সাক্ষাৎকার: গ্যারি ক্রোডাস ও ড্যান জিওরগাকাস
ভূমিকা ও অনুবাদ: আসিফ রহমান সৈকত
ভূমিকা
এমিল ডি আন্তোনিও [১৯২০–১৯৮৯] যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়ার এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মার্ক্সবাদে দীক্ষিত প্রথম দিকের লোক তিনি। অনেক রকম কাজ করার পর (বার্জ ক্যপ্টেন, শিক্ষক এবং সমুদ্র বন্দরের কাজে লং-শোর-মেন হিসাবে), ১৯৬৪ সালে (৪৪বছর বয়সে) ফিল্মের লাইনে আসেন; ম্যাককার্থির শুনানির ওপর একটা কম্পাইলেশনের কাজ করেন, যেটার নাম পয়েন্ট অব অর্ডার!
এর পর তিনি তার বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে অনেকগুলো ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। যার মধ্যে আছে ইন দ্য ইয়ার অব দ্য পিগ [১৯৬৯], যে চলচ্চিত্র ভিয়েতনাম যুদ্ধের ওপর নির্মিত; মিলহাউস: অ্যা ওয়াইট কমিডি [১৯৭১], যেখানে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল; আন্ডারগ্রাউন্ড [১৯৭৬]– কট্টর পুঁজিবাদবিরোধী আবহাওয়াবিদদের আন্ডারগ্রাউন্ড আন্দোলনের ওপরে নির্মিত। আরেকটা হলো পেইন্টারস পেইন্টিং [১৯৭২], অন্যভাবে দেখলে একটা অপরিচিত ঢঙের ডকুমেন্টারি, যার বিষয় ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী ‘নিউইয়র্ক স্কুল অব পেইন্টারে’র অবস্থা।
মৃত্যুর ঠিক আগে আগে তিনি মিস্টার হুভার অ্যান্ড মি নামে একটি আত্ম-প্রতিকৃতিমূলক ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেন, যা তার নিজের ওপর এফবিআই’র [ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন] করা ১০ হাজার পাতার একটা রিপোর্টের ভিত্তিতে বানানো। ওই এফবিআই ডকুমেন্টগুলো তিনি তথ্য অধিকার আইনের ভিত্তিতে আইনজীবীর মাধ্যমে যোগাড় করেন।

সাক্ষাৎকার
গ্যারি ক্রোডাস/ড্যান জিওরগাকাস :: ইন দ্য ইয়ার অব দ্য পিগ-এর মতো একটা কম্পাইলেশন ডকুমেন্টারি করার ব্যপারে কীভাবে জড়িয়ে গেলেন? আগেই ভেবে রাখা কোনো পলিটিকাল থিসিসের ওপর ভিত্তি করে এটা বানাতে চেয়েছিলেন? নাকি কাজটা করার জন্য আগে আপনি ফিল্ম রিসার্চ করে তারপর এই বিষয়ে পাওয়া যায়– এই রকম একটা ন্যরেটিভ লাইন ঠিক করেছেন?
এমিল ডি আন্তোনিও :: আমি সচেতনভাবেই আমার সব কাজ বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে করেছি। আজকের দিনে পরিষ্কারভাবে মার্কসবাদী বা এই সম্পর্কীয় বিষয় নিয়ে কথা বলা অনেক কঠিন; কিন্তু এটা ১৯৬৭ সালের দিকে আরেকটু বেশি পরিষ্কার ব্যপার ছিল, যখন আমি পিগ সিনেমাটা শুরু করেছিলাম। রাগ, ক্ষোভ আর গভীর আবেগ থেকে এই সিনেমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
তবে আমি জানতাম, এই সবকিছুই অনেক গুরুত্বপূর্ণ; কেননা এগুলো মোটিভেশন হিসাবে কাজ করে, আর কাজটা ভুল হিসাবে পরিগণিত হবে –যদি ফিল্মে ঠিকমতো সব কিছু লক্ষ্য রাখা না হয়। কারণ আপনি শুধু একটা চিৎকার দিয়ে শেষ করে ফেলতে পারেন সিনেমাটা; একটা পোস্টার, যেটা চিৎকার করে বলে– ‘ভিয়েতনাম ছাড়ো!’
