খণ্ডহর: মৌন অসহায় জীবনের প্রতিচ্ছবি নাকি মনুষ্যত্বের ধ্বংসাবশেষ?

353
খণ্ডহর

লিখেছেন: জিম ইসমাইল

খণ্ডহর

খণ্ডহর
Khandhar
ফিল্মমেকার ও স্ক্রিনরাইটার: মৃণাল সেন
উৎস গল্প: প্রেমেন্দ্র মিত্র
প্রডিউসার: জগদীশ চৌখানি
সিনেমাটোগ্রফার: কে. কে. মহাজন
এডিটর: মৃন্ময় চক্রবর্তী
মিউজিক: ভাস্কর চন্দ্রভরকার
কাস্ট [ক্যারেকটার]: শাবানা আজমী [যামিনী]; নাসিরুদ্দিন শাহ [সুভাষ], গীতা সেন [মা]; পঙ্কজ কাপুর [দীপু]; রাজেন তরফদার [হরিহর]; আন্নু কাপুর [অনিল]
ভাষা: হিন্দি
রানিংটাইম: ১ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট
দেশ: ভারত
রিলিজ: ৮ জুন ১৯৮৪
অ্যাওয়ার্ড: গ্র্যান্ড প্রাইজ [বেস্ট ফিল্ম], শিকাগো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ১৯৮৫


‘আজ বাতাসে বাতাসে যে আগুনের মতো কি এক মন্ত্র লেগেছে।’ সাতের দশক। পুরো একটি দশক, মৃণাল সেন রাজনৈতিক ছবি করে গেলেন। সময়ের টানে । ইন্টারভিউ [১৯৭১] থেকে আকালের সন্ধানে [১৯৮০]– প্রতিটি চলচ্চিত্রে তার রাজনৈতিক চেতনার ছাপ। রাগী, বিদ্রোহী, আপসহীন। সেদিনের সেই ‘রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার’ আশির দশকে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ভাবনা থেকে সরে এলেন। সত্তরের উত্তাল দশক অতিক্রম করে মুখ ফেরালেন ব্যক্তির দিকে– ব্যক্তির অন্তর্জগত, ইনার ভায়োলেন্সের দিকে।

মৃণাল সেনের এই পর্বের অন্যতম ছবি খণ্ডহর। হিন্দি ছবি। মৃণাল সেনের নিজের কথা, ‘আজকে খণ্ডহর-এ যা দেখছেন তা হলো দ্য লজিকাল এক্সটেনশন অব হোয়াট আই ওয়াজ টোয়েন্টি ইয়ার্স এগো।’

এই ছবির নিচের জমিটুকু হলো প্রেমেন্দ্র মিত্রের বিখ্যাত গল্প তেলেনাপোতা আবিষ্কার। শেষ থেকে ছবির শুরু। শুরুতেই ক্যামেরা ধীরে ধীরে একটি ডার্ক রুমকে ফুটিয়ে তোলে। সেখানে কাজ করছে একজন ফটোগ্রাফার– সুভাষ। সে সযত্নে একটি ছবি ডেভেলপ করছে। লাল আলোতে সাদা কাগজের উপর ধীরে ধীরে একটি মেয়ের মুখ উদ্ভাসিত হতে দেখি। একটি ধ্বংসস্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েটি, যামিনী। যামিনীর মুখ ফুটে উঠতেই গোটা ফ্রেমটা ফ্রিজ করে দেওয়া হয়। তার উপর ছবির টাইটেল শুরু হয়।

মূল গল্পে নায়কের শখ ছিল মাছধরা। চলচ্চিত্রে নায়ক হয়ে গেল ফটোগ্রাফার। ১৯৮৪ সালে ব্যাপারটা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। গ্রামীণ চালচিত্রের সঙ্গে কনট্রাস্ট হিসেবেও ফটোগ্রাফারের সপ্রতিভ নাগরিকতা যায় ভালো।

সুভাষ ডার্ক রুম থেকে বেরিয়ে কাজের টেবিলে ব্যস্ত। তার ঘরে, বাইরের দৈনন্দিন কোলাহলের শব্দ এসে ঢুকছে। ক্লোজ শটে, একটি স্থিরচিত্রকে ব্যস্ত কলকাতা শহর বলে ভ্রম হয়: রাস্তায় অসংখ্য মানুষ, বিশাল বিশাল বাড়ি। ক্যামেরা পুলব্যাক করলে বোঝা যায় ওটি কলকাতা শহরের ব্লোআপ। এইভাবে বেশ কয়েকবার স্টিল ফটো দিয়ে মৃণাল সেন দর্শককে ধাঁধায় ফেলেছেন, রহস্য তৈরি করেছেন।


