না বলা কথায় আমি তোমাকে চাই: রাহুল রায়ের ‘ম্যান অ্যান্ড ওয়াইফ’

335
ম্যান অ্যান্ড ওয়াইফ

লিখেছেন: সায়ন্তন দত্ত

ম্যান অ্যান্ড ওয়াইফ
শর্ট ফিল্ম
স্ক্রিনরাইটার ও ফিল্মমেকার: রাহুল রায়
প্রডিউসার: রুদ্রজিৎ রায়
কাস্ট: আতিফ আলী দাগমান; কঙ্কনা চক্রবর্তী
ডিপি: মানস ভট্টাচার্য্য
সাউন্ড: অনিন্দিত রায়; আদীপ সিং মাঙ্কি
রিলিজ: ২০২১


ইদানীংকালের বেশিরভাগ বাংলা ছবি তো বটেই, দেশীয় বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সিনেমার অন্যতম বড় সমস্যা– বেশি কথা বলা। শুধুমাত্র সংলাপধর্মীতার কথাই নয়, বরং একটি ছবি কী বলতে চাইছে, তা গোদা গোদা অক্ষরে একাধিকবার দর্শকদের কাছে চড়াভাবে না বললে যেন নির্মাতারা নার্ভাস হয়ে থাকেন, বুঝতে পারেন না তাদের বক্তব্য সার্থকভাবে বাহিত হচ্ছে কি না!

সমকালীন এক বাংলা ছবি তো তার মোদ্দা বক্তব্য শুরুতে একবার সংলাপে, বিরতির পর সংলাপে, শেষে তাতেও যেন ভরসা না পেয়ে গান গেয়ে আবার কী বলতে চাইছে, তা বলার চেষ্টা করে। আর দুঃখের বিষয়, ছবির বিষয় যদি হয় নির্দিষ্ট কোনো আইডেন্টিটিকে কেন্দ্র করে, তা সে মহিলা, দলিত, তৃতীয় লিঙ্গপরিচয়ের কেউ, কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণের মানুষ যেই হোন না কেন– তাহলে তো নির্মাতাদের নার্ভাসনেস আরও বেড়ে যায়, তারা বারবার করে তালিকায় টিক দেওয়ার মতো করে পলিটক্যাল কারেক্টনেসের পরীক্ষায় যে কত ভালোভাবে পাস করেছেন, তার প্রমাণ দিতে থাকেন।


পরিমিতি বোধ,
স্বল্পকথন, সূক্ষ্মতা,
কথা লুকিয়ে রাখা, আভাসে
ইঙ্গিতে সিনেমাটিক মুহূর্ত
তৈরি করা– এইসমস্ত
গুণ যখন নব্বই
ভাগ বাংলা
ছবি
থেকে
স্রেফ উধাও
হয়ে গেছে, তখন
এইরকম ছবি সিনেপ্রেমীদের
কাছে একঝলক ঠাণ্ডা বাতাসের
মতো হয়ে ওঠার
ক্ষমতা
রাখে

রাহুল রায়ের স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ম্যান অ্যান্ড ওয়াইফ [২০২১] শুরুতেই চমকে দেয় তার পরিমিত কথনভঙ্গিমার জন্য। ছবিটি যা বলতে চাইছে, তা তো কোনোমতেই সংলাপে বলে না, উল্টে ইমেজ আর সাউন্ডও যেন ক্রমশ গল্পের ছোট্ট কাঠামো ছেড়ে স্বকীয়তা পেতে চায়। পরিমিতি বোধ, স্বল্পকথন, সূক্ষ্মতা, কথা লুকিয়ে রাখা, আভাসে ইঙ্গিতে সিনেমাটিক মুহূর্ত তৈরি করা– এইসমস্ত গুণ যখন নব্বই ভাগ বাংলা ছবি থেকে স্রেফ উধাও হয়ে গেছে, তখন এইরকম ছবি সিনেপ্রেমীদের কাছে একঝলক ঠাণ্ডা বাতাসের মতো হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে।

ম্যান অ্যান্ড ওয়াইফ। ফিল্মমেকার: রাহুল রায়

সরু সুতোর মতো যে গল্পের কাঠামোয় ছবিটি নিজেকে তৈরি করে, তা এককথাতেই বলে দেওয়া সম্ভব। অল্পবয়সী শহুরে এক বাঙালি যুবক সম্মন্ধ করে বিয়ে করার অনুষ্ঠানের ঠিক আগের মুহূর্তে হবু স্ত্রীর কাছে তার ফ্লুইড সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি প্রকাশ করে দিতে চায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই কথাগুলোও ছবিতে স্পষ্ট করে বলা নেই, ইমেজের সাথে সাথে সামান্য দুই তিন সংলাপের আঁচড়ে আমরা এই তথ্য পাই।

তার সাথে এও বুঝতে পারি, তার যৌনসত্ত্বা প্রকাশ করার সাথে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার আশংকাকেও সে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করে দেখে। এবারে তার হবু স্ত্রী এ কথা জানতে পেরে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, এখানেই গল্পের বাকি অংশের নাটকীয়তা লুকিয়ে রয়েছে।


