সাক্ষাৎকার: ওরখান আতা
অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
লার্স ফন ত্রিয়া [৩০ এপ্রিল ১৯৫৬–]। ডেনিশ মাস্টার ফিল্মমেকার। আলোচিত ফিল্ম মুভমেন্ট ‘ডগমা ৯৫’-এর অন্যতম প্রবক্তা। ‘ইউরোপা’ [১৯৯১], ‘ব্রেকিং দ্য ওয়েভস’ [১৯৯৬], ‘ড্যান্সার ইন দ্য ডার্ক’ [২০০০], ‘ডগভিল’ [২০০৩], ‘অ্যান্টিক্রাইস্ট’ [২০০৯], ‘মেলানকলিয়া’ [২০১১], ‘নিমফোমেনিয়াক’ [২০১৩] প্রভৃতি মাস্টারপিস সিনেমার নির্মাতা। দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন দুরারোগ্য মানসিক রোগে। ‘পাম দি’অর’জয়ী এই ফিল্মমেকারের এই সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারী অনলাইনে নিয়েছেন আজারবাইজানের অভিনেতা ওরখান আতা। ২০২১ সালের ২৪ মার্চ আজারবাইজানের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আজ ডট মিডিয়ায় ইংরেজিতে প্রকাশ পেয়েছে এটি…
ওরখান আতা :: লার্স, ইদানিং আপনি ভীষণ শান্ত এবং খানিকটা নির্বাণপ্রাপ্ত ধরনের হয়ে উঠেছেন বলে মনে হয়। জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার প্রবল কোনো প্রভাব পড়েছে আপনার ওপর? এমন কিছু ঘটে থাকলে জানাবেন কি?
লার্স ফন ত্রিয়া :: বিশেষ কিছু ঘটে গেছে, তা বলব না। আমি আসলে নিজের জীবন এবং নিজের সিনেমাগুলোতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিলাম। আসলে, বিরাট বাজেটের আমেরিকান ফিল্মের ড্রামাটার্জি থেকে বেরিয়ে যেতে চাই আমি। এ কাজ আমার জন্য বেশ কঠিন। এ যেন এমনই ফর্মুলা, যেটি আপনার শিশুকালেই আপনার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, এবং তারপর থেকে আপনি সেই পন্থায়ই আপনার (সিনেমার) স্টোরি দেখান।
আমি চেষ্টা করছি… বলতে পারেন ব্যাপারটা এমন: আপনি যদি দুটি বিন্দু জাহির করেন, তাহলে দর্শক সেই দুই বিন্দুর মাঝখানে একটি রেখা এঁকে নিতে পারবেন। সেটিও কিন্তু অনুকরণই, বুঝলেন? তারকোভস্কি আমার আদর্শ; তার মিরর [১৯৭৫] সিনেমাকে কেউ হয়তো একদমই বোধাতীত বলে গণ্য করতে পারেন; তবে আমার কাছে এটি একেবারেই বিশুদ্ধ স্বাধীনতার নমুনা। মিরর পুরোদস্তুর দুর্দান্ত।
প্রসঙ্গ: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও শিল্প
আতা :: লার্স, আপনার (ফিল্মমেকিং) স্টাইলের আবির্ভাব ঘটেছে কোত্থেকে? কী-ই-বা এটি?
ফন ত্রিয়া :: আপনি যখন স্টাইলের কথা বলবেন… দেখুন, ফিল্ম স্কুলে পড়তে চেয়েছিলাম আমি, কিন্তু পারিনি। পরে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি ফিল্মে পড়ার জন্য। সেখানে প্রচুর সিক্সটিন এমএম ফিল্ম দেখেছি। এ ছিল সত্যিকারের সিনেমা, বুঝলেন? তারা [বিশ্ববিদ্যালয়ে] আমাদের প্রচুর সিনেমা দেখিয়েছে। প্রচুর সিনেমা দেখেছি আমি। সেগুলো দেখেই শিখেছি, সিনেমা কাকে বলে। আমি কী শিখতে পারব আর কী পারব না– সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। এভাবেই স্টাইলটির আবির্ভাব ঘটেছে।

আতা :: আরেকটু গভীরে যেতে চাই: এই স্টাইলকে এত বেশি অনন্য করে তোলা কনটেক্সটির আবির্ভাব ঘটেছে কোত্থেকে?
