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করেন, তবু এটি নিও-রিয়ালিস্ট ছবি নয়। ইতালিয়ান নিও-রিয়ালিজম সম্পর্কে তির্যক মন্তব্য করতে গিয়ে ১৯৫৩ সালের পোয়েট্রি অ্যান্ড সিনেমা নামক একটি প্রবন্ধে বুনুয়েল লিখেছিলেন, ‘নিও-রিয়ালিজম বা নব্য-বাস্তবতার যে বাস্তব তা অসম্পূর্ণ, আঙ্গিকগত দিক দিয়ে গতানুগতিক, এবং সর্বোপরি যুক্তির সর্বগ্রাসী উপস্থিতিতে বিনষ্ট।’ বুনুয়েল আরও লেখেন, ‘কাব্য, রহস্য, এবং আরও অনেক কিছুই যা আমাদের স্পৃশ্য বাস্তবকে সম্পূর্ণ করে তুলে তা সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি দেয়, নব্য-বাস্তবতায় অনুপস্থিত।’
প্ৰিয় পাঠক, খেয়াল করলেই দেখবেন Los Olvidados-এ এমন অনেক দৃশ্য আছে যা বাস্তবকে ছলনা করে পরাবাস্তবতার পরশ নিয়ে আসে। একটি শটে আমরা দেখি, ছেলেটি একটা ডিম নিয়ে সোজা ক্যামেরাকে লক্ষ্য করে ছুড়ল, তারপর সেই ফাটা ডিম খোসা সহিত পর্দায় ঝুলতে থাকে; অবশ্যই ডিমটি লেন্সের গায়ে তখনো লেগে রয়েছে। এ যেন একভাবে ক্যামেরার ভয়েরিস্টিক গেজকে স্বীকার করে নিয়ে, চতুর্থ দেওয়াল ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টা। বা সেই স্লো-মোশনে তোলা ড্রিম সিকোয়েন্স, যার মাধ্যমে পেদ্রো অবচেতনের ভয়, উদ্বেগ সুপ্ত বাসনার উন্মেষ হয়।
…
বুনুয়েলের
উদ্দেশ্যই
যেন
এই
ঝকঝকে
আধুনিকতার
উপকণ্ঠে অবস্থিত
যে অন্ধকার, তাকে
অন্তরাল থেকে তুলে এনে
দর্শকের সম্মুখবর্তী করে তোলা
…
Los Olvidados ছবির শুরুতেই আমরা কিছু ঝাঁ-চকচকে শহরের পরপর শটের কতগুলো মন্তাজ দেখতে পাই– নিউইয়র্ক ম্যানহ্যাটন স্কাইলাইন, লন্ডনের বিগ বেন, এবং প্যারিসের আইফেল টাওয়ার। বুনুয়েলের উদ্দেশ্যই যেন এই ঝকঝকে আধুনিকতার উপকণ্ঠে অবস্থিত যে অন্ধকার, তাকে অন্তরাল থেকে তুলে এনে দর্শকের সম্মুখবর্তী করে তোলা। বামপন্থী বুনুয়েল যে আমাদের আধুনিকতার দ্বান্দ্বিকতা সম্পর্কে অবহিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করা উদ্বৃত্ত শ্রেণির মানুষদের রূঢ় বাস্তব নিয়ে নির্মিত এই নির্মম আখ্যান মেক্সিকান প্রেস ও সাধারণ দর্শকের বিরক্তির উদ্রেক করলেও পঞ্চাশোর্ধ বুনুয়েল আন্তর্জাতিক মহলে বহুদিন পর তার হৃত গৌরব ফিরে পেয়েছিলেন Los Olvidados-এর হাত ধরে। বলা যেতে পারে এটি বুনুয়েলের এক প্রকার কাম-ব্যাক ছবি। ১৯৫১ সালে ছবিটি বুনুয়েলকে কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান এনে দেয়।
Los Olvidados ছবিটিকে ইউনেস্কো ‘প্রান্তিক মানুষের জীবনের ওপর নির্মিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করে আরো বলেছে, ‘বুনুয়েল নির্মমভাবে সৎ, তার দেখানোয়।’
