বাখ-বিথোফেনদের উত্তরসূরি হ্যান্স জিমারের শ্বাসরুদ্ধকর স্কোর

311
হ্যান্স জিমার

লিখেছেন: উপল বড়ুয়া

হ্যান্স জিমার। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭–; জার্মানি

শ্বাসরুদ্ধকর– ক্রীড়া জগতে যাদের বিচরণ, প্রায় সময় তাদের শব্দটি ব্যবহার করতে দেখি। আমাদেরও তো ব্যক্তিগত জীবনে শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তের মুখোমুখি কম হতে হয়নি! কিন্তু মিউজিকে? এমন একজন আছেন যার সুরের বড় জায়গা জুড়ে আছে হার্টবিট বাড়িয়ে দেওয়া সুর। তিনি পিয়ানো-গিটার বা যেকোনো পারকাসন হাতে তুলে নিলে বেরিয়ে আসে শ্বাসরুদ্ধকর সব অনুভূতি।

গত কয়েক দশকের সবচেয়ে আলোচিত ফিল্মের বেশ কয়েকটির সাউন্ডট্র্যাক বা স্কোর বেরিয়েছে তার হাত ধরে। ডার্কনাইট ট্রিলজি, ইন্টারস্টেলার, ইনসেপশন, গ্লাডিয়েটর কিংবা সাম্প্রতিক সময়ের সাইফাই মুভি ধুন বা জেমস বন্ড সিরিজের নো টাইম টু ডাই নিশ্চয় দেখেছেন? এসব দারুণ ফিল্মের স্কোর কে করেছে জানেন? হ্যান্স জিমার।

চার দশকের ক্যারিয়ারে ১৫০-এর বেশি ফিল্মের মিউজিক কম্পোজ করেছেন তিনি। একবিংশ শতকে জিমারের চেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ভার্সেটাইল মিউজিশিয়ান নেই বললেই চলে। তবে তার সিগনেচার বা ট্রেডমার্ক সুরকে যদি এক বাক্যে ব্যাখ্যা করতে হয়, সেক্ষেত্রে আমি কেবল একটি শব্দই ব্যবহার করব– শ্বাসরুদ্ধকর। সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী হলিউডি পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের মুভিতে যেমন রুদ্ধশ্বাস সাসপেন্স, অ্যাডভেঞ্চার, বিজ্ঞান, তত্ত্বের মারপ্যাঁচ থাকে, তেমনি জিমারের মিউজিক যেন সেসব বিষয়কে ঘিরেই বাজতে থাকে। উভয়ের রসায়নটাও চমৎকার। নোলানকে ইন্টারস্টেলার নির্মাণে কে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন জানেন? জিমার।

ড্রিম ইজ কলাপ্সিং। ইনসেপশন। মিউজিক: হ্যান্স জিমার

কেবল ইন্টারস্টেলার নয়; নোলানের ইনসেপশন, ডার্কনাইট ট্রিলজি [ব্যাটম্যান বিগিনস; দ্য ডার্ক নাইটদ্য ডার্ক নাইট রাইজেস], ডানকার্ক-এর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর করেছেন জিমার।

এই মহান সুরসাধকের নামের সঙ্গে আমার পরিচয় ডানকার্ক দেখতে বসতে। বুঝতেই পারছেন, পরিচয়টা বেশিদিনের নয়। মাত্র পাঁচ বছর আগের। অবশ্য জিমারের মিউজিক এর আগে যে শুনিনি, তা নয়; বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে ডানকার্ক দেখতে বসে যে সময়টুকু ভীতি ও আতঙ্কের ভেতর কাটিয়েছিলাম, তার দায় জিমারের ওপরে বর্তায়। দৃশ্যের চেয়ে তার সুরের জাদুতে হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিল।


ড্রামে
ঝড় তোলার
পাশাপাশি দ্রুতগতির
রিদম আপনার হৃদয়কে নাচাবেই

এমন কথা শুনে হয়তো ভাবছেন, জিমারের মিউজিক কেবল শরীর-মন অবশ ও হিম করে দেওয়ার? তা নয় আদতে। রিডলি স্কটের গ্লাডিয়েটর নিশ্চয় দেখেছেন। গা জুড়ানো বা স্যুদিং ও হৃদয়কে বিষাদগ্রস্ত করে দেওয়ার সুরও যে তিনি করেন তার অন্যতম উদাহরণ– গ্ল্যাডিয়েটর, দ্য লাস্ট সামুরাই, টুয়েলভ ইয়ার্স আ স্লেভ বা পার্ল হারবার। তবে সে জায়গায় একটু ভিন্ন রেইন ম্যান, ব্লেড রানার ২০৪৯ বা পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান-এর সাউন্ডট্র্যাক। ড্রামে ঝড় তোলার পাশাপাশি দ্রুতগতির রিদম আপনার হৃদয়কে নাচাবেই। তবে রিডলি স্কটের থেলমা অ্যান্ড লুইস-এর সাউন্ডট্র্যাকে ছিল গিটারের প্রাধান্য।

