সাক্ষাৎকার: ড্যানিয়েল ইগান
অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
অনুবাদকের নোট
ক্রিস্টোফার ডয়েল [২ মে ১৯৫২–]। অস্ট্রেলিয়ান-হংকং মাস্টার সিনেমাটোগ্রাফার। কাজ করেছেন শতাধিক সিনেমায়। এরমধ্যে রয়েছে ‘চাংকিং এক্সপ্রেস’, ‘হ্যাপি টুগেদার’, ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’, ‘টেম্পট্রেস মুন’, ‘এন্ডলেস পোয়েট্রি’, ‘লাস্ট লাইফ ইন দ্য ইউনিভার্স’, ‘অ্যাশেজ অব টাইম’ প্রভৃতি…

ড্যানিয়েল ইগান :: লাভ আফটার লাভ নিয়ে আলাপ শুরু করা যাক।
ক্রিস্টোফার ডয়েল :: এই ইংরেজি শিরোনামটা আমার বিশ্রী লাগে। ইলিন চেংকে চেনেন আপনি? ১৯৫০ ও ’৬০-এর দশকে তিনি ছিলেন এক প্রলিফিক ও জনপ্রিয় লেখিকা। আমার ধারণা, তার সাহিত্যকর্ম অবলম্বনে তিনটি সিনেমায় আমি কাজ করেছি, যার মধ্যে রেড রোজ, হোয়াইট রোজও [স্ট্যানলি কোয়ান; ১৯৯৪] রয়েছে।
লাভ আফটার লাভ বানিয়েছেন আন হুই। তিনি ইলিন চেংয়ের দারুণ ভক্ত। আমার ধারণা, ইলিনের বই থেকে তিনি তিন-চারটি সিনেমা বানিয়েছেন। ওইসব বইয়ের থিমগুলো তার কাজের সঙ্গে বেশ মানানসই।
এই সিনেমার সূচনা ঘটে ধূপকাঠির একটি শট দিয়ে। আসলে উৎস-ছোটগল্পটির শিরোনামও এটাই [‘অ্যালোসউড ইনসেন্স: দ্য ফার্স্ট ব্রাজিয়ার’ বা, ‘আগরকাঠের ধূপ: প্রথম তাম্রকার’]। একটি ধূপকাঠি– যেটি কি না পুতপবিত্র, যেটি নিষ্কলুষতা হারিয়েছে, যা কি না স্বয়ং এই তরুণী [সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র]– এ ক্ষেত্রে ‘ধূপায়িত’ই সম্ভবত সেরা শব্দ। যেটিকে ভালোবাসার শিখা হিসেবে নিজে ভাবে, সেই জিনিস গ্রাস করে ফেলেছে এই তরুণীকে।
(শিরোনাম হিসেবে) লাভ আফটার লাভ একটু দুর্বল। আমি হলে এই সিনেমার শিরোনাম দিতাম, ‘লাস্ট আফটার লাস্ট’ [‘লালসার পর লালসা’]। আমি জানি না আসলে; আমি তো স্রেফ ক্যামেরাম্যান।
ইগান :: এই সিনেমার শুট করেছিলেন কোথায়?
ডয়েল :: চীনারা যেটিকে ‘অন্যায্য চুক্তি’ বলে ডাকে, সেটির ফলাফল হিসেবে উনবিংশ শতকের সাংহাই, হংকং, দালিয়ানে (শুটিং করেছি)। একটা ছিল শামিয়ান, তখন ওই অঞ্চলকে আমোয় ডাকা হতো। চীনা উপকূলের পাশের ওই দ্বীপ সে সময়ে স্থবির হয়ে পড়েছিল। এটি দেখতে ১৯৫০-এর দশকে হংকং যেমন ছিল, ঠিক সে রকম: দুর্দান্ত ঔপনিবেশিক স্থাপত্য, প্রস্তরকর্ম, আবহাওয়া। তবে প্রতিদিনই প্রায় ২ লাখ পর্যটক সেখানে ভীড় করেন। এ এক ভয়াবহ দুস্বপ্নের মতো। প্রতিদিন রাস্তায় এত মানুষ আমি আর কখনোই কোথাও দেখিনি।
আমরা আসলে একটি কম্পাউন্ডে সিনেমাটির মূল সেট বসিয়েছিলাম। এই সিনেমার শুটিংই সম্ভবত আমি সবচেয়ে দ্রুত গতিতে করেছি। দিনে ছয় থেকে আট ঘণ্টা শুট করেছি আমরা।

ইগান :: লাভ আফটার লাভ-এর লক্ষণীয় বিষয় হলো, এর চরিত্রগুলো নিজেদের দুর্নীতির প্রতি সহমত; পরে ভুগতে হবে– এ কথা জেনেও এসব কাজ তারা মনের আনন্দেই বেছে নেয়। একটি পতিতালয়ের মেজমেজে ও অবক্ষীয়মান আবহে এর কাহিনি জায়গা করে নিয়েছে। ওই দুনিয়াকে কী করে গড়ে তুললেন আপনি?
