সাক্ষাৎকার: দ্য টক প্রতিনিধি
অনুবাদ: আসিফ রহমান সৈকত
আলেহান্দ্রো ইনারিতু। মেক্সিকান মাস্টার ফিল্মমেকার। হলিউডে দেখাচ্ছেন দাপট। ফিচার ফিল্ম ‘আমোরেস পারোস’ [২০০০], ‘টুয়েন্টি ওয়ান গ্রামস’ [২০০৩], ‘বাবেল’ [২০০৬], ‘বিউটিফুল’ [২০১০], ‘বার্ডম্যান’ [২০১৪] ও ‘দ্য রিভেন্যান্ট’ [২০১৫]-এর নির্মাতা
দ্য টকস প্রতিনিধি :: একজন ফিল্মমেকারকে কি তার চলচ্চিত্রের সঙ্গে বাস করতে হয়, মিস্টার ইনারিতু?
আলেহান্দ্রো ইনারিতু :: আমি মনে করি প্রতিটা চলচ্চিত্রই কোনো একভাবে আপনার নিজের এক্সটেনশন। সেটা যাই হোক না কেন। আমার কাজ করা প্রতিটি চলচ্চিত্রই আমার নিজের এক্সটেনশন। মাঝে মধ্যে টের পাই, চলচ্চিত্রগুলো বাস্তবতার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
দ্য টকস :: হঠাৎ করে উদ্ভট ঝাপসা লাইন উধাও হয়ে যায় এবং সেগুলো সিনেমাতে থিমেটিক্যালি ঘটতে থাকে; আর সেগুলো আপনার জীবনে সত্যিকার অর্থেই আপনাকে ঘিরে থাকে…
ইনারিতু :: এমনটা আমার সঙ্গে বহুবার ঘটেছে।
দ্য টকস :: বিশেষত কোন চলচ্চিত্রগুলোর ক্ষেত্রে এটা ঘটে?
ইনারিতু :: এবার সেটা ঘটেছে দ্য রেভেন্যান্ট-এর ক্ষেত্রে। শারীরিকভাবেই সিনেমার থিমটা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল। পানি ছিলো ভয়াবহ ঠাণ্ডা। একদিন তো আমরা জিরোর চেয়েও চল্লিশ ডিগ্রি নিচে ছিলাম। তখন চলচ্চিত্রটির সত্যিকারের শারীরিক বাস্তবতা আমাদের জীবনেই সত্যি হয়ে দেখা দিলো এবং আমাদের নিজেদের শারীরিক অনুভূতির অভিজ্ঞতার সঙ্গে হয়ে গেল একাকার।

দ্য টকস :: এই রকম একটা বৈরী পরিবেশে শুটিং করার জন্য আপনারা কেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন?
ইনারিতু :: বুনো পরিবেশে কাজ করতে যেতে পেরে আমি খুবই খুশি ছিলাম। ট্র্যাডিশনে এবং সিনেমার আদি জায়গায় ফিরে যেতে পেরে ছিলাম খুশি– যেখানে সত্যিকারভাবে ঘটনাগুলো ঘটে এবং যেখানে সত্যিকার জায়গাতে শুটিং করা হয়। সেখানে আমরা সেট তৈরির মাধ্যমে কোনো কৃত্রিম পৃথিবী তৈরি করিনি; আমাদের চারপাশে অথবা ডিজিটালি সেই জায়গাগুলো বানিয়ে নিইনি।
…
সেট
তৈরির
মাধ্যমে কোনো
কৃত্রিম পৃথিবী তৈরি করিনি
…
অপ্রত্যাশিতভাবে বাস্তবতা এবং সত্যিকারের প্রাকৃতিক ব্যপারগুলোর জটিলতা এবং রিয়েল লাইট… আমার কাছে এটা পরিষ্কার যে কম্পিউটারে যত ভালোই (ভিএফএক্স) কিছু হোক বা সেটা ডিজাইনার যত সেরাই হোক না কেন, (রিয়েল লোকেশন আর রিয়েল লাইটের) সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা চলে না।
দ্য টকস :: কেন নয়?
