লিখেছেন । সুমন সাহা
পাঞ্জাব নিয়ে গুরবিন্দরের সমসাময়িক কোনো স্মৃতি নেই, যা আছে সব সেই পার্টিশনের সময়কার।
ঠাকুরদা ছিলেন রাওয়ালপিণ্ডিতে এক চালকলের মালিক। সাতচল্লিশের আগেই অমৃতসরে শিফ্ট করেন, তবে চালকল সেই রাওয়ালপিণ্ডিতেই ছিল। অমৃতসরে বাড়িখানা ছিল মুসলিম চৌহদ্দির মধ্যে। সাতচল্লিশে দাঙ্গা লাগল, ঠাকুরমা তাই গুরবিন্দরের বাবাকে নিয়ে কাছাকাছি থাকা গোল্ডেন টেম্পলে গিয়ে লুকোলেন। বাবার বয়স তখন সদ্য দুই। ঠাকুরদা তো পড়িমড়ি করে রাওয়ালপিণ্ডি থেকে অমৃতসর ছুটে এলেন, এসে দেখলেন বাড়িতে আগুন! মনে ভয়, বুকে কান্না। শেষমেশ নিজের বউ-বাচ্চাকে গোল্ডেন টেম্পলে খুঁজে পেলেন।
ভারতজুড়ে তখন হানাহানি, দিনরাত চলছে বিশ্বাসঘাতকতার খেলা। কোথায় যাবেন, ভাবতে ভাবতে, নিজের ভাইয়ের কথা মনে পড়ল। ভাই থাকেন শিমলা। তাই বউ আর দু-বছরের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে শিমলা চলে গেলেন। তারপর গোয়ালিয়র, গঙ্গাসাগর, অসম– কাজের সূত্রে তথা পেটের টানে বিভিন্ন স্থানে।
দেশভাগের পরের পাঁচ বছর কি তার বেশি অচলাবস্থা সঙ্গী ছিলই। তারপরে দিল্লিতে এসে থিতু হলেন ও ছোটোখাটো একখান ব্যবসা খুলে বসলেন।

গুরবিন্দরের জন্ম এই দিল্লিতেই, দক্ষিণ প্রান্তে রাজৌরি গার্ডেনে। ‘দেশ’-খেদানো পাঞ্জাবিদের গড় ছিল এই রাজৌরি। ওখানে ওর প্রায় সকলেরই মুখে মুখে পার্টিশন-পূর্ববর্তী পাঞ্জাবের কথা। তবে গুরবিন্দর যেহেতু দেশভাগের অনেকটাই পরে জন্মেছেন [১৯৭৩], তাই পাঞ্জাব নিয়ে তথা দেশভাগ নিয়ে কোনো স্মৃতিই ওর নেই। পাঞ্জাবি জানেন না। ছোটোবেলা থেকেই ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা। সাহিত্যও পড়েছেন ইংরেজিতেই, দেশিগুলো সব অনুবাদের সাহায্যে। তবে যখন মাথায় ফিল্ম বানানোর পোকা নড়ে উঠল, তখন মনের গহীনে একটা বিষয়েরই অনুরণন অহরহ: ‘ফিল্ম বানাব তো হিন্দিতেই বানাব।’
তবে তার জন্য তো হিন্দিতে পড়তে জানা চাই! সেই কারণে গুরবিন্দর পড়া শুরু করলেন মোহন রাকেশ, মান্টো, কৃষ্ণ বলদেব বেদ, বিনোদ কুমার শুক্ল, গজানন মাধব মুক্তিবোধের লেখাপত্তর।
…
এইভাবে কোনো উপন্যাস
এর আগে ওকে এতটা
ভাবাতে পারেনি
আর এরকম
একটা
পাঞ্জাবকে
গুরবিন্দরও এর
আগে এভাবে দেখেননি
…
লাইব্রেরিতে গিয়ে বইপত্রের খোঁজ করাকালীন গুরদয়াল সিং-এর সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। ১৯৭৬ সালে লেখা গুরদয়ালের উপন্যাস আন্হে ঘোড়ে দা দান পড়ে তো গুরবিন্দরের যাকে বলে একপ্রকার মেটামরফসিস ঘটল। পাঞ্জাবি ভাষাটা জানা ছিল না; গুরদয়ালের খান পাঁচ-ছয়েক বই পড়েছিলেন, তাও সেসব হিন্দি অনুবাদে। কিন্তু গুরবিন্দরের খেয়াল হলো, এইভাবে কোনো উপন্যাস এর আগে ওকে এতটা ভাবাতে পারেনি আর এরকম একটা পাঞ্জাবকে গুরবিন্দরও এর আগে এভাবে দেখেননি। এমন ধরনের চরিত্র, এমন সব সমস্যা, এমন সব গ্রাম্য প্রেক্ষাপট। গুরদয়ালের শৈলী অনেকটাই চেখভের মতো– আবহ, মুড ও প্রেক্ষাপটের দিক থেকে। তখন থেকেই বলা চলে গুরবিন্দরের মনের গভীরে আন্হে ঘোড়ে দা দান কোথাও একটা সুপ্ত অবস্থায় রয়ে গেল।
