সাক্ষাৎকার: কলিন কেলসি
অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
অনুবাদকের নোট
৯ ডিসেম্বর ২০২১। চিরতরে চোখ বুজলেন ইতালিয়ান মাস্টার ফিল্মমেকার লিনা ভের্তমুলার। ১৪ আগস্ট ১৯২৮ জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। দীর্ঘ আয়ুর ক্যারিয়ারে, ১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকে ২০০০-এর দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত সচল ছিলেন ফিল্মমেকার হিসেবে। বানিয়েছেন ‘সেভেন বিউটিস’, ‘দ্য সিডাকশন অব মিমি’, ‘লাভ অ্যান্ড অ্যানার্কি’, ‘সুইপ্ট অ্যাওয়ে’র মতো মাস্টারপিস সিনেমা। পেয়েছেন অস্কার। বছর চারেক আগে, ১৪ এপ্রিল ২০১৭-তে ‘ইন্টারভিউ ম্যাগাজিন’-এ প্রকাশিত তার একটি সাক্ষাৎকার হাজির করা হলো এখানে…

কলিন কেলসি :: আপনি কি এখনো রাজনৈতিক বিষয়আশয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত?
লিনা ভের্তমুলার :: গণমাধ্যম ও সংবাদপত্র মারফত এখনো রাজনীতির খবর রাখি, তবে নিজে এতে সম্পৃক্ত নই। যদিও আমার সিনেমাগুলো রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত, তবে নিজেকে কখনোই কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক আন্দোলন কিংবা দলের সঙ্গে জড়াইনি। আমার সম্পৃক্ততা এ ক্ষেত্রে বরাবরই একটি বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে।
কেলসি :: আপনাকে ঘিরে বানানো ভালেরিও রুইজের ডকুমেন্টারিতে [বিহাইন্ড দ্য হোয়াইট গ্লাসেস; ২০১৫] আপনি বলেছেন, আপনার পক্ষে অভিনেত্রী হওয়ার সম্ভবনা থাকলেও ফিল্মমেকার হয়ে ওঠাটাই ছিল বেশি স্বাভাবিক। নিজের পক্ষে ফিল্মমেকিংই মানানসই– এই উপলব্ধি কখন হলো?
লিনা :: পিয়েত্রো শারোফ থিয়েটার একাডেমিতে পড়াকালে ক্যারিয়ার শুরু আমার। শুরুর দিকেই বেছে নিয়েছিলাম ফিল্মমেকার হওয়ার পথ। নিজের প্রথম সিনেমাটি বানানোর আগে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে বহু বছর কাজ করেছি। এ সময়ে ফেদেরিকো ফেল্লিনির সান্নিধ্যে আসার দারুণ সুযোগ ঘটে। কোন মুহূর্তে সেটি ঘটেছিল– এখন আর ঠিকঠাক মনে পড়ে না। ভবিষ্যতে ফিল্মমেকারই হতে চাই– সম্ভবত এই আকাঙ্ক্ষা আমার ভেতর সবসময়ই ছিল।
কেলসি :: থিয়েটারে আপনার প্রথম দিকের কাজগুলো সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে?
লিনা :: থিয়েটারে কাজের অভিজ্ঞতা আমাকে অভিনেতা সামলানোর ক্ষেত্রে বেশ দারুণ প্রস্তুতি এনে দিয়েছিল। আমি সবসময়ই অভিনেতাদের নিয়ে বহুদিন রিহার্সাল করার মাধ্যমে সিনেমার প্রস্তুতি নিয়েছি। একদম প্রথম দিকের সিনেমাগুলো থেকেই, অভিনেতাদের সঙ্গে চিত্রনাট্য পড়া ও প্রতিটি দৃশ্যের রিহার্সাল করার পেছনে সবসময় অন্তত ৪০ দিন করে সময় ব্যয় করেছি। অভিনয়ে ইমপ্রোভাইজেশনও আমার পছন্দ; আর সেটি সম্ভবত নিজের থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেই পেয়েছি।

কেলসি :: ফেল্লিনির সঙ্গে প্রথম দেখা হয় কখন? তার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল? অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে তার ৮ ১/২ সিনেমায় কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
লিনা :: বন্ধু ফ্লোরা কারাবেল্লা ও মার্সেল্লো মাস্ত্রোইয়ান্নির মাধ্যমে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা আমার ক্ষেত্রে আলোকবর্তিকা হয়ে কাজে দিয়েছে। ফেদেরিকোকে আমার কাছে একজন জাদুকর, ইমেজের একজন সত্যিকারের কবি বলে মনে হয়। তার মতো কোনো প্রতিভাধর মেধাবির কাছ থেকে কিছু শেখা সম্ভব নয়; বরং তার কাজ করার ধরনের প্রতি সুনির্দিষ্ট মুগ্ধতা অনুভব করা সম্ভব।
কেলসি :: ৮ ১/২-এর বেশির ভাগ ক্রু আপনার প্রথম সিনেমা দ্য লিজার্ডস-এ কাজ করেছেন। সিনেমাটি আপনি দক্ষিণাঞ্চলে বানিয়েছেন। আপনার আরও অনেক সিনেমাতেই দক্ষিণাঞ্চলীয় মানুষের চরিত্র কিংবা ওইসব অঞ্চল জায়গা করে নিয়েছে। এর সঙ্গে আপনার সংযোগটি কী?
