লিখেছেন: রওশন আরা মুক্তা

লাল মোরগের ঝুঁটি
Call of the Red Rooster
কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: নূরুল আলম আতিক
প্রযোজক: মাতিয়া বানু শুকু
অভিনয়: লায়লা হাসান, আহমেদ রুবেল, আশনা হাবিব ভাবনা, অশোক বেপারী, আশীষ খন্দকার, জয়রাজ, শিল্পী সরকার, ইলোরা গওহর, জ্যোতিকা জ্যোতি, দিলরুবা দোয়েল, স্বাগতা, শাহজাহান সম্রাট, অনন্ত মুনির, দীপক সুমন, খলিলুর রহমান কাদেরী, সৈকত, যুবায়ের
চিত্রগ্রহণ: সুমন সরকার, কাশেফ শাহবাজী, মাজাহারুল ইসলাম
সম্পাদনা: সামির আহমেদ
শব্দ: সুকান্ত মজুমদার
সংগীত: রাশিদ শরীফ শোয়েব
শিল্প নির্দেশনা: লিটন কর, ওয়াদুদ রেইনি
ভাষা: বাংলা, উর্দু
দেশ: বাংলাদেশ
মুক্তি: ১০ ডিসেম্বর ২০২১
সিনেমাটা দেখার আগেই ভাবছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে নির্মিত, তাই নামের সাথে, রাগী মোরগের চেহারার সাথে মিলিয়ে ধরে নেয়া যায়, লাল মোরগের ঝুঁটি প্রতিবাদী মানুষদের রূপক আকারে দেখার সুযোগ আছে। পরবর্তীকালে এটা দেখার প্রতিক্রিয়ায় এমনটাই ধরে নিয়েছেন অনেকে– নানা খবর-লেখা পড়ে বুঝতে পারলাম। যদিও ফিল্মটি সাদাকালো, তবু মোরগ লাল ছিল না কালো ছিল সেই প্রশ্ন দেখতে গিয়ে মাথায় আসেনি। বরং মনের চোখ সেটিকে লালই দেখছিল। এমনকি মোরগের ঝুঁটিটাও লাল টকটকে দেখেছি!
কোনো সন্দেহ নাই, সাদাকালো ফিল্মে লাল দেখানোর এই কৃতিত্ব নির্মাতারই। সাদাকালো পর্দায় লাল দেখানোর এই নির্মাণ কৌশলই অতীতের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাকে দর্শকের চেতনায় বর্তমান অনুমানের ছবি দেখায়। নূরুল আলম আতিক পরিচালিত সরকারি অনুদানের ‘মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা’ লাল মোরগের ঝুঁটি অনুচ্চারিত আরও কী কী দেখালো ও বললো আমাদের, সেটাই লিখে রাখছি।
…
যদিও লাল মোরগের ঝুঁটি
অতীতের ঘটনার
চিত্রায়ণ; তবু
একে
সময়হীন
বাস্তবতার এক
দুনিয়া দেখার মাধ্যম
হিসেবে গ্রহণ করা যায়
…
তবে এই ছবি আমি অতীত বা বর্তমান দিয়ে না, বরং সময়হীন বাস্তবতা দিয়ে দেখতে আগ্রহী। তিন-চার বছর আগে এক কন্যা তার মৃত্যু আলিঙ্গনে থাকা বাবার সাথে ফোনে লাস্ট কনভারসেশনে বলেছিল, ‘আব্বু তুমি কান্না করতেছ যে?’ সেই কন্যার চোখ দিয়ে দেখলে সময়হীন বাস্তবতার চেহারা স্পষ্ট হতে পারে; অথবা, বুয়েটের আবরারের পরিবারের চোখ দিয়ে যদি দেখি তাতেও স্পষ্ট হয় সময়হীন বাস্তবতা কাকে বলে। যদিও লাল মোরগের ঝুঁটি অতীতের ঘটনার চিত্রায়ণ; তবু একে সময়হীন বাস্তবতার এক দুনিয়া দেখার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা যায়। এই ছবি মুক্তিযুদ্ধের– সেটা ভুলে গিয়ে নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেখি যদি, কী দেখা যায়?
