কিম কি-দুকের ‘টাইম’: আচ্ছন্নতার আর্তনাদ

295
কিম কি-দুক

লিখেছেন: ম্যানফ্রেড সেলজার
অনুবাদ: রুদ্র আরিফ

কিম কি-দুক

টাইম
[Shi gan]
ফিল্মমেকার, স্ক্রিনরাইটার, এডিটর ও প্রডিউসার: কিম কি-দুক
সিনেমাটোগ্রাফার: জুং-মু সাং
মিউজিক: হিয়ুং-য়ু নো
কাস্ট [ক্যারেক্টার]: হা জুং-য়ু [জি-য়ু]; জি-ইয়েয়ন পার্ক [সে-হি]
রানিংটাইম: ১ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট
ভাষা: কোরিয়ান
দেশ: দক্ষিণ কোরিয়া
রিলিজ: ৩০ জুন ২০০৬


টাইম হয়তো কিম কি-দুকের সেরা সিনেমাগুলোর একটি নয়, তবু অনেক বেশি বিনোদনমূলক এবং মানসিকভাবে উপলব্ধির জন্য সহজতর। এই অসাধারণ ফিল্মমেকারের কাজের একটি ভূমিকাপর্ব হিসেবে এই সিনেমাকে বেছে নেওয়া হয়তো খারাপ হবে না। এখানে কিছু ত্রুটিও হয়তো রয়েছে– যেগুলোর প্রসঙ্গে একটু পড়ে বলব; তবে সিনেমাটি সব মিলিয়ে দুর্বলই!

কিম কি-দুক এখানে একটি সিনেমার ভেতর জনরার অনেক বেশি অভিজ্ঞতা জাহির করেছেন বলে মনে হয়। এ কারণে এটিকে কিমের একটি হতাশাজনক কাজ হিসেবে অভিহীত করা সম্ভব নয়; তবু টাইম নিশ্চিতভাবেই এই ফিল্মমেকারের কাছ থেকে আমরা যে ধরনের কাজ প্রত্যাশা করি, সেই বিবেচনায় কম গভীরবোধী এবং আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে বেশি কলঙ্কপূর্ণ। তারপরও সিনেমাটি যথেষ্ট নাড়া দিতে, এবং কখনো কখনো এমনকি ডিস্টার্বিং হয়ে ওঠতে সক্ষম।

কোরিয়ার সাম্প্রতিকতম বিউটি ক্রেজের সমালোচনা এবং ব্যক্তিমানুষের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটি এখানে কিমের একটি অপেক্ষাকৃত আনটিপিক্যাল পন্থায় জড়িয়ে রয়েছে। কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও ফিল্মমেকারের ওপর খেপে যাওয়া ঠিক হবে না আমাদের; কেননা তার এই ড্রামা তবু তার সহকর্মীদের অনেকের চেয়ে অনেক বেশি কিছুই জাহির করে।


আমরা
আসলে কোনো
কসাইয়ের কাজ দেখছি

একটি প্ররোচনামূলক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ভূমিকাপর্ব দিয়ে সিনেমার শুরু। আমরা একটি রিয়েল ফেস অপারেশন দেখতে পাই, একেবারেই সোজাসাপ্টা স্টাইলে, চারপাশে রক্তের ছড়াছড়ি আর নৃশংসতার চিত্র। ফলে শেষমেষ ভাবি, আমরা আসলে কোনো কসাইয়ের কাজ দেখছি। আপনার পাকস্থলি যদি দুর্বল হয়ে থাকে, তাহলে শুরুর এই দৃশ্য এড়িয়ে যাওয়াই ভালো!

এর পরপরই আমরা জি-য়ু ও সে-হি যুগলের জীবনের সঙ্গে পরিচিত হই। প্রতিটি যুগলকেই কিছু কঠিন সময় কিংবা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় অবশ্য, কিন্তু এমন ক্ষেত্রে সে-হি একেবারেই চূড়ান্ত রকমের বাতিকগ্রস্ত ও অযৌক্তিক সত্তা হয়ে ওঠে। জি-য়ু নিশ্চিতভাবেই অন্য নারীদের স্কার্টে চোখ বুলায়, কিন্তু স্রেফ দেখাটুকুই সার। এরচেয়ে বেশি কিছু করে না এই যুবক! তাতে সে-হির প্রতিক্রিয়াটি যথেষ্ট বাড়াবাড়ি, এবং অপারেশন করে নিজের চেহারা বদলে ফেললে এই উৎকণ্ঠায় ভোগার সমস্যার সমাধান হবে– তার এমন ভাবনায় অবাক হওয়ার কিছু নেই।

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, নিজের চেহারাকে আরও সুন্দর নয়, বরং স্রেফ আরেক রকম করে তোলার অনুরোধ ডাক্তারকে জানায় সে। নিজের এই নিয়তি সম্পর্কে ৬ মাস সে প্রেমিককে কিছু না জানিয়ে তাকে ধোয়াশার মধ্যে রাখে; তবে এ সময়ে প্রেমিকটিকে বুঝতে না দিয়েই ওর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে রাখে না সে, বরং ওকে নতুন কোনো সম্পর্কে জড়ানো থেকে নিবৃত্ত রাখে।

