সাক্ষাৎকার: লিন্ডসে অ্যান্ডারসন
অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
অনুবাদকের নোট
১৯৬৯-৭০-এর কোনো এক সময় ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল ফিল্ম থিয়েটারে [এনএফটি] সত্যজিৎ রায়ের এই সাক্ষাৎকার পর্বের সঞ্চালক ছিলেন ব্রিটিশ ফিল্মমেকার ও সিনে-সমালোচক লিন্ডসে অ্যান্ডারসন। এই অনুবাদকর্ম পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রথম প্রকাশ পায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মাসিক কৃত্তিবাস’-এর ‘বিশেষ সংখ্যা: তরজমায় সত্যজিৎ ১০০’-তে [মে ২০২১]। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি এখানে দুই কিস্তিতে পুনঃপ্রকাশ করা হচ্ছে। আজ রইল প্রথম কিস্তি…
লিন্ডসে অ্যান্ডারসন :: (আপনার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য) আমি কিছু নোট নিয়েছিলাম, ভুলে ফেলে এসেছি। এটাকে বলে ফ্রয়েডিয়ান এরর। কারণ তিনি [ফ্রয়েড] এ ধরনের ভুল পছন্দ করতেন না। এখন তার অবস্থায় পড়ে আমিও এটা পছন্দ করছি না। তাই আলাপ এগিয়ে নিতে আমরা আপনার সাহায্য চাইছি। আমার ধারণা, ফটকাবাজি প্রশ্নের চেয়ে বরং নিরেট প্রশ্নই মিস্টার রায় বেশি পছন্দ করেন; কেননা, যেকোনো শিল্পীর মতোই, নিজের কাজের দিকে চোখ রেখে এ ধরনের প্রশ্নের সেরা জবাবগুলো দেওয়া সম্ভব।
আমার সবসময় মনে হয়, সাবেক সাম্রাজ্যবাদী জাতি হিসেবে যথার্থই ব্রিটেনে আমরা ভারত সম্পর্কে বাজে রকমের অজ্ঞ। এখানে আপনাকে একজন ভারতীয় ফিল্মমেকার হিসেবে অভিহীত করার প্রবণতা রয়েছে; অথচ আপনাকে একজন বাঙালি ফিল্মমেকার হিসেবে ডাকাটাই অধিক শ্রেয়। আপনি কি একমত?
সত্যজিৎ রায় :: হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়।
লিন্ডসে :: আপনার সিনেমা বাদে ভারতীয় সিনেমা সম্পর্কে আমাদের খুব একটা ধারণা নেই। (ভারতে) প্রোডাকশনের কেন্দ্রস্থল তিনটি। প্রতিটি একেবারে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ফিল্মমেকিংয়ের প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৬৫ সালে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়ে আমি এ সম্পর্কে অল্প-বিস্তর জেনেছি। আমরা মাদ্রাজ, কলকাতা আর বোম্বে [মুম্বাই] গিয়েছিলাম। বোম্বের ফিল্মমেকারদের বানানো হিন্দি সিনেমা আর মাদ্রাজ ফিল্মমেকারদের বানানো তামিল সিনেমার মধ্যে থাকা একেবারেই স্বতন্ত্র পার্থক্য যে কেউ টের পাবে…
সত্যজিৎ :: …(মাদ্রাজ ফিল্মমেকারেরা) হিন্দি সিনেমাও বানান…
লিন্ডসে :: হ্যাঁ, তবে রেওয়াজ একেবারেই আলাদা। অবশ্য বোম্বে আসলেই বাণিজ্যিক ফিল্মমেকিংয়ের কেন্দ্রস্থল।
সত্যজিৎ :: মাদ্রাজও। আমরাও আমাদের মতো করেই বাণিজ্যিক সিনেমা বানানোর চেষ্টা করি।
লিন্ডসে :: আসলে, অবাণিজ্যিক বলে অভিহীত হতে কারও ভালোলাগার কথা নয়; কারণ আমাদের সবার লক্ষ্যই বাণিজ্যিক হওয়া। কিন্তু আমি বাংলা সিনেমা নিয়ে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। কেননা, এটির একটি নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। আপনি যখন সিনেমা বানাতে শুরু করলেন, তখন কি বাংলায় [পশ্চিমবঙ্গে] ফিল্মমেকিংয়ের কোনো ঐতিহ্য ছিল?