আমার কাছে মনে হলো, সবচেয়ে আবেগপূর্ণ বক্তব্য হতে পারে সেটাই, যদি এমন একটা সিনেমা বানাই– যেটিতে ভিয়েতনামের ইতিহাসকে ফুটেজের মধ্য দিয়ে যত আগের সময়ে যেতে পারা যায়, যেখানে পুরো যুদ্ধটার ইতিহাস ভালোমতো ফুটে উঠবে। একেবারে এর প্রথম দিককার সময় থেকে টেট অফেন্সিভ [উত্তর ভিয়েতনামিজদের দক্ষিণ ভিয়েতনামের শতাধিক শহর ও ফাঁড়িতে একটি সমন্বিত আক্রমণ] পর্যন্ত যেটা ১৯৬৮ সালে হয়েছিল, যে বছরে আমি আমার সিনেমাটার কাজ শেষ করি।
প্রথমে আমি ভিয়েতনামবিষয়ক প্রায় ২০০ বই– যেগুলো ফ্রেঞ্চ আর ইংরেজিতে লেখা– সবগুলো পড়ে ফেলি। আমি বুঝতে পারি, এ কাজ করতে করতে আমার পক্ষে নিজের চলচ্চিত্রের ইমেজগুলো খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আজকের দিনে অনেকেই কম্পাইলেশন-ডকুমেন্টারি বানাতে চান, যারা আসেন অ্যান্টি-ইন্টেলেকচুয়াল জেনারেশন থেকে, কিংবা যাদের কোনো ধরনের ইতিহাস সংক্রান্ত বোধজ্ঞান নাই। তারা প্রাথমিক মোটিভেশনটা পান বিভিন্ন ফ্ল্যাশি ইমেজ [ছাড়া ছাড়া জানাশোনা থেকে], নয়তো সাধারণভাবে প্রচলিত পূর্বধারণা থেকে– যেখানে আসলে তাদের দরকার ছিল ইতিহাসভিত্তিক জানাশোনা থেকে আলোড়নটা তোলার, যেগুলো আসলেই চলচ্চিত্রায়ণের যোগ্য।
গ্যারি/ড্যান :: অন্যভাবে বললে, আপনি আপনার ইমেজগুলোকে কিংবা নিজের সাধারণ একটা দৃশ্য খুঁজে পেতে পড়াশোনা শেষ হবার পর নিজেকে নিয়োজিত করেন– যেখানে কিছু চলচ্চিত্র নির্মাতা মনে করেন, তারা প্রচুর আর্কাইভাল ফুটেজ ঘাঁটাঘাঁটি করবেন এবং সেখান থেকেই খুঁজে বের করবেন নিজের সিনেমা।
ডি আন্তোনিও :: ঠিক তাই। আমি মনে করি, আপনাকে এই ধরনের কাজের জন্য ভয়াবহ রকমের হোমওয়ার্ক করতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।তারপর আমি সবগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করে সেই বিষয়ের ওপর একটা অগোছালো খসড়া তৈরি করি। আমি জানতাম, একটা ঐতিহাসিক ঘটনার ধারা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি, যদিও সেটার কালানুক্রমিক ধারা হওয়া জরুরি নয়। আমার এক বন্ধুর বাক্সের কারখানা আছে; তিনি আমাকে রোল করে মোড়ানো অনেক কাগজ দিতেন, যেগুলো একেকটি ফুট লম্বা। আমি কাগজগুলোকে আমার অফিসের দেয়ালে সেঁটে রাখতাম।
হয়তো শুরু করতাম ‘হান ডাইনেস্টি’ কথাটা লিখে, যদিও জানতাম, হান ডাইনাস্টি সম্পর্কে আমার চলচ্চিত্রে কিছুই দেখাব না; তবু যেহেতু চাইনিজ অভিজ্ঞতাটা আসলে তো সেখান থেকেই শুরু! আমি অবশ্যই লিখে ফেলব, ‘দিয়েন বিয়েন ফু, ১৯৫৪, মে, ৮’ এবং অন্যান্য ঝাপসা ধারণা– যেমন ‘অত্যাচার’, ‘অমানবিকতা’ এবং অন্যান্য বিষয়– যেগুলো আমাকে আগ্রহী করে তোলে।