ইনারিতু :: এটা শুধু এর জটিলতা ও সৌন্দর্য্যের প্রশ্নে নয়। এটা করা হয়েছে মানসিক একটা অবস্থা তৈরির জন্য, যেটা এই সত্যিকারের পরিবেশ আপনাকে দিতে সাহায্য করে; বুঝলেন? পুরো কাজের প্রক্রিয়াতে এটা একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে । এই জায়গা থেকে আমি আসলেই এই অভিজ্ঞতাকে ভালোবাসি। সিনেমা তৈরির ওডিসিটা [একটা লম্বা, ঘটনাবহুল জার্নি বা অভিজ্ঞতা] নিজেই একটা সিনেমা হয়ে ওঠে। আমরা ফাঁদ পেতে জন্তু ধরা শিকারির মতো হয়ে যাই। সেটা দারুণ এবং সে এক বিশাল আবেগাত্মক ও শারীরিক অভিজ্ঞতা।
দ্য টকস :: এ কথা শুনে (ভের্নার) হের্জোগের আগুইরে, দ্য রথ অব গড-এর [Aguirre, der Zorn Gottes, ১৯৭২] কথা মনে পড়ে গেল; সেটা বানানোর সময় তিনি বিশ্বাস করতেন, পেরুভিয়ান রেইনফরেস্টের বৈরি পরিবেশে শুটিং সেরাটা বের করে নিয়ে আসবে সিনেমাতে।
ইনারিতু :: হ্যাঁ, তাই। হের্জোগের আগুইরে অথবা ফিৎসকারাল্ডো [১৯৮২] সিনেমার প্রভাব আছে আমার ওপর। অথবা আকিরা কুরোসাওয়ার দেরসু উজালা [১৯৭৫] কিংবা এমনকি (ফ্র্যান্সিস ফোর্ড কপোলার) এপোক্যালিপস নাউ-এর [১৯৭৯] প্রভাব। ওই সিনেমাগুলোতে ছিল প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের লড়াইয়ের; সেখানে থাকা ল্যান্ডস্কেপগুলো কোনো না কোনোভাবে সিনেমার চরিত্রগুলোর আবেগাত্মক অবস্থাকে পরিচালিত করেছিল। ওই সিনেমাগুলো আমার সত্যি প্রিয়।

দ্য টকস :: কিন্তু এই ধরনের শুটিংয়ের বাজে প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। আগুইয়েরার প্রোডাকশনের সময় হের্জোগ এবং (কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনেতা) ক্লস কিন্সকি শুটিংয়ের অতিরিক্ত চাপের কারণে আরেকটু হলে একে অপরকে প্রায় খুনই করে ফেলতেন!
ইনারিতু :: তা সত্য। সেখানে যাওয়ার পরই শুধু আপনার পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব– কাজটা আসলে দশগুণ বেশি কঠিন! চলচ্চিত্রটা আমার একেবারে সোজাসাপ্টা সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত রূপ। আমার ওই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ, (এ ব্যাপারে) আমি ছিলাম পুরো অন্ধকারে। নিঃশ্বাস নেবার মতো সুযোগ রাখিনি। প্রতিদিনই যুদ্ধ করতে হয়েছে আমাকে। সেটাই ছিল আমাদের কাজের পদ্ধতি। এ ছিল রক ক্লাইম্বিংয়ের মতো: যখন আপনি দড়ির সাহায্য ছাড়া, দেয়াল ধরে উঠতে থাকবেন এবং মাঝখানে পৌঁছাবেন, তখন কোনো ভুল করবেন তো জানেন, পতন ও মৃত্যু নিশ্চিত। প্রতিদিন আমাদের চেতনাতে এই চলচ্চিত্র সেভাবেই ছিল।
দ্য টকস :: শুনতেই তো ভয়ংকর লাগছে!