ফন ত্রিয়া :: আপনার কাছে এটাকে অনন্য মনে হয়? আমি অবশ্য এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। আসলে সমস্যা হলো… আমি একটি পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি, কিংবা অন্তত বছর কয়েক আগে ছিলাম– যখন নিজের চাওয়ামতো যেকোনো কিছু অর্থলগ্নি করার অবস্থা ছিল আমার। বলতে চাচ্ছি, আমার কাছে টাকা ছিল। আর সেটিই (আমার ভেতর) চাপ তৈরি করেছে।
…
ভবিষ্যতে
সৃষ্টি করতে
চাই– এমন কিছুর
ক্ষেত্রে সুযোগের তলানিতে
পৌঁছাব না
আমি
…
আমার ধারণা, অত্যধিক টাকা নষ্ট করা ঠিক নয়; ফলে একটি ভিন্ন পন্থা বেছে নিয়েছিলাম। আমার ধারণা, এখানে আমরা পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার কথা বলতে পারি। আর এই স্বাধীনতা থেকেই দায়িত্ববোধের আবির্ভাব। আর সেই দায়িত্ববোধ থেকেই ওই স্টাইলের আবির্ভাব– যেটিকে আপনি অনন্য বলছেন। আমি কারও চেয়ে ভালো– এমন কথা বলতে পারব না। বরং স্রেফ একটি ভীষণ রকমের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি, এবং আশা করছি, ভবিষ্যতে সৃষ্টি করতে চাই– এমন কিছুর ক্ষেত্রে সুযোগের তলানিতে পৌঁছাব না আমি।
আতা :: কী সহজ: স্বাধীনতাই সাফল্যের গোপনমন্ত্র; প্রথমত ও প্রধানত, আর্থিক স্বাধীনতা…
ফন ত্রিয়া :: নিশ্চয়ই। যদি সমমর্যাদার অন্য শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেন, তাহলে বিবাদ বাঁধতে এবং কোনো না কোনো আপসের পথ খুঁজে নিতে আপনি বাধ্য। কিংবা তা [বাধ্য] নন। কিন্তু যখন একা কাজ করেন, সব সিদ্ধান্ত নিজেই নেন, তখন এক ধরনের অনন্যতা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক।
আতা :: দারুণ! এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, আপনার পরবর্তী পরিকল্পনায় ছিল ১০ মিনিটের শর্ট ফিল্ম ‘ইটুডস’ বানানো। সে কাজ কেমন চলছে?
ফন ত্রিয়া :: একদমই চলছে না। আমি এখন দ্য কিংডম-এর [টিভি মিনি সিরিজ] শেষ সিজনের স্ক্রিপ্ট লিখছি। কাজটা কঠিন। দেখুন, ২০ বছর আগে দ্য কিংডম-এর প্রথম ও দ্বিতীয় সিজনে অভিনয় করা অনেক অভিনেতাই এখন আর বেঁচে নেই। তাদের ছাড়া সিরিজটি চালিয়ে নেওয়া সহজ ছিল না। এখন একটা নতুন অ্যাঙ্গেল দরকার। আর আমি সেটা বের করারই চেষ্টা চালাচ্ছি। স্টোরিটেলিংয়ের জায়গায় এটি একটি ভীষণ ট্র্যাডিশনাল প্লট। আমাকে সম্ভবত কিছু বিভ্রান্তি ও চক্রান্ত জুড়ে নিতে হবে।
আতা :: তার মানে, আপনি তৃতীয় সিজনের শুটিং শুরু করতে যাচ্ছেন।
ফন ত্রিয়া :: আমরা সম্ভবত আগামী বছর শুটিং শুরু করব– বসন্ত কিংবা শরৎকালে। পাতা ঝরা গাছ দরকার পড়বে আমাদের।

আতা :: শুভ কামনা রইল।
ফন ত্রিয়া :: ধন্যবাদ।
আতা :: ‘জান্তা ল’ [ডেনিশ-নরওয়েজিয়ান লেখক আকসেল সান্দেমোস প্রবর্তিত ফিকশনে একটি কোড-অব-কনডাক্ট ক্রিয়েশন] সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
ফন ত্রিয়া :: ‘জান্তা ল’ আমার কাছে একটি অনুপ্রেরণা।
আতা :: কীভাবে?