কখনো কখনো আমি সেখানে ওই সম্পর্কিত ছবিও জুড়ে দিতাম, যাতে দেয়ালে লেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে একটা ভিজুয়াল ইমেজও থাকে। পুরো আউটলাইনটা দাঁড়িয়ে যেতেই আমি ব্যাপক গবেষণার দিকে এগিয়ে গেলাম। যেমন ধরুন, আমি প্রাগে গিয়েছিলাম, যেখানে এনএলএফ-এর [ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট] প্রধান কার্যালয় ছিল; তারা আমাকে প্রচুর ফুটেজ দিয়ে সাহায্য করলেন। আমি পূর্ব জার্মানিতে গিয়ে সোভিয়েতদের সঙ্গে দেখা করলাম, যারা আমাকে রোমান কারমেনের করা ‘দিয়েন বিয়েন ফু’র কাজগুলো দিয়েছিলেন।
কথা প্রসঙ্গে বলতে চাই, অধিকাংশ মানুষ যারা ইন দ্য ইয়ার অব পিগ দেখেছেন, তারা ভেবেছিলেন এ সত্যি সত্যিই দিয়েন বিয়েন ফু’র যুদ্ধ, যদিও আসলে এটা খুবই দুঃখের ব্যাপার, যখন ভালো গবেষণার ফলটা পাওয়া যায়!
…
তাদের
প্রত্যেকেরই
পোশাক খুবই
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন,
এবং পোর্টের দিকে
এমনভাবে দৌড়াচ্ছিল,
যেন কোনো মেজর পেছন
থেকে তাদেরকে অর্ডার দিচ্ছে
…
আজকাল যখন আমার ফিল্মটা নিয়ে বক্তৃতা দেই, দর্শকদেরকে বলি, ‘আপনার আরেকটু ভালো করে এগুলো দেখবেন; কারণ যদি আপনারা চলচ্চিত্রটাতে ভিয়েতমিন ট্রুপদেরকে ভালো করে দেখেন, তাহলে জানবেন, তারা আসলে এই যুদ্ধের মধ্যে ছিল না। তাদের প্রত্যেকেরই পোশাক খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, এবং পোর্টের দিকে এমনভাবে দৌড়াচ্ছিল, যেন কোনো মেজর পেছন থেকে তাদেরকে অর্ডার দিচ্ছে।’
তারপরেও, ফুটেজগুলো সুন্দর ছিল, এবং আমার মনে হয়, আমি ঠিকঠাক সেগুলো ব্যবহার করতে পেরেছি। কারণ আমি সেখান থেকে কেটে আসল ফুটেজ যোগ করেছি– যেখানে সব সাদা মুখগুলো হলুদ মুখগুলোর কাছে আত্মসমর্পন করছিল, যেটা ওই যুদ্ধের অন্যতম প্রতীক।
প্যারিসে থাকা হ্যানয়ের [ভিয়েতনাম] মানুষদের সঙ্গে আমি দেখা করি এবং প্রথম পশ্চিমা লোক হিসাবে অসাধারণ একটা ফিল্ম হাতে পাই, যার নাম– দ্য লাইফ অব হো চি মিন, যেটা আসলে ভিয়েতনামিদের দৃষ্টিকোণ থেকে হো’র কথা, যেখানে আছে পরিবারসহ তার একেবারে শুরুর দিকের স্থিরচিত্র এবং ফ্রেঞ্চ কমিউনিস্ট পার্টিতে তার যোগ দেবার অসাধারণ সব ফুটেজ [১৯২২ সালের]।
এই রকম জিনিসই আমার পছন্দ। আমি ফ্রেঞ্চ আর্মির ফিল্ম লাইব্রেরিতেও যেতে পেরেছিলাম, যেখানে ভিয়েতনামের ওপর সবচেয়ে সেরা ফুটেজগুলোর সংগ্রহ রয়েছে। এটা আরও পুরনো সময়, ১৯০২ সালের কথা। সেখানে আমি পিয়ের শোয়েনডোরফারের দারুণ সব ফুটেজ দেখেছি, যেগুলো কেউ আগে কখনোই দেখেনি। তিনি ভিয়েতনামে সার্জেন্ট ছিলেন, ক্যামেরা ক্রুদের প্রধানও; এবং উনার তোলা কিছু ফুটেজ, যেগুলো যুদ্ধের সময় জঙ্গলে ট্যাংকের যে যুদ্ধগুলো হয়েছিল, সেগুলো আমার দেখা দারুণ ফুটেজ। তিনি অনেকগুলো ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিলেন, যার মধ্যে আছে লা ৩৭৫-ইয়েম সিকশিউ [La 317ème Section] এবং দ্য এন্ডারসন প্লাটুন।