সত্যজিৎ :: আপনাকে বলছি, শুনুন, ১৯২০ দশকের নির্বাক সিনেমার যুগ থেকেই আমরা সিনেমা বানাচ্ছি। যতদূর মনে পড়ে, (ভারতে) প্রথম ফিচার ফিল্মটি বানানো হয় বোম্বেতে, ১৯১৩ সালে; হলিউডের খুব বেশিদিন পরে কিন্তু নয়। কলকাতা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এর অল্প কিছুকাল পরই যাত্রা শুরু করে। তখনকার দিনে খুবই অল্প কয়েকজন বাঙালি ফিল্মমেকার ও অভিনেতা ছিলেন। বোম্বে থেকে পার্সিরা এসে কলকাতায় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি চালু করেছিল, এরপর সেটির দায়িত্ব নেয় বাঙালিরা। তারপর থেকেই আমাদের একটা ইন্ডাস্ট্রি আছে। আমাদের নির্বাক সিনেমাগুলো অনেকটাই অন্য যেকোনো জায়গার নির্বাক সিনেমার মতোই। দুটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডে বেশির ভাগ নির্বাক ফিল্মই পুড়ে গেছে। ফলে ওগুলো আমরা আর কোনোদিনই দেখতে পাব না। ওগুলোকে যথাযোগ্যভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি।
…
বাংলায়
আমাদের
একটা ঐতিহ্য
আছে বলাই শ্রেয়;
যদিও নিজেকে আমি
মূলধারার অংশ
মনে করি
না
…
যতদূর মনে পড়ে, এখানে সবাক সিনেমার যাত্রাও শুরু হয়ে হলিউডের ঠিক পরপরই, ১৯৩১ সালে। ফলে আমি মনে করি, বাংলায় আমাদের একটা ঐতিহ্য আছে বলাই শ্রেয়; যদিও নিজেকে আমি মূলধারার অংশ মনে করি না। এখানে একটি ঐতিহ্য আছে; কেননা, বাংলায় আমাদের একটি সাহিত্য ঐতিহ্যও ছিল– গল্প ও উপন্যাসের যথেষ্ট ঋদ্ধ সেই ভাণ্ডার, যেখান থেকে অনেকগুলোই সিনেমায় রূপান্তর করা হয়েছে। উনবিংশ শতকের শেষভাগে, ব্রিটিশ প্রভাবে উপনাস্যের আবির্ভাব ঘটেছে। তারপর থেকে আমাদের একটি সাহিত্য ঐতিহ্য ছিল। (রবীন্দ্রনাথ) ঠাকুর প্রায় দেড় হাজার ছোটগল্প লিখেছেন– যেগুলোর মধ্যে তিন-চার শ’টি মাস্টারপিস; (সেগুলো অবলম্বনে) সহজেই সিনেমা করে তোলা সম্ভব; আমি এ পর্যন্ত প্রায় ছয়টি নিয়ে সিনেমা বানিয়েছি।

লিন্ডসে :: পাশ্চাত্যে এক সময় ঠাকুরের ব্যাপক নাম-ডাক ছিল, এখন অবশ্য তাকে এখানে খুব একটা চেনে না কেউ।
সত্যজিৎ :: এর অন্যতম কারণ, তার সাহিত্য সম্ভবত অনুবাদের ঊর্ধ্বে। বেশিরভাগ বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। আপনি যেমনটা বললেন, তিনি সেই ১৯২০ দশকের মতো এখন আর অতটা পরিচিত কিংবা ভালোবাসার কিংবা পছন্দের কিংবা সমীহের লোক নন; শুনুন, চমৎকার সব ছোটগল্প কিন্তু লিখে গেছেন তিনি– এ কথা এখনো সত্য। অন্য সাহিত্যিকদের পাশাপাশি তার লেখা অবলম্বনে অনেক ফিল্মমেকারই সিনেমা বানিয়েছেন; ফলে আমি মনে করি, এখানে গল্পের এই মজুদ থেকে ফিল্মমেকার সাহায্য নিতে পারেন।
এ পর্যন্ত ১৭-১৮টি সিনেমা আমি বানিয়েছি; এরমধ্যে মৌলিক চিত্রনাট্য থেকে বানিয়েছি মাত্র দুটি; বাকি সবই ছোটগল্প কিংবা উপন্যাস অবলম্বনে। আমার কাছে বড়গল্পকেই (সিনেমায়) অ্যাডাপটেশনের জন্য আদর্শ মনে হয়।
লিন্ডসে :: (বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের) মৌলিক উপন্যাসটি কত দীর্ঘ ছিল?
সত্যজিৎ :: আসলে (তার) দুটি বই [পথের পাঁচালী ও অপরাজিত] থেকে আমি তিনটি সিনেমা বানিয়েছি। প্রথম সিনেমাটির [পথের পাঁচালী] জন্য প্রথম বইয়ের অর্ধেক ব্যবহার করেছি; দ্বিতীয় সিনেমাটির [অপরাজিত] জন্য ব্যবহার করেছি প্রথম বইয়ের শেষ অর্ধেক। আর তৃতীয় সিনেমাটির [অপুর সংসার] জন্য দ্বিতীয় সিনেমাটির একটি সিগমেন্ট ব্যবহার করেছি।

প্রসঙ্গ: রেনোয়া
লিন্ডসে :: আপনি যখন পথের পাঁচালী বানাতে এলেন, ওই বই থেকে সিনেমা বানানোর আকাঙ্ক্ষা কি আপনার ভেতর সবসময়ই ছিল? আপনার বানানো প্রথম সিনেমাটি কী করে হয়ে উঠল?
সত্যজিৎ :: চিত্রনাট্য লেখার অভ্যাসকে আমি শখে পরিণত করেছিলাম। যে গল্পগুলো সিনেমার বাজারে বিক্রি হয়েছে, সেগুলো খুঁজে বেড়াতাম; এবং নিজে সেই গল্পের ওপর স্ক্রিপ্ট লিখতাম, তারপর (সেই গল্প অবলম্বনে বানানো সিনেমাটির সঙ্গে) তুলনা করে দেখতাম। আমি কিন্তু ১৯৪৭ সালের দিকের কথা, মানে আমার ফিল্মমেকিংয়ে আসার চার-পাঁচ বছর আগের কথা বলছি। বড় পর্দায় যা দেখেছি, সেটির সঙ্গে নিজের ভার্সনটির তুলনা করতাম আমি। প্রায় সময়ই আমার কাছে দুটি ভার্সন থাকত– একটা হলো, সিনেমার পর্দায় যে রকম দেখতে পাব, তার একটা অনুমাননির্ভর… [হাহাহা]…
লিন্ডসে :: সত্যি?
সত্যজিৎ :: হ্যাঁ। আর এটা যথেষ্ট কাজে দিয়েছে।
লিন্ডসে :: সেগুলো কি একেবারেই পুঙ্খানুপুঙ্খ লিখতেন?

সত্যজিৎ :: আসলে তা নয়। স্রেফ খসড়া রূপরেখা লিখতাম। কখনো কখনো একদমই পুঙ্খানুপুঙ্খ লিখতাম; সেগুলোর কয়েকটি নিয়ে সিনেমা বানানোর ইচ্ছে এখনো আমার রয়েছে। এটি [পথের পাঁচালী উপন্যাস] প্রকাশ পেয়েছে ১৯৩০ কি ১৯৩১ [প্রকৃত অর্থে ১৯২৯] সালে; তবে আমি পড়েছি ১৯৪০-এর দশকের কোনো এক সময়। তখনো আমি একজন অ্যাডভারটাইজিং আর্টিস্ট; বইয়ের ইলাস্ট্রেশন করি। বইটির একটি নতুন সংস্করণের ইলাস্ট্রেশন করার কাজ পড়েছিল আমার ওপর। পড়তে পড়তে চমকে গিয়ে ভাবলাম, এটা দিয়ে দারুণ একটা সিনেমা বানানো সম্ভব।
লিন্ডসে : এটা কি দ্য রিভার-এর [জ্যঁ রেনোয়া] আগের ঘটনা?