টাইম। ফিল্মমেকার: কিম কি-দুক

টাইম আসলে কী জিনিস, সেটা কেবল এর পরেই দৃশ্যমান হয়। শুরুতে মনে হলেও, কিমের কাজটি কোরিয়ার বিউটি ক্রেজের প্রতি সমাজ-সমালোচনার পথে অপেক্ষাকৃত কম ধাবমান থাকে। কোরিয়ান নারীদের অর্ধেকেরও বেশি অংশ ২০ বছর বয়সের মধ্যেই কোনো কসমেটিক সার্জনের কাচির নিচে নিজেকে সঁপে দেন, এ তথ্য বেশ বেদনাদায়ক। অবশ্য, এই পরিচালক তার কাহিনির এই দিক থেকে সরে গিয়ে এর কাছে মাত্র অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রেই ফিরে এসেছেন, এবং তা এক ভীষণ বিচক্ষণ পন্থায়।

আমরা আসলে কে– এই প্রশ্নকেই উত্থাপন করতে চেয়েছেন তিনি। আত্মপরিচয় বলতে কী বোঝায়? এ কি কেবলই আমাদের চেহারার ওপর নির্ভর করে? নিশ্চয়ই নয়; তবে সি-হি যখন জি-য়ুকে জিজ্ঞেস করে, যুবকটি তাকে নাকি নিজের পুরনো প্রেমিকা সে-হিকে ভালোবাসে, তখন সিনেমাটি খানিকটা টুইস্ট হয়ে ওঠে। আসলে নিজের প্রেমিকার প্রতি জি-য়ুর তখনো অনুভূতি কাজ করছে, আর এ কারণে এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে সে অপারগ। তাই সি-হি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে।

কিন্তু কার প্রতি এই ঈর্ষা? নিজের প্রতি…। এখানে তার খণ্ডিত একটি অংশের দেখা মেলে; আর যদিও নিজের এমন ঈর্ষাকাতরতার উদ্ভটত্ব সে বুঝতে পারে শুরুতেই, এবং এ প্রসঙ্গে হাসিমুখে মন্তব্য করে, তবু সে হয়ে পড়ে আরও বেশি ঘোরগ্রস্ত, এবং নিজেকেই নিজে হারানোর লক্ষ্যে ধাবিত হয় বলে মনে হয়।

অভিনেতাদের অর্জন বিবেচনায় আমরা এখানে বেশ উঁচুমানের কাজ পেয়েছি, কিম কি-দুকের কোনো সিনেমা থেকে যার অন্যথা প্রত্যাশিত নয়। কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্রে হা জুং-য়ু করেছেন দারুণ অভিনয়। এই চরিত্রের সঙ্গে যে কেউই সংশ্লিষ্টতা অনুভব করতে পারবেন, এমনকি চরিত্রটি যদিও এখানে-সেখানে সারাক্ষণ অন্য নারীদের দিকে তাকিয়ে নিজের প্রেমিকার সঙ্গে ‘প্রতারণা’ করে, তবু।

কিম কি-দুক
টাইম

তার প্রেমিকার চরিত্রে সে-হি/সি-হির গ্রাউন্ডওয়ার্ক সফলভাবে তৈরি করেছেন পার্ক জি-ইয়েয়ন, এবং সিয়ং হিয়েয়ন-আ’র কাজ ছিল চরিত্রটিকে আরও গভীরভাবে আর্দ্র করার। ইরোটিক ভ্যাম্পের ভূমিকায় নিজের উন্নীত হওয়া উচিত– স্রেফ এমন কোনো মেয়ে সে নয়, চরিত্রটিকে সহজভাবে তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। বিশেষত, যে হিস্টিরিয়া, ও পরবর্তীকালে যে ইমোশনাল ব্রেকডাউন তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন, তা অভিনেত্রী হিসেবে তার মেধার প্রমাণ দেয়।

সাধারণত এটিই বোধহয় সেই সময়, যখন আমি কিমের সিনেমাগুলোতে জায়গা করে নেওয়া অসংখ্য প্রতীক ও মোটিফের ওপর আরেকটু বিশদ আলোচনা করতে চাইব। অবশ্য, ঘটনা হলো, বিস্ময়করভাবে, এ বেলা এ প্রসঙ্গে কথা বলার খুব কমই আছে। ‘স্কাল্পচার পার্ক’টিতে বিশ্লেষণ করার মতো কিছু জিনিস রয়েছে, ব্ল্যাঙ্ক ডেটের ইন্টারমেজোটি আসলেই দারুণ; কিন্তু এখানে এরচেয়ে বেশি কিছু নেই। এখানে একজন ছোট্ট বালিকাও রয়েছে, যে জি-য়ুর কাছে একটি প্রেমের বার্তা পৌঁছে দেয়, এবং জি-য়ু কাজ করে যেন কোনো কাটার বা এ রকম কিছুর মতো। কোন সিনেমার ওপর কাজ করছে সে? থ্রি আয়রন!