…
যখন হো জাহাজটা ছেড়ে চলে
আসছিলেন, ফরাসিরা
তাকে স্যলুট দিয়ে
বিদায় দিলেন
…
পিগ ফিল্মে একটা সুন্দর শট আছে, যেটা আপনি এই দেশে পাবেন না। দেশের বাইরে অবস্থানের সময়ে, ব্যাটলক্রুজার রিশিউতে হো চি মিনের সঙ্গে ভিয়েতনামের ফ্রেঞ্চ কমিশনার এডমিরাল দারঝলিউ’র ভিডিও। সেটা ছিল তাদের কথাবার্তার শেষ, সত্যিই একটা ভালো প্রতীকী দৃশ্য। কারণ যুদ্ধটা এখন সত্যি শেষ হয়ে এসেছে এবং যখন হো জাহাজটা ছেড়ে চলে আসছিলেন, ফরাসিরা তাকে স্যলুট দিয়ে বিদায় দিলেন। তিনি সিগারেট বের করে মুখে স্বভাবগত সচরাচর ভঙ্গিমায় দিকটা উল্টো করলেন।
আমাকে এই শটটা পেতেই হবে, তাই ছেলেটাকে বললাম, ‘শুনো,আমি এটা চুরি করব। কিছু মনে না করলে, তুমি কি কিছু সময়ের জন্য একটু বাইরে চলে যাবে? কারণ আমি চাই না এইসবের মধ্যে তোমাকে জড়ানো হোক।‘
তারপর আমি রোল থেকে আমার দরকারি শটটা, ৩৫ মিলিমিটারের নেগেটিভটা কেটে আমার রেইনকোটের পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম। আমি এখন বুঝতে পারছি, যেহেতু তারা আমার পরিচয় জানত, তাই গেটে যারা বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা আমাকে আটকানোর একটা ভালো ঝুঁকি ছিল; তাতে আমি পাঁচ বছরের জন্য ফ্রান্সে আটকা পড়তে পারতাম। কিন্তু ভেবে দেখেছিলাম, মূল্যবান এই রকম একটা জিনিসের জন্য এমন ঝুঁকি নেওয়া যেতেই পারে। কেননা, চলচ্চিত্র নির্মাণ মানেই ঝুঁকি নেওয়া।

যে বিষয় আমাকে আসলে অবাক করেছিল, সেটা হলো– যদিও টিভি নেটওয়ার্কগুলো একের পর এক ভিয়েতনামবিষয়ক খবর প্রচার করে এবং অন্যান্যরা ভিয়েতনাম বিষয়ে ফিল্ম বানিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তারা কেউ ওই ফুটেজগুলো খুঁজে পায়নি, যেগুলো আমি পরে পিগ সিনেমাতে ব্যবহার করেছিলাম। আমি অনেকগুলো দারুণ দৃশ্য যোগ করেছিলাম যেগুলো কেউ আগে কখনো ব্যবহার করেননি, যার মধ্যে আছে পুরো ফিল্মের অন্যতম সেরা দৃশ্য, যেগুলো ১৯৩০-এর দশক থেকে নেওয়া।
সেখানে দেখা যায়, ভয়ংকর অহংকারী ফরাসি কিছু লোক তাদের কলোনিয়াল টুপি ও সাদা স্যুট পরে বসে আছেন। তারা একটু আগেই ওই জায়গাতে ভিয়েতনামিদের রিকশায় চড়ে এসেছিলেন। রিকশাওয়ালারা রিকশা নিয়ে ক্যাফের সামনে হাজির হলেন– যেখানে একজন লম্বা ধরনের মরোক্কান লোক মাথায় মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী লালটুপি পরে দাঁড়িয়েছিলেন।
…
মরক্কোর লোকটা তাদেরকে
আবর্জনার মতো দূর
দূর করে তাড়িয়ে
দেন
…