ফন ত্রিয়া :: আমার ধারণা, স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানোর মাধ্যমেই আমি আমার সেরা কাজগুলো সৃষ্টি করতে পেরেছি। ‘জান্তা ল’ সম্পর্কে আপনি কী জানেন?
আতা :: সামান্যই জানি। ডেনমার্কে থাকাকালে এ নিয়ে পড়েছি। এর মূল বিষয় হলো– এটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। এই আইন বলে, ‘নিজেকে বিশেষ কেউ ভেবো না; কারণ তুমি তা নও।’ যদি ভুল না করি, এটাই প্রথম বিধি।
ফন ত্রিয়া :: হ্যাঁ। আমি মনে করি, আমি ‘বিশেষ কেউ’। নিজেকে বিশেষ কেউ ভাবাটা মানুষের সহজাত স্বভাব। আমরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী।
আতা :: কোন জিনিস আপনাকে একজন ভালো মানুষ হতে প্রেরণা জোগায়?
ফন ত্রিয়া :: আমি ঈশ্বরবিশ্বাসী নই। আমার তাই ভালো মানুষ না হয়ে উপায় নেই।
আতা :: নাস্তিক্যবাদ আপনাকে প্রেরণা দেয়?
ফন ত্রিয়া :: প্রচুর।
আতা :: এ পর্যন্ত আপনার পাওয়া সেরা উপদেশ কোনটি?
…
আমি সব সময়ই কোনো
একটি জনরা দিয়ে
(ফিল্মমেকিং)
শুরু করি,
তারপর
সেই
রাস্তা
আমাকে অন্য
কোথাও নিয়ে যায়
…
ফন ত্রিয়া :: সেরা উপদেশটি আমি আমার এক শিক্ষকের কাছ থেকে পেয়েছি। যখন আপনি নোয়্যা কিংবা অন্য কিছু… কোনো একটি জনরা-ফিল্ম বানাচ্ছেন, তখন জনরাটিতে বিভ্রান্ত না হওয়ার চেষ্টা করবেন। বুঝতে পারছেন, আমি কী বলছি? আমি সব সময়ই কোনো একটি জনরা দিয়ে (ফিল্মমেকিং) শুরু করি, তারপর সেই রাস্তা আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যায়। ফলে, এটিই আমার পাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ।
আতা :: মৃত্যু নিয়ে ভাবেন?
ফন ত্রিয়া :: মৃত্যু নিয়ে প্রচুর ভাবি। আমি আমার বাড়িতে আইসোলেশনে রয়েছি; কেননা, আমার মধ্যে বিভিন্ন উপসর্গ আছে।
আতা :: কীসের উপসর্গ? এটা কি কোনো সত্য ঘটনা? নাকি ভ্রান্ত ধারণা?
ফন ত্রিয়া :: অবশ্যই সত্য ঘটনা। আমার কম্পন রোগ রয়েছে। হাত ও শরীর কাঁপে।
আতা :: আইসোলেশন কোনো কাজে আসে?
ফন ত্রিয়া :: হ্যাঁ, কাজে আসে। ভালোই কাজে আসে। এখন আমি হরদমই বনে যাই হাঁটতে। গাছ ও গাছের পাতার প্রতি আমার ভীষণ কৌতুহল। যেসব গল্প ও ঘটনা অন্যকে শোনানো কঠিন বলে মনে হয় আমার কাছে, আমি সব সময় সেগুলো নিয়েই কাজ করি। এ খুবই কঠিন কাজ…।
আজকের আবহাওয়া দারুণ। আমি একটি ছোট্ট নদীর কাছে থাকি। মাত্রই নিজের বাড়ির চারদিকে একটা রোমান্টিক চক্কর দিয়ে এলাম। জানি না! আমার একজন মালী আছেন; তিনি মাঝে মধ্যে এসে আমাকে সাহায্য করেন। আমার একটা বাগানও আছে; তবে দেখলে আপনি সেটিকে বাগান বলবেন না। মনে হবে কোনো কুম্ভশালা।
প্রসঙ্গ: অসুস্থতা ও উন্মাদনা
আতা :: ফিল্মমেকার হিসেবে কোন কোন উন্মত্ততা আপনি দেখাতে সক্ষম?