…
নিজের ফিল্মমেকিং
মেথডের ফাঁদে
পড়ে গেলাম
আমি
…
ইনারিতু :: আমি যে কি পরিমাণ পাগল– এটা আসলে ভয়েরই ব্যাপার! সবকিছু খুব সহজেই ভেস্তে যেতে পারে। তখন প্রতিদিন এত বেশি চ্যালেঞ্জ ছিল, আপনি নিজের কাজেই নিজে একটা জন্তুতে পরিণত হয়ে যাবেন। কখনো নিজেই প্রভু, আবার কখনো নিজেই জন্তু। এখানে আপনি স্রেফ এমনি এক জন্তু, যে নিজের তৈরি দুনিয়াতে টিকে থাকতে চাচ্ছে।
তাছাড়া আর্থিক ঝুঁকিটাও গুরুত্বপূর্ণ– যা এই রকম একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্পে বিগড়ে যেতে পারে। এর স্ট্যান্ডার্ড এত উঁচুতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যা আমাদেরকে ফাঁদে ফেলে দিয়েছিল। নিজের ফিল্মমেকিং মেথডের ফাঁদে পড়ে গেলাম আমি। আর সরে আসতে পারলাম না; দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমি যদি এটা শেষ করতে না পারি, অথবা যেভাবে চেয়েছিলাম সেভাবে কাজটা না হয়, তাহলে সেটা হবে এক ভয়াবহ বিপর্যয়!
এ যেন ম্যরাথন দৌড়ের মতো– থেমে যাওয়ার নেই উপায়; আপনাকে দৌড় শেষ করতে হবে। বুঝতে পারছেন আপনি নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন, কিন্তু আপনাকে কাজটা শেষ করতে হবে!
দ্য টকস :: আপনার ক্যরিয়ার নিশ্চয় নিজের বৈবাহিক সম্পর্কের জন্য বেশ কঠিন?
ইনারিতু :: আশা করি আমাদের যেন সহসা ডিভোর্স না হয়ে যায়– হাহাহা…! এটা আসলেই কঠিন। কঠিন, অনেক কঠিন। চলচ্চিত্র নির্মাণ আপনার কাছ থেকে অনেক বেশি কিছু চায়, ইট টেইকস এ লট অফ শিট ফ্রম ইউ। আপনি সব মানুষজন থেকে দূরে থাকতে বাধ্য– যাদের পাশে থাকা আপনার দরকার। এটাই (ফিল্মমেকিংয়ের) অন্যতম কঠিন অংশ।
দ্য টকস :: আর আপনি তো দ্য রেভেন্যান্ট সিনেমাটা নিয়ে কাজ করছিলেন যখন বার্ডম্যান সিনেমাটার জন্য গত বছর (২০১৫) অস্কার জিতলেন। আপনি কি তাও বলবেন না– একটা বিরতি নেবার সময় হয়েছে?
ইনারিতু :: আমি দুটি ম্যরাথন একসঙ্গে চালিয়েছি। তাই আমার এখন থামা দরকার। সত্যি বলতে, বার্ডম্যান সিনেমাটার সঙ্গে কী ঘটেছিল, বোঝারও সময় ছিল না হাতে! সে এক অদ্ভুত অবস্থা। আমি মনে করি আমার কয়েক মাস বিশ্রাম নেওয়া দরকার। তারপর বোঝা দরকার, গত আড়াই বছরে আমার জীবনে আসলে কী ঘটেছে।

সাধারণত আমার প্রতিটা চলচ্চিত্রের পর আমি দুই বা তিন বছরের একটা বিরতি নিয়ে থাকি। তাই একটামাত্র ব্যপার নিয়ে আমি সত্যি সত্যি ভাবছি, আগামী তিন বছর শুধু বিশ্রাম। আমার এটা সত্যিই প্রয়োজন।
দ্য টকস :: বার্ডম্যান ও দ্য রেভেন্যান্ট-এর মতো সিনেমাতে অর্থায়নের জন্য কি আরনন মিলখানের মতো (মিডিয়া) মোগলকে চাই, যিনি আগে ওয়ানস আপোন অ্যা টাইম ইন আমেরিকা ও ব্রাজিল-এর মতো সিনেমার পাশে ছিলেন; যার জন্য এই ধরনের উচ্চাভিলাষী চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণ সম্ভব হয়েছে?