এক. ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা অস্ত্রবাজ কিছু মানুষ,
দুই. তাদের সেবায় নিয়োজিত কিছু লোভী মানুষ,
তিন. কিছু প্রতিবাদী মানুষ– তাদের অসহায় পরিবার, এবং
চার. কিছু সাধারণ মানুষ।
এবার বর্তমানে এসে নিজেকে কোন দলে ফেলতে পারেন, হিসাব করে নিন– এই চিন্তাটা সাদাকালো হলেও, নানা রঙের চিন্তার খোরাক এই ছবির প্রায় প্রতিটি চরিত্রায়ণে ছিল।
ধরণী বাবু, হিন্দুমানুষ তার গালভর্তি দাড়ি; অন্যদিকে তার বন্ধু সাহেব আলী, নিয়মিত চাছা গাল তার, সে হলো মুসলমান। একে সমাজে ব্যক্তি স্বাধীনতা চর্চার চিত্র বোঝার চরিত্রায়ণ বলাই যায়। এটা আরও পরিষ্কার হয় যখন শুনি, পাকিস্তানি মিলিটারি অফিসার এক নতুন রাজাকারকে বলছে, ‘তুম মুসলমান হো, তো তুমহারা দাড়ি কাহা হ্যায়?’ হাস্যকর (ভয়ানক) ব্যাপার হলো, সেই অফিসারেরও দাড়ি ছিল না।

কারও ওপর ক্ষমতার চর্চার শুরুই হয় তার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। ‘এই তোমার চুল বড় কেন?’ ‘তোমার চুল ছোট কেন?’ চুলে রঙ কেন?’, ‘ওড়না কই?’ এইসব মন্তব্য হরহামেশাই শুনি আমরা। এসব প্রশ্ন বা মন্তব্যগুলো তো শুধু অপরপক্ষকে নাজেহালের জন্যই। সামাজিক পরিসরে, ছেলের শ্বশুরকে ‘কেন নামাজ পড়েন না’– এ প্রশ্ন করা যায়, মেয়ের শ্বশুরকে করা যায় না। স্বাভাবিক মনে হলেও, এর গোড়া কিন্তু ক্ষমতা চর্চাতেই নিহিত। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কেউ যে নিয়ম কারও ওপর চাপাচ্ছে, সেই নিয়ম সে নিজেই মানছে না। অর্থাৎ সে আইনের ঊর্ধ্বেই নয় শুধু, সে নিজেই আইন!
ধরণী বাবু ও তার স্ত্রীকে গাছের সাথে বেঁধে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়, সে আগুন দেখা যায় না, আমরা শুধু কিছু আর্তনাদ শুনি। এখানেও পরিচালকের মুন্সিয়ানা, আগুন দেখা গেল না কিন্তু পুড়ে ছাই হয়ে গেল! অদৃশ্য এ আগুন শুধু বড় পর্দায় না, আপনার-আমার চেনা পরিধিতে সবখানে এ আগুন জ্বলছে, মানুষ এমনই কয়লা হচ্ছে এখনও। মুক্তিযুদ্ধ শেষ, আমরা জয়ী– এই ভেবে, সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরি আমরা, শান্তিতে ঘুম যাই।
…
সিনেমাটা
আগুন না দেখিয়েও
অনেক আগুন দেখিয়ে
দিতে পারে
আপনাকে
…
জ্যান্ত পুড়ে মরার সময়ের চিৎকারগুলো আপনার কানে বাজতে থাকবে, মনে পড়ে যেতে পারে: এই তো গেল বছর শুধুমাত্র ফায়ার এক্সিট না থাকায়, নিয়ম মেনে ভবন না বানানোর কারণে কিছু লোভী মানুষের অবহেলায় সেজান জুসের কারখানায় জ্যান্ত পুড়ে মরেছে ৫২ জন মানুষ! তাজরিন, ট্রাম্পাকো আরও কত কারখানায় কত অগ্নিকাণ্ডে কত তাজা প্রাণ এভাবে পুড়ে গেছে এই স্বাধীন বাংলাদেশে! সিনেমাটা আগুন না দেখিয়েও অনেক আগুন দেখিয়ে দিতে পারে আপনাকে। পর্দায় এই আড়াল, বা না দেখিয়েও দেখানো, এবং না বলেও বলার ভঙ্গিই আমাদের চেতনায় শত চিন্তার মালা গেঁথে দেয়।
সাহেব আলীর মেয়ে রেবা, তার এক পায়ে নূপুর পরা থাকে। নুপুরের রিনঝিন শব্দ পাওয়া যায় তার চলাফেরায়। সে যখন পালাতে চায়, তখনও তার পায়ে নূপুর থাকে, মিলিটারির হাতে ধরা পড়া, নির্যাতিত হওয়া এবং শেষ পর্যন্তও তার পায়ে একটা নূপুর দেখা যায়। বেশ ভাবাচ্ছিল এ বিষয়টা। এখানে দুটো সঙ্কট: এক পর্যায়ে নূপুর নেই দেখা গেলে কন্টিনিউয়েশন ব্রেক হয়, আবার নূপুর এত টানা-হ্যাচড়াতেও বহাল থাকাও তো অস্বাভাবিক। এমনকি এক পর্যায়ে এ চরিত্রের হাত বন্ধনমুক্তও দেখা যায়। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, সে নিজেও তো খুলে ফেললো না তার নূপুর?

