লিখেছেন: ক্লেরা আথারতোঁ
ফ্রেঞ্চ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: ফেলিসিটি চ্যাপলিন
ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
১৬ নভেম্বর ২০১৫, প্যারিসের বিখ্যাত ‘ফ্রেঞ্চ সিনেমাটেক’-এ ‘নো হোম মুভি’র প্রিমিয়ারের আগে চান্তালের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে লিখিত এই টেক্সট পড়ে শোনান তার দীর্ঘদিনের কর্মসঙ্গী ও ফিল্ম এডিটর ক্লেরা
নো হোম মুভির প্রিভিউ স্ক্রিনিংয়ের কথা আমি হরদম কল্পনা করতাম। কিন্তু সেটি এভাবে হবে, কোনোদিন ভাবিনি…।
চান্তালকে নিয়ে কথা বলতে চাই আমি। তিনি আমাকে যা কিছু দিয়েছেন, তিনি আমাকে যা কিছু শিখিয়েছেন, আমরা দুজনে যা কিছু ভাগাভাগি করে নিয়েছি– সব শোনাতে চাই আপনাদের। বলছি শুনুন, ছিলেন কেমন তিনি: আলোকিত, বুদ্ধিদীপ্ত, বিস্ময়কর, এবং মজারও…।
চান্তাল সম্পর্কে হরদমই বলা হয়ে থাকে, তার ছিল কিছু নন্দনতাত্ত্বিক মূলমন্ত্র। দেখুন, আমি বিশ্বাস করি, সেই মূলমন্ত্রগুলোই আমাদের সুরক্ষা দিয়েছে; অথচ স্বয়ং নিজেকে সুরক্ষা দেননি চান্তাল। যা ঘটতে পারে– তার ওপর আস্থা রাখতেন তিনি; কী করে ঘটনাচক্রকে স্বাগত জানাতে হয়– জানতেন।

তার কর্মপন্থার ওপর আলো ফেলা একটি গল্পের কথা আমি ভাবছি। আলমেয়ার’স ফলির কাজ চলাকালে একটি বন্দরের দরকার পড়েছিল তার। বড় নাকি ছোট বন্দর চান– তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তার অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। তিনি বলেছিল, ‘বড় একটা বন্দর।’ কোনো ছোট বন্দর হলেই সম্ভবত তুলনামূলক শ্রেয় হবে বলে তার কাছে আবারও জানতে চাওয়া হলো, সত্যি তিনি বড় বন্দর চান কি না। মনে পড়ে, আমি আর চান্তাল তখন রাস্তায় হাঁটছিলাম; ফোনে (অ্যাসিস্ট্যান্টের সঙ্গে) কথা বলছিলেন তিনি। (অ্যাসিস্ট্যান্টের এমন প্রশ্ন শুনে) তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন, আর পা দাপিয়ে বললেন, ‘আমার একটা বড় বন্দর চাই, আর আমি সে কথাই তোমাকে বলছি; আমার কাছে এর কারণ জানতে চেয়ো না।’ নিজের ইশারাভাষাকে তিনি ন্যায্য হিসেবে জাহির করতে চাননি, বরং একে স্বাগত জানিয়েছেন, রূপান্তর ঘটিয়েছেন, এবং এরপরই সম্ভবত করে তুলেছেন বোধগম্য।
…
ইমেজের
সঙ্গে, কালারের
সঙ্গে, সাউন্ডের সঙ্গে,
রিদমের সঙ্গে মস্তিষ্কজনিত
সংযোগের চেয়ে বরং শারীরিক
সংযোগেরই ছিলেন অধিক পক্ষাপাতি
…
চান্তাল ছিলেন ভীষণ রকমের মুক্তমনা ও স্বজ্ঞালব্ধ মানুষ; কখনো কখনো প্রলোভনীয়। তার মধ্যে বিধিনিষেধের কোনো বালাই ছিল না। “আমাদের অবশ্যই ‘এভাবে’ সিনেমা বানানো উচিত, আমাদের অবশ্যই ‘ওভাবে’ ফ্রেম ধরা উচিত, আপনি ‘এটা’ করতে পারবেন না, তুমি ‘ওটা’ করতে পারবে না”– এমনতর কথা তিনি বলতেন না। নিজের অন্তস্তল থেকেই চয়েসগুলো বেরিয়ে আসত তার। নিজের অনুভূতি তাকে পথ দেখাত। ইমেজের সঙ্গে, কালারের সঙ্গে, সাউন্ডের সঙ্গে, রিদমের সঙ্গে মস্তিষ্কজনিত সংযোগের চেয়ে বরং শারীরিক সংযোগেরই ছিলেন অধিক পক্ষাপাতি। আমি এডিটিংয়ের সময় কোনোদিন তাকে বলতে শুনিনি: ‘আমার একটা আইডিয়া আছে।’ বরং তিনি বলতেন, “আমি ‘এটা’ শুনেছিলাম, কিংবা ‘ওটা’ ভেবেছিলাম, কিংবা ‘এটা’ চাই, কিংবা ‘ওটা’র প্রতি আমি আচ্ছন্ন।’ কিন্তু ‘আমার একটা আইডিয়া আছে’– এমন কথা কোনোদিনই বলেননি।
কোনো ডকুমেন্টারি বানানোর সময় তিনি কী করতে যাচ্ছেন– সে কথা ব্যাখ্যা করতে চাইতেন না। যদি ব্যাখ্যা করে ফেলতেন, তাহলে সেটির বানানোর প্রতি তার আর কোনো আকাঙ্ক্ষা কাজ করত না। তিনি বরং সরাসরি লোকেশনে চলে যেতে চাইতেন, এবং একটি সংবেদনশীল ফলক, একটি জীবনযাপন কাটাতে চাইতেন।

সিনেমাকে তিনি কোনো প্রজেক্ট হিসেবে সীমাবদ্ধ করতে রাজি ছিলেন না; বরং চাইতেন, সেটি যেন নিজে থেকে তার কাছে ধরা দেয়, আর তিনি ম্যাটেরিয়ালটির হাতে নিজেকে সঁপে দিতেন। চান্তালের ইমেজগুলো যদি ভীষণ গভীরবোধী ও দাপুটে হয়ে থাকে, সেগুলো যদি যা দেখায়– তারচেয়েও আরও অনেক বেশি অর্থ প্রকাশ করে থাকে, এর কারণ– সেগুলোকে কোনো উদ্দেশ্যের অংশ হিসেবে আবদ্ধ করা হয়নি, বরং তার নিজেরই দুনিয়ার সকল সংস্পর্শ ও আচ্ছন্নতার ভেতর থেকে এগুলোর আবির্ভাব ঘটেছে।
‘কাজ করতে করতে আবিষ্কার করার’ এই যে কর্মপন্থা, এটি তিনি ইনস্টলেশন বানানোর সময় আরও বেশি জোরাল হয়ে উঠেছিল। এ রকমই একটি ইনস্টলেশন প্রজেক্ট প্রসঙ্গে চান্তাল লিখেছিলেন: ‘আমি ফ্রম দ্য ইস্ট (ডকুমেন্টারিটি) বানানোর আগে, যে ইনস্টলেশনকে অনুসরণ করে এটি বানিয়েছি, সেটি সম্পর্কে প্রচুর কথা বলে ফেলেছি; আর বুঝে গেছি, কোনো ইনস্টলেশনের পক্ষে একটি সিনেমার তুলনায় আমার কাছে আগেভাগে বেশিকিছু জাহির করা সম্ভব নয়, কেননা, স্বয়ং কাজটি চলার সময়ই একটু একটু করে জন্ম ঘটে এর। এ বেলায়ও আমি প্রয়োজনীয় অংশবিশেষ ছাড়া আর কিছুই বলব না; কেননা, এটি বেশ ভালোভাবেই দেখিয়ে দিয়েছে, একটি পৃথিবীর সবকিছু আমাদের পক্ষে দেখানো সম্ভব নয়।’

ফ্রম দ্য ইস্ট-এর এডিটিংয়ের সময় আমরা অনুভব করেছিলাম, অপেক্ষমান লোকেদের মুখগুলোর ওপর লং ট্র্যাকিং শটগুলো, লোকেদের হেঁটে বেড়ানোর ইমেজগুলো অন্য কোনো লোকেদের অপেক্ষার কিংবা হাঁটার কথা, অন্য কোনো সরিবদ্ধথার কথা, ইতিহাসের অন্য কোনো গল্পগুলো মনে করিয়ে দেয়; তবু এ নিয়ে আমরা কথা বলিনি। এর এক বছর পর যখন আমরা ফ্রম দ্য ইস্ট: বর্ডারিং অন ফিকশন [১৯৯৫] ইনস্টলেশনটি তৈরি করছিলাম, ওই ইমেজগুলোর প্রতিধ্বনীর ওপর কথামালা জুড়ে দেওয়ার কালে তখনই শুধু সে কথা আমাকে বলেছিলেন চান্তাল। (ওই ইনস্টলেশনের) ২৫তম স্ক্রিনে থাকা লেখাটির শেষ অনুচ্ছেদ আমি আপনাদের পড়ে শোনাচ্ছি:
…
একদিন
সিনেমাটির
কাজ শেষ হলে
নিজেকে বলেছিলাম, ‘ওহ,
তাহলে এই কাণ্ড
ছিল, আবারও!’
…
“গতকাল, আজ আর আগামীকাল– ঠিক এই মুহূর্তে এখানে ছিল, এখানে রয়েছে, এখানে থাকবে যে মানুষগুলো– তাদের যে ইতিহাস (যেখানে ইতিহাসের ‘ই’ অক্ষরটির ওপরও কোনো গুরুত্ব দেওয়া নেই), সেই ইতিহাসকে ধূলিস্মাৎ করে দেওয়া হয়েছে। এখানে যে মানুষগুলো অপেক্ষারত, একসঙ্গে জড়ো হয়ে রয়েছে খুন হয়ে যাওয়ার জন্য, পিটুনি খাওয়ার কিংবা অনাহারে মরার জন্য, কিংবা হেঁটে যাচ্ছে– কোথায় যাচ্ছে তা না জেনেই– দলবেঁধে কিংবা একা। এ নিয়ে কিছুই করার নেই। এ ঘোর লাগানো ব্যাপার; আর আমি ঘোরগ্রস্ত। সেলো [বাদ্যযন্ত্র] থাকা সত্ত্বেও, সিনেমা থাকা সত্ত্বেও। একদিন সিনেমাটির কাজ শেষ হলে নিজেকে বলেছিলাম, ‘ওহ, তাহলে এই কাণ্ড ছিল, আবারও!’”
ফ্রন্টাল শট পছন্দ করতেন চান্তাল। এটি কোনো ফরমাল সিদ্ধান্ত নয়, বরং রুচির ব্যাপার; অনেকটা দরকারিও। ফ্রন্টাল অ্যাক্সিস কোনো বর্ণনা দেয় না, কোনো আখ্যা দেয় না; বরং পারসেপশন ও রিফ্লেকশনের একটি স্পেস সৃষ্টি করে। সেই স্পেস নিয়েও আমরা এডিটিংয়ের সময় কাজ করতাম। দর্শকদের জন্য স্পেসটি রেখে দেওয়া হতো, যেন তারা সেটি প্রত্যক্ষ করেন, অনুভব করেন আর সেটির করেন অনুসন্ধান।
চান্তাল জোর দিয়ে বলতেন, দর্শকের কাজ দর্শককেই করতে হবে। তিনি হরদম বলতেন, তার সিনেমাগুলোর মধ্যে সময়ের বহমানতা দর্শক যেন অনুভব করে, তিনি তা-ই চান। কেউ যখন বলত, ‘ওহ, কী অসাধারণত এক সিনেমা দেখলাম, সময়ের বহমানতা আমি খেয়ালই করিনি,’ তিনি এমন কথাকে প্রশংসা হিসেবে দেখতেন না। ভাবতেন, তার মানে দর্শকের সময়টি তিনি চুরি করে নিয়েছেন।
এডিটিংয়ের সময় আমরা কখনো বলিনি, ‘আরে, এখানে আমাদের একটা লং শট দরকার।’ স্বজ্ঞা থেকেই আমরা (শটের) ডিউরেশন বেছে নিতাম; আর সেটার কারণ টের পেতাম পরে। শটটি কোন মুহূর্তে কাটা জরুরি, ঠিক সেই মুহূর্ত বোঝাতে সময় গুনতে পছন্দ করতেন চান্তাল। একই জিনিসের দেখা পেতাম দুজন।
…
সিনেমাটি
স্বয়ং যদি কোনো
শট বাতিল করে দেয়–
হোক সেটি যতই সুন্দর শট,
আমরা রাখার ব্যাপারে
জোর করতাম
না
…
মনে পড়ে একবার, সিনেমাটির স্ক্রিনিং প্রগ্রেসের একটি কাজ শেষ করার পর আমাদের মধ্য থেকে একজন বললেন, একটি নির্দিষ্ট ট্র্যাকিং শট অনেক বেশি দীর্ঘ হয়ে গেছে এবং আরেকটি হয়ে গেছে অতিরিক্ত ছোট। চান্তাল উপসংহার টানেন, ‘আমরা একমত, তার মানে এখানে একটি সমস্যা রয়েছে!’ সেই মুহূর্ত থেকে সেটি সিনেমাটিতে বাতিলকৃত দৃশ্যগুলোর অস্তিত্ব দেখতে শুরু করেছিল; এ কারণে আমরা কেটে ফেলতে কিংবা ছোট করে নিতে কোনো দ্বিধাবোধ করিনি। সিনেমাটি স্বয়ং যদি কোনো শট বাতিল করে দেয়– হোক সেটি যতই সুন্দর শট, আমরা রাখার ব্যাপারে জোর করতাম না। সেটি বরং আমাদের একটি গতি দিত, যেন (শেষ পর্যন্ত) সিনেমাটিরই জয় হয়। এডিটিং মানে ‘পরাজিতের জয়ী হওয়ার’ এক খেলা– এ কথা আমরা হরদম বলতাম।
প্রতিটি সিনেমা, প্রতিটি ইনস্টলেশন ছিল যেন প্রথম কোনো কাজ। কোনো নিয়ম-নীতির, ভয় কিংবা বাধার বালাই ছিল না আমাদের। প্রতিবারই আমরা একটি নতুন সংবেদনশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযাত্রায় পুনঃপ্রবেশ করতাম। আমাদের (দুজনের) কথাবিনিময় ছিল একেবারেই সাদামাটা। অল্প কিছু শব্দ উচ্চারণ করতাম, যেন বেশি কথা বললেই কাজটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। আমরা হরদম বলতাম, ‘এটা দারুণ’ কিংবা ‘এটা দাপুটে।’