এ দৃশ্য পুরো ফরাসি কলোনিয়ান সাম্রাজ্যবাদের ব্যাপারটা একবারে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে এবং যখন ভিয়েতনামি রিকশা শ্রমিকরা তাদের পাওনা ভাড়া চেয়ে হাত বাড়িয়ে দেন, তখন সেই মরক্কোর লোকটা তাদেরকে আবর্জনার মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। আমার মতে, ঔপনিবেশিক সময়ের আচরণ সম্পর্কে তাদের যা বলার, তারা তা কোনো কথা না বলেই একটা দৃশ্যের মধ্যে বলে দিয়েছেন।
যেটা ইমেজ দিয়ে এই পৃথিবীর একেবারে গোড়ার সত্য কথা বলে, যেটা এই ইমেজ সবার সামনে উদঘাটন করে ফেলতে পারে, এখানে এমন কিছু যদি থেকে থাকে, সেটা হচ্ছে ওই রিকশাগুলোর ইমেজ। কলোনিয়ালিজমের অর্থ বোঝানোর জন্য ওই একটা দৃশ্য অনেকগুলো অধ্যায় সম্বলিত গুরুগম্ভীর যেকোনো বইয়ের সমতুল্য।
গ্যারি/ড্যান :: যারা আপনার চলচ্চিত্রটাকে ‘প্রোপাগান্ডা’ হিসাবে বাতিল করে দিচ্ছে, কী জবাব দিবেন তাদের?
ডি আন্তোনিও :: অবশ্যই চলচ্চিত্রটাতে অনেক অনেক প্রোপাগান্ডা আছে। যদিও মাঝে মাঝে আমি জানি না, প্রোপাগান্ডা ও আবেগ এবং প্রোপাগান্ডা ও রাজনীতির মধ্যে পার্থক্যটা আসলে কোথায়!
আমি চেয়েছিলাম যেন হো’কে সবার সামনে একজন ভালো মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করা যায়। সেটা খুব একটা কঠিন ছিল না। হো ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক ও মার্কসবাদী। ফিল্মে একটা দারুণ সিকোয়েন্স আছে, যেখানে হো চি মিনকে একদল বাচ্চা ঘিরে রেখেছিল এবং ড্যান ব্যারিগান ভয়েস-ওভারে বলছেন, ‘ভিয়েতনামিরা জানেন, এমন একজন নেতা থাকা কতটা বড় ব্যাপার– যিনি একেবারে সাধারণ জীবনযাপন করেন।’
আমি আরেকটা শট ব্যবহার করেছিলাম, যেখানে হো যে জায়গায় থাকতেন, তার শট রয়েছে। সেটা একটা ছোট জায়গা, যেখানে ততোধিক ছোট একটা টাইপরাইটার আছে এবং একটা এক্সট্রা ভিয়েতনামিজ স্যুট ঝুলে ছিল; জানেন তো, এটা কোনো বানানো গল্প না।

১৯৬৯ সালের মে-ডে’তে আমার ফিল্ম নিয়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা বলার সময় একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ঘটল। তখনো অবস্থা অনেকটাই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। বিক্ষোভের ধারা অব্যাহত ছিল। যদিও সেটা ছিল ১৯৬৮ সালের দাঙ্গার পরের সময়। চলচ্চিত্রটাতে আমি এমন একটা দৃশ্য দেখালাম, যেখানে স্যাম থ্রি মিসাইল আমেরিকার প্লেনগুলোকে ভূপাতিত করে দিচ্ছিল। তখনো সেখানে গন্ডগোল ছিল, যদিও সেটা ১৯৬৮ সালের দাঙ্গার পরের সময়। চলচ্চিত্রে আমি দেখালাম, স্যাম-থ্রি মিসাইল আমেরিকান প্লেনকে ভূপাতিত করছে এবং যখন প্রথম আমেরিকান প্লেনটা উপর দিয়ে উড়ে গেল, সেটার চলে যাওয়ার চিহ্ন তখনো দেখা যাচ্ছিল এবং সেটাকে গুলি করা হলো। হলভর্তি দর্শকরা হাততালি দিয়ে উঠল। আমি ভাবলাম, ‘হায় ঈশ্বর, ব্যাপারটা কেমন অদ্ভূত না? এ আমি কী করলাম!’