ফন ত্রিয়া :: যাতেই সক্ষম কিংবা অক্ষম হই না কেন, সেটিকে আমি উন্মত্ত করে তুলতে চাই না। উন্মাদ, উন্মত্ততা… এসব ভাল্লাগে না আমার।
আতা :: আচ্ছা, উন্মত্ততা নয়, বরং বলা ভালো…
ফন ত্রিয়া :: …ইন্টারেস্টিং। এটাকে বরং ‘ইন্টারেস্টিং’ বলুন।
আতা :: শিল্পী হিসেবে আপনি স্বপ্নবাজ ও যোদ্ধা…
ফন ত্রিয়া :: স্বপ্নবাজ ও যোদ্ধা?
আতা :: হ্যাঁ, আপনার সিনেমা দেখে আমার এমনটাই মনে হয়েছে।

ফন ত্রিয়া :: দারুণ তো! মনেই যদি হয়ে থাকে, তাহলে দারুণ।
আতা :: জেনে খুশি হলাম, লার্স। আপনার দেখা সেক্সিয়েস্ট ড্রিম কী ছিল?
ফন ত্রিয়া :: ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলাপ না করাই ভালো। এ ব্যাপারে ইন্টারনেটের ওপর বিশ্বাস নেই আমার।
আতা :: ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি। যদি আমাদের কখনো সামনাসামনি দেখা হয়, তখন আপনার সেক্সিয়েস্ট ড্রিম সম্পর্কে আলাপ করব। নিজেকে হরদম আপনি কোন মিথ্যেটি বলেন?
ফন ত্রিয়া :: নিজেকে প্রচুর মিথ্যে বলি। নিজের দুশ্চিন্তা ব্যাধির বেলায় এটা করতেই হয় আমাকে। আমার ওসিডি [অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার; মানসিক রোগবিশেষ] রয়েছে। ওসিডি মানেই নিজেকে সারাক্ষণ মিথ্যে বলা।
আতা :: আপনার ওসিডি-ও রয়েছে?
ফন ত্রিয়া :: হ্যাঁ।
আতা :: কতদূর পর্যন্ত পরিকল্পনা করতে পারেন?
ফন ত্রিয়া :: এখন দ্য কিংডম থ্রির পরিকল্পনা করছি। এর বাইরে কোনো পরিকল্পনা আমার নেই।… অন্যদিকে, দ্য ইটুডস রয়েছে।… গোদারও শর্ট ফিল্ম বানিয়েছেন এবং এ ধরনের নিরীক্ষা করেছেন।
আতা :: তার মানে, শর্ট ফিল্মে এর আগে কেউ করেনি– এমন কোনো নিরীক্ষা করতে চান? আর সেটি কাজে লাগলে নিজের ভবিষ্যতের সিনেমায় প্রয়োগ করবেন? নিরীক্ষা বলতে কি এ কথাই বোঝাচ্ছেন?
ফন ত্রিয়া :: হ্যাঁ; তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ফলাফলকে খেলা হিসেবে নেওয়া।… আমি বলতে চাচ্ছি, খেলার ইচ্ছে আপনার মধ্যে থাকতে হবেই। যদি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, তাহলে সেটা হলো বলের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে স্রেফ সেটিকে ঠেলে বেড়ানো কুকুরের মতো।…
এটা মজার হওয়াই উচিত। আর আমি এটা এভাবে করারই চেষ্টা করি। দ্য কিংডম-এর এন্ডিং খুব একটা মজার হয়নি– এ কথা সত্য; তবে এর মূল কারণ হলো মনস্তাত্ত্বিক নিগূঢ়তার ব্যাপারে আমার জানার ঘাটতি। আপনি অবশ্য অন্য কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন…
আতা :: এই নিরীক্ষার প্রয়োগ আপনার ভবিষ্যতের সিনেমায় দেখতে পাব কি না?
ফন ত্রিয়া :: নিরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন করলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি নিরীক্ষা করছি না; সিনেমাটি আমি নিজের মাথার ভেতর ইতোমধ্যেই দেখে ফেলেছি। তাই এটি কোনো নিরীক্ষা নয়, বরং প্রকাশ।
আতা :: বাহ!