এরপর যেই ছবি সর্বাধিক আলোচনার দাবি জানায়, তা হলো ১৯৬২ সালে নির্মিত দ্য এক্সটারমিনেটিং অ্যাঞ্জেল [El ángel exterminador]। গোটা ছবিটিই আঙ্গিক দিক দিয়ে বিচার করলে একটি সম্পূর্ণ পরাবাস্তববাদী ছবি, যার কাহিনি ও বিষয়বস্তু অলীক এবং অবাস্তব। ছবিটি গড়ে উঠেছে একটি বিত্তশালী দম্পতির আয়োজন করা একটি নৈশভোজের আসরকে কেন্দ্র করে। এডমুন্ড নোবিলে ও তার স্ত্রী লুসিয়ার দেওয়া এই নৈশভোজের আসরে, একের পর এক বন্ধু-বান্ধব তাদের স্ত্রী-পরিজনদের নিয়ে আসতে থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রত্যেকেই উচ্চশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ধনী সম্প্রদায়ের। কিন্তু সন্ধ্যে হতে না হতেই ভারী অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে থাকে। আগেভাগেই রান্না-বান্না সেরে রাঁধুনী, ভৃত্য, পরিচারিকারা সব একে একে কেটে পড়তে থাকে কোনো এক অজানা কারণে। শেষমেষ পরে থাকে শুধুমাত্র চিফ কুক।
কিন্তু আসল ঘটনার সূত্রপাত ডিনারের পর। নৈশভোজ সেরে সকলে মিউজিক রুমে একত্রিত হয়, ব্ল্যাঙ্কা নামক এক আমন্ত্রিত মহিলার পিয়ানো শুনবে বলে। সোনাটা বাজানো শেষ, স্বামী-স্ত্রী আশা করে এবার হয়তো সবাই ফিরে যাবে এবং তারাও একটু বিশ্রাম নিতে পারবে, সারাদিন যা ধকল গেছে। ঠিক এই মুহূর্তে বুনুয়েল তার তুরূপের তাসটি চেলে দেন। অদ্ভুত এক আলিস্যি এসে ভর করে সমস্ত আমন্ত্রিত অতিথিকে। তারা আর ফিরে যাবার নাম করে না বড় হলঘরের যে যেখানে ছিল, সেখানেই জবুথবু হয়ে বসে পড়ে গা এলিয়ে দেয়। হতভম্ভ দম্পতি বুঝতেই পারে না ঠিক কী করা উচিত। এদিকে চক্ষুলজ্জাবশত চলে যেতেও বলতে পারে না। অগ্যতা অনন্যোপায় হয়ে ঠিক করে, একটি রাতেরই তো ব্যাপার, পরের দিন সকালেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে আলুলায়িত ভঙ্গিতে হল ঘরের ভিতর যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবাই শুয়ে পড়েছে– কেউ মেঝেতে, কেউবা সোফায়।

পরের দিন ভোরবেলা সবাই আবিষ্কার করে কোনো এক অলৌকিক কারণে বাড়ি ছেড়ে কেউ বেরোতে পারছে না। এমন নয় যে দরজা বন্ধ; কিন্তু হলঘরের বাইরে পা রাখতে উদ্যোগী হলেই কোনো না কোনো কারণবশত বারে বারে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কোনো এক দুর্নিবার চৌম্বকীয় আকর্ষণ তাদের সবাইকে বেঁধে রেখেছে। এদিকে খাবার-দাবার, এমনকি জলও শেষ হতে থাকে; কার্যত নিরম্বু উপবাসের অবস্থা হয়। সবার মেজাজও যায় বিগড়ে। মার্জিত রুচিবান বিত্তশালীদের পরিশীলিত আচরণের মুখোশের তলায় লুকোনো স্বরূপ আস্তে আস্তে উন্মোচিত হয়। অসহিষ্ণুভাবে একে অপরের সাথে মারামারি-হানাহানি করতে থাকে, আর প্রকাশ পায় তাদের পরকীয়াকাতর দিকটি। ইতিমধ্যে এক বৃদ্ধের কার্যত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ঘটেছে, এবং একটি প্রেমিক-প্রেমিকা জুটি নিজেদের ক্লোসেটে বন্ধ করে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয়েছে।