গিটার হাতে নিলে জিমার যে একজন রকস্টার হয়ে উঠেন, তা কারও অজানা নয়। তার মেলোডিয়াস মিউজিকের মূলভিত্তি ইলেক্ট্রিক্যাল ও অর্কেস্ট্র। তিনি কেবল সুরকে প্রাধান্য দেন না, তার প্রতিটি মিউজিকে থাকে গল্প। সিনেমার গল্পের সঙ্গে সঙ্গে এগোতে থাকে সুরের গল্পও। ছবির সঙ্গে সুরের পরম্পরা।

সলোমন। টুয়েলভ ইয়ারস আ স্লেভ। মিউজিক: হ্যান্স জিমার

চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময়ে কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এতদূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তবে চলচ্চিত্র অভিনয়কে যেন বড় ধরনের ‘পুশ’টা করেছে সুর। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না! এখন দর্শক কেবল পর্দার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে থাকেন না; কানকেও কাজে লাগাতে হয় সিনেমাবোধের জন্য।

জিমারের কথা বলতে বসে সিনেমার ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তবে তার দ্য লায়ন কিং-এর কথা না বললে লেখা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্সের এই অ্যানিমেশন দর্শকদের পাশাপাশি শ্রোতাদেরও আকর্ষণ করেছিল ছবিতে বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী এলটন জন ও টিম রাইসের গানের জন্য। আর ছবির স্কোর লিখেছিলেন জিমার।

ইন্টারস্টেলার। অফিসিয়াল সাউন্ড ট্র্যাক [ফুল অ্যালবাম]। মিউজিক: হ্যান্স জিমার

কী অসাধারণ সুর! তার জন্য বেস্ট অরিজিনাল স্কোর ক্যাটাগরিতে অস্কারও জেতেন তিনি। কিন্তু অতীব আশ্চর্যের বিষয়, এরপর বেশ কয়েকবার মনোনয়ন পেয়েও এই পুরস্কার আর জেতেননি জিমার। দ্য লায়ন কিং-এর আগে কেবল ডাস্টিন হফম্যান ও টম ক্রুজের রেইন ম্যান-এর স্কোর লেখার জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন। এরপর অবশ্য মনোনয়নের সংক্ষিপ্ত তালিকায় প্রায় দেখা গেছে জিমারের নাম। যে ডানকার্ক, ইন্টারস্টেলার, গ্ল্যাডিয়েটর তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল, তার জন্য অস্কার জুটেনি!

কিন্তু পুরস্কার তো বড় কিছু নয়, গত কয়েক দশকের প্রায় সব ব্লকবাস্টার ছবির স্কোর লিখেছেন তিনি। সঙ্গীতের এই জার্মান জাদুকর যে বিথোফেন, সেবাস্তিয়ান বাখ, ফ্রিডেরিখ হাঁদেল, শ্যুমানদের যোগ্য উত্তরসূরি তার প্রমাণ তো ইতোমধ্যেই দিয়েছেন। পশ্চিমা ক্লাসিক্যাল মিউজিকে জার্মানদের যে জয়জয়কার, সেই মাটিতে জিমারের জন্ম হওয়া যেন স্বাভাবিক।

ডানকার্ক। অফিসিয়াল সাউন্ডট্র্যাক। মিউজিক: হ্যান্স জিমার

কিংবদন্তি মিউজিশিয়ান বিথোফেনের প্রভাবও যে তার উপরে নেই, তা বলা যাবে না। যেন এই প্রভাব থেকেই নিজের সিগন্যাচার সুর খুঁজে পেয়েছেন জিমার। বিথোফেনের ফিফ্থ সিম্ফনির যে রুদ্ধশ্বাস গতি, তা জিমারের ডার্ক নাইট বা ডানকার্ক-এও যথেষ্ট পাওয়া যায়। সুরের আনন্দ বা প্রধান ব্যাপারটাই হলো, কালোত্তীর্ণ সুর কালোত্তীর্ণ সুরকে প্রভাবিত করা। সুর তো জীবন্ত বিষয়। প্রভাব বিস্তারও স্বাভাবিক।

দারুণ এক তথ্যও রয়েছে জিমারকে নিয়ে। এই লেখা তৈরির জন্য ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে দেখি, ২০১৭ সালে প্রকাশিত দ্য টেলিগ্রাফ-এর করা বর্তমান বিশ্বের ১০০ জীবন্ত কিংবদন্তির তালিকায় রয়েছে জিমারের নাম। পুরস্কারের মতো তালিকায় থাকা না থাকা তেমন বড় বিষয় নয়, জিমার শতকের পর শতক জীবন্ত রয়ে যাবেন সিনেমাপ্রেমীদের মনে, সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে।

Print Friendly, PDF & Email
কবি; ঢাকা, বাংলাদেশ ।। কবিতার বই: কানা রাজার সুড়ঙ্গ [২০১৫], উইডের তালে তালে কয়েকজন সন্ধ্যা [২০১৮] ও তুমুল সাইকেডেলিক দুপুরে [২০২০]। ছোটগল্পের বই: ডিনারের জন্য কয়েকটি কাটা আঙুল [২০২০]