সত্যজিৎ :: হ্যাঁ; দ্য রিভার-এর তিন-চার বছর আগের কথা।
লিন্ডসে :: আপনি যখন সিকুয়েন্স-এ [ব্রিটিশ ফিল্ম জার্নাল] লিখলেন, তখন আপনার সঙ্গে আমাদের প্রথম যোগাযোগ হয়।
সত্যজিৎ :: হ্যাঁ, রেনোয়ার ওপর একটা লেখার প্রস্তাব দিয়ে সিকুয়েন্স-এ চিঠি লিখেছিলাম আমি।
লিন্ডসে :: হ্যাঁ, সেটি ১৯৪৯ সালের কথা।
সত্যজিৎ :: হ্যাঁ, ১৯৪৯; বিশ বছর আগের কথা।
লিন্ডসে :: হায় ঈশ্বর!
সত্যজিৎ :: রেনোয়া তখনো (দ্য রিভার-এর) শুটিং শুরু করেননি। তিনি লোকেশন দেখতে (কলকাতায়) এসেছিলেন, এবং দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল, “ফরাসি মিস্টার জ্যঁ রেনোয়া এসেছেন এ শহরে, তিনি তার সিনেমার একটি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অ্যাঙ্গো-ইন্ডিয়ান মেয়ে খুঁজছেন।” তিনি যে হোটেলে উঠেছিলেন, আমার অ্যাডভারটাইজিং অফিস সেটির কাছেই ছিল। ফলে আমি একদিন হোটেলে গিয়ে তার সামনে হাজির হয়ে নিজের পরিচয় দিলাম। তার সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই মিশলাম; কেননা, গ্রামাঞ্চলটি আমার বেশ ভালোভাবেই চেনা ছিল, এবং তিনি এমন কাউকেই চেয়েছিলেন তাকে পথ দেখানোর জন্য, ফলে তিনি রোববার ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আমাকে তার সঙ্গে নিয়ে যেতেন।
লিন্ডসে :: আপনি তখন চাকরি ছাড়েননি?
সত্যজিৎ :: নিজে যখন শুটিং শুরু করেছি, তখনো ছাড়িনি; কারণ বেতনের একটা অংশ সিনেমাটিতেই খরচ হতো… [হাহাহা…]।
লিন্ডসে :: দ্য রিভার ১৯৪৯ নাকি ১৯৫০ সালে বানানো?

সত্যজিৎ :: আমার ধারণা, ১৯৫০। আমি যখন ইংল্যান্ডে চলে আসি, তখন তিনি আসলে দ্য রিভার-এর শুট করছিলেন। তাকে বলেছিলাম, আমার কাছে ‘এই’ কাহিনিকে সিনেমা করে তোলার একটি আইডিয়া আছে। তাকে সংক্ষেপে শুনিয়েছিলাম কাহিনিটা। তিনি বলেছিলেন, ”বাহ, দারুণ তো, বানিয়ে ফেলো।” আমি কিন্তু তখনো স্ক্রিপ্ট লিখতে শুরু করিনি। ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পথে, জাহাজে প্রথম খসড়াটি লিখেছি।
লিন্ডসে :: আপনি এক সাক্ষাৎকারে ফ্ল্যাহার্টির [আমেরিকান ফিল্মমেকার রবার্ট জে. ফ্ল্যাহার্টি] ক্লাইমেট নিয়ে কথা বলেছিলেন…
সত্যজিৎ :: লুসিয়ানা স্টোরি [ফ্ল্যাহার্টি; ১৯৪৮] আমি ইংল্যান্ডে দেখেছিলাম। আমাকে যথেষ্ট প্রেরণা দিয়েছে ওই সিনেমা। আরও কিছু সিনেমাও আমার ভালো লেগেছে, তবে ফ্ল্যাহার্টির সিনেমা ও রেনোয়ার সিনেমার একটা প্রভাব আমার কাজে পড়ার কারণ, ট্রিলজিটির [‘অপু ট্রিলজি’] প্রেক্ষাপট ও মানুষের সম্পৃক্ততা।
লিন্ডসে :: সে সময়ে এমন একটি সিনেমা বানানো তো যথেষ্টই বৈপ্লবিক ব্যাপার ছিল, তাই না?
সত্যজিৎ :: হ্যাঁ।
লিন্ডসে :: টাকা পেলেন কোথায়?
সত্যজিৎ :: দেখুন, আমার কাছে একটা খসড়া আর ড্রয়িংয়ের একটা বই ছিল। কাজটা কঠিন ছিল। কেননা, এটি কোনো গতানুগতিক কাহিনি ছিল না; ফলে এটিকে চিত্রনাট্যে পরিণত করা কঠিন ছিল: কোনো এক পুকুরে পোকামাকড়ের সাঁতার ও সেটির শব্দ– এ তো আপনি বর্ণনা করে বোঝাতে পারবেন না…
প্রসঙ্গ: শুরুর গল্প
লিন্ডসে :: বাংলার সিনেমা কি বোম্বের সিনেমার মতোই?