এমন এক পাঞ্জাবের প্রতি গুরবিন্দরের আকাঙ্ক্ষা গড়ে উঠল, যে পাঞ্জাবকে তিনি কখনো দেখেননি, রূপ-রস-গন্ধ টের পাননি; অথচ জানেন জন্মগতভাবে সেই রাজ্যের সঙ্গে ওর আছে নাড়ির টান। পরে যখন গুরবিন্দরের সঙ্গে গুরদয়াল সিং-এর দেখা হয়, তখন গুরদয়াল ওকে ১৯৭০-এর দশকের এক অন্য পাঞ্জাবের গল্প শোনান। ৭০-এর দশকে গুরদয়াল ভাতিন্ডায় এক কলেজে অধ্যাপনা করতেন। সেই সময়ে তিনি যে কালপ্রবাহ লক্ষ করেছিলেন, সেসবই জায়গা করে দিয়েছিলেন নিজের সাহিত্যে: পাঞ্জাব জুড়ে থার্মাল পাওয়ার প্লান্টের গড়ে উঠতে থাকা, রেলওয়ে লাইনের জমাট বাঁধা, ক্যানালের জন্য জমি কোপানো– এমন সব নিত্য নতুন বিষয় ঘটতে লাগল। নেহেরুর সময়কার পরিকাঠামো উন্নয়নের শেষ লগ্ন তখন। পাঞ্জাব বদলে যাচ্ছিল চোখের পলকে

২
পাঞ্জাব কেবল সাহিত্যের হাত ধরেই গুরবিন্দরের জীবনে জোড়েনি। সংগীতেরও ভূমিকা আছে অনেকটাই। গুরবিন্দরকে সংগীতই একপ্রকার পাঞ্জাবের বুকের কাছাকাছি আসতে সাহায্য করে। না, গান গেয়ে নয়; বরং গান ভালোবেসে।
কম বয়সে আশা সিং মস্তানা, সুরিন্দর কৌর শুনে বড়ো হওয়া। তাঁদের গানের ভাষা ছিল লোকসংগীতের– অথচ তাঁরা সেই সময়ে বেশ জনপ্রিয় রেডিয়ো আর্টিস্টও ছিলেন। সেই সময় নব্য প্রচলিত হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতেন। পাকিস্তান থেকে কেউ গুরবিন্দরকে এনে দিয়েছিল ‘কিস্সা’র ক্যাসেট। কিস্সা হচ্ছে পাঞ্জাবি ভাষায় মৌখিক গল্প বলার ঐতিহ্য, যা একদা আরব ও সমসাময়িক ইরান থেকে স্থানীয় ব্যক্তি ও অভিবাসীদের সংমিশ্রণে দক্ষিণ এশিয়ায় এসেছিল। যে সময় ক্যাসেট হিসাবে কিস্সা অমনিবাসের সংস্পর্শে আসা, সেই সময়েই পাঞ্জাবি লোকসংগীতের বিভিন্ন বাজনা নিয়ে লেখা অলকা পাণ্ডের গবেষণামূলক বইও পড়ার সুযোগ আসে। ভালোবাসা ও কৌতূহল এতটাই তুঙ্গে ওঠে যে, ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টস [India Foundation For The Arts– IFA]-এ আবেদন জানিয়ে ফেলেন দুই-বছরের অনুদানের জন্য, যাতে কিস্সা গায়কদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে তাদের কাজকম্ম, রোজনামচা ইত্যাদি ক্যামেরায় ধরতে পারেন। অনুদান পেয়ে যান।
তারপর বছর খানেক ধরে এইসব গায়কদের দলের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। পয়সার ভান্ডার একটা সময় ফুরুত হয়, তবে IFA-র কাছে আবার আবেদন করায় কাজ চালানোর মতো কিছু টাকা-পয়সা মিলেও যায়। এইভাবে টানা চার কি পাঁচ বছর চলে। মাঝে মধ্যে কোনো এক সাউন্ড রেকর্ডিস্টকে সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে পড়া– কখনো কোনো মেলাতে, বা কোনো দরগা বা কোনো বিয়েবাড়িতে যাওয়া। সুফিয়ানা চামড়ায় মিশে যাওয়ার সেই শুরু।
সুফি কিস্সা গায়করা সকলেই মুসলিম, তবে তারা সুফি সাধকদের ব্যাপারে যেমন গান গাইতেন, তেমনিভাবে হীরও গাইতেন, যা সুফি ঐতিহ্যের অঙ্গ। শিখ কিস্সা গায়করা প্রাথমিকভাবে মুসলিমই ছিলেন, তবে পরে ধর্ম পরিবর্তন করে এবং গাওয়া শুরু করে শিখ যোদ্ধাদের বিষয়ে। কিস্সাই বিভিন্ন ছোটো-বড়ো কিস্সাকে আপন করে নেয়।
ওই ভ্রাম্যমাণ জীবনপর্বে গুরবিন্দরের সঙ্গে যাদের পরিচয় ছিল, তারা প্রত্যেকেই ছিলেন তথাকথিত নিচু জাতের লোকজন। কিস্সা গায়কদের মধ্যে বাল্মীকি, মাজহাবি জাতের সুফি-শিখ ছিলেন। কিস্সা শুনতেন চাষি-সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা, মূলত শিখরাই। দেশভাগের পরে, পাঞ্জাবের দরগাগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কিন্তু কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এই হিন্দু ও শিখরাই। দরগাগুলো বেঁচে ছিল তাদেরই ভালোবাসায়।
ছবি তোলার জন্য চার-পাঁচ বছর ধরে এত র’ মেটিরিয়াল জমে গিয়েছিল যে প্রথমে তো গুরবিন্দরের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল সেগুলো সংকলন ও সম্পাদন করতে গিয়ে! এসব জটিলতায় না গিয়ে অবশেষে তিনি কেবল একজন ব্যক্তির উপরেই মূল গুরুত্ব ঢেলে দেন, যার সঙ্গে বেশির ভাগ মুহূর্ত ওর এতদিন কেটেছে ছবি তোলার সময়– নাম তার পালা, যার নামেই ছবিরও নাম [Pala; 2003]।
এইভাবে প্রথমবারের মতো পাঞ্জাবকে কাছাকাছি গিয়ে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করা। এমনই একটা সময় অনেকদিন আগে পড়া গুরদয়াল সিং-এর আন্হে ঘোড়ে দা দান-এর চরিত্রগুলোর ভূত গুরবিন্দরের মাথায় এসে ঘাঁ মারে। চরিত্রগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্ব, জাতিপ্রথার নিরিখে তাদের অবস্থান গুরবিন্দরের মনে কোলাহল তোলে।
…
জাতপাতের
ভেদাভেদকে বাদ
দিয়ে পাঞ্জাবের গল্প
বলা সম্ভব
নয়
…
জাতপাতের ভেদাভেদকে বাদ দিয়ে পাঞ্জাবের গল্প বলা সম্ভব নয়। গ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকায় নোংরা দশায় বাস করবে নিচু জাতের লোকজন, অন্যদিকে গ্রামের প্রধান অঞ্চলগুলোতে রাজকীয় সব বাড়িতে বাস করবে উঁচু জাতের লোকজন– যেন হিসাবটা বড্ড সহজ! ধর্মীয় স্থান গুরুদ্বারেও চরম ভেদাভেদ। নিচু জাতের ব্যক্তিদের টেকনিক্যালি বাধা দেওয়া হতো না, তবে অন্য বিভিন্ন টেকনিকে গুরুদ্বারের মধ্যে অচ্ছুত করে রাখা হতো। উঁচু জাতের ভিড়ে নিচু জাত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারত না, সেকেন্ড ক্লাস হয়ে থাকতে হতো। তাই হয়তো একান্ত নিরুপায় হয়েই নিচু জাতের লোকজনেরা মিলে গ্রামে গ্রামে নিজস্ব গুরুদ্বার চালু করেন। অবলা শ্রেণির গুরুদ্বার।
এভাবেই ১৯৯৯ সালে প্রথমবার পড়া উপন্যাসকে ২০০৯ সালে স্ক্রিপ্টে রূপান্তরিত করা। এবং ২০১১-এর মধ্যে সিনেমার রূপ দেওয়া।
…
রুক্ষ
ক্লান্ত বিশ্বায়নের
প্রবল দাবদাহে মুছে যাওয়া
পাঞ্জাব গুরবিন্দরকে বারবার
পিছু টানতে
থাকে
…
ছবিটা বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে ঘোরাফেরা করে ওই সময়। আবু ধাবি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘স্পেশ্যাল জুড়ি অ্যাওয়ার্ড’, গোয়ায় আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অফ ইন্ডিয়ায় সেরা ছবি হিসাবে ‘গোল্ডেন পিকক’ জেতে। সেরা পরিচালনা, সেরা সিনেমাটোগ্রাফি ও সেরা পাঞ্জাবি ফিল্ম হিসাবে জাতীয় পুরষ্কার পায়। কিন্তু রুক্ষ ক্লান্ত বিশ্বায়নের প্রবল দাবদাহে মুছে যাওয়া পাঞ্জাব গুরবিন্দরকে বারবার পিছু টানতে থাকে।
২০১১-তে তোলা আন্হে ঘোড়ে দা দান [Anhe Ghore Da Daan/ Alms for a Blind Horse] প্রথম ফিচার ফিল্ম, আর দ্বিতীয় ফিচার ফিল্ম ২০১৫-তে তোলা চৌথি কূট [Chauthi Koot/ The Fourth Direction]। আশির দশকে শিখ উগ্রবাদ ও পাঞ্জাবের কিছু সাধারণ মানুষের এক বাস্তবধর্মী আখ্যান। বৈরাম সিং সাধুর দুটো ছোটোগল্পের উপর ভিত্তি করে এই ছবি বানানো। ছবিটা কানের আনসার্টেন রিগার্ডস বিভাগে দেখানো হয়। চৌথি কূট বেলগ্রেড ফিল্ম ফেস্টে ‘গ্র্যান্ড প্রিক্স’, সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টে সেরা এশিয়ান ফিচার ফিল্মের জন্য ‘সিলভার স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড’ ও মুম্বই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা ভারতীয় ছবি হিসাবে ‘গোল্ডেন গেটওয়ে’ পায়। জাতীয় পুরষ্কার লাভ করে সেরা পাঞ্জাবি ছবি হিসাবে।
পরের বছর [২০১৬] এক টার্কিশ প্রোডাকশন হাউজ তাকে ইন দ্য সেম গার্ডেন [In The Same Garden] শিরোনামের দশটি দেশের দশটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের একটি আন্তর্জাতিক সংকলনের অংশ হিসাবে শর্ট ফিল্ম ইনফিল্ট্রেটর [Ghuspaithia/ Infiltrator] পরিচালনা করার আমন্ত্রণ জানায়।
এই ২০১৬-তেই, জনপ্রিয় পাঞ্জাবি কবি ও বন্ধু অমরজিৎ চন্দনের উপরে গুরবিন্দর ৪৫ মিনিটের এক ট্রাভেলগ ফিল্ম তুলে ফেলেন, নাম দেয় আওয়াজে [Awaazan/ Voices]।

২০১৬-তেই আরেকটা বিস্ময়-জাগানো কাজ করেন এই ছেলে। মার্কেজের ছোটোগল্পের উপরে ভিত্তি করে ৪৫ মিনিটের এক পরীক্ষামূলক ছবি বানান, নাম দেন সি অফ লস্ট টাইম [Sea of Lost Time]। কিন্তু ছবিটা অসমাপ্ত অবস্থায় ছেড়ে দিতে হয়। ছবিটা FTII-এর স্টুডেন্টদের নিয়ে বানানো এক গ্র্যাজুয়েশন ফিল্ম। যেহেতু গুরবিন্দর আগে এখানে পড়েছেন, পড়িয়েছেন, তাই ছবিটা নির্দেশনা করার আমন্ত্রণ পান। কিন্তু সেই সময়ে, অর্থাৎ ২০১৫-২০১৬ নাগাদ FTII-এর চেয়ারম্যান পদে বিজেপি সদস্য ও প্রাক্তন অভিনেতা গজেন্দ্র চৌহানের নিয়োগ হওয়াকালীন একদল পড়ুয়া পথ জুড়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করা শুরু করেন। এর জন্য পুলিশি জুলুম থেকে ইনস্টিটিউটের ভেতরকার রাজনীতির কদর্য মুখোশেরও মুখোমুখি হতে হয় ওদের। সেই সময়ে বরখাস্ত হওয়া এক ছাত্রের সপক্ষে কথা বলায় গুরবিন্দরকে এই প্রোজেক্ট থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয় এবং প্রোজেক্টটাও স্থগিত করে দেওয়া হয়। কিন্তু গুরবিন্দর ২০১৯ নাগাদ এই আধা-ভাঙা কাজটাই এডিট করে রটারডাম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ‘ল্যাবরেটরি অফ আনসিন বিউটি’ বিভাগে পাঠিয়ে দেন।
এই ২০১৯-এ তৃতীয় ফিচার ফিল্মও বানিয়ে ফেলেন: খানুর [Khanaur/ Bitter Chestnut]। ভাষাটা হিমাচল প্রদেশের ‘পাহাড়ি’ বাচন।
চতুর্থ ফিচার ফিল্ম আঁধ চাঁদনি রাত [Adh Chanani Raat/ Crescent Night] ২০২২-এ মুক্তির অপেক্ষায়।
৩
রাজনৈতিক ছবি বানান না, কারণ সিনেমা ও পলিটিক্স দুটো ভিন্ন মাধ্যম। তবে FTII-এর সঙ্গে বিরোধিতা প্রসঙ্গে বেশ সবাক: ‘FTII-এর সঙ্গে আমার দ্বন্দ্বের কারণ তারা সবসময় তরুণ, সরল শিক্ষার্থীদের ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে চলে, যেন তারাই সর্বেসর্বা, শিক্ষার্থীরা কিচ্ছু নাহ্! যখন আদুর [গোপালকৃষ্ণন] বা গিরিশ [কারনাড] ওখানে পড়াতেন, তখন আমাদের এসব সমস্যা ছিল না। শীর্ষস্থানে অদক্ষ ব্যক্তিদের জায়গা দিলে এমনটাই হয়।’
কিংবা বাহুবলী চলচ্চিত্র সম্পর্কে ছেলের স্পষ্ট নির্ভীক বক্তব্য: ‘বাহুবলী ছবিটা হিন্দুত্বের উগ্র বহিঃপ্রকাশ। আমার মতে এটি কোনো যোগ্য সিনেমা নয় এবং যখন বলা হয় এটি সেই বছর ভারতে বানানো সবচেয়ে সেরা সিনেমা, সেক্ষেত্রে আমার আপত্তি আছে। এছাড়াও এই বছরেই বিজেপি ক্ষমতায় আসে, তাই তারা ছবিটার মাধ্যমে তাদের উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শগত ঝোঁকে বাড়তি শক্তি যোগানোর চেষ্টা করেছিল বলেই মনে হয়। ব্যাপারটা মোটেও ভালো নয়।’