বলতে চাচ্ছি, আমি নিজে এয়ার ফোর্সে ছিলাম, বিমান চালিয়েছি এবং চলচ্চিত্রটার এডিটিং টেবিলে দৃশ্যগুলোর দিকে তাকিয়ে কখনোই হাততালি দিইনি। তাদের কাজটা ঠিক আছে, অবশ্যই; তবু আমার অনুভূতিটা আরেকটু বেশি জটিল এই ব্যাপারে।
গ্যারি/ড্যান :: এডিটিং করার সময় আপনার মনোভাব কেমন থাকে?
ডি আন্তোনিও :: আমিই খুবই ধীরজ। মানে, চাইলে দুই সপ্তাহে এডিটিং শেষ করতে পারি এবং সেটা হয়তো সঠিক; কিন্তু সেটা আমার নিজের চলচ্চিত্র হবে না। এডিটিংয়ের ক্ষেত্রে আমি ভীষণ খাটি; কখনোই সহজে সন্তুষ্ট হই না। পুরো ব্যপারটাকে, পুরো ফিল্মটাকে মাথায় রেখে এডিট করি। একটা দৃশ্য শেষ হবার পর পুরো ফিল্মটা শুরু থেকে আবার দেখি– কী দাঁড়াচ্ছে। নিজে পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত দৃশ্যটি নিয়ে কাজ করতেই থাকি।
উদাহরণ হিসাবে, পিগ-এর জন্য একটা যথাযথ শেষ দৃশ্য আসলেই সমস্যা হিসাবে ধরা দেয় আমার কাছে। সত্যিকারভাবে আসলে, এটা শেষ করতে আমি ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম কিছু ফুটেজ, যেগুলো হ্যানয়ের লোকজন আমাকে দিয়েছিলেন। সেগুলো নিয়ে আমি বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে খেলেছি। ওটা ছিল উত্তর ভিয়েতনামের শান্ত চুপচাপ একটা রাস্তার এবং হঠাৎ করে রাস্তাটা যেন জেগে উঠল, ভিয়েতমিনরা [ভিয়েতমিনরা হলো কমিউনিস্ট-ডমিনেটেড জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সদস্য, ১৯৪১-এ গঠিত, এবং তারা ফ্রান্সের উপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়ছিলেন। ভিয়েতমিনরা পরে ভিয়েতকংয়ে যোগ দিয়েছিলেন] এলেন এবং দৃশ্যটাতে, তারা সবাইকে চেক করতে লাগলেন।
আমি ভাবলাম, ‘হায় হায়, আমি তো একজন আমেরিকান!’ মানে, আমি তো আশা করি যেন ভিয়েতনামিরাই যুদ্ধে জিতে, আমি মনে করি আমাদের অবস্থান অনৈতিক, এবং আমি একজন মার্কসবাদী; তবে ভিয়েতনামি নই। ভিয়েতনামি ফিল্মের ক্ষেত্রে সেটাই সবচেয়ে ভালো হতে পারত; অথচ আমি একজন আমেরিকান। সিদ্ধান্ত নিলাম, যদিও আমরা আমেরিকান, ভিয়েতনামিরা আমাদেরকে শাস্তি দিতে পারেন, সেইজন্য মৃত ও আহত আমেরিকানদের ফুটেজগুলোকে নিলাম, যেখানে তাদের চোখ ব্যন্ডেজ দিয়ে বাঁধা– অন্ধ হয়ে যাওয়া, উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া আমেরিকানদের।
তারপর আমাদের গৃহযুদ্ধের একটা ভাস্কর্যের শট নিলাম– একজন অল্পবয়সী যুবকের, যে গেটিসবার্গে মারা গিয়েছিল। সেটাকে রিভার্স করে ফিল্মের নেগেটিভে যোগ করে দিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, আমার মাথায় যেটা কাজ করছিল– ভিয়েতনামে আমরা যে কারণে যুদ্ধ করছি, সেই ছেলেটা সেই কারণে ১৮৬৩ সালে জীবন দেয়নি– এটা দেখানো। তারপর দ্য ব্যাটল হিম অব দ্য রিপাবলিক-এর একটা পুরনো ভার্সন দেখালাম। আমার কাছে সেটাই ছিল উপযুক্ত সমাপ্তি; রাজনৈতিকভাবে সুসঙ্গত, সহজবোধ্য একটা সমাপ্তি…।
গ্যারি/ড্যান :: অ্যান্ডি ওয়ারহল আপনাকে নিয়ে একটা ফিল্ম বানিয়েছিলেন। সেটা কেমন?
ডি আন্তোনিও :: অ্যান্ডি আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু, তিনি পেইন্টার হিসাবে আত্মপ্রকাশেরও অনেক আগে থেকে। একদিন আমাকে বললেন, ‘ডি, আমার মনে হয় আমাদের একসঙ্গে একটা সিনেমা বানানো দরকার।’
আমি বললাম, ‘ধুর, কী বলো, অ্যান্ডি! আমরা তো বন্ধুমানুষ, কিন্তু আমি পলিটিক্যাল ফিল্ম বানাতে পছন্দ করি; আর তুমি তো ঝাকানাকা টাইপের সিনেমা বানাও।’
তারপর এক রাতে ওর সঙ্গে একটা পানশালায় দেখা হলো। আমি তখন পুরোদস্তুর মাতাল। বললাম, ‘ঠিক আছে অ্যান্ডি, চলো শুরু করি!’
তিনি বললেন, ‘কী নিয়ে শুট করব আমরা?’
বললাম, ‘আমি ২০মিনিটের মধ্যে এক কোয়ার্টার হুইস্কি খেয়ে ফেলব!’
আমি জানতাম, ওই ২২ বছরের মেরিন সেনারা এমনটা করতে গিয়ে মারা গিয়েছিল। তবে কী করছি, জানা ছিল আমার। মদ খাওয়ার ক্ষেত্রে আমি ওস্তাদ!
আমি আমার বউ আর একজন ড্রিংকিং পার্টনারের সঙ্গে অ্যান্ডির স্টুডিওতে গেলাম। তারা সবগুলো লাইট জ্বালিয়ে দিলো। আমি পায়ের ওপর পা তুলে, দেয়ালে হেলান দিয়ে জে-অ্যান্ড-বি হুইস্কির এক কোয়ার্টার খেয়ে ফেললাম, ২০ মিনিটের মধ্যেই।
সময়টা খুব বোরিং ছিল; কিছুই হচ্ছিল না। গ্লাসটা আর ভালো লাগছিল না, তাই ভেঙে ফেললাম। আমার কাছে কিছু বরফ ছিল, সেগুলোও ছুড়ে ফেললাম। অ্যান্ডি ১২০০ ফুটের ১৬ মিলিমিটারের ম্যগাজিন দিয়ে শুট করছিলেন, প্রায় ৩৫ মিনিট ধরে। যখন ম্যগাজিনটা পরিবর্তন করার সময় এলো, তার ১৫ মিনিট লাগল সেটা পরিবর্তন করতে; কেননা, এই ক্যমেরা চালানোর ব্যাপারে তার কোনো দক্ষতা ছিল না। সেজন্য, পরের রোল চালানোর আগে আগে আমি ফ্লোরে বসে ছিলাম। মানে, নিজে নিজে দাঁড়াতেও পারছিলাম না।
দেয়ালে হাত দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের গান গাচ্ছিলাম। আর করছিলাম চিৎকার ও গালিগালাজ। ব্যাপারটা একেবারেই বলার অযোগ্য, যা-তা অবস্থা!
শেষ পর্যন্ত বউ আর বন্ধুর সাহায্য নিয়ে হেঁটে বের হয়ে ঘরে ফিরলাম আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন আমি একদম সজ্ঞানে আমার উকিলকে জানালাম এবং তাকে দিয়ে অ্যান্ডিকে ফোন দিয়ে জানালাম, ‘ডি প্রদর্শনীর জন্য কোনো চুক্তি করেননি, তাই যদি ফিল্মটা কখনো দেখানো হয়, তাহলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’ অ্যান্ডির ফিল্মোগ্রাফিতে ওই ফিল্মের কথা প্রকাশ করা আছে– নাম ড্রিংক; তবে এটা কোথাও কখনো দেখানো হয়নি।

গ্যারি/ড্যান :: আপনি কীভাবে আপনার দর্শকদের উপলব্ধি করেন? কাদের জন্য ফিল্ম বানান? আপনার চলচ্চিত্রগুলো কী ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ফেলতে সক্ষম?
ডি আন্তোনিও :: মহান আমেরিকান ওয়াল্ট হুইটম্যান বলেন, একটা ভালো কবিতার জন্য আপনার অবশ্যই ভালো পাঠক লাগবে। যেহেতু আমি ইতিহাসের ব্যাপারে আগ্রহী, লম্বা সময়ের পরে আমার সিনেমাগুলোর কী অবস্থা হবে– সেটা জানার ব্যাপারে খুবই কৌতুহলী। সিনেমা যারা বানান, তারা সবাই চান, তার সিনেমা লোকে দেখুক। আমিও আমার সিনেমা দর্শকদের দেখানোর জন্য সবকিছুই করতে আগ্রহী, শুধুমাত্র সেটার কোনো ধরনের পরিবর্তন করা ছাড়া।
কিন্তু আমেরিকা ও অধিকাংশ পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোতে চলচ্চিত্র শুরুর সময় থেকেই, সেই নিকেলডিওনের দিনগুলো থেকে আজকের দিনের সবচেয়ে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা মানুষকে পর্যন্ত টেলিভিশন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটাকে আফিমের মতোই একটা বিনোদনের ব্যাপার বলে দেখা হয়। হলিউডে পুরনো একটি কথার প্রচলন আছে: ‘যদি আপনার কোনো বার্তা থাকে, তাহলে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ব্যবহার করুন।’
হ্যাঁ, ঠিক আছে, আমার সব চলচ্চিত্রেই কিছু বার্তা নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু আমি সেগুলো ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন দিয়ে পাঠাতে চাই না।
হলিউডে সিনেমা বানানোর আগে ডকুমেন্টারি বানানোর প্রক্রিয়াটা একটা শিক্ষানবিস ব্যাপার– এই ধরনের ফালতু কথাতে কখনোই বিশ্বাস নেই আমার। আমি সব সময়ই ডকুমেন্টারি বানাতে চেয়েছি। ডকুমেন্টারি ফিল্ম আমি ভালোবাসি, ডকুমেন্টারির রাজনৈতিক ঐতিহ্য ভালোবাসি, এবং ডকুমেন্টারি যে ধরনের বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারে– সেই বিষয়গুলোকেও ভালোবাসি।
সূত্র: সিনেয়াস্টা; ১৯৮২