ডয়েল :: প্রথমত আমার একটা বিরাট সুবিধা ছিল: যাদের সঙ্গে কাজ করেছি, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ব্যক্তিগতভাবে আমার বন্ধু। স্ট্যান লাই, গাস ভ্যান স্যান্ট, আন– আমরা পরস্পর চেনা। ফিল্মমেকিং ঘিরে নয়, বরং ব্যক্তিত্ব ঘিরে, অভিপ্রায় ঘিরে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ঘিরে একটি পারস্পরিকতা, একটি আদান-প্রদান ছিল সেখানে। ব্যাপারটি এমন ছিল– ‘এই আইডিয়াকে তার প্রাপ্য আমি কীভাবে দেব?’
যাদের নিয়ে কাজ করেছি তাদের প্রায় প্রত্যেকেই যেহেতু প্রথমত আমার বন্ধু, তাই এখানে কোনো কর্তৃত্বের বালাই ছিল না। কাজ করার জন্য এ ছিল এক চূড়ান্ত রকমের অনুকূল ও সৃজনশীল পরিবেশ। এ ছিল এমন ব্যাপার– ‘কীভাবে কাজটা করব আমরা?’ এ ছিল আদান-প্রদানের ব্যাপার। এ ছিল কাজের পরিবেশকে উপভোগ করার ব্যাপার। আমার ধারণা, এ সম্পর্কে জেমস ক্যামেরনের কোনো ধারণাই নেই!
ইগান :: এ কথা থেকে অবশ্য বোঝা গেল না, কাজটা কীভাবে করেছেন। এই সিনেমার এক দৃশ্যে জর্জকে [চরিত্র] একটা উঠোন পেরিয়ে নিয়ারের [চরিত্র] রুমে যেতে দেখা যায়। সারভেন্ট’স কোয়ার্টারে পৌঁছানোর জন্য অন্ধকার থেকে বেরিয়ে সে পা বাড়ায় আলোর জলাশয়ে। এই লাইটিং নিশ্চয় আপনি আগে থেকে করে রেখেছিলেন; নিশ্চয় সেটি আপনাআপনি ছিল না। তা ছাড়া, আন হুইও জানিয়েছেন, ওভাবেই দৃশ্যটার কাজ করেছেন আপনারা।
…
আমি
আমার
সীমিত অভিজ্ঞতায়
স্পেসকে সব সময়ই ন্যারেটিভের
এনভায়রনমেন্ট
সৃষ্টি করতে
দিই
…
ডয়েল :: স্বয়ং স্পেসই আমাদের গল্প বলে দেবে– আমার ধারণা আমার কাজের প্রক্রিয়া এমনই ছিল। আমি আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় স্পেসকে সব সময়ই ন্যারেটিভের এনভায়রনমেন্ট সৃষ্টি করতে দিই। ওই উঠোনের ছিল নিশ্চিত সীমাবদ্ধতা এবং কাঠামোগত সম্ভাব্যতা। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রেও ইলিন চেংয়ের উৎস-কাহিনিটির দ্বারস্থ হতে হবে আপনাকে। ওই চাকরানি কেন সিঁড়ির তলার এ রকম একটি কুঁড়েঘরে থাকে? কারণ, তারা তাকে ওখানেই রেখেছে। সিঁড়ির তলায়ই কুঁড়েঘর।
এটি কোনো কনস্ট্রাকশনের বিষয় নয়; এটি কোনো থ্রি-অ্যাক্ট স্ক্রিপ্টের বিষয় নয়। মোটেও নয়। এ হলো এই কাহিনি এই স্পেসেই জায়গা করে নিতে পারে– সেই সম্ভাবনার বিষয়। আমরা যদি ঠিকভাবে স্পেস বেছে নিতে পারি, আমরা যদি অভিনেতাদের সামনে নির্দিষ্ট সম্ভাবনাগুলো জাহির করতে পারি, তাহলে আশাবাদী কিছু অনুরণিত হবেই: আমি সৃজনশীল বলছি না; বলছি– অনুরণনের কথা। অন্য কোথাও বানানোর তুলনায় সেখানো বানানোটা একটি ভিন্ন সিনেমা পাওয়ার আশাবাদ জাগিয়ে তুলবে।
…
নিজের কাছে যা আছে, তা-ই
গ্রহণ করো এবং তাকে
আরও বড় করে
তোলো
…