ফন ত্রিয়া :: হ্যাঁ। তবে সিনেমাটিকে দর্শক কীভাবে নেবেন– তা নিয়ে না ভাবাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দর্শক নিয়ে যত কম ভাবা যায়, তত ভালো। আপনি [ফিল্মমেকার] নিজে সিনেমাটিকে কেমন দেখছেন, সেটাই ভাবুন। আমি সিনেমা বানাই নিজের জন্য। সেগুলো থেকে অন্য কারও যদি কোনো উপকার হয় কিংবা অন্য কেউ যদি পছন্দ করে, সেটি বাড়তি পাওয়া। তবে মূলত আমি নিজের জন্যই সিনেমা বানাই।
আতা :: নিজের কোন কোন সিনেমা আপনার কাছে স্পেশাল?
…
নিজের
সিনেমায়
নিজেকে বহুলাংশেই
জুড়ে দিই
আমি
…
ফন ত্রিয়া :: ডগভিল সিনেমাটি আমার সবচেয়ে প্রিয়। এ সিনেমা আমার কাছে অনেক কিছু। তবে আমার সিনেমাগুলোতে আমি নিজে জুড়ে রয়েছি অনেকটুকুই। একবার এক সাক্ষাৎকারে ইংমার বারিমন যেমনটা বলেছিলেন, আপনার [ফিল্মমেকার] নিজেকে প্রচুর মাত্রায় (নিজের সিনেমায়) জুড়ে দিতে হবে। আমি সব সময়ই নিজেকে জুড়ে দিই। আমার যেকোনো সিনেমার যেকোনো দৃশ্যের ক্ষেত্রেই এটা সত্য। সেখানে আমার কণ্ঠস্বর খুঁজে পাবেন। তার মানে, নিজের সিনেমায় নিজেকে বহুলাংশেই জুড়ে দিই আমি। হয়তো সেটি বারিমন যেভাবে বলেছেন, সেভাবে নয়। তার বানানো দুর্দান্ত সিনেমাগুলো এখনো আমার ভালোলাগে।

নতুন সিনেমা আমি দেখি না। সত্যি বলতে, ফিল্ম স্কুলে থাকাকালে এত সিনেমা দেখেছি, যা এক জীবনের জন্য যথেষ্ট। দারুণ একটা বাক্স আছে আমার। সেটাতে আমার সিনেমার ভান্ডার। সেটিই আমার দুনিয়া। এ কারণে আধুনিক সিনেমা দেখি না। সমস্যা হলো, দেখলে সেগুলো হয়তো আামকে আকৃষ্ট ও রোমাঞ্চিত করতে পারে; আর এর ফলে বিজ্ঞানী হিসেবে নিজের ওপর আস্থা থাকবে না আমার। নিজেকে আমি বিজ্ঞানী ভাবি।
আপনি যদি পূর্বদিকে যেতে চান, তাহলে আপনাকে পূর্বদিকেই এগিয়ে যেতে হবে। যদি পশ্চিমদিকে ইন্টারেস্টিং কোনোকিছুর দেখা পাই, তাহলে সেটিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের পথে, পূর্বের দিকেই এগিয়ে যেতে হবে আমাকে।
প্রসঙ্গ: পূর্ব-পশ্চিম
আতা :: পূর্বদিকে যাওয়াটাই আপনার জীবনের মূলনীতি?
ফন ত্রিয়া :: হ্যাঁ।
আতা :: পূর্বদিকে কী খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশা করেন?
ফন ত্রিয়া :: শুনুন, আমি যখন ‘পূর্ব’ কথাটি বলি, তার মানে এটি স্রেফ একটি আইডিয়া, এক ধরনের প্রস্তাবনা। এ অনেকটা কম্পিউটার গেমের মতো। দেখুন, এটা বোঝা হয়তো খানিকটা কঠিন, তবে আমি সেখানে একটা রেখা দেখতে পাই, আর সেই রেখা ধরেই পূর্বদিকে এগিয়ে চলি।
আপনি যদি আমাকে প্রাচ্যের সিনেমা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে বলব, হ্যাঁ, কয়েকটি নতুন সিনেমা দেখেছি, আর এর সবগুলোই নতুনতর প্রযুক্তিগত বিকাশের ওপর ভর দিয়ে বানানো। আধুনিক প্রযুক্তি যতটা কম সম্ভব ব্যবহারের চেষ্টা করছি আমি।
আতা :: আমাদের প্রযুক্তিপ্রবণ দুনিয়ায় (আপনার) এ এক ইন্টারেস্টিং অবস্থান। লার্স, একটি ডেনিশ অ্যাক্টিং স্কুল এবং একটি ইউএস ডিরেক্টিং স্কুলের স্নাতক হিসেবে আপনাকে যদি আমার সিনেমায় অভিনয় করার প্রস্তাব দিই, গ্রহণ করবেন? আপনার পক্ষে অভিনয় করা সম্ভব?