লিনা :: দ্য লিজার্ডস সিনেমাটির প্রেক্ষাপট (ইতালির) আপুলিয়া ও বাজিলিকাতা অঞ্চল। আমার দাদার পরিবার এসেছে ইতালিয়ান দক্ষিণাঞ্চল, নির্দিষ্ট করে বললে– (বাজিলিকাতার) পালাজ্জো সান গেরভাসিও শহর থেকে। ওই ছোট শহরেই আমি নিজের প্রথম সিনেমার কিছু অংশের শুট করেছি। ইতালির রৌদ্রোজ্জ্বল অঞ্চলগুলো আমার বরাবরই প্রিয়। সমুদ্র ও সূর্যের আলো ভরা ওই লোকেশনের প্রতি আমার এক ধরনের সহজাত টান রয়েছে।

কেলসি :: তবু, রুইজের ডকুমেন্টারিতে আপনি যেমনটা বলেছেন, ‘আপনার স্বভাব’ গড়ে দিয়েছে আসলে নিজের ‘দুটি আত্মা’– হালকা ও গুরুতর মেজাজের। আরও বলেছেন, শুধু সমাজসচেতন ফিল্মমেকার হিসেবেই নয়, বরং একজন ‘আমোদপ্রিয় ফিল্মমেকার’ হিসেবেও যেন আপনাকে গণ্য করা হয়। আপনার সিনেমাগুলোতে, সেগুলোর থিম, সাবজেক্ট ইত্যাদিতে এর প্রভাব কতটুকু? নিয়মনীতি সম্পর্কে আপনার ভাবনা কী?
…
কঠোর নিয়মমালার ক্ষেত্রে
সৃজনশীল বিশৃঙ্খলা
আমার পছন্দ
…
লিনা :: আমার আত্মা দুটি: একটি সমাজসচেতন, অন্যটি হালকা মেজাজের। আমার সিনেমাগুলোতে এই দুই আত্মার দেখা বরাবরই মেলে। কেননা, ট্রাজেডি ও হিউমার, আয়রনি ও সার্কাজম, কমেডি ও ড্রামার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আমার উদ্ভট স্টাইলটির ভেতর এগুলো নিখুঁতভাবে মানিয়ে যায়। আমি আরও মনে করি, নিয়ম বানানোই হয় ভেঙে দেওয়ার জন্য; বিশেষত শিল্পের ক্ষেত্রে! কঠোর নিয়মমালার ক্ষেত্রে সৃজনশীল বিশৃঙ্খলা আমার পছন্দ।
কেলসি :: অন্তত আমার কাছে সুইপ্ট অ্যাওয়েকে ‘পারসোনাল ইজ পলিটিক্যাল’ আইডিয়াটির একটি মনোমুগ্ধকর প্ররোচনাদায়ক উদাহরণ বলে মনে হয়। সিনেমাটিতে এই আইডিয়ার বিকাশ আপনি কীভাবে ঘটালেন?
লিনা :: আমি আমার স্বামী এনরিকো ও কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে তখন (ইতালির) সারদিনিয়া দ্বীপে একটি পালতোলা নৌকায় সপ্তাহখানেক সময় কাটাচ্ছিলাম। সেই ছুটি কাটানোর কালে আমার মাথায় আইডিয়াটি এলো, আর সঙ্গে সঙ্গে লিখে রাখলাম। আমি বরাবরই মাত্র কয়েক সপ্তাহেই সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলি। জনমানবশূন্য দ্বীপের আইডিয়াটি আমার মনে এক ধরনের গভীর অনুভূতি এনে দিয়েছিল। কোনো বিধান নেই, কোনো আইন নেই, শুধু জেন্নারিনো ও রাফফায়েল্লার [চরিত্র] ভালোবাসাই যেখানে অস্তিত্বমান– এমন একটি দুনিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে এটি।
কেলসি :: যৌনতা ও রাজনীতি যখন একাকার হয়ে যায়, এর ফল তখন এমন বিস্ফোরক হয়ে ওঠে– এমনটা কেন মনে করেন আপনি? ইতালিতে পৌরুষের জয়গানের যে সংস্কৃতি রয়েছে, সেটিকে নিয়েও ব্যঙ্গাত্মকভাবে প্রচুর মজা কুড়িয়েছেন আপনি।
…
আয়রনি
আমার বিশ্বস্ত
সহচর
…
লিনা :: হ্যাঁ, লাভ অ্যান্ড অ্যানার্কি সিনেমায় ফ্যাসিবাদের বর্ণনা করতে গিয়ে প্রচুর আয়রনির ব্যবহার করেছি। আয়রনি আমার বিশ্বস্ত সহচর। এটি আমাকে মানবসত্তার কলঙ্ক ও ত্রুটিগুলো ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে। আপনার প্রশ্নসূত্রে বলি, এটি দুটি [যৌনতা ও রাজনীতি] টপিক সবসময়ই দর্শকের মনে কৌতুহল ও বিদ্বেষবোধ জাগিয়ে তোলে বলে আমার ধারণা।
কেলসি :: আপনার সিনেমাগুলোতে জিয়ানকার্লো জিয়ান্নিনি ও মারিয়াঞ্জেলো মেলাতোকে বারবার কাস্ট করার কারণ কী? আপনার সৃষ্ট চরিত্রগুলোতে এই দুই অভিনেতা-অভিনেতা দারুণভাবে মানানসই বলে মনে করেন কেন?
লিনা :: এর কারণ একদম সহজ: তারা দুজনই ভীষণ দারুণ অভিনয়শিল্পী! আপনি যদি একই অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে অনেকগুলো সিনেমা বানান, তাহলে তাদের সঙ্গে আপনার একটা বিশেষ বোঝাপড়া গড়ে উঠবে। নিজের চেনা-জানা ও আস্থাভাজন লোকদের নিয়ে কাজ করতে আমি পছন্দ করি। কারণটা আগেই যেমন বলেছি, শুটিং শুরুর বহুদিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে ও রিহার্সাল করাতে প্রচুর সময় ব্যয় করি আমি।

কেলসি :: নিজের প্রয়াত স্বামী এনরিকো [ইতালিয়ান প্রোডাকশন ডিজাইনার এনরিকো জব] আপনার সিনেমাগুলোতে দারুণসব সেট ও কস্টিউম সৃষ্টি করে গেছেন। তার সঙ্গে আপনার কাজের প্রক্রিয়া কেমন ছিল?
লিনা :: ব্যক্তিজীবনে আমি ভীষণ ভাগ্যবতী। এনরিকোর সঙ্গে জীবনের ৪০টি বছরেরও বেশি সময় কাটাতে পেরেছি। তিনি একজন বিরল দাপুটে শিল্পী; ভীষণ বিচক্ষণ ও খানিকটা মুখচোরা। নিজের শিল্পকর্মকে (প্রোডাকশন ডিজাইনার হিসেবে) থিয়েটার ও সিনেমার জগতে ছড়িয়ে দেওয়ার আগে পেইন্টার ও ভিজুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে শিল্পযাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। (আমার স্ক্রিপ্টের) তিনিই ছিলেন প্রথম পাঠক ও সমালোচক। আমাদের কাজগুলোতে সবকিছুর শুরু হতো স্কেচ থেকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দারুণসব স্কেচ এঁকে ফেলতে পারতেন তিনি। পেইন্টিং ও ড্রয়িং করে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন। তার ড্রয়িংগুলোই আমাদের (সিনেমাগুলোর) সূচনাবিন্দুর প্রতিনিধিত্ব করত; কেননা, সেগুলো এতটাই সুস্পষ্ট ও ঋদ্ধ ছিল যে, মুহূর্তেই কাহিনিটির আবহমণ্ডল ধরে ফেলা যেত। আমার সব সিনেমাতেই এনরিকোর শিল্পরুচি ছড়িয়ে রয়েছে। আমার জন্য এরচেয়ে বেশি সৌভাগ্য আর কিছুই হতে পারে না।
কলিন কেলসি :: আপনার কোনো অনুতাপ আছে?
লিনা ভের্তমুলার :: কোনো অনুতাপ নেই। আমি ভীষণ ভাগ্যবতী। এখনো বেঁচে আছি বলে ভীষণ আনন্দ হয় আমার।