আমি ছবিটা দেখি ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। পরদিন যথারীতি কর্মযজ্ঞ শেষে ঘরে ফিরছিলাম। পরপর দুইটি রাস্তায় ৭/৮টি ট্রাক দেখলাম। লাল সবুজ কাপড় পরিহিত, বিজয় দিবসের ক্যাপ পরা নারী-পুরুষরা হুল্লোর করছে। বেশ ভালো স্পিডে চলছে শকটগুলো। সেই সাথে ধুম-ধারাক্কা মিউজিক। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপন বলে কথা! হুট করেই ট্রাকে থাকা নারীদের পায়ের নূপুরের স্পষ্ট রিনিঝিনি শব্দ শুনে ফেললাম ঐ ভীড়ের মধ্যেও, ওমন বিকট সাউন্ড সিস্টেমের মধ্যেও। তখনই রেবার পরিচয় ধরা দিল আমার কাছে। বিজয় দিবস উদযাপন করা ওই ট্রাকের মেয়েটা হয়তো আবার কোনো এক কারখানার আগুনে ‘মানুষের’ অবহেলায় পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে; আমাদের তার নূপুর দেখেই চিনে নিতে হবে– এটা এক নারীর লাশ।
সৈয়দপুর বিমানবন্দর তৈরির সময় সাধারণ মানুষদের ধরে এনে বন্দি রেখে তাদের দিয়ে নির্মাণকাজ চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। অনাহারে-অর্ধাহারে একের পর এক শ্রমিকরা অসুস্থ হতে থাকে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই লাল মোরগের ঝুঁটির গল্পের বিস্তার। ছবিতে দেখি এই ক্ষমতাবাজ মিলিটারিগুলো সাধারণ মানুষদের মুরগীগুলোকেও ছাড়ে না; আস্ত রোস্ট করে বীভৎসভাবে খায়। এ বছর চালু হতে চাওয়া রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য উচ্ছেদ করা হয়েছিল প্রায় আট হাজার মানুষকে। ওরা সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতো, কেউ পশুর নদীতে মাছ ধরতো। ওদেরকে শুধু উচ্ছেদই করা হয়নি, স্বীকারও করা হয়নি এ উচ্ছেদের কথা। অর্থাৎ তারা তাদের জমি থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং কোনো ক্ষতিপূরণও পায়নি। আর নির্মিত সেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন আছে কিনা, সেটা নাকি আবারও ভেবে দেখা হচ্ছে। আমার চোখে আস্ত মুরগীর রোস্ট চিবানোর কিছু বীভৎস ছবি ভেসে ওঠে! লাল মোরগের ঝুঁটি লাফায়।

সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম করে, তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে, তাদের ঋণের দায়ে জর্জরিত করে, এরপর তাদের শ্রম নামমাত্র মূল্যে কিনে নেই আমরা– পদ্মা সেতু বানাই, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাই। ভাগ্য বিড়ম্বিত এ সমস্ত সাধারণ মানুষের রক্ত পানি করা উন্নয়নের ছবি ছাপি বড় রাস্তার মোড়ে।
হয় তুমি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, নতুবা তোমাকে মরতে হবে। সাহেব আলী ‘জয় বাংলা’ বলায় গুলি করে মারা হয় তাকে। যুদ্ধগুলো এমনই। ডব্লিউ. বুশও বলেছিল, ‘হয় তুমি সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের পক্ষে, অথবা তুমি আমাদের শত্রু।’ ক্ষমতাবানের এই সাদাকালো ভেদের চক্করে বহু লাল-নীল রঙ মারা পড়ে– সাদাকালো লাল মোরগের ঝুঁটি এমনই দেখালো। অনন্ত এক মুক্তিযুদ্ধের কথাই শোনাল এ সিনেমা।