সত্যজিৎ :: আসলে বোম্বের সিনেমা এখন যে রকম, সবসময় সে রকম ছিল না। এটির একটি স্থানীয় ইন্ডাস্ট্রি ছিল। সেখানে স্থানীয় প্রেক্ষাপটে বাস্তবধর্মী সিনেমা বানানো হতো। কিন্তু বছরের পর বছর, ধীরে ধীরে এটি পাল্টে গেছে। আমার ধারণা, এই মুহূর্তে টাকাওয়ালা লোকেরাই এটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে। ফিল্মমেকারদের নিজেদের কোনো ওস্তাদপনা নেই; তারা একগুচ্ছ নকশা অনুসরণ করেন শুধু। তবে তারা এভাবে কাজ করার কারণ, এইসব সিনেমা বানাতে প্রচুর টাকা খরচ হয়।
লিন্ডসে :: প্রডিউসারেরা নিশ্চয়ই আপনাকে খুব একটা পছন্দ করে না, তাই না?
…
অর্থলগ্নি
করার ক্ষেত্রে আমি
যথেষ্ট নিরাপদ ফিল্মমেকার
…
সত্যজিৎ :: কোথায়? [হাহাহা…।] আমার ধারণা, কাজের সময় আমাকে তারা যথেষ্টই পছন্দ করেন; কেননা, অর্থলগ্নি করার ক্ষেত্রে আমি যথেষ্ট নিরাপদ ফিল্মমেকার। কারণ, আমার সিনেমা যদি তাদের ঘরে খুব বেশি টাকা এনে না-ও দেয়, ভারতের বাইরে সেগুলো দেখিয়ে তারা খরচ উঠিয়ে নিতে পারেন।
লিন্ডসে :: প্রথম সিনেমাটি বানিয়েছিলেন…
সত্যজিৎ :: সেটির কাজ আমরা নিজেদের টাকায় শুরু করেছিলাম। কারণ, আমরা এমন কিছু ফুটেজ শুট করতে চেয়েছিলাম, যেন সেগুলো দেখে প্রডিউসারেরা বুঝতে পারেন, আমাদের কোমড় বেশ শক্ত। এরপর আমাদের টাকা শেষ হয়ে গেল।
আমরা যে ফুটেজগুলোর শুট করেছিলাম, সেগুলো তাদের পছন্দ হয়নি। যেমন ধরুন, বৃদ্ধা নারীটির চেহারা তাদের ভালো লাগেনি।

লিন্ডসে :: এই ম্যাটেরিয়ালই কি পরবর্তীকালে ব্যবহার করেছেন?
সত্যজিৎ :: হ্যাঁ। অবশ্য প্রথম দুই-তিনদিনের শুটিং ব্যবহার করিনি। আমরা তো আসলে (ফিল্মমেকিংয়ের) কিছুই জানতাম না। আমাদের পড়াশোনা প্রচুর ছিল, দেখা প্রচুর ছিল ঠিকই; কিন্তু আপনি যখন ক্যামেরা নিয়ে শুটিংয়ে নামবেন, তখনই শুধু শিখতে পারবেন। আরও শিখতে পারবেন এডিটিং রুমে ঢুকে। প্রথম দুই-তিনদিনের শুটিংয়ে আমরা যে ভুলগুলো করেছিলাম, সেগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। তখন বুঝে গেছি, ম্যাটিরিয়ালটি সম্পাদনা করা লাগতে পারে।… ফলে আমাদের হাতে প্রায় ৪০ মিনিটের রাফ কাট ছিল, সেটি নিয়েই আমরা একের পর এক, প্রায় ডজনখানেক প্রডিউসারের কাছে ধর্ণা দিয়েছি; কিন্তু কেউ আগ্রহ দেখাননি। এরপর আমরা কিছু টাকা জড়ো করেছি; তারপর আরও কিছু শুট করেছি। আর এভাবে করতে গিয়ে দুই বছরের মতো লেগে গেছে।
অবশেষে আমরা কিছু সাহায্যের সুযোগ নিলাম; শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজি হলো (সিনেমাটিতে অর্থলগ্নি করতে)। তারা টাকা দিলো। তবে সিনেমাটি দেশে ব্যবসাসফল হয়েছে।
লিন্ডসে :: সেই সময় থেকে আপনি সামনে এগিয়ে গেলেন এবং এটি কম-বেশি শেষ করলেন?
সত্যজিৎ :: হ্যাঁ।
লিন্ডসে :: আপনি সবসময় একই টিম নিয়ে কাজ করেন।
সত্যজিৎ :: কম-বেশি। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমার সেই একই আর্ট ডিরেক্টর– বংশী চন্দ্রগুপ্ত, যিনি দ্য রিভার-এরও আর্ট ডিরেক্টর ছিলেন। আমার সেই একই এডিটর। তবে আমি এ পর্যন্ত দুজন ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে কাজ করেছি– প্রথমজন সুব্রত মিত্র, যিনি আমার বেশিরভাগ সিনেমায় ক্যামেরা চালিয়েছেন, এবং যিনি জিম আইভরির [আমেরিকান ফিল্মমেকার] সঙ্গেও কাজ করেছেন। আরেকজন মিত্রেরই অ্যাসিস্ট্যান্ট, যিনি এখন ইনডিপেনডেন্ট ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করছেন, এবং যার কাজ কম-বেশি মিত্রের মতোই।
লিন্ডসে :: তাদের খোঁজ পেলেন কোথায়? তারা কি টেকনিশিয়ান ছিলেন?