এখানে
নৈঃশব্দের
জয়গান গাওয়া
হয়নি– যেমনটা কিমের
সিনেমাগুলোতে
সাধারণত
গাওয়া
হয়

আরেকটু গভীরভাবে দেখলে হয়তো আরও কিছু জিনিসের দেখা মিলবে, তবে এ বেলা পর্দায় যা চলছে, সেটির ব্যাখ্যা স্বয়ং দর্শকের কাছে বোধহয় চাননি কিম। সতেজকর ব্যাপার হলো, এই সিনেমা সংলাপে ভরা; এখানে নৈঃশব্দের জয়গান গাওয়া হয়নি– যেমনটা কিমের সিনেমাগুলোতে সাধারণত গাওয়া হয়।

অবশ্য এই ফিল্মমেকার ও এই প্লট কোনো না কোনোভাবে নিজ নিজ স্ক্রিপ্টে একসঙ্গে বিজড়িত হয়ে গেছে। দেখে মনে হয়, কিম যেন জানেনই না– সিনেমাটিকে তিনি কোথায় নিয়ে যেতে চান কিংবা কোন কথা প্রকাশ করতে চান এর মাধ্যমে। কখনো কখনো যেন তিনি যথেচ্ছভাবে স্রেফ একটির পর একটি দৃশ্য জুড়ে দিয়েছেন বলেই মনে হয়।

তাছাড়া এই সিনেমার শিরোনামের সঙ্গে স্বয়ং সিনেমাটির ঠিক কী সম্পর্ক? আসলে, সেটা সিনেমার একেবারেই সমাপ্তিতেই শুধু বোঝা যায়, যখন সবকিছু হয়ে পড়ে খানিকটা বিমূর্ত, আর আমরা একটা ‘টাইম’-সার্কেলের দেখা পাই। এ আসলেই দারুণ, তবে আজবও। সি-হি কি শেষ পর্যন্ত তার আত্মপরিচয় পুরোপুরি খুইয়ে ফেলেছিল?


এত
এত উদ্ভটত্ব
যেখানে জড়িয়ে,
সেখানে কেন এই দৃশ্য
এমন মর্মস্পশী অথচ এত
সিম্পল: উত্তর একটাই–
এর নির্মাতা কিম
কি-দুক

স্টোরিটেলিংয়ের প্রশ্নে টাইম নিশ্চিতভাবেই সিদ্ধান্তমূলক নয়, এবং কিছু কিছু দৃশ্যকে হাস্যকরও লাগতে পারে; যেমন, যখন নিজের মাথায় নিজের পুরনো চেহারার একটি ছবি মুড়িয়ে নিয়ে নিজের বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যায় সি-হি। আচমকা, সেখানে সেই একই মাস্কের ওপর কান্নার ছাপও চোখে পড়ে! এত এত উদ্ভটত্ব যেখানে জড়িয়ে, সেখানে কেন এই দৃশ্য এমন মর্মস্পশী অথচ এত সিম্পল: উত্তর একটাই– এর নির্মাতা কিম কি-দুক! বছরের পর বছর ধরে তিনি এত বেশি অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, যদি কোনো ভালো সিনেমাও বানাতে যান, তবু নিশ্চিতভাবেই নিজের স্টোরির ট্র্যাক হারিয়ে ফেলেন!

কিম কি-দুক
টাইম

টাইমও ভালোবাসা বিষয়ে বোঝাপড়া করেছে, তবে এই বেলা অনেক বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে ভালোবাসার অনেকগুলো দিকের মধ্যে একটির ওপর: আচ্ছন্নতা। ফিল্মমেকার যদি বিউটি ক্রেজের সমালোচনার প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারতেন, তাহলে দারুন হতো; তবে সেই ঘাটতি তিনি পুষিয়ে দিয়েছেন হারানো আত্মপরিচয়ের মোটিফ জাহির করার মাধ্যমে।

টাইম কিমের সেরা কাজের একটি নয় ঠিকই; তবে দেখে মনে হয়, তিনি যেন অবশেষে একটি নতুন পথে পা বাড়িয়েছেন। তাই আগের কাজগুলো দিয়ে যাদের মুগ্ধ করেছেন, শুধু সেই আর্ট-হাউস সিনে-সমালোচকদের খুশি করাই নয়, বরং ‘সাধারণ’ দর্শককে খুশি করার ব্যাপারটিও কিম এ বেলা বিবেচনায় রেখেছেন বলে এই সিনেমাকে নিশ্চিতভাবেই গণ্য করা উচিত।


ম্যানফ্রেড সেলজার: সিনে-সমালোচক
সূত্র: এশিয়ান মুভি ওয়েব। অনলাইন ফিল্ম জার্নাল
Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান