সাক্ষাৎকার: কলিম আফতাব
অনুবাদ: আসিফ রহমান সৈকত
অনুবাদকের নোট
বং জুন-হো। পাম দি’অর ও অস্কারজয়ী দক্ষিণ কোরিয়ান মাস্টার ফিল্মমেকার। ফিচার ফিল্ম: ‘বার্কিং ডগস নেভার বাইট’ [২০০০]; ‘মেমোরিস অব মার্ডার’ [২০০৩]; ‘দ্য হোস্ট’ [২০০৬]; ‘মাদার’ [২০০৯]; ‘স্নোপিয়ার্সার’ [২০১৩]; ‘ওকজা’ [২০১৭] ও ‘প্যারাসাইট’ [২০১৯]

কলিম আফতাব :: পরিচালক বং, যদিও ডার্ক-হিউমারের জন্য আপনার সিনেমাগুলো সবাই পছন্দ করে, তবে এগুলো দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে একইসঙ্গে হতাশাকেন্দ্রিক (নিষ্ঠুর ও বিদ্রূপাত্মক)। আপনি কি নিজেকে নৈরাশ্যবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে চান?
বং জুন-হো :: নিজেকে কোনোভাবেই, কোনো অংশেই নৈরাশ্যবাদী ভাবি না আমি। তবে আমাদের সামনে যে বাস্তবতা উপস্থিত রয়েছে, তার প্রতি সৎ থাকতে চাই। মানবজাতি আজ পর্যন্ত এত বিরাট উন্নতি করেছে, যেমন আমাদের সামনেই এই মোবাইল; কিন্তু আমরা যদি গত ৩০ বছরের দিকে তাকাই, তাহলে ধনী আর গরিবের মধ্যে ব্যবধানটা একটুও কমেছে কি? কমেনি। প্যারাসাইট সিনেমায় আমার ভাবনা ছিল সেটা ঘিরেই।
…
আমি
এই ভয়
আর বিষণ্ণতার
ব্যাপারে সৎ
থাকতে
চাই
…
আমার নিজের একটা ছেলে আছে। তার প্রজন্মে এই অবস্থার কোনো উন্নতি হবে– এমন চিন্তা আমি কি করতে পারছি? নিজেও সত্যি মনে করি না সে রকম কিছু ঘটবে। আসলে, সেটাই বিরাট ভয়ের উৎস। সেজন্য আমি এই ভয় আর বিষণ্ণতার ব্যাপারে সৎ থাকতে চাই এবং সত্যিকার অর্থেই তা দেখাতে চাই (আমার সিনেমায়)।
কলিম :: ভয়ের এই ব্যাপারটা কি এই সময়ের জন্য বিশেষ কিছু? নাকি এটা এমন এক ব্যাপার, যা নিয়ে আপনি অনেকদিন ধরেই ভাবছেন?
বং :: দেখুন, ২০১৩ সাল থেকেই এই আইডিয়া নিয়ে ভাবছি আমি। তার মানে (প্যারাসাইট মুক্তির) ছয় বছর আগের আইডিয়া এটি। তবে অবশ্যই প্রধান ইস্যু হলো ধনী আর গরিবের মধ্যকার যে ব্যবধান, সেটা। অর্থনৈতিক মেরুকরণের ব্যাপারটা তখনো খুব বেশি অন্য রকম কিছু ছিল না।
আমি তখন স্নোপিয়ার্সার সিনেমার পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজে ছিলাম। ওই সিনেমার বিষয়বস্তুও অনেকটা একই: শ্রেণিবৈষম্য ও শ্রেণিসংগ্রাম। সেখানে ধনী ও গরিব একই ট্রেনের ভিন্ন ভিন্ন বগিতে থাকত। তাই আমি যে শ্রেণিবৈষম্যের ব্যাপারগুলো নিয়ে আইডিয়া আর কাজের চিন্তার মধ্যে ভালোভাবেই তখনই ছিলাম, সেটা আপনি বলতে পারেন।
তবে প্যারাসাইট-এর ক্ষেত্রে আমি এমন একটা গল্প বলতে চেয়েছিলাম, যেটা আরও বেশি আমার চারপাশের সঙ্গে সম্পর্কিত, আমার নিজের প্রতিদিনের পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত।

কলিম:: দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই শ্রেণিসংগ্রামের ব্যাপারটা দুনিয়ার প্রায় সব জায়গাতেই যেন অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
বং :: হ্যাঁ, এটা সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অবশ্যই সেখানে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহমর্মিতার এবং বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে যোগাযোগের ব্যাপারগুলো থাকতে পারে । কিন্তু আমি মনে করি যেভাবে সিনেমাটাতে পরিবর্তিত হয়ে, পরিণত হয়ে, যে পথে এগিয়ে যাচ্ছিল, এটা খুবই সম্ভব একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার।
আমরা সবাই ধনী-গরিবের এই ব্যবধানের ব্যাপারে সচেতন। একইসঙ্গে এটা খুবই দুঃখজনক এবং ভয়েরও ব্যাপার। কিন্তু মৌলিকভাবে আরও বেশি ভয়ের হলো সেই ‘ভয়’– যার কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি: এটা ভবিষ্যতেও ঠিক হবে না; আমাদের সন্তানদের প্রজন্মেও সেটা থেকেই যাবে। এটা এমন এক ব্যাপার– যা আমরা সবাই বুঝতে পারি, এবং এ থেকে মুক্তি পাওয়া আসলে বেশ কঠিন।
কলিম :: আপনি কীভাবে এই ভয় ও আবেগের ব্যাপারগুলোকে সত্যিকার অর্থে ও মানবিক জায়গা থেকে নিশ্চিত করেন? অভিনেতাদের আবেগের মধ্যেও কি এটা চলে আসে?
বং :: ফিল্মমেকার হিসেবে আমি অভিনেতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় যথাসাধ্য চেষ্টা করি,যেন প্রতিটি পরিস্থিতি সহজ ও তাৎক্ষণিক মনে হয়; যেন তারা সেটাকে আবেগের সঙ্গে নিতে পারেন। ‘শুনুন, স্ক্রিপ্টটা বিশ্লেষণ করলে দেখবেন, এখানে একটা রাজনৈতিক বক্তব্য আছে’– এমনতর কথা আমি অভিনেতাদের বলি না। আমি মনে করি না এগুলো নিয়ে আলাপের কোনো দরকার আছে। বরং সব সময় বলি, ‘চরিত্রটার জন্য আপনার খারাপ লাগছে না?’
এমনতর সহজাত আলাপই আমি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে করি। আর তা তাদের রোল প্লে করতে সাহায্য করে। তবে আমি মনে করি, সিনেমার লোকেশন বা জায়গাটা– যেখানে ঘটনাটি ঘটছে বলে দেখানো হবে, সেটাও সিনেমার সাফল্যের নেপথ্যে চরিত্র বা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ।

কলিম :: আরেকটু খোলাসা করুন…
বং :: যখন দারুণ কোনো লোকেশন খুঁজে পাই অথবা একটা দুর্দান্ত লোকেশনের কথা ভাবি, তখন আমার ভেতর একজন সেরা অভিনেতাকে খুঁজে পাওয়ার মতোই রোমাঞ্চ কাজ করে! ওকজা সিনেমাটির কথাই ধরুন: কোরিয়ার একদম প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের দিকের একটা (বিরাট উঁচু) পর্বত থেকে শুরু করে, শেষ করলেন নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটে গিয়ে। এই বিশাল জার্নি কিন্তু কয়েকটা মহাদেশে ছড়িয়ে গেছে।
প্যারাসাইট-এর পক্ষে একটা থিয়েটার প্রোডাকশন হওয়াও সম্ভব। সেভাবেই স্থানের সঙ্গে কাহিনিটা তীব্রভাবে জড়িয়ে আছে, যেখানে কাহিনির ৯০ ভাগই ঘটেছে দুই বাড়িতে। এ রকম চ্যালেঞ্জ অবশ্য আগে কখনোই আমি নিইনি। ভার্টিক্যাল সেন্স বা খাড়া কিছু উঠে যাচ্ছে– এই অনুভূতি এই সিনেমার জন্য ভীষণ জরুরি ছিল। অন্যদিকে, স্নোপিয়ার্সার-এর বেলায় হরাইজন্টাল সেন্স বা অনুভূমিকের বা সমতলের সঙ্গে সমান্তরালে রাখার অনুভূতিটা ছিল ভীষণ জরুরি।
কলিম :: ২০১৭ সালে নেটফ্লিক্সের জন্য ওকজা বানানোর পর, সিনেমা-হলের জন্য আবার সিনেমা বানাতে পেরে আপনি খুশি?
বং :: ওকজা বানানোর সময় সিনেমাটোগ্রাফার আর আমি কথা বলছিলাম: কীভাবে সিনেমাটা বানালে আমরা দর্শককে স্মার্টফোন থেকে বের হতে বাধ্য করতে পারি। আমরা চাচ্ছিলাম এমনভাবে সিনেমাটা বানাই, যেন তারা সিনেমা-হলে গিয়ে দেখতে বাধ্য হয়। অথবা অন্তত প্রজেক্টরের সাহায্যে বড় পর্দায় দেখে। তাই অনেকগুলো শটই এমনভাবে ফ্রেমবন্দি করেছি, বড় পর্দায় দেখা ছাড়া যেন তাদের আর কোনো উপায় না থাকে। যেমন, একটা এক্সট্রিম লং শট– যেখানে মেয়েটাকে খুবই ক্ষুদ্র দেখায়। স্মার্টফোনের স্ক্রিনে খুঁজেই না পাওয়া যায় (ওর অস্তিত্ব)।
…
বড়
পর্দায়ই
সিনেমার
আসল অভিজ্ঞতাটা
পাওয়া
যায়
…
তাই বলে স্ট্রিমিংকে আমি অপছন্দ করি না; খারাপ ভাবি না। বরং নেটফ্লিক্সের সঙ্গে আবারও কাজ করতে চাই। তবে বড় পর্দায়ই সিনেমার আসল অভিজ্ঞতাটা পাওয়া যায় । কারণ সেটাই একমাত্র উপায় ও জায়গা, যেখানে দর্শক চাইলেই (রিমোট কন্ট্রোলের বা ল্যাপটপের) স্টপ বাটনে প্রেস করতে পারবে না। সিনেমাটাকে নিজের ইচ্ছেমতো জায়গাতে ফ্রিজ করে দিতে পারবে না।

কলিম :: এটা কি স্কেলের জায়গা থেকে আবার আপনার আগের জায়গায় ফিরে যাওয়ার মতো অনুভূতি? ওকজা ও স্নোপিয়ার্সার— দুটোই বড় বাজেটের ফিল্ম, যদিও আপনি ইনডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকিংয়ের একটা সফল ক্যারিয়ার বরাবরই উপভোগ করেছেন…
বং :: টের পাচ্ছি, আবারও আমি মাদার ও মেমোরিস অব মার্ডার-এর মতো সাইজ, স্কেল ও বাজেটের চলচ্চিত্রে ফিরতে পেরেছি। অল্প বাজেটের চলচ্চিত্রে ফিরে আসাটা আমাকে অনেক মানসিক শান্তি দেয় এবং ফিল্মের আরও ডিটেইলে কাজ করার জন্য আরও বেশি মনোযোগী হতে সাহায্য করে।আর যেহেতু স্নোপিয়ার্সার ও ওকজার বাজেট ছিল বিরাট, সেটা আমাকে ফিল্মমেকার হিসেবে আরও অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। আমার পুরো শক্তির আরও অনেকটুকু শুষে নিয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে ওকজার কথাই ধরুন, সেখানে প্রায় ৩২০টা বিরাট শূকরের শট আছে। সেই ভিজ্যুয়ালগুলো ঠিকঠাক করতে গিয়ে অবিশ্বাস্য রকমের শক্তি ব্যয় করতে হয়েছে আমাকে। আবার, প্যারাসাইট-এর ক্ষেত্রে, প্রতিটা চরিত্রের বিশ্লেষণে এবং সিনেমার ডিটেইল নিয়ে অনেক বেশি ভাবার সুযোগ পেয়েছি বলে আমি দারুণ খুশি।

কলিম :: সিনেমায় কোন ধরনের ডিটেইল আপনাকে বেশ বিমুগ্ধ করে?
বং :: আমি ভীষণ নিগূঢ় ও ডিটেইল সিনেমা বানাতে চাই, যেখানে আপনি প্রতিটি চরিত্রের এমনকি গন্ধটাও টের পাবেন। নিজেকে জনরা ডিরেক্টর মনে করি আমি। মনে করি, জনরা সিনেমাগুলোর পক্ষে রাজনৈতিক রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেটা সাই-ফাই সিনেমার মধ্যেও আছে।
যদিও স্নোপিয়ার্সার ও ওকজা— এই দুই সিনেমার মধ্যেই সাই-ফাইয়ের ভাবটা খুব শক্তিশালীভাবেই আছে, তবু আপনি বলতে পারেন, এগুলো খুবই শক্তিশালী পলিটিক্যাল সিনেমা। প্যারাসাইট-এর ক্ষেত্রে কাহিনির মূল ভিত্তি হচ্ছে– এটা গরিব আর ধনীর গল্প; তাই আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, একেবারে শুরু থেকেই এটি খুবই পলিটিক্যাল। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েই আমি সিনেমাটা শেষ করতে চাইনি।
কলিম আফতাব :: আজকাল জনরা-ফিল্মগুলো সম্ভবত বেশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এর কারণ কী বলে মনে করেন?
বং জুন-হো :: তাই নাকি? আমি যেহেতু জনরা-ফিল্ম বানাই এবং এখন কি ট্রেন্ড চলছে বা কি প্রচারিত হচ্ছে বা দেখানো হচ্ছে– সেটা নিয়ে কোনো সমালোচনা করি না কিংবা কোনো ক্রিটিক নই, তাই কথাটা শুনে ভালো লাগল। আমি জনরা-ফিল্মের বিরাট ভক্ত।
…
সাধারণত আমি জনরার
বিধিসীমার মধ্যে
থেকেই কাজ
করি
…
যদিও জনরার রীতিকে ভেঙ্গে দিতে, বাঁকিয়ে দিতে পছন্দ করি, তবু সাধারণত আমি জনরার বিধিসীমার মধ্যে থেকেই কাজ করি। জনরা-ফিল্মগুলো একটা খুবই নির্দিষ্ট ধরনের ফিল্ম উত্তেজনা তৈরি করতে সক্ষম। সেটাও জনরা-ফিল্মকে আমার ভালোবাসার একটা কারণ।
সূত্র: দ্য টকস। অনলাইন ইন্টারভিউ ম্যাগাজিন