এই নাগরিক বিচ্ছিন্নতা
তো এখন আমাদের
ছায়াসঙ্গী …

যেহেতু ক্যামেরা একবারও ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোয় না, তাই ঐ ব্লোআপটা অন্যরকম তাৎপর্য পেয়ে যায়। পরে দেখি সুভাষের দুবার টেলিফোন আসে। কিন্তু রং নাম্বার। সুভাষকে নয়, অন্য কাউকে চাইছে। অর্থাৎ যোগাযোগ যথাযথ নয়। সুভাষ যে শহরের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন, পরিচালক সেটা বুঝিয়ে দেন। ব্যস্ত শহরে সুভাষও ব্যস্ত এবং বিচ্ছিন্ন। এই নাগরিক বিচ্ছিন্নতা তো এখন আমাদের ছায়াসঙ্গী।

সুভাষের বন্ধু দীপু এসে প্রস্তাব দেয়, কলকাতা শহর থেকে দূরে তাদের পৈতৃক বাড়ি থেকে কয়েকদিন ঘুরে আসার। অতীতের জমিদার বাড়ি, সেই রমরমা ছিল। এখন কিছু নেই, শুধুই ধ্বংসস্তূপ [খণ্ডহর] । নাগরিক ক্লান্তি কাটাতে তিনজনে বেরিয়ে পড়ে– সুভাষ, দীপু, সঙ্গে আরেক বন্ধু অনিল। এরপর কাট। কাট টু একটি যাত্রীবোঝাই বাস। তারা বাস থেকে নামে। বাকি রাস্তা গরুর গাড়িতে যেতে হবে। বাস এবং গরুর গাড়ির বৈপরীত্যে মৃণাল সেন শহর ও গ্রামের বৈষম্য বুঝিয়ে দেন।

খণ্ডহর। ফিল্মমেকার: মৃণাল সেন

আলোকশিল্পী তাপস সেন আলো নিয়ে ভাল কাজ করেছেন এই ছবিতে। ব্ল্যাক স্ক্রিনে খুব দূর থেকে একটি আলোর বিন্দুকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। কাছে আসলে বোঝা যায় ওটি একটি লণ্ঠন, গরুর গাড়িতে দুলছে। দীপু টর্চ জ্বেলে সুভাষকে জঙ্গলের মধ্যে ‘আন্ধেরা’ চেনাতে শুরু করে। আলোর বিভিন্ন প্যাটার্নে জঙ্গলের ভেতরটা অবধি যেন পড়ে নেওয়া যায়।

জঙ্গলে আলোর এই কারসাজি সম্পর্কে বলতে গিয়ে মৃণাল সেন বলছেন, “একটা প্রিজমের ভেতর দিয়ে দেখলে যেমন হয় আলোকে অনেকটা সেরকম চেয়েছিলাম। ক্যামেরার সামনে একটা কাঁচ রেখে ওপাশ থেকে জল ঢালা হচ্ছিল। জলটা যখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল তখন আমরা ক্যামেরাটা পুরো আউট অব ফোকাস করে দিলাম। তার উপর নানা বর্ণের আলো ফেলে ‘আন্ধেরা’র রঙ তৈরি করেছিলাম।”

চরিত্ররা গন্তব্যে এসে পৌঁছায়। নিস্তরঙ্গ গ্রামের ভেতর একটি জীর্ণ বাড়ি। এখানে পৌঁছে আমরা ঠিক ততটুকুই দেখতে পেলাম, যতটুকু একটা লণ্ঠনের আলোতে দেখা যায়। সুভাষ টর্চ নিয়ে ছাদে গেল চারপাশটা দেখবে বলে। চারদিকে সুভাষ টর্চের আলো ফেলতে শুরু করল। এখানেও তততুকুই দেখা গেল যতটুকু টর্চের আলোতে দেখা সম্ভব।