ফন ত্রিয়া :: না, না!
আতা :: আচ্ছা, তার মানে আপনি রাজি নন।
ফন ত্রিয়া :: এ আপনার মহানুভবতা! কেননা, লোকে সাধারণত ‘না’ নিতে পারেন না; জোরাজুরি করতে থাকেন। তারা পিছু নেন আমার। কিন্তু তাদের বলে দিই, আমি পূর্বদিকে যাচ্ছি, আর আমাকে তাতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে হবে। হ্যাঁ, এটা ইন্টারেস্টিং, এটা হতে পারে; এবং নিঃসন্দেহে আমি একজন ভীষণ স্বার্থপর মানুষ।
আতা :: লার্স, আপনাকে দুটি প্রশ্ন করি। উত্তর দিতে ইচ্ছে না করলে দেবেন না। তবে উত্তর দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।
ফন ত্রিয়া :: ঠিক আছে।
আতা :: আমি আপনার সব সাক্ষাৎকারই দেখেছি এবং পড়েছি। এরমধ্যে একটা সাক্ষাৎকার এক উদ্ভট তরিকায় বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল। রাশিয়ান ব্লগান কসেনিয়া সবচাককে দেওয়া সাক্ষাৎকারটির কথা বলছি। আপনার মনে আছে?
ফন ত্রিয়া :: মনে আছে।
আতা :: তিনি যখন আপনার রিফ্রিজারেটর খুলে ভেতরটা দেখছিলেন, আপনার কেমন লেগেছিল? কসেনিয়ার আচরণ খুবই অশোভন ছিল। দেখতে অস্বস্তি লাগছিল আমার। তিনি আপনার ফ্রিজ খুললেন কেন?
ফন ত্রিয়া :: তাতে কী হয়েছে? সেখানে ইন্টারেস্টিং কিছু তিনি খুঁজে পাননি। সত্যি বলতে, আমার রিফ্রিজারেটরে ইন্টারেস্টিং কিছুই নেই। আমার পরিচিত অন্য ফিল্মমেকারদের যেমন… প্রচুর ফিল্মমেকার– যারা সিনেমা নিয়ে কথা বলতে পারতেন, অথচ এখন আর বেঁচে নেই। আমি আমার ব্যক্তিগত দুনিয়াকে একান্তই ব্যক্তিগত রাখার চেষ্টা করি।
আতা :: দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো: অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা সময় কাটানোর সুযোগ পেলে তাকে নিয়ে কী করতেন?
ফন ত্রিয়া :: তাকে মেরে ফেলতাম কি না? হিটলার আসলে প্রতিদিন হেরোইন ও অ্যামফেটামিন সেবন করতেন। তিনি যখন ভরপুর নেশাগ্রস্ত– সেই অবস্থায় তার সঙ্গে আলাপ করতে পারলে ইন্টারেস্টিং হতো। আমার ধারণা, তার এত বড় শয়তান হয়ে ওঠার পেছনে ওষুধের ভূমিকা রয়েছে। তিনি স্বশরীরে কখনোই বন্দিশিবির সফর করেননি; সত্যিকারের সহিংসতা নিজ চোখে সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না তার। তিনি স্রেফ নিজের বাংকারে কিংবা বাড়িতে বসে থেকে সিদ্ধান্ত নিতেন। জেনারেলেরা যদি তার সঙ্গে দ্বিমত জানাত, তবু তিনি পূর্বদিকেই যেতেন। আর সেটা ছিল ভুল। তখন সেকেন্ড ফ্রন্ট ওপেন হয়ে গেল। হিটলার লড়তে পারেননি।
তাকে কী জিজ্ঞেস করতাম? জিজ্ঞেস করতাম, নিজের রিফ্রিজারেটরে তিনি কী রেখেছেন? সমস্যা হলো, তার চরম নিষ্ঠুরতার জন্য… কিছু মনে করবেন না, এ এক পুরনো আলাপ, কানে [ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল] আমার সামনে যা ঘটেছিল– সে কথাই বলছি এখন। সেটাই আমি তখন বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। যেকোনো ইতিহাসভিত্তিক চ্যানেলের দিকে তাকান– সবগুলোই হিটলার নিয়ে, সবকিছুই তাকে নিয়ে। নিশ্চয় স্তালিনকে নিয়েও সিনেমা আছে; কিন্তু সত্যি হলো, হিটলারের সঙ্গে তার তুলনা চলে না। কিন্তু স্তালিন কি ভালো ছিলেন? আপনি কী মনে করেন? আপনি যদি ২৪ ঘণ্টা স্তালিনের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পেতেন, তাহলে তাকে কী জিজ্ঞেস করতেন?