আপনি কি জানেন, ইন দ্য মুড ফর লাভ [ওং কার-ওয়াই; ২০০০] দেখতে কেন ওরকম হয়েছিল? কারণ, আমরা ওই সিনেমার শুট ওটির যথাযোগ্য স্পেসে করতে পেরেছিলাম। এটি আমার পক্ষ থেকে তরুণ ফিল্মমেকারদের প্রতি একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। নিজের কাছে যা আছে, তা-ই গ্রহণ করো এবং তাকে আরও বড় করে তোলো। যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে ওই স্পেসে ঢুকে পড়ো।
নিশ্চয় (হাই জাওয়ের) আর্ট ডিরেকশনে কিছু একটা ছিল; নিশ্চয় (কস্টিউম ডিজাইনার) ইমি ওয়াদার কস্টিউম ডিজাইনে কিছু একটা ছিল, নিশ্চয় কর্মপরিবেশের নির্দিষ্ট প্যারামিটার আমরা লাভ করেছিলাম। তবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যেভাবে আমি নিজে এবং আমার সঙ্গে কাজ করা আরও অনেকে সিনেমাগুলো বানাই, সেটি প্রদত্ত স্থান ও স্পেসের একটি আইডিয়ার, এবং ওই আইডিয়াতে ব্যক্তিত্বের বিকাশের একটি পদক্ষেপ। এটি জিনিসপত্র জড়ো করার ব্যাপার নয়; বরং (অপ্রয়োজনীয়) জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলার ব্যাপার।

যাহোক, আমার ধারণা এটিই কস্টিউম ডিজাইনার ইমি ওয়াদার শেষ সিনেমা। আমরা একসঙ্গে হিরো [জ্যাং ইমৌ; ২০০২] সিনেমায়ও কাজ করেছিলাম। তার সঙ্গে জাপানে একটি সিনেমায়ও কাজ করেছিলাম আমি– দে সে নাথিং স্টেস দ্য সেম [ জো ওদাগিরি; ২০১৯]। তার সঙ্গে আমি তিন-চারটি সিনেমায় কাজ করেছি। তার কাজের মধ্যে এক মনোমুগ্ধকর ডিটেইল রয়েছে। ইমি ওয়াদা আমাদের ধৈর্য্যশীল হতে শিখিয়েছেন।
ইগান :: দেখুন, ওই শটে আপনি আর্ট ডিজাইন দেখতে পারেন না, কস্টিউম দেখতে পারেন না, এখানে দেখতে পাওয়ার বিষয়– আলো ও অন্ধকার। আর, আপনিই সেই আলো ও অন্ধকার তৈরি করেছেন। স্রেফ খুঁজে পাওয়া স্পেস ব্যবহার করেছেন– তা নয়; বরং আপনি তাতে লাইটিং করেছেন, চরিত্রটি ওই আলোর জলাশয় দিয়ে ‘এখান’ দিয়ে ‘ওখানে’ যাবে– সেই সিদ্ধান্তও আপনারই নেওয়া। ওখানে যা ছিল, তা-ই ব্যবহার করার বিষয় এটি নয়; বরং এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হয়েছে।
ডয়েল :: সাহিত্য থেকে আসা চরিত্রকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ এখানেই। এটি একজন সিনেমাটোগ্রাফারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বহু চরিত্রের বেলায় বহুভাবে এ কাজ করেছি আমি। হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, আলোটা নীল হওয়ারই ছিল। কিন্তু এটিকে টেকসই ও অন্তস্থলীয় কীভাবে করে তুলব আমরা– সেটাই ঘটনা। সাহিত্য, কনসেপ্ট, এমনকি বিজ্ঞাপনের জগত থেকে আসা বহুলোকের সঙ্গেই আমি কাজ করেছি। লিখিত কাগজে আইডিয়া খুবই নিগূঢ়ভাবে থাকে, কিন্তু সেটাকে যথাযোগ্য করে তোলার কী উপায়?
ইগান :: ওয়েইলং ও চার্লি [চরিত্র] একটি গাছের কান্ডে বসে আছে– এমন একটি টু-শটের দেখা পাই আমরা, যেখানে আপনি ওয়াইড থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে ক্লোজ করে এনেছেন শট।
ডয়েল :: ওটা আমার খুবই প্রিয় শট।
ইগান :: আমি বোঝার চেষ্টা করছি– কীভাবে আপনি কাজ করেন, কীভাবে শট ওরকম হয়ে ওঠে। কখন ক্লোজশট নিতে হবে, ফ্রেম কী হবে– এইসব সিদ্ধান্ত কে নেয়?
ডয়েল :: দেখুন, গাছটা দেখতে পেয়েছিলাম আমি। ওই চরিত্র দুটো প্রচুর বকবক করছিল। এ অবস্থায় (সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে) আপনার আর কী করার ছিল? আমরা ছিলাম একটা দ্বীপে, একটা কম্পাউন্ডে, আর ওই একমাত্র জায়গাটিতে ঘোরার মতো ২০ হাজার লোক আমাদের ছিল না। আপনার কাছে যা ছিল, তা নিয়েই কাজ করতে হবে। কেন সেটা করব না?

ইগান :: আপনাকে ঘিরে টেড ম্যাকডোনেলের বানানো লাইক দ্য উইন্ড [২০২১] ডকুমেন্টারিটি নিয়ে আলাপ করা যাক।
ডয়েল :: ‘লাইক দ্য উইন্ড’ আমার চীনা নাম। আমার শিক্ষক আমাকে আমার ‘দু কে ফেং’ চীনা নামটি না দিতেন যদি, এই সাক্ষাৎকারসহ এসবের কিছুই করা সম্ভব হতো বলে আমার মনে হয় না।
আমি ভ্রমণ করছিলাম আর ভাষা বুঝছিলাম– যা কি না আপনার আর আমার দুজনেরই ভালো লেগেছে; আর তা ভীষণ জরুরি ব্যাপার। আপনি যেভাবে কথা বলেন, তা-ই আপনার ভাবনাকে প্রকাশ করে। অস্ট্রেলিয়ান ইংরেজি আমি পরিমিতভাবে ভালোই বলি। আপনি আপনার (ভাষার) স্পেস কীভাবে বাড়িয়ে তুলবেন? ইংরেজি আছে, স্প্যানিশ আছে, আরবি আছে, চাইনিজ আছে। এগুলো তো পৃথিবীরই ভাষা।
আমি তাই হংকংয়ে গেলাম; কেননা, সে সময়ে চীনে যাওয়া সম্ভব ছিল না। চীনা ভাষা শেখার জন্য হংকংয়ের চাইনিজ ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম আমি। আর বিস্ময়করভাবে আমার দারুণ শিক্ষকটি আমাকে এই নাম দিয়ে দিলেন– ‘দু কে ফেং’।
ইগান :: এ নামের অর্থ আপনার কাছে ‘লাইক দ্য উইন্ড’; তাই তো?