আলো-অন্ধকার নিয়ে রহস্য
তৈরি করা হয়েছে
খণ্ডহর-এ

টর্চের আলো গিয়ে পড়ল দূরের একটি জানালার উপর। সেখানে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে– যামিনী; দীপুর খুড়তুতো বোন। সুভাষ টর্চ বন্ধ করে দিলো। এবার ঘরের ব্যাকলাইটে যামিনীকে আবার দেখা গেল। একটি লণ্ঠন সিঁড়ি বেয়ে নামে, বারান্দা পেরিয়ে এগিয়ে যায়। বোঝা যায় লণ্ঠনটি বয়ে বেড়াচ্ছে যামিনী। তারপর চারপাশ দেখে সে দরজা বন্ধ করে দেয়। ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে যায় পর্দা। এই অন্ধকারকে কিছুক্ষণ পর্দাতে ধরে রাখা হয়। এইভাবে আলো-অন্ধকার নিয়ে রহস্য তৈরি করা হয়েছে খণ্ডহর-এ।

মূল গল্পে লেখা ছিল, ‘জীবন্ত পৃথিবী ছাড়িয়ে অনুভূতিহীন কুয়াশাময় এক স্বপ্নের জগত, সময় যেখানে স্তব্ধ, স্রোতহীন।’ জীর্ণ বাড়িটাতে সুভাষরা খুঁজে পায় একটি পরিত্যক্ত ক্যালেন্ডার– ফাঁকা– ‘সাল মাহিনা দিন কুছ ভি নাহি।’ সুভাষের মন্তব্য, ‘দ্য টাইম অব দ্য প্রলগ ইজ ইটার্নিটি!’ কার্নিশে বসে থাকা একটি পেঁচাকে দেখে মদের গ্লাসটা তার উদ্দেশ্যে তুলে ধরে দীপু, ‘চিয়ার্স টু ইউ মাই ফোরফাদার্স।’ জলসাঘর ছবিতে এটি ছবি বিশ্বাসের সংলাপ ছিল। ‘উল্লেখযোগ্য কোনো কিছুর সঙ্গে আমার শিল্পকে সম্পর্কিত করতে আমি ভালোবাসি’– বলেছিলেন মৃণাল সেন। এই ছবিতেই আগেও গরুর গাড়িতে যেতে যেতে সুভাষ গাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আউর কিতনি দূর যানা হে দেবদাস?’– দেবদাস ছবিকে এইখানে সম্পর্কিত করে নেওয়া হয়েছে।

অন্ধকারে যখন আমাদের চোখ সয়ে গেছে, তখন ধীরে ধীরে পর্দায় আলো ফুটে ওঠে। ভোর হয়। যামিনীর মায়ের সঙ্গে আলাপ হয়: পঙ্গু, আগে চোখে দেখতে পেতেন, এখন পুরোপুরি অন্ধ। পঙ্গু মা অপেক্ষমান কোনো এক নিরঞ্জন আসবে ও যামিনীকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। সে কথা দিয়ে গেছে। কিন্তু যামিনী জানে সে আসবে না। নিরঞ্জন অন্য কোথাও বিয়ে করেছে।

খণ্ডহর

মা বড় মেয়ের বাড়িতে যেতে চায় না বলে যামিনীও থেকে যায়– এই খণ্ডহরে– একা, ভবিষ্যৎহীন। পঙ্গু মাকে ঘিরেই তার দৈনন্দিন যাপন। এই দৈনন্দিন জীবনের টুকরো টুকরো ছবি পরিচালক আমাদের দেখান: কুয়ো থেকে জল তুলছে, কাপড় কাচছে, কলসিতে করে জল আনছে, উনুন নেভাচ্ছে, মাকে গল্প পড়ে শোনাচ্ছে, নয়তো মায়ের জন্য তুলসী রস বানাচ্ছে। যামিনীর যাওয়া-আসা-কথা বলা স্নিগ্ধ, মায়ের প্রতি সে সকরুণ। যে মা তার দেহটাকে নাড়াবার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে, সেই পঙ্গু মায়ের পাশে যামিনী এক কোমল জীবনীশক্তি। যামিনী মৌন ব্যাথাতুর, কিন্তু পরাজিত নয়। মৃণাল সেন বলছেন, ‘She remains a part of the ruins yet stands as a contrast to the ruins.’