সত্যজিৎ :: না; মিত্র সদ্যই কলেজ থেকে বেরিয়েছিলেন। স্টিল ফটোগ্রাফির প্রতি ভীষণ আগ্রহ ছিল তার। রেনোয়া যখন দ্য রিভার বানাচ্ছিলেন, তিনি তখন সেটির ধারে-কাছেই ছিলেন; কেননা, করার মতো (তখন) তার কোনো কাজ ছিল না। তিনি আমার মতো চাকরিজীবী ছিলেন না। রেনোয়ার শুটিং দেখতে আমার খুব ভালো লাগত। মনে হলো, মিত্রের রুচি খুবই উন্নত, এবং তিনি আমার কথা শুনবেন; কেননা, আমাদের দুজনের মনোভাব কম-বেশি একই রকম। আমরা দুজনই কার্তিয়ে ব্রেসোঁর [ফরাসি সিনেমাটোগ্রাফার] খুব ভক্ত ছিলাম; সেটি একটি বড় অনুপ্রেরণা আমাদের জন্য।
প্রসঙ্গ: লেখালেখি, শুটিং, এডিটিং…
লিন্ডসে :: আপনি মূলত যথেষ্ট নিবিড় স্ক্রিপ্ট লিখে থাকেন।
সত্যজিৎ :: সেখানে ইমপ্রোভাইজেশন সুযোগ সবসময়ই থাকে। আপনি যখন অন-লোকেশনে শুটিং করবেন, স্পটে কিছু আইডিয়ার, নতুন অ্যাঙ্গেলের দেখা পাবেন। বড় ধরনের পরিবর্তন আপনাকে করতে হবে না; তবে গুরুত্বপূর্ণ পরিমার্জনগুলো ঠিকই করতে পারবেন– যেগুলো কোনো সেটে করা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক কারণেই আপনাকে সেটি করতে হবে।
লিন্ডসে :: সিনেমাটির ভিজুয়াল স্টাইল ও রিদম আপনার মাথায় আগে থেকেই যথেষ্ট মূর্তভাবে তৈরি থাকে, তাই না?
সত্যজিৎ :: হ্যাঁ, ক্যামেরায় সেটি অনেকটাই ঠিক করে নিতে পারি। এডিটিং রুমে গিয়ে আমরা স্রেফ সেটির আরও মসৃণ রূপ ফুটিয়ে তুলি।
লিন্ডসে :: নিজেই এডিট করেন?
সত্যজিৎ :: সে তো সবসময় সম্ভব নয়। আমি এখন যে সিনেমার শুটিং করছি, সেটির প্রায় সবটুকুর শুটিংই শেষ করে আনতে পেরেছি ঠিকই, (কিন্তু দেখা যায়) আমার পক্ষে তখন পর্যন্ত মাত্র ২ হাজার ফুট রাশ ফুটেজ দেখা সম্ভব হয়েছে।
লিন্ডসে :: সম্পাদনার দায়ভার এডিটরের হাতে ছেড়ে দেন?
সত্যজিৎ :: না, আমি সবসময়ই (এডিটিংয়ে) হাজির থাকি। এমনকি রাফ কাটের সময়ও। আমার উপস্থিতি ছাড়া কিছুই ঘটে না।
লিন্ডসে :: একদম ঠিক কাজ করেন আপনি… [হাহাহা…]!
সত্যজিৎ :: একটি সিনেমা আসলে কী নিয়ে– সে কথা একমাত্র ফিল্মমেকারই জানেন।
লিন্ডসে :: শুটিং চলাকালে দিনে যা কিছু শুট করলেন, সন্ধ্যায় সেগুলো নিয়ে এডিটিংয়ে বসে যান?
সত্যজিৎ :: না। এমনটা করা অসম্ভব। এমনটা করলে নিজের সেরাটা দেওয়া সম্ভব না।
লিন্ডসে :: অর্থনৈতিক কারণে আপনাকে কি আমাদের এখানকার মতো নির্বিকারচিত্তে সিডিউল মেনে শুটিং করতে হয়? আপনি কি কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেন না?
…
শুটিং চালিয়ে
যেতে আমি
ভালোবাসি
…
সত্যজিৎ :: যতটা সম্ভব শুটিং করতে আমার ভালো লাগে। শুটিং চালিয়ে যেতে আমি ভালোবাসি। অন লোকেশনে আমরা রোববারগুলোতেও, সপ্তাহের প্রতিটি দিনই শুটিং করি। আর সেটা নিশ্চয় আবহাওয়া অনুকূল থাকলে, তবেই।
লিন্ডসে :: আপনার এই মেথড তো ভারতীয় বেশিরভাগ ফিল্মমেকারের মেথডের চেয়ে একেবারেই আলাদা, তাই না?
সত্যজিৎ :: বোম্বের পরিমণ্ডল একেবারেই ভিন্ন। (সেখানে) বেশিরভাগ শীর্ষ নায়ক-নায়িকাই একইসঙ্গে দশ-বারোটি সিনেমায় অভিনয় করেন, ফলে একেকজন ফিল্মমেকারকে তারা দিনে দুই ঘণ্টার মতো সময় দিতে পারেন; দেখা যায় সকালে বোম্বেতে, আবার সন্ধ্যায় মাদ্রাজে শুটিং করছেন। এমনটা ঘটে।
কখনো কখনো একই ফিল্মমেকার একসঙ্গে তিনটি সিনেমা বানান। দেখা গেল, তিনি মাদ্রাজে একটি সিনেমার আর বোম্বেতে আরেকটি সিনেমার শুটিং করছেন; কিন্তু মাদ্রাজের শুটিংয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় বলে টেলিফোনেই সেটির ডিরেকশন দিচ্ছেন। ওদিকে শুটিং চলছেই। সিডিউল ঠিক থাকছে… [হাহাহা…]!
লিন্ডসে :: আপনি একটি সিনেমা বানানো হয়ে গেলে পরের সিনেমায় একই মেজাজ বা স্টাইল অনুসরণ করতে পছন্দ করেন না?
সত্যজিৎ :: এমন কাজ আমি একবারই করেছি। পথের পাঁচালীর পর বানিয়েছি অপরাজিত। তখন অবশ্য আমার মাথায় ট্রিলজির ভাবনা ছিল না। দেশে পথের পাঁচালী কিছুটা সাফল্য পাওয়ার পরই আমি দ্বিতীয় অংশটি বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে (এর পরপরই) একই ধরনের সিনেমা আমি আর বানাতে চাইনি; সে কারণে একটি মিউজিক্যাল ফিল্ম বানিয়েছি। অপরাজিত-এর পর বানিয়েছি পরশ পাথর। এটি একটি বিদ্রূপাত্মক কমেডি ফিল্ম; এর খুব একটা নাম-ডাক হয়নি। সিনেমাটি বানিয়ে দারুণ মজা পেয়েছিলাম।

লিন্ডসে :: ব্যবসাসফল হয়েছিল?