ইনারিতু :: নিঃসন্দেহে। আপনার এই রকম একজনকে প্রয়োজন যার সেই প্যাশনটা আছে একটা বিশেষ স্বাদের প্রতি; যিনি কি না একজন শিল্পপ্রেমী ও পাগলালাটে লোক– ইতিবাচক অর্থে। এই রকম একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে সবকিছুই একইসঙ্গে দরকার।
দ্য টকস :: বাকিরা সবাই কি টাকা নিয়ে একটু বেশি মাথা ঘামান?
…
যখন
সবকিছু
শুধু লাভের
খাতিরেই ঘটতে
থাকে, তখন চলচ্চিত্র
একটা পণ্য
হয়ে যায়
…
ইনারিতু :: সেইজন্যই তো এইরকম ফিল্ম আর তেমনভাবে তৈরি হচ্ছে না। কারণ যারা এখন সিনেমার সঙ্গে জড়িত, তাদের অধিকাংশই এমন অর্থবিনিয়োগকারী– যাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো মুনাফা অর্জন করা। আর যখন সবকিছু শুধু লাভের খাতিরেই ঘটতে থাকে, তখন চলচ্চিত্র একটা পণ্য হয়ে যায় অথবা একটা আরামদায়ক প্রোডাক্ট– যেটা কারও ধার ধারে না এবং যেভাবেই হোক যত বেশি দর্শককে আনা সম্ভব (সেটাই লক্ষ্য থাকে)। তাই সেটা একটা বিপজ্জনক অবস্থা। আমরা এখন এই অবস্থার মধ্যেই রয়েছি। লাভই শেষ কথা, একমাত্র কথা।
আমি অতো সহজসরল নই যে ভাবব, আগে ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। এটা সবসময়ই এইরকমই ছিল; কিন্তু এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি মাত্রায়।
দ্য টকস :: পেছনে তাকিয়ে কি মনে হয় দ্য রেভেন্যান্ট-এর মতো করে আরেকটা সিনেমা বানাতে কখনো চাইবেন?
ইনারিতু :: এটা করে ফেলেছি বলে আমার এ নিয়ে কোনো অনুতাপ নেই। আমি মনে করি, যেসব পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গিয়েছি, তার গুরুত্ব আছে। আমি খুবই গর্বিত। কিন্তু আরেকবার এভাবে সিনেমা বানাতে চাইব না… হাহাহা…!

কাজটা ভয়াবহ কঠিন ছিল। এক্সট্রিমলি, অতিমাত্রায় ডিমান্ডিং। টিকে থাকার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছিল, আসলেই। ফিল্মমেকার হিসাবে, আমি এমনসব মুহূর্তের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, যেগুলো খুবই কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং ছিল।
দ্য টকস :: এমনসব মুহূর্তে আপনি কীভাবে আশার আলো দেখেন?
ইনারিতু :: যখন আপনি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবেন এবং বুঝতে পারবেন, যেভাবে কাজটা করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিছুতেই সেভাবে করতে পারছেন না, তখনো আপনাকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। দেখবেন, হুট করেই একটা গুটির দানে সবকিছু জায়গামতো খাপ খেয়ে যাবে। যেটা কাজ করছিল না, আচানক সেগুলো সব চলতে শুরু করে দেবে। যখন আপনি দিনের একটা ভয়ানক মুহূর্তের মধ্যে থাকবেন এবং কোনো কিছুই ঠিকমতো হচ্ছে না বলে অনুভব করবেন চরম নৈরাশ্য, তখনো হাল ছাড়বেন না। দেখবেন, হঠাৎ সব ঠিকমতো ঘটতে শুরু করে দিয়েছে! এ যেন এক অলৌকিক কাণ্ড।
সূত্র: দ্য টকস। অনলাইন ইন্টারভিউ জার্নাল