ডয়েল :: এর মানে, ন্যায়পরায়ণ একজন মানুষের অবশ্যই উইন্ডের, মানে বাতাসের মতো হওয়া লাগে। এর মানে, আসা যাওয়া; এর মানে, একটা ঝড়ের মতো, বজ্রঝড়ের মতো। কিংবা কখনো কখনো অস্থিরতার মতো। আমি যদি বাতাসের মতো না হতাম, তাহলে এখন যা, তা হতে পারতাম না। এ এক দারুণ উপহার। এ এক চমৎকার চীনা নাম। তা ছাড়া, আপনি যদি কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন, তাহলে এই সংখ্যাগুলো আসলেই অর্থবহ।
তার মানে, আপনি এখন যে মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন, তার কোনো অস্তিত্ব নেই। ‘দু কে ফেং’ নামের এই মানুষের কোনো বাবা-মা নেই। তার কোনো বাবা কিংবা কোনো মা নেই। সে হলো একটা কনসেপ্ট। সে হলো চীনা লোকদের মনে বাসা গড়া একটি কনসেপ্ট। সে আমার মনেও বাস করা একটি কনসেপ্ট আসলে। আমার কাছে এই নামকে তাই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। একজন মানুষের পক্ষে যা হওয়া সম্ভব, তাকে তারচেয়েও বেশি কিছু করে তোলার জন্য এই দূরত্বের দরকার রয়েছেই।
ইগান :: আপনি দ্য ব্ল্যাক ইন লাকার নামে একটি বইয়ের কাজ শেষ করেছেন।
ডয়েল :: শিরোনামটি অ্যালান ওয়াটসের কাছ থেকে নেওয়া। এ বইয়ে লেসলি (চিয়ুং) কোলাজ করে দিয়েছেন আমার ভালোবাসার জীবন। কথার বুনন আমার প্রিয়। লিখতে আমি ভালোবাসি। লেখার সময় আমি কাঠামোটা ইংরেজিতে লিখি ঠিকই, তবে তা চীনা ভাষায় অনুবাদ করার পরই আমরা প্রকৃত অর্থটা ধরতে পারি। ইংরেজি মোটামুটি চলে; তবে চীনা ভাষা দারুণ। কারণ এটি গ্রন্থিবদ্ধ।
ইগান :: আপনার ক্ষেত্রে এ হলো নিজেকে নিজের পরিধির বাইরে বের করে আনা।
…
আমাদের দায়িত্ব হলো স্পেস
খুঁজে বের করে নিজ
সত্তাকে সরিয়ে
নেওয়া
…
ডয়েল :: শিল্পীদের এটাই করতে হয়। চলুন আমরা বরং আসল আলাপে ফিরে যাই। আপনার কাছে একটা লেখা আছে, আপনি একজন ফিল্মমেকার। আমাদের দায়িত্ব হলো স্পেস খুঁজে বের করে নিজ সত্তাকে সরিয়ে নেওয়া। ফিল্মমেকিংয়ের শিল্পকলা এমনই হওয়া উচিত। এ হলো একটি আইডিয়াকে গ্রন্থিবদ্ধ করা, এবং স্বয়ং আইডিয়াটিকে দেখার নিমিত্তে নিজের সত্তাকে সরিয়ে ফেলা। আমার কাছে এ হলো নাচের মতো; এ বরাবরই নৃত্যকলা। আপনি যদি ঠিকঠাক স্পেস পান, চরিত্রগুলোর চাওয়া সম্পর্কে অবগত হতে পারেন, তাহলে সেগুলোকে চলতে দিন। আমি তো জেমস ক্যামেরন নই!
ইগান :: এই লেখার শিরোনাম তার মানে ওটাই।
ডয়েল :: এখানে আপনি ফিঞ্চারকেও নিতে পারেন। আমি জেমস ক্যামেরন নই, আমি ডেভিড ফিঞ্চার নই। এমনকি আমার নাম ডেভিডও নয়।
আমার সিনেমাগুলোতে দারুণ দেখাক– তা আমি চাই না। আপনি যদি বলেন, ‘বাহ, দারুণ সিনেমা তো,’ তার মানে আমরা ‘চুদে গেছি’! সিনেমাটি স্থানের অনুরণন ঘটাতে পারবে– এমন স্পেস হাজির করার আকাঙ্ক্ষা আমি নিশ্চয় রাখি। আপনি যেমনটা বললেন, লোকটি সিঁড়ি বেয়ে নামল, সেখানে নীল আলো– আমি বুঝতে পেরেছি। এ এমনই এক নির্দিষ্ট অলঙ্করণ, যেটির প্রতি আমাদের বিশ্বস্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
…
মানুষ
রাখাটা
আমাদের
একান্তই দরকার
…