সত্যজিৎ :: খুব একটা ব্যবসাসফল হয়েছে– বলা যাবে না; তবে খরচ উঠে এসেছে। সবসময়ই আমি ভিন্ন ভিন্ন মেজাজের সিনেমা বানাতে চেয়েছি। কোনো একটি রাশভারি, ট্র্যাজিক, বিষাদগ্রস্ত সিনেমা বানানোর পর সেটির প্রভাব আপনার ওপর পড়বেই; আর তখন নিশ্চয়ই আপনি চাইবেন হালকা মেজাজের কিছু বানাতে।
লিন্ডসে :: গড়ে বছরে একটা করে সিনেমা বানান আপনি…
সত্যজিৎ :: দেড়টা… আসলে সোয়া একটা– যদি সঠিক হিসেব জানতে চান…
লিন্ডসে :: একটা সিনেমা বানানোর পরপরই কি আরেকটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন?
সত্যজিৎ :: তিন-চার মাসের একটা বিরতি নিতে পারলে আমার খারাপ লাগত না অবশ্য; কিন্তু নিজের ক্রুর জন্য সিনেমা বানানো চালিয়ে যেতেই হয় আমাকে। কেননা, তাদের কোনো নির্দিষ্ট বেতন নেই বলে তারা তো পরবর্তী সিনেমাটির দিকে তাকিয়ে থাকেন।
লিন্ডসে :: তারা কি অন্যদের সিনেমায়ও কাজ করেন না?
সত্যজিৎ :: না করারই চেষ্টা থাকে তাদের। আমার ক্যামেরাম্যান অন্যদের সঙ্গে কাজ করেন, আমার এডিটরও; কিন্তু অ্যাসিস্ট্যান্টরা শুধু আমার সঙ্গেই কাজ করতে পছন্দ করেন। এ কারণেই একটির পর আরেকটি সিনেমা বানাই।
প্রসঙ্গ: ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন
লিন্ডসে :: আপনার সাম্প্রতিকতম সিনেমাটি আরেক ধরণ বদল; কারণ এটি এক রূপকথা।
সত্যজিৎ :: এটি আমার দাদার [ঠাকুরদার] একটি গল্প অবলম্বনে; তিনি খুবই বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ছিলেন। এটি প্রায় ষাট বছর আগের লেখা; তার সম্পাদিত একটি ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল, আমি শিশুকালে পড়েছি। আমি ম্যাগাজিনটি আবার নতুন করে প্রকাশ করছি; আমরা ষাট বছর আগের এই গল্প পুনর্মুদ্রণ করেছি। এই সিনেমা আমি অনেক দিন আগেই বানাতে চেয়েছিলাম; কিন্তু এর জন্য প্রচুর মিউজিক ও প্রচুর এক্সট্রার প্রয়োজন…। তাই মনে হয়েছিল, এই সিনেমা বানাতে অনেক বেশি টাকা লেগে যাবে, এবং আমাকে এর পেছনে অর্থলগ্নিকারী খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
সিনেমাটি দুই বছর আগেই বানানোর কথা ছিল। গানগুলোর কম্পোজ করে ফেলেছিলাম এবং সেগুলোর রেকর্ডিংও হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রডিউসার সরে গেলেন। ফলে আমার আর তখন কিছুই করার ছিল না। সে সময়ে আমি একটি গোয়েন্দা কাহিনি বানিয়েছি; সেই সিনেমা আসলে নিজের মর্জিতে বানাইনি। এ সময়ে আমার অ্যাসিস্ট্যান্টরা কিছু একটা করতে চেয়েছিল; তারা ওই গল্পের সত্ত্ব কিনে এনেছিল, এবং এতে একজন শীর্ষ অভিনেতাকে সম্পৃক্ত করেছিল।
…
ডিস্ট্রিবিউটর
বলেছিলেন, আমার
নাম না দিলে তারা কোনো
সিনেমা-হল পাবেন না;
তাই নামটা
দিতেই
হলো
…
ওই সিনেমায় নিজের নাম আমি ব্যবহার করতে চাইনি। বলেছিলাম, ”সিনেমাটি আমি বানাব ঠিকই, তবে এখানে বরং আমিই তোমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট হব।” তারা দিনে দিনে আরও বেশি নার্ভাস হয়ে গেল; ফলে শেষ পর্যন্ত দায়িত্বটা নিতে হলো আমাকেই। ডিস্ট্রিবিউটর বলেছিলেন, আমার নাম না দিলে তারা কোনো সিনেমা-হল পাবেন না; তাই নামটা দিতেই হলো।
লিন্ডসে :: (আপনার) সিনেমাগুলো তো খাঁটি বাঙালিদের মধ্যে যথেষ্ট ভালোভাবেই ডিস্ট্রিবিউশন হয়, তাই না?
সত্যজিৎ :: পাকিস্তান [দেশভাগ] হয়ে যাওয়ার পর স্থানীয় বাজার একেবারেই ছোট হয়ে গেছে। এই বাজার থেকে টাকা তুলে আনতে হলে আপনার পক্ষে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি অর্থব্যয় করা সম্ভব হবে না। পাকিস্তানে ভারতীয় সিনেমা নিষিদ্ধ; ফল আমাদের [বাঙালি দর্শকের] বাজার অর্ধেক হয়ে গেছে। আমার সিনেমাগুলো শুধু বাংলায় [পশ্চিমবঙ্গ] চলে; নগর ও ছোট শহরগুলোর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি আমার দর্শক। বোম্বে, মাদ্রাজ ও দিল্লিতেও সেগুলো দেখানো হয়– যেখানে বাঙালিরা রয়েছেন। প্রচুর অবাঙালিও দেখেন; তারা সঙ্গে করে বাঙালি বন্ধুদের নিয়ে যান, সংলাপ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য।
লিন্ডসে :: সাবটাইটেল থাকে না?