একটা সময় আভা-গার্দ ফিল্মমেকার মণি কৌলের খুব কাছাকাছি থেকেছেন এই ছেলে। ‘ইমেজের ভূত’ মগজ থেকে বের করে দিতে সাহায্য করেছিলেন মণি কৌলই। ইমেজের ভূত, পার্থিব মাধ্যম হিসাবে সিনেমা, সময়, চেতনা নিয়ে গুরবিন্দরের বক্তব্য: ‘তিনি [মণি কৌল] আমার মন থেকে ইমেজের ভূত তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার মতে সিনেমা কোনো ভিজুয়াল মাধ্যম নয়, বরং সিনেমা এক পার্থিব মাধ্যম। এটা অনেকটা সংগীতের মতো, অনেকটা সময়ের মতো। স্পেসে উন্মোচিত হতে পারে, কিন্তু এটা একপ্রকার সময়ের ভিন্নরূপ। সম্পাদনার স্বাভাবিক উপায় হলো দর্শক যখনই তথ্য সম্পর্কে অবগত হন, তখনই কাট করা হয়। কিন্তু আপনি যদি তথ্য পাওয়ার পরেই কাট না ঘটান, যদি চান দর্শক কোনো কিছুকে আরেকটু মন দিয়ে দেখুক, তথ্য উপলব্ধ করার পরে তাদের মধ্যে সেসব প্রতিবিম্বিত করাতে চান, তাহলে দর্শক হঠাৎ করে বহমান সময় সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। ব্যাপারটা বিপরীতভাবেও কার্যকরি হয়– দর্শকের তরফে তথ্য সম্পূর্ণভাবে আত্মস্থ করার আগেই যদি আপনি কোনো দৃশ্য কেটে দেন, সেক্ষেত্রেও দর্শক সময় সম্পর্কে সচেতন হয়ে যান: সম্পূর্ণভাবে দেখতে না পাওয়ার ফলে কী হলো, তা বোঝাই গেল না। ক্যামেরার মধ্যে দিয়ে জগতটাকে দেখার ক্ষেত্রে আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি পরিবর্তন এনেছিলেন।’
এবং সিনেমায় শব্দের ভূমিকা প্রসঙ্গে গুরবিন্দর বলেন: ‘ভিজুয়ালভাবে শব্দের উপস্থাপনের উৎস স্ক্রিনে দেখানো উচিত নয়। আপনাকে স্ক্রিনে অবশ্যই ফ্রেমের ঘেরাটোপের বাইরে থাকা জগত গড়ে তুলতে হবে। সম্পূর্ণভাবে এরকম এক অনুশীলন ছিল আন্হে ঘোড়ে। বর্তমানে আমি যখন স্ক্রিপ্ট লিখি, তখন সেইসব শব্দগুলি নিয়ে বেশি চিন্তা করি, যেগুলি প্রত্যেকটা শটের স্তরে গভীরতা যোগ করবে: দূর থেকে, কাছ থেকে বা এমন কোনো শব্দ, যা ডিস্টার্বিং। কারণ আপনার স্ক্রিনে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি মাত্র ইমেজ থাকতে পারে, কিন্তু আপনার কাছে অসংখ্য শব্দ ব্যবহার করার সুযোগ আছে।’

ফিল্মোগ্রাফি
• পালা [Pala; ২০০৩; পাঞ্জাবি; ৬৫ মিনিট]
• লেগস অ্যাবোভ মাই ফিট [Legs Above My Feet; ২০০৭; ইংরেজি ও হিন্দি; ৪০ মিনিট]
• কাভালাম [Kavalam; ২০০৯; মালায়ালাম ও ইংরেজি; ৬০ মিনিট]
• আন্হে ঘোড়ে দা দান [Alms for a Blind Horse; ২০১১; পাঞ্জাবি; ১১৩ মিনিট]
• চৌথি কূট [The Fourth Direction; ২০১৫; পাঞ্জাবি; ১১৫ মিনিট]
• আওয়াজে [Voices; ২০১৬; পাঞ্জাবি; ৪৫ মিনিট]
• ইনফিল্ট্রেটর [Ghuspaithia; ২০১৬; পাঞ্জাবি; ১৬ মিনিট]
• সি অব লস্ট টাইম [Sea of Lost Time; ২০১৯; হিন্দি; ৪৫ মিনিট]
• খানুর [Bitter Chestnut; ২০১৯; পাহাড়ি, হিন্দি ও ইংরেজি; ১০০ মিনিট]
• আঁধ চাঁদনি রাত [Crescent Night; ২০২২; পাঞ্জাবি; ১০৯ মিনিট]