কিন্তু এটি তো একটি সিনেমা। আর, আমাদের তো দায়িত্বভার রয়েছে। আমি ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস ৭৫’ বানাতে চাই না। আমি আমার দুনিয়ায় আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে চাই না। আমি লোকদের চাই। মানুষ রাখাটা আমাদের একান্তই দরকার। আবেগের উদযাপন আমাদের করা জরুরি। ফ্রেম ভরিয়ে তোলা মুখকে ভালোবাসা আমাদের জরুরি। কোনো ফালতু আগ্নেয়াস্ত্র কিংবা জেমস বন্ড বিষ্ঠা চাই না। আমি এমন কাউকে চাই, যে বা যারা আমাকে সেসবের কথা বলবে, যেসবের খেয়াল নিজেরাও রাখে। তারা নিজেরা যেসব নিয়ে ভাবে এবং আমার সঙ্গে সেইসব ভাবনা ভাগাভাগি করে নিতে চায়– এমন মানুষ চাই আমি। বাকিরা তো বিষ্ঠা! আপনাকে দেখতে চাই আমি, আপনাকে ভালোবাসতে চাই, আপনার সঙ্গে থাকতে চাই।
ইগান :: সদ্যই যে সিনেমার কাজ শেষ করেছেন, সেটি সম্পর্কে কিছু বলুন।
ডয়েল :: এ ছিল আমার জীবনে কাজ করা সবচেয়ে বাজে স্পেস। জোঁকে ভরা। ঘাসে জোঁক কীভাবে রাখবেন আপনি? ফিল্মমেকার ইয়ান জি শিয়োংয়ের প্রথম কাজ এটি। কেন আমরা ওই সিনেমায় কাজ করেছি, জানি না; তবে করেছি। একেবারেই দক্ষিণাঞ্চলে, একেবারেই বিরানভূমিতে কাজ করেছি আমরা। এই চীনের দেখা এর আগে কেউ পায়নি।
সমুদ্রস্তর থেকে ৩৫০০ মিটার উঁচুতে কেন আপনাকে সিনেমা বানাতে হবে? নোংরা রাস্তা ধরে সাড়ে তিন ঘণ্টার জার্নি করতে হবে আপনাকে। কখনো কখনো এক কি দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে; এবং লোকেশনে পৌঁছানোর জন্য হাঁটতে হবে আরও এক কি দুই কিলোমিটার। এমন একটা স্পেসে সিনেমা বানানোর কী দরকার আমাদের? নিশ্চয় আমরা এর প্রতি মমতাবোধ করি।

আপনার মধ্যে যদি এই প্রবণতা না থাকে, সিনেমা কিংবা শিল্পের উদযাপনকে এ রকম গ্রাম্য ধারণার মধ্যে দেখার প্রবণতা যদি আপনার না থাকে– আমার ধারণা কথাটি সম্ভবত ড্যানিয়েল ডে-লুইস বলেছেন, যে, আপনি যদি শিল্পী হতে চান, তাহলে এ কাজ করবেন না। অন্যদিকে, শিল্পী হওয়া যদি আপনার একান্তই প্রয়োজন হয়ে থাকে, তাহলে আপনার অন্য কোনো উপায় নেই।
সিনেমাটির চীনা শিরোনাম তিয়ান কি অ্যান্ড শি শেং। মূল দুই চরিত্রের নামে নাম। এটি কুরোসাওয়ার দ্য হিডেন ফরট্রেস-এর [১৯৫৮] একটি পুনঃনির্মাণ। আমরা আরও ভালোভাবে কাজটা করতে পেরেছি, বিশ্বাস করুন।
মূলত এটি চরিত্র-তাড়িত। এটি দুই বদমাশের কাহিনি। একজন ভীষণ লোভী; অন্যজন আরেকটু বেশি– ঠিক কী বলা যায়– নাছোড়বান্দা বা নিজের প্রতি সত্যবান। তাদের দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। তারা পালিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে নিজেদের বাড়ি ফিরে পাওয়া যায়, সেই চেষ্টা চালাচ্ছে।
…
যত
সিনেমা
বানিয়েছি,
সবগুলোর
থিম একই: নিজেদের
স্পেসের প্রতি মানুষ
কীভাবে সাড়া
দেয়
…
আমি আসলেই বিশ্বাস করি, যত সিনেমা বানিয়েছি, সবগুলোর থিম একই: নিজেদের স্পেসের প্রতি মানুষ কীভাবে সাড়া দেয়। তা সেটি আর্হেন্তিনায় লেসলি ও টনির [লিয়ুং চিয়ু-ওয়াই] সঙ্গে (হ্যাপি টুগেদার), কিংবা ১৯৬০-এর দশকের হংকংয়ে ম্যাগির [ম্যাগি চিয়ুং] সঙ্গে (ইন দ্য মুড ফর লাভ], কিংবা প্যারানয়েড পার্ক অথবা র্যাবিট প্রুফ ফেঞ্চ-এর চরিত্রগুলোকে নিয়ে বানাই না কেন। আমি সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করি, যা কিছু আমরা করেছি তার সবই স্পেসের মধ্যে থাকা মানুষগুলোকে, এবং এর প্রতি তাদের সাড়াকে ঘিরে বানানো।
সূত্র: ইন্ডিওয়্যার। ফিল্ম ওয়েবসাইট। ৩ জুন ২০২২