সত্যজিৎ :: আমি সাধারণত আমার প্রডিউসার ও ডিস্ট্রিবিউটরদের একটা কিউ-শিট দিয়ে দিই; কিন্তু তারা কখনোই সেটি সংযুক্ত করেন না। এর একটা কারণ, ভারতে কোনো যথাযোথ্য টাইটেলিং মেশিন নেই। একটি হিথ-রবিনসন হোম-মেড ডিভাইসের মাধ্যমে কাজটি করা হয়। আপনি যদি আপনার সিনেমায় সাবটাইটেল ব্যবহার করতে চান, আপনাকে তাহলে বৈরুতে যেতেই হবে; আর সেজন্য অনুমোদন নিতে হবে– যেটি দিল্লি থেকে পাস হয়ে আসতে সম্ভবত ছয় মাস লেগে যাবে।
লিন্ডসে :: ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা?
সত্যজিৎ :: ইউরোপে, মিউনিখের কোনো এক ভদ্রলোক আছেন, যিনি আমি যা বানাই, সবই কিনে নেন; তারপর সেগুলো আর কোথাও দেখান না… [হাহাহা…]!
…
বানানো
সিনেমাটির
(ভবিষ্যৎ) ছেড়ে দিই
ডিস্ট্রিবিউটরদের হাতেই
…
তিনি ইস্টার্ন ইউরোপসহ পুরো ইউরোপের জন্যই কেনেন। তবে তাকে বরং একজন সংগ্রাহক বলেই মনে হয়।… এগুলো নিয়ে তিনি করেনটা কী, আমার জানা নেই। আমার সিনেমাগুলোর কী হলো– সেই খোঁজ রাখি না। একটা বানানো শেষ হলে পরেরটাতে মন দিই, আর বানানো সিনেমাটির (ভবিষ্যৎ) ছেড়ে দিই ডিস্ট্রিবিউটরদের হাতেই। আপনাকে তো কারও না কারও ওপর আস্থা রাখতে হবেই… [হাহাহা…]!
লিন্ডসে :: তারা সেগুলো বিদেশে বিক্রি করেন?
সত্যজিৎ :: এড হ্যারিসন নামে আমাদের একজন ডিস্ট্রিবিউটর ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে, দুভার্গ্যক্রমে দুই বছর আগে তিনি মারা গেছেন। বার্লিনে কেউ একজন আমাকে বলেছিলেন, আমার সিনেমাগুলো সারা দুনিয়াতে চলছে, এবং তারা ডিস্ট্রিবিউটরদের মধ্যে সেগুলো ডিস্ট্রিবিউট করেছেন। সিনেমাগুলো তারা চালাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু আমি সেসবের কোনো খোঁজ জানি না। সেগুলোর মধ্যে দুটির মালিকানা আমার, এবং অন্য কিছু যদি না-ও পাই, অন্তত মাসিক স্টেটমেন্টটা তো আমার পাওনা।
লিন্ডসে :: এজন্য আপনার মেজাজ খারাপ হয় না?
সত্যজিৎ :: হলেও এক মুহূর্তের জন্য। কেননা, আমাকে সাধারণত অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়; অন্যদিকে মনোযোগ দিতে হয়…।
প্রসঙ্গ: মিউজিক
লিন্ডসে [দর্শকদের উদ্দেশে] :: আপনাদের কোনো প্রশ্ন আছে?
দর্শক :: আপনার প্রথম দিকের সিনেমাগুলোর মিউজিক রবি শঙ্করের?

সত্যজিৎ :: হ্যাঁ। তিন কন্যা থেকে আমি নিজেই মিউজিক কম্পোজ করছি। এর আগে যে কম্পোজারদের ব্যবহার করেছি, তারা ফিল্ম কম্পোজার ছিলেন না। তারা কনসার্ট পারফরমার। রবি শঙ্কর প্রচুরসংখ্যক ব্যালে কম্পোজিশন করেছেন।
লিন্ডসে :: দ্য রিভার-এর মিউজিকও তিনি করেছেন?
সত্যজিৎ :: না; তবে সিনেমাটির শুরুতে যে সেঁতার আপনারা শোনেন, সেটি আমার ক্যামেরাম্যানের বাজানো; তিনি একজন জন্মগত সেঁতারবাদক… [হাহাহা]। তার সেঁতার বাজানোর একটা দৃশ্যও রয়েছে।
…
দীর্ঘকাল ধরেই
মিউজিক
আমার
প্রথম
প্রেম
…
তাদের সঙ্গে কাজ করা আমার জন্য মুশকিল ছিল; কেননা, তারা আমার বন্ধু, এবং আমার নিজের মাথায় প্রচুর আইডিয়া গিজগিজ করতে শুরু করেছিল। নিশ্চয়ই কোনো কম্পোজার একটা পর্যায়ের পর তার কাজে কারও নাক গলানো পছন্দ করবেন না, এবং আমিও চাইনি বন্ধুত্বে গোলমাল লাগুক; তাই নিজেই চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ কাজে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না ঠিকই, তবে দীর্ঘকাল ধরেই মিউজিক আমার প্রথম প্রেম। ওয়েস্টার্ন ও ভারতীয় ক্লাসিক্যাল– উভয় ধরনের মিউজিকের প্রতিই আগ্রহ ছিল আমার।
প্রথম দিকে এ কাজ খুবই কঠিন ছিল আমার জন্য; এবং আমি যা কম্পোজ করতাম, অর্কেস্ট্রায় তা খুবই বাজে শোনাত। ফলে আমাকে প্রচুর জোড়াতালি দিতে হয়েছে। দ্য পোস্টমাস্টার-এর জন্য কিছু মিউজিক লিখেছিলাম, কিন্তু সেটির কোনোটাই ব্যবহার করতে পারিনি; কারণ সাউন্ডটিকে যুৎসই মনে হয়নি আমার কাছে। তবে পরে আমি একটা নির্দিষ্ট মাত্রার দক্ষতা আত্মস্থ করেছি।
লিন্ডসে :: পাশ্চাত্যে যেভাবে মিউজিক লেখা হয়, আপনাদের ওখানেও কি ও-রকম স্বরলিপি লেখেন?