পছন্দের কিছু কথা ছিল আমাদের। তিনি বলতেন, আমাদের কোনো ধরনের ছাড় না দিয়ে, কঠোর হতে হবে। ঝটপট এডিটিং শেষ করতে হবে– এমন কথাও বলতাম আমরা। তাকে আমি কখনো কখনো বলতাম, ‘আমাদের (কাজটি) জটিলতর করে তুলতে হবে।’ এ কথা তিনি পছন্দ করতেন। বলতেন, ‘হ্যাঁ, খানিকটা জটিলতর করা যাক।’ যখন কোনোকিছুকে আমাদের কাছে অতিরিক্ত সোজাসাপ্টা, অতিরিক্ত একরৈখিক মনে হতো, তখন এমন কথা বলতাম। জটিলতর করে তোলা মানে দুর্বোধ্য করে তোলা নয়; বরং চাপা উত্তেজনাকে তীক্ষ্ণ করে তুলতে আরেকটু বেশি ওয়েট ও কাউন্টার-ওয়েট জুড়ে দেওয়া।
ভেরিসিমিচ্যুড কিংবা রিয়ালিজম– কোনোটারই সন্ধান করতেন না চান্তাল। অ্যানাক্রোনিজমের ভয় ছিল না তার। ন্যাচারালিজম অপছন্দ করতেন। বাস্তবতার অনুলিপি করার কিংবা বাস্তবতাকে উপস্থাপনের চেষ্টা তিনি কখনোই করেননি; বরং সেটির করতেন রূপান্তর। তার সিনেমাগুলোতে, তার ইনস্টলেশনগুলোতে বর্তমানকাল ও দৃশ্যমানতাগুলো অদৃশ্য ও অন্তভৌমের সঙ্গে অনুনাদিত হয়েছে। (এদমোঁ) জাবেসের একটি উদ্ধৃতি তার প্রিয় ছিল: ‘প্রতিটি জিজ্ঞাসাই চাহনির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।’ তিনি বলতেন, এ কথার সত্যতা না জানলেও কথাটি তাকে মন্ত্রণা দেয়।
মনস্তত্ত্ববাদের [সাইকোলজিজম] প্রতিও বিরাগ ছিল চান্তালের। মনস্তত্ত্ববাদ হলো ক্রিয়া-কর্ম ও অনুভূতির মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। চান্তালের সিনেমা কখনোই কোনো কিছুর ব্যাখ্যা দেয় না; বরং আমাদের দিকে ছুড়ে দেয় প্রশ্ন, এবং আমাদেরকে নিজেদের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এ কারণেই এগুলো এত দাপুটে ও এত জলজ্যান্ত।

চান্তালের কাছে অসম্ভব বলে কিছু ছিল না। নিজেকে কোনো নির্দিষ্ট ধারার মধ্যে বন্দি করতে তিনি চাননি। কখনোই বানাতে চাননি এলিটিস্ট কিংবা কনফিডেনশিয়াল সিনেমা। অ্যা কোচ ইন নিউইয়র্ককে তিনি একটি বাণিজ্যিক সিনেমা হিসেবে বানানোর আশা করেছিলেন, যেটি সবাই দেখতে যাবে।
এই ফাঁকে বলে রাখি, তিনি চাইতেন তার সিনেমাগুলো সবাই দেখুক। আমি যখন অ্যা কোচ ইন নিউইয়র্ক-এর এডিটিং শুরু করেছি, চান্তাল তখনো সিনেমাটির শুটিং চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম– প্রতিটি শটেরই এত-এত টেক। চান্তালের সঙ্গে ব্যাপারটি মেলাতে পারছিলাম না; কেননা, সাধারণত তার কাছে কোনো টেক’কে ঠিকঠাক মনে হলে তিনি পরের দৃশ্যের দিকে পা বাড়ান।
…
এইসব
সান্ত্বনার
চাপে পড়ে
আমার এখন
দমবন্ধ অবস্থা
…
(সেবার) শুটিং থেকে ফিরে তিনি আমাকে কারণটা জানালেন। বললেন, সিনেমাটিতে এমন একটি আর্থিক ঝুঁকি ছিল, এ কারণে ‘কাভারেজে’র জন্য তিনি এত বেশি টেক নিয়েছেন। তবে তিনি আমাকে আরও বলেন, ‘এটি আর কাভার নেই, বরং হয়ে গেছে সান্ত্বনার স্তূপ! এইসব সান্ত্বনার চাপে পড়ে আমার এখন দমবন্ধ অবস্থা!’