দিন পেরিয়ে রাত হয়ে যায়, তবু বেরোনোর কোনো নাম-গন্ধ নেই। মাঝে রোস্ট করার জন্য রাখা এক পাল ভেড়া নিচে নেমে এসে সে এক জগাখিচুড়ী অবস্থা সৃষ্টি করে। প্রচণ্ড পিপাসায় বাধ্য হয়ে শেষে দেওয়াল ভেঙে পাইপ ফাটিয়ে জল খেতে উদ্যত হয়। সেখানেও মারামারি-কাড়াকাড়ি পড়ে যায়।
এইভাবে টানা দুই রাত্রি আটকে থাকার পর অবশেষে তারা মুক্তি পায়, সেও এক অলৌকিক উপায়ে। আটকে পরার আগের মুহূর্তে সেদিন রাতে মিউজিক রুমে যে যেই অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থায় পুনরায় ফিরে যেতেই যেন ম্যাজিকের মতো স্পেল কেটে গিয়ে সবাই মুক্ত হয়ে যায়।
অবিশ্যি এই মুক্তি সাময়িক। ছবির শেষে আমরা দেখব, একটি গির্জায় প্রার্থনা সারতে গিয়ে একইভাবে আবার এরা এক অজানা কারণে আটকে পড়েছে; তাদের সঙ্গী ক্যাথলিক পাদ্রীসহ আরও অনেকে। বাইরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়, সম্ভবত দাঙ্গা, এবং সেটা দমন করার জন্য রাষ্ট্র মিলিটারি নামিয়ে দেয়। ছবির শেষে আমরা দেখব, এক পাল ভেড়া গির্জার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন হচ্ছে, এসবের মানে কী? বুনুয়েল কী উদ্দেশ্য নিয়ে ছবিটি বানিয়েছেন? আসলে গোটা ছবিটিই রূপকার্থে বুর্জোয়া শ্রেণির প্রগতিবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল স্থিতাবস্থাপ্রীতি মনোভাবকে তীব্রভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে। শুধু তাই নয়, টেবিল ম্যানার্সের আড়ালে লুকিয়ে রাখা তাদের হিংস্রতা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি নানা প্রবৃত্তির মাধ্যমে তাদের প্রকৃত রূপটিও প্রকট হয়।
এই ছবির এক জায়গায় পণ্যসমাহারে বিলাসে-ব্যাসনে অভ্যস্ত প্রেমিকা তার প্রেমিককে বলছেন, ‘When we get back to Lourdes I want you to buy me a washable virgin, made of rubber… You will buy it for me, won’t you?’ এই পণ্যসর্বস্ব সময়ে কমডিটি ফেটিসিজম এমন এক চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে মানুষ ঈশ্বরকেও পণ্যদ্রব্যের সমতুল্য বানিয়ে ফেলেছে।
ষাট ও সত্তরের দশক জুড়ে বুনুয়েল একের পর এক অসামান্য সব ছবি আমাদের উপহার দিয়েছেন। এর মধ্যে আলোচনার জন্য আমি বেছে নেব ১৯৭২-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ফরাসি ভাষায় নির্মিত দ্য ডিসক্রিট চার্ম অব দ্য বুর্জোয়া [Le charme discret de la bourgeoisie]। এই একটি মাত্র ছবি সম্ভবত বুনুয়েলের সমগ্র ক্যারিয়ার জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ছবিতে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ ও বিশ্বাসকে একত্রে উপস্থিত করে।
…
‘আমি তো আগেই বলেছি
আমেরিকানরা
ব্যবসায়ী
হিসেবে
সৎ!’
…
এই ছবি অস্কারে ভূষিত হয়, অবিশ্যি তার আগেই সিনে-দুনিয়ায় তিনি বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন অস্কার পাবার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করে; এবং এও বলেছিলেন, পুরস্কারটি কিনতে তাকে নাকি পঁচিশ হাজার ডলার খরচা করতে হয়েছে! পরে ছবিটি সত্যিই অস্কার পাবার পর বুনুয়েলের সোজাসাপ্টা বক্তব্য, ‘আমি তো আগেই বলেছি আমেরিকানরা ব্যবসায়ী হিসেবে সৎ!’
কমেডি জনরার অন্তর্ভুক্ত একটি আদ্যন্ত সুররিয়ালিস্ট এই ছবিতে আমরা দেখি ছয়জন বিত্তশালী (তিনজন মহিলা, তিনজন পুরুষ) যতবারই তাদের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য একত্রিত হয়, ততবারই কোনো না কোনো কারণে তাদের খাওয়া ব্যাহত হয়। অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্যা সৃষ্টি হয়ে তাদের এক সাথে খাওয়ার প্ল্যান ভন্ডুল করে দেয়। কখনো সেটা ভুল তারিখের জন্য, কখনো নিমন্ত্রণকারী দম্পতি বাগানে প্রেম করতে ব্যস্ত, কখনো তারা খেতে গিয়ে দেখে রেস্তোরাঁর মালিক প্রয়াত বা কখনো মিলিটারি ড্রিলের শব্দ তাদের খাওয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র রাফায়েল আকোস্তা মিরান্ডা নামক একটি কাল্পনিক দেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ফরাসি দূতাবাসে কর্মরত। কিন্তু এই কপট ও ভণ্ড রাষ্ট্রদূত আসলে একটি বেআইনি মাদক পাচারকারী সংস্থার সাথে জড়িত। তার নিজের দেশে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন চলছে, এবং সেখানকার একটি প্রতিবাদী ছাত্রী ফ্রান্সে এসে আকোস্তাকে অনুসরণ করতে থাকে, শেষে তাকে নিজের ফ্ল্যাটে তুলে এনে প্রলুব্ধ করার চেষ্টায় ব্যর্থ হলে গুন্ডাদের দিয়ে মেয়েটিকে অপহরণ করায়।
আর আছে একজন পাদ্রী, যে অপমানিত হওয়া সত্ত্বেও বিত্তশালী দম্পতির বাগানের মালি হওয়ার জন্য উদগ্রীব। রাষ্ট্রদূত বা কোনো বড় সামরিক অফিসারকে দেখলেই বন্ধুত্ব পাতানোর জন্য পাদ্রীবাবুর প্রাণ ছটফট করে ওঠে। বলা বাহুল্য, এই ক্যাথলিক প্রিস্ট খ্রীস্টের দেখানো পথ পরিহার করে আর্ত ও পীড়িতদের সেবা করার বদলে উচ্চপদস্থ বিত্তশালীদের অধীনস্থ হয়ে থাকতেই বেশি উৎসাহী। ছবির একটি মাত্র সিনে, যখন সে অক্ষরিক অর্থেই এক মুমূর্ষু রোগক্লিষ্ট গরিব মৃত্যুপথযাত্রীর বাড়িতে তার ডাইং কনফেশন নিতে হাজির হয়, তার স্বীকারোক্তিতে রাগান্বিত হয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে পাদ্রী। আসলে ধনতন্ত্রের ধ্বজাধারী রাষ্ট্র এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যে গভীর নেক্সাস, এবং এই দুই প্রতিষ্ঠান মিলে সাধারণ মানুষকে কীভাবে নিষ্পেষিত করে, বুনুয়েল আসলে সেটাই দেখাতে চেয়েছেন। মাদক পাচারকারী আকোস্তা এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা ধরা পড়লেও সরকারের হস্তক্ষেপে পুলিশ তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ছবিতে অসংখ্য স্বপ্ন দৃশ্য ব্যবহৃত হয়েছে, যার মাধ্যমে চরিত্রের মনের মধ্যে থাকা ভয়, গিল্ট, উদ্বেগ উন্মোচিত হয়। বিত্তশালীদের করা পাপাচারই যেন তাদের বারে বারে ফিরে এসে হন্ট করে, এবং খাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়।
বুনুয়েল ফরাসি নবতরঙ্গের কিছু টেকনিক এই ছবিতে প্রয়োগ করেছেন; যেমন জাম্প কাট, শব্দ বা ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজকে মোক্ষম জায়গায় আগ্রবর্তী করে দেওয়া ইত্যাদি। আসলে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি আকোস্তাকে তরুণী প্রতিবাদী ছাত্রীটির তাড়া করা তো একধরনের প্রতিষ্ঠানবিরোধী রাগের বহিঃপ্রকাশ, যেই রাগ সাতের দশকের যুবসমাজের অন্তর্লীন চোরাস্রোত। একজন সত্যিকারের বড় শিল্পী লুই বুনুয়েল কীভাবে তার সময়কে এড়িয়ে যেতে পারতেন? সমসাময়িককে নথিভুক্ত করাই তো একজন প্রকৃত স্রষ্টার কাজ।

শুধু যে কালচেতনা, তা নয়; আমরা দেখব বুনুয়েলের এই ছবিটি ইতিহাস চেতনার দ্বারাও সম্পৃক্ত। ছবিতে একটি বিশেষ সিনের দিকে পাঠকগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করব: সময়মতো লিমুজিনে চড়ে সিনেচাল দম্পতির বাড়িতে সবাই উপস্থিত। উদ্দেশ্য অবশ্যই মধ্যাহ্নভোজের আসর। এদিকে দোতলার উপর ঘরে দরজা বন্ধ করে স্বামী-স্ত্রী রতিরঙ্গে মেতে উঠল। পরিচারিকার কড়া নাড়ায় মিস্টার সিনেচাল যদিওবা নিজেকে সামলে নিয়ে বিরত হয়, মিসেস সিনেচাল চিলেকোঠার উন্মাদিনীর মতো তাকে আষ্টেপৃষ্টে জাপ্টে ধরে। নাছোড় সে; করবেই। অবশেষে বাধ্য হয়ে স্বামী-স্ত্রী পিছনের জানলা দিয়ে দোতলা থেকে সোজা মাটিতে নেমে বাগানের নিভৃতে পলায়ন করে শৃঙ্গার স্বচ্ছন্দে উপভোগ করার জন্য। এদিকে বাকি চারজন আমন্ত্রিত অতিথি ঠায় বসে। অবশেষে শৃঙ্গার সমাপ্ত হলে তারা বাগান থেকে গায়ে ঝোপ-ঝাড় মেখে বেরিয়ে আসে, তখন অবিশ্যি সব অতিথি কেটে পড়েছে।
আমি বলব, এই বাগানের এপিসোডটি বাইবেলের জেনেসিসে বর্ণিত আদম ও ইভের ইডেনের উদ্যান থেকে ঈশ্বর দ্বারা বহিঃস্কৃত হবার ঘটনাকে সরাসরি উদ্ধৃতি করে। জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষনই মানুষের আদি পাপ হিসেবে বাইবেলে চিহ্নিত করা হয়, যেখান থেকে পতনের সূত্রপাত।
বুনুয়েলের চলচ্চিত্র ভাবনার কয়েকটি বৈশিষ্ট সম্পর্কে বলতে গেলে বলা চলে– ব্ল্যাক হিউমার, ধর্মবিদ্বেষ, হিংসা ও যৌনতার সৎ ও নিষ্ঠুর প্রয়োগের ইতিবৃত্ত। বার্গম্যান যে চারজন পরিচালককে নিজের চেয়েও বড় বলে উল্লেখ করেছেন, তাদের প্রথমজন হলেন বুনুয়েল।
সবশেষে বলব, বুনুয়েল আজও প্রাসঙ্গিক কেন। গোটা পৃথিবী জুড়েই যখন আরেকবারে নতুন করে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, স্বৈরাচারীদের বাড়বাড়ন্ত মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এবং বিকল্প শিল্প-ভাবনা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে সংস্কৃতি কারখানার আগ্রাসনে, তখন আসুন বুনুয়েলকে আরেকবার আবিষ্কার করি।