সত্যজিৎ :: ভারতীয় মিউজিকে ও-রকম অর্কেস্ট্রাশনের কোনো সিস্টেম নেই; ফলে আমরা এক রকম লিখে রাখি আরকি!
লিন্ডসে :: সেগুলোর কি প্রচুর ইমপ্রোভাইজেশন হয়?
সত্যজিৎ :: দেখুন, আমি চাইলে রবি শঙ্করের নির্দিষ্ট মেজাজগুলোর কথা বর্ণনা করতে পারি। তিনি সাধারণত সিনেমা দেখতেন না; তবে তার মাথায় মূল মোটিফটা থাকত। ফলে বিভিন্ন টেম্পোতে ভিন্ন ভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে তিনি ছয় কি সাতটি মোটিফ নিয়ে কাজ করতেন। তারপর আমি তাকে তিন মিনিট দৈর্ঘ্যরে সেঁতার মিউজিক এবং অর্কেস্টাশনের বিভিন্ন পিস করালাম– যেগুলো ভিন্ন ভিন্ন মেজাজে ইমপ্রোভাইজ করা হয়েছিল। যখন সেটিকে ট্র্যাকে ফেলা হলো, আমি দেখি, মিউজিক খানিকটা কম পড়ে গেছে; আমার আরও বেশি দরকার। সেটির কিছুটা আমার ক্যামেরাম্যান করে দিলেন। [পথের পাঁচালী] ফেরিওয়ালার মিউজিক রবিশঙ্কর নন, বরং তিনিই করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে রবি শঙ্করকে এই নিয়ে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়; যখনই কেউ তাকে ফেরিওয়ালার অংশ থেকে মিউজিক শোনাতে বলে, তিনি তো সেটা পারেন না… [হাহাহা]!
লিন্ডসে :: আপনি যখন মিউজিক করেন, তখন কি সেটিকে ছবির কাছাকাছি নিয়ে যেতে চান?

সত্যজিৎ :: ছবিটা তো আমার মাথায় ভালোভাবেই থাকে, ফলে সেটির দিনে (আলাদা করে) নজর রাখার দরকার পড়ে না। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কনসেপ্ট কিন্তু বদলে যাচ্ছে। আজকের দিনে এটিকে যত কম সম্ভব, ব্যবহার করা হয়। অপুর সংসার-এ রবি শঙ্কর চায়ের কাপ ব্যবহার করে মিউজিক করেছেন। ব্যাপারটি এ রকমই। টোকা মেরে বাজানো। গোয়েন্দা সিনেমাটিতে, কাহিনিটি যেহেতু আমার ভালো লাগেনি, তাই মিউজিক নিয়ে খানিকটা মজা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি কিছু বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সেগুলোর রেকর্ডিং ভিন্ন ভিন্ন স্পিডে করেছি, এবং এর সবটাই ছিল সিনথেটিক। সবটাই আমার রুমে বসে করা। এগুলো যেভাবে বাজানো হয়েছে, সেটি কেউই করতে পারবে না; তবে এর আকাঙ্ক্ষিত প্রভাবটি ঠিকই পড়েছে।
লিন্ডসে :: আপনি যখন মিউজিক স্কোরে কোনো মিউজিক্যাল ঐকতান ব্যবহার করেন, সেখানে কতগুলো লোককে সম্পৃক্ত করেন?
সত্যজিৎ :: সর্বোচ্চ ত্রিশজনকে করেছি। সাধারণত ১৬ জনের মতো লাগে একেকটি স্ট্রিং সেকশনে। আমি সবসময়ই ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন বাদ্যযন্ত্রের মিশ্রণ ঘটাই।
লিন্ডসে :: আপনি ওয়েস্টার্ন স্বরলিপি বাজাতে পারেন?
সত্যজিৎ :: হ্যাঁ। কোনো কোনো মিউজিশিয়ান ওয়েস্টার্ন স্বরলিপি জানেন না, ফলে আমাকে কখনো কখনো সেটির ভারতীয় ভার্সনও করতে হয়। আমার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আছেন, যিনি বংশীবাদকও; তিনিই কনডাক্ট করেন।
লিন্ডসে :: এই সিনেমার জন্য আপনি কি অনেকগুলো গান লিখেছেন?
সত্যজিৎ :: আমি একটি একেবারেই ট্রেডিশনাল মিউজিকের ওপর গানের কথা লিখেছি; সেটির শত শত ভার্সন রয়েছে।
লিন্ডসে :: [প্রশ্ন শোনা যায়নি।]
…
আমার
প্রথম দিকের
বেশিরভাগ সিনেমার
এডিটিংয়েই ত্রুটি
আছে
…
সত্যজিৎ :: …বিশেষ করে চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার পর সবসময়ই এক ধরনের তাড়া অনুভব করি। এডিটিং পর্যায়ে গিয়ে তাড়াহুড়ো করাটা কিন্তু বিপজ্জনক; কেননা, আমার প্রথম দিকের বেশিরভাগ সিনেমার এডিটিংয়েই ত্রুটি আছে। এমন মারাত্মক কিছু ত্রুটি রয়েছে, যদি আরেকটু সময় পেতাম, সেগুলো থাকত না। আমার সিনেমাগুলোকে ধীরগতির মনে হওয়ার অন্যতম কারণ, সাউন্ডট্র্যাকটি যথেষ্ট এক্সপ্রেসিভ নয়; সম্ভবত আরও কিছু সাউন্ড বা মিউজিক ওগুলোতে দরকার ছিল।
লিন্ডসে :: আপনার কি স্পেশাল ডাবিং এডিটর আছে?
সত্যজি :: না; একই এডিটিং টিম কাজ করে।
দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি, আসছে...