স্বৈরতন্ত্র
আতা :: দেশ ছেড়ে পালানোর জন্য তার কাছে একটা ইন্টারন্যাশনাল পাসপোর্ট চাইতাম।
ফন ত্রিয়া :: তিনি তাহলে গুলি করে দিতেন আপনাকে! কাকে কাকে মারা হবে– রাতের বেলা বসে বসে তিনি নিজ হাতে সেই তালিকা করতেন। এটাই ছিল তার রাতের পাঠ্য।
আতা :: লার্স, আপনি এক সাক্ষাৎকারে শিল্পের সেন্সরশিপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। শিল্পের প্রগতিতে স্বৈরতন্ত্রের সুবিধাগুলো প্রসঙ্গে। আপনি যেহেতু প্রাচ্যে যেতে চান, আমাদের সমস্যাসংকুল এলাকা– আজারবাইজান, আরমেনিয়া, জর্জিয়ায় যাবেন নাকি? এসে একবার দেখে যান, আজারবাইজানে শিল্পের বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে কী জিনিস।
ফন ত্রিয়া :: না, আমি এখানেই স্বস্তিতে আছি। একনায়কতন্ত্রের প্রসঙ্গে আমি আসলে বোঝাতে চেয়েছি, একনায়কতন্ত্রের অধীনে নির্দিষ্ট কিছু শিল্পীর বস্তুত বিচ্ছুরণ ঘটে। আর এটা বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। আমি স্পিয়ারের কথা, লেনি রিফেনস্টালের কথা বোঝাচ্ছি। নিজেদের প্রমাণ করার মতো সৌভাগ্যবান ছিলেন তারা। উদাহরণ হিসেবে স্পিয়ারের কথা যদি ধরেন, তিনি একজন মাঝারি মানের আর্কিটেক্ট; অথচ একনায়কতন্ত্রের অধীনে নিজের অসীম কল্পনাশক্তিকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তার লার্জ-স্কেলের প্রকল্পগুলো আলোর মুখ দেখেছিল।

আমরা যদি একনায়কতন্ত্রের কথা বলি, সেক্ষেত্রে গণতন্ত্রের সমস্যাগুলোর কথাও আমাদের বলা উচিত। ইউরোপে এখন কী দেখছি? এখানে একটা বড় বাঁকবদল ঘটে গেছে। ট্রাম্প কি এই সময়ের গণতন্ত্রের উদাহরণ? গণতন্ত্রের জন্য মানুষ যদি অতিশয় বেকুব হয়ে ওঠে, তার ফল কী দাঁড়ায়? ইন্টারনেট আমাদের কী কাজে লাগছে? এ এমনই এক উদ্ভাবন, কোনো সায়েন্স ফিকশন লেখকই যেটির আন্দাজ করতে পারেননি। আমরা এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করি। ইন্টারনেট এখন সবাইকে নিজের কণ্ঠ ছড়ানোর এবং প্রত্যেকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে শনাক্ত করতে দিয়েছে। এটাকে সামলানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
অবশ্য, আমি কোনো রাজনীতিক নই।
ওরখান আতা :: লার্স, আমি যেমনটা বললাম, আপনার সঙ্গে আবারও কথা বলার, সামনাসামনি মন খুলে কথা বলার আশা রাখি। তাহলে খুব খুশি হবো। কেননা, আপনি এ সময়ের জীবিত সর্বসেরা ও কিংবদন্তি ফিল্মমেকারদের একজন। আমি আপনার গুণমুগ্ধ ও অনুরাগী।
লার্স ফন ত্রিয়া :: আশা করি, আরও কয়েকটা বছর আয়ু পাব।