হ্যাঁ, চান্তাল বেশ মজার মানুষ ছিলেন। সে কথা আমরা মাঝে মধ্যে ভুলে যেতাম। মজার ও উদার মানুষ ছিলেন তিনি। ছিলেন সাধারণের একদম বাইরে। সাউথ-এর এডিটিংয়ের দিনগুলোতে দুপুরে আমরা এডিট করতাম এবং সকালে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়তাম। একদিন আমি তার সামনে হাজির হলে তিনি বললেন, ‘আজ সকালে আপনি কী করেছেন?’ এ ধরনের ছোট ছোট প্রচুর প্রশ্ন করছিলেন: ‘আপনি কী করেছেন? কী খেয়েছেন?…’। তাকে বললাম, ‘আমি পর্দা বানিয়েছি।’ তিনি বললেন, ‘এই সবগুলো পর্দা আপনার নিজের বানানো? শুনুন, বেস্ট এডিটিং ক্যাটাগরিতে আপনি যদি অস্কারও পান, তারচেয়ে বেশি এটি আমাকে আকৃষ্ট করেছে!’
নো হোম মুভি সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলার ক্ষেত্রে, আমি মনে করি, এর এডিটিং শেষ হওয়ার কয়েক মাস পরে চান্তালের নিজের লেখা থেকে আমার মতে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কথাগুলো বলাই শ্রেয়। এটি ২০১৪ সালের হেমন্তকালের কথা। চান্তাল বলেছেন–
“যখনই কোনো শটের সম্ভাব্যতা অনুভব করেছি, জগতের যে প্রান্তেই হোক, সিনেমার শুটিং শুরু করেছি আমি– এমনটা বহুকাল হলো। সত্যিকার অর্থেই কোনো উদ্দেশ্য নয়, বরং এই ইমেজগুলোকে কোনো সিনেমায় কিংবা ইনস্টলেশনে একদিন জায়গা করে দেওয়া যাবে– এই অনুভূতি থেকেই। নিজেকে বলেছি– এগিয়ে চলো নিজ আকাঙ্ক্ষা ও প্রবণতায় ভর দিয়ে। কোনো স্ক্রিপ্ট ছাড়াই, কোনো সচেতন প্রকল্প না ভেবেই। এই ইমেজগুলোর জন্ম হয়েছিল তিনটি ইনস্টলেশনের ভেতর– যেগুলো (পৃথিবীর) নানা জায়গায় দেখানো হয়েছে।

“এই বসন্তে, ক্লেরা আথারতোঁ ও ক্লেমোঁস কারিকে সঙ্গে নিয়ে আমি প্রায় ২০ ঘণ্টা ব্যাপ্তির ইমেজ ও সাউন্ড জড়ো করেছিলাম– কোনো উদ্দেশ্য-বিধেয় না জেনেই। আমরা ম্যাটেরিয়ালটির ভাস্কর্য গড়তে শুরু করেছিলাম। সেই ২০ ঘণ্টা নেমে এসেছিল আট ঘণ্টায়, তারপর ছয় ঘণ্টায়, এবং তারপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সময়ব্যয়ের পর দুই ঘণ্টায়।
“আর সেখানে আমরা দেখতে পেলাম… দেখতে পেলাম একটি ফিল্ম। নিজেকে বললাম: নিশ্চয় এই ফিল্মই আমি বানাতে চেয়েছিলাম। নিজের কাছে এ সত্য স্বীকার না করেই।
…
এই
নারী
ব্রাসেলসে
নিজ অ্যাপার্টমেন্টে
এবং একান্তই নিজের
ভেতরে
লীন
…
“কেউ যখন বলে, এই ফিল্মের লাল সুতোটি একটি চরিত্র, পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া এক নারী– যে ১৯৩৮ সালে বেলজিয়ামে পাড়ি জমিয়েছে– হত্যাযজ্ঞ ও ত্রাস থেকে পালিয়ে। এই নারী আমার মা। এই নারী ব্রাসেলসে নিজ অ্যাপার্টমেন্টে এবং একান্তই নিজের ভেতরে লীন।”