(সম্ভবত)
কলকাতার
কোনো হোটেলের
বাথরুমের একটিমাত্র
পরিসরই গোটা ছবিটির
একমাত্র স্থান, আর প্রধান
চরিত্রের মানসিক অস্বস্তি ও
দুশ্চিন্তাকে যথাযোগ্য সঙ্গত করে
অসামান্য একটি
সিনেমাটিক
সিদ্ধান্ত

কিন্তু রাহুল এই গল্প বলার প্রয়োজনে যথাসম্ভব বাহুল্যবর্জিত, অতিসূক্ষ্ম এক শৈলী বেছে নেন যা ছবিটির প্রধান সম্পদ। (সম্ভবত) কলকাতার কোনো হোটেলের বাথরুমের একটিমাত্র পরিসরই গোটা ছবিটির একমাত্র স্থান, আর প্রধান চরিত্রের মানসিক অস্বস্তি ও দুশ্চিন্তাকে যথাযোগ্য সঙ্গত করে অসামান্য একটি সিনেমাটিক সিদ্ধান্ত। নির্মাতারা ঠিক করেন, তারা সমকালীন ছবির সাধারণ অ্যাসপেক্ট রেশিও (পর্দার দৈর্ঘ্য-প্রস্থের অনুপাত), ওয়াইড স্ক্রিন (১৬:৯) কিংবা সিনেমাস্কোপ (২.৩৫:১) ব্যবহার করবেন না, বরং ছবিটি তৈরি হবে অ্যাকাডেমি রেশিওতে (৪:৩)।

এই ধরনের রেশিওতে যেমন নির্দিষ্ট কোনো চরিত্রের পোর্ট্রেট খুব ভালো তৈরি করা যায়, তেমনই ছবির ডান আর বামদিকের জায়গা কমে যাওয়ার ফলে নির্দিষ্ট লেন্সের ব্যবহারে ফ্রেমে একধরনের বদ্ধতা তৈরি হয়, যা সিনেমাটিক্যালি কাজের লাগানো সম্ভব। বাথরুমের ছোট্ট পরিসরের বদ্ধতাকে এইভাবে আরও বেশি করে ব্যবহার করা যায়, যা আখেরে ছবিটির নান্দনিক মূল্য হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ম্যান অ্যান্ড ওয়াইফ

রাহুল আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন– চরিত্রপ্রধান ন্যারেটিভ ফিকশন ছবির সাধারণ নিয়মমাফিক মানুষের মুখের শট এবং সেইমতো চরিত্রকে অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকেন। অধিকাংশ সময়েই মুখের বদলে আমরা দেখতে পাই চরিত্রদের হাত, পায়ের ক্লোজআপ। গল্পের কজালিটির যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে একমাত্র পরিসরটিকে (স্পেস) মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে মানস ভট্টাচার্য্যের ক্যামেরা।

কিছু শটে দেখি ফোরগ্রাউন্ডে বাথরুমে কাপড়জামা টাঙানো, ব্যাকগ্রাউন্ডে চরিত্রটি হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে, যাকেও ঘষা কাঁচের ওপারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কখনো বেসিন, সামনে জ্বলতে থাকা বাল্বের আলো, আর উল্টোদিকের আয়না– এদেরকে ভিত্তি করে তৈরি করা কম্পোজিশনে বেশ পরে যুক্ত হয় গল্পের চরিত্র। কখনো আয়না দিয়ে তৈরি করা অত্যন্ত দক্ষ কম্পোজিশনে একটি চরিত্রকেই তিনটি প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে দেখি।

ম্যান অ্যান্ড ওয়াইফ

এই অংশগুলোতে বিখ্যাত ফরাসি ফিল্মমেকার ব্রেসোঁ কিংবা ইতালীয় ফিল্মমেকার আন্তোনিওনির ছোঁয়া দেখতে পাওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু রাহুল জোর করে কোনো রেফারেন্স গুঁজে দেন না, বরং পরিমিত শৈলীর মধ্যেই এই সুপ্ত জায়গাগুলো ছবির প্রবাহের অন্তর্গত হয়ে যায়। চরিত্র থেকে মুক্ত হয়ে পরিসর যেন তার নিজের কিছু না বলা কথা বলে উঠতে চায়, যা অব্যক্ত থেকে ছবির লুকিয়ে রাখা কথার অংশ হয়ে ওঠে। দর্শকের কল্পনা উস্কে দিয়ে বহু সময় সে সরাসরি কথা বলে না, বরং আভাসে ইঙ্গিতে কথার উদ্রেক করে।

ফলে ছবিটি শেষমেশ যতটুকু বলে উঠতে পারে, তার চাইতেও অনেক অনেক বেশি কথার আভাস থেকে যায়, যা বলা হয় না বলেই শিল্প হিসেবে ছবিটি সার্থক হয়ে ওঠে।

Print Friendly, PDF & Email