পরিচালক
তার এই গোপন
আভিজাত্যবোধকে
সম্মান দিয়েছেন; তার
দুঃখ-কষ্টকে উচ্চকিত করেননি

এই বিশাল কঙ্কালসার জমিদারবাড়ির অসীম শূন্যতার মধ্যে একা জেগে আছে যামিনী। যামিনীর মধ্যে আছে নম্র আভিজাত্যবোধ, তার ভাবপ্রকাশ সংযত। পরিচালক তার এই গোপন আভিজাত্যবোধকে সম্মান দিয়েছেন; তার দুঃখ-কষ্টকে উচ্চকিত করেননি। দর্শকদের করুণা ভিক্ষা করেননি।

খণ্ডহর-এ এই ভাঙ্গা বাড়ি, ধ্বংসাবশেষ নিজেই একটি চরিত্র। এক অসম্পূর্ণতার বোধ তৈরি করে। এই বাড়ি কি যামিনীদের জীবনের প্রতিচ্ছবি নাকি মনুষ্যত্বের ধ্বংসাবশেষ?

ছবিতে এক বিশেষ নাট্য পরিস্থিতিতে, যামিনীর মা ব্যাকুল হয়ে ওঠে– ‘নিরঞ্জন তু কাঁহা? একবার বোল বেটা।’ এর উত্তরে সুভাষের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘হাঁ’। সুভাষ নিরঞ্জন সেজে তুষ্ট করে যামিনীর মাকে। যামিনী বোঝে কী পরিস্থিতিতে সুভাষকে নিরঞ্জনের ভেক ধরতে হয়েছে, তবু সে একটি রক্ত মাংসের মানুষ। তার মধ্যেও তৈরি হয় প্রত্যাশার মূর্ছনা। কিন্তু প্রত্যাশা পূর্ণ হয় না।

খণ্ডহর

কলকাত্তাওয়ালারা গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার আগে যামিনীর একটি ছবি তোলে সুভাষ। ভাঙ্গাচোরা জীর্ণ ধ্বংসস্তূপের পটভূমিকায় যামিনীর মুখ। শূন্য চাহনি, তাতে আবার কত না অব্যক্ত ব্যথার দ্যোতনা। যামিনীর এই চেয়ে থাকার কাছে সুভাষের ফটোগ্রাফি ব্যর্থ হয়ে যায়। সুভাষদের ক্লীবত্ব প্রকাশ পেয়ে যায়। যামিনীর ছবি স্থির। এই স্থানু থেকে তার মুক্তি নেই। তার সামনে দাঁড়িয়ে এই শহুরে যুবকরা উদাসীন, নিস্পৃহ। এরা কোনো দায়িত্ব নিতে জানে না। ‘ওরা মনের গোপন চেনে না।’ ছবির শেষে আমরা বুঝতে পারি, নিরঞ্জন আর সুভাষের বিশেষ পার্থক্য নেই। নিরঞ্জনকে এই ছবিতে দেখানোর দরকার পড়ে না, সুভাষই নিরঞ্জনের অলটার ইগো।


বুদ্ধিজীবী
মৃণাল সেন
নয়, এই ছবিতে
তিনি আরও বড়

খণ্ডহর সিনেমার ভাষায় তৈরি ত্রুটিমুক্ত একটি সিনেমা। ‘সমাজসংস্কারক’ মৃণাল সেন এই ছবিতে জোর করে তার বক্তব্য গুঁজে দেননি। কোনো কিছুই উঁচুতারে বাঁধা নয়। ফলে, খণ্ডহর-এর বিকাশ স্বাভাবিক এবং সাবলীল। বুদ্ধিজীবী মৃণাল সেন নয়, এই ছবিতে তিনি আরও বড়– হৃদয়জীবী মৃণাল সেন।

শেষ দৃশ্যে দেখি স্টুডিওতে সুভাষ মডেলদের বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ছবি তুলতে ব্যস্ত। স্টুডিওর দেয়ালে যামিনীর সেই স্টিল। শোপিসের মতো সাজানো। ‘নিজের নগ্নতার উপরে পরিয়েছে শিল্পের উত্তরীয়।’ বাইরে থেকে শহরের কোলাহলের শব্দ আসছে। এদিকে স্টিলে যামিনীর চাহনি নিঃশব্দ। দৃষ্টি সুদূর। বাইরের শব্দ বাড়তে থাকে, যামিনীর ছবিটিও দর্শকের আরও কাছে চলে আসে– একেবারে আমাদের চেতনার কাছে। লেন্সের জুমচার্জে স্ক্রিন জুড়ে জেগে থাকে শুধু যামিনীর স্টিল। বাইরে নাগরিক কোলাহলের শব্দ !

তথ্যসুত্র:
১। আমি ও আমার সিনেমা, মৃণাল সেন, বাণীশিল্প
২। মৃণাল সেনের ফিল্মযাত্রা, শিলাদিত্য সেন, প্রতিক্ষণ
Print Friendly, PDF & Email