‘ঢাকা ড্রিম’-এর খেরো খাতা

225
ঢাকা ড্রিম

লিখেছেন: প্রসূন রহমান

শুরুর কথা: ১

মিথ্যা নাকি ৩ প্রকারের হয়। সাধারণ মিথ্যা, ডাঁহা মিথ্যা আর পরিসংখ্যান। যা হোক, একদিন দৈনিক প্রথম আলো’র প্রথম পাতায় বুয়েটের রিসার্চ থেকে একটি পরিসংখ্যান ছাপা হয়। সেখানে দেখা যায়, প্রতিদিন ঢাকা শহরে গড়ে প্রায় ১৭০০ নতুন মানুষ স্থায়ীভাবে যুক্ত হচ্ছে। তারা আসছে নানা প্রয়োজনে। বেশিরভাগ আসতে বাধ্য হচ্ছে।

তবে আমি দেখলাম, গবেষণার এই সংখ্যাতাত্ত্বিক বিষয়টি বাদ দিয়ে আমি আগ্রহী হয়ে উঠছি এর পেছনের কারণ জানতে। কেন আসে মানুষ এই শহরে? কোন স্বপ্ন নিয়ে? ঠিক কী কারণে আসতে বাধ্য হয় তারা?


কিছু
বিষয়,
কিছু ঘটনা,
কিছু কারণ মাথার
ভেতরে কেবলই
ঘুরপাক খেতে
থাকে

সে আগ্রহ থেকেই একদিন ছোট একটি টিম নিয়ে ক্যামেরাসহ রাস্তায় নেমে যাই। শতাধিক মানুষের ইন্টারভিউ করি। কমন‌ কিছু ঘটনার বাইরেও অদ্ভুত সব কারণ জানতে পারি তাদের কাছ থেকে। অনেক বৈচিত্র্যময় সেসব কারণ। সেখান থেকে কিছু বিষয় আমাকে খুব আকর্ষণ করে। কিছু বিষয়, কিছু ঘটনা, কিছু কারণ মাথার ভেতরে কেবলই ঘুরপাক খেতে থাকে।

বিষয়টি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের উপযোগী হলেও, কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমি একটি মাল্টি ন্যারেটিভ ফিকশনের জন্যে ‌প্রস্তুতি নিই।‌ আর তারপরই তৈরি হয় প্রথম চিত্রনাট্যের খসড়া।

ঢাকা ড্রিম
ঢাকা ড্রিম। ফিল্মমেকার: প্রসূন রহমান

শুরুর কথা: ২

ক্রমে আমরা জেনেছি, এককালে রিকশার শহর বলে পরিচিত ঢাকা শহর ধীরে ধীরে মানুষের শহরে পরিণত হয়েছে। ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষের বসবাস এই শহরে। কারণ, সকল কিছুর কেন্দ্র এইখানে। তাই দেশের সকল প্রান্ত থেকে নানা কারণে প্রতিদিন হাজারও স্বপ্ন নিয়ে রাজধানীর দিকে পাড়ি জমাচ্ছে হাজারও মানুষ।

ব্যবসার জন্যে, চাকরির জন্যে, শিক্ষার জন্যে, ভিক্ষার জন্যে, নদী ভাঙনে ঘর হারিয়ে, ঘূর্ণিঝড়ে বর হারিয়ে, খুন করে, গুম করে, রাগ করে, সাধ করে, নানা কারণে আসছে এই রাজধানী ঢাকা শহরে।

একটি শহরের তো ধারণক্ষমতার একটা সীমা থাকে। তাই হয়তো‌ বাসযোগ্যতার মানের দিক থেকে বিশ্বমানচিত্রে এর অবস্থান নেমে এসেছে সবচেয়ে নিচের দিকে।

কিন্তু কি হবে তাদের জন্যে, যারা সামনে আসবার প্রস্তুতি নিচ্ছে? কিছু মানুষ তো আজও এসেছে, আসবে আগামীকালও।

গল্প কথা: ১

ঢাকা ড্রিম ঢাকা বাদ দিয়ে বাকি ৬৩ জেলার যে কোনো জেলার গল্প। যে কেউ এ গল্পের সাথে নিজেকে রিলেট করতে পারবেন। এর চরিত্রগুলো সব আমাদের দেখা, আমাদের চেনা ‌চারপাশ থেকে নেওয়া। কেউ হয়তো আমাদেরই একজন।


চেষ্টা
ছিল, তাদের
চোখের দিকে
তাকিয়ে বুকের
ভেতরটা দেখবার

রাস্তায় দাঁড়ালে চোখের সামনে দিয়ে যে মানুষগুলোকে আমরা হেঁটে যেতে দেখি, তাদের সবার একটি‌ করে গল্প আছে। তাদের সবার একটি করে স্বপ্ন আছে। সবারই থাকে। স্বপ্নগুলো প্রায় একই রকম সহজ এবং মৌলিক। একটি ছবিতে তাদের ক’জনের কথা‌ আর বলা যায়। তবু চেষ্টা ছিল, তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা দেখবার। তাদের সহজ স্বপ্নগুলো ক্যামেরায় তুলে আনবার।

এইসব সাধারণ গল্পের ভেতর থেকে যদি কেউ জীবনের কোনো গভীর ভাবনার খোঁজ পায়, যাপিত জীবনের ঘটমান বর্তমানের ছায়া থেকে যদি কেউ নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার কোনো উপাদান খুঁজে পায়, তখনই হয়তো আমাদের সকল সৃজনশীল আয়োজন, সব পরিশ্রম স্বার্থক হয়ে উঠবে।

ঢাকা ড্রিম

গল্প কথা: ২

আভ্যন্তরীন বাস্তুচ্যুতি, জীবিকার প্রয়োজন এবং উন্নত জীবনের আশায় ঢাকায় আসতে‌ চাওয়া, আসতে বাধ্য হওয়া কিছু প্রান্তিক মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের গল্প ঢাকা ড্রিমঢাকা ড্রিম অন্যরকম এক ভ্রমণ অভিজ্ঞতার গল্প, যা একইসাথে পৃথক এবং সম্মিলিত।

তবে বাস্তুচ্যুতি, বিকেন্দ্রীকরণ, কিংবা স্বপ্ন ও বিভ্রমের গল্প, এসব কথা শুনতে হয়তো খানিকটা খটোমটো লাগতে পারে। সহজ করে বললে– ঢাকা ড্রিম একটি সমকালীন বাস্তবতার জীবন ঘনিষ্ঠ চালচিত্র। মাটির গন্ধমাখা চেনা মানুষদের নিয়ে একটি সহজ সরল দেশীয় সিনে-মায়া। সেখানে প্রযুক্তি ব্যবহারের যান্ত্রিক বাহুল্য নেই। আছে শুধু বুকের ভেতর ডুব দিয়ে, নতুন ভঙ্গিতে গল্প বয়ানের সামান্য নিরীক্ষা।

পুনশ্চ: ১

ঢাকা ড্রিম-এর চিত্রনাট্য ২০১৪ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত নবীন‌ নির্মাতা প্রকল্পের অধীনে চিত্রনাট্য প্রতিযোগিতায় প্রস্তাবিত ১৩৪টি চিত্রনাট্য থেকে নির্বাচিত সেরা ১০-এর একটি। নির্বাচিত ১০টি চলচ্চিত্রই বেঙ্গলের প্রযোজনায় নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই প্রকল্প স্থগিত হয়ে গেলে এবং আমার প্রথম চলচ্চিত্র সুতপার ঠিকানা মুক্তি পেয়ে গেলে, ঢাকা ড্রিম প্রকল্পটি স্বাধীনভাবে নির্মাণের প্রস্তুতি নিই।

কিন্তু অল্প অল্প করে কয়েকভাগে শুট করতে গিয়েও যথাসময়ে প্রয়োজনীয় অর্থের সংযোজন না ঘটাতে পারায়, কোনো সহ-প্রযোজক, কিংবা যথাযথ স্পন্সর/পৃষ্ঠপোষক যুক্ত করতে না পারায় কাজটি শেষ করতে প্রায় পাঁচ বছর লেগে যায়। এই দীর্ঘ সময়ে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ক্যামেরা ব্যবহারের ফলে ইমেজ যুক্তকরণে কিছু খাপছাড়া ব্যাপারও ঘটে গেছে। ভাগ্য প্রসন্ন ছিল প্রথম পর্যায়ে কোনো শিশু শিল্পী না থাকায়। নয়তো শেষ পর্যায়ে এসে শিশুটি হয়তো কিশোর হয়ে‌ যেত। শিল্পীরাও সবাই তাদের ফিটনেস ধরে রেখেছেন একইরকম।

ঢাকা ড্রিম

এর মাঝে জন্মভূমি এবং নিগ্রহকালসহ অন্য আরও কিছু কাজ শেষ হলেও ঢাকা ড্রিম-এর স্বপ্নটা কখনো মলিন হয়ে যায়নি। কখনো ফোকাস হারায়নি। তাই হয়তো শেষাবধি কাজটা শেষ হতে পেরেছে। শিল্পী, কলাকুশলীসহ সহযোদ্ধা এবং সংবাদকর্মী বন্ধুদের কাছ থেকেও অকৃপণ সহযোগিতা ‌ও নিরন্তর উৎসাহ পেয়ে এসেছি।

জেনেছিলাম, মানুষ যা তার বুকের ভেতর থেকে উচ্চারণ করে, তা সহজেই অন্যের বুকে পৌঁছায়। মানুষ যে গল্প তার ভালোবাসা দিয়ে বয়ান করে, সে গল্পও অন্যের ভালোবাসা পায়‌। আমাদের গল্পগুলো, গল্পের চরিত্রগুলো এবং তাদের সহজ স্বপ্নগুলো সেই ভালোবাসাটুকু পাক, এইটুকু প্রত্যাশা।

পুনশ্চ: ২

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শেষাবধি ২২ অক্টোবর প্রেক্ষাগৃহে আলোর মুখ দেখেছে ঢাকা ড্রিম। এর আগে কানাডার দক্ষিণ এশিয় চলচ্চিত্র উৎসব ‘ইফসা টরন্টো’তে এর আন্তর্জাতিক প্রিমিয়ার হয়। প্যান্ডেমিকের মাঝে আরও কয়েকটি উৎসবে নির্বাচিত এবং আমন্ত্রিত হলেও উৎসবগুলো ভার্চুয়াল হওয়ায় পাইরেসির ভয়ে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হয়।

ঢাকা ড্রিম

শেষ কথা

ঢাকা ড্রিম-এর নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয় কুমার বিশ্বজিতের স্টুডিওতে শিল্পী বারী সিদ্দিকী’র কণ্ঠে গান রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে। নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি হারানো এক কৃষকের বুকভাঙা হাহাকার ধরা আছে সেই গানে। আর সে গানটি চিত্রায়িত হয়েছে কৃষকের চরিত্রে অভিনয় করা অগ্রজ শিল্পী এস এম মহসীনের এর ওপর। ঘটনাক্রমে দুজন মানুষকেই আমরা হারিয়েছি আমাদের মাঝ থেকে। আমরা তাই এই সময়ে‌ দুজন মানুষকেই স্মরণ করছি শ্রদ্ধা ভরে।

নির্মাণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে ঢাকা ড্রিম নামের এই‌ স্বপ্নের সাথে যারা জড়িত হয়েছেন, ছিলেন, আছেন, তাদের সবাইকে এবং ঢাকা ড্রিম-এর সংবাদ সবার কাছে পৌছাতে যারা‌ সবসময় আমাদের পাশে ছিলেন তাদের সবার প্রতি আমার বিনীত কৃতজ্ঞতা।

জীবন মঙ্গলময় হোক। সবার জন্যে শুভকামনা।

Print Friendly, PDF & Email
লেখক ও ফিল্মমেকার; ঢাকা, বাংলাদেশ ।। ফিচার-ফিল্ম: সুতপার ঠিকানা [২০১৫]; জন্মভূমি [২০১৮]; ঢাকা ড্রিম [২০২১] । ডকু-ফিল্ম: ধান ও প্রার্থণা [২০০৮]; দ্য ওয়াল [২০০৯]; ফেরা [২০১২]; নিগ্রহকাল [২০১৯]; নদী ও নির্মাতা [২০১৯]; ব্যালাড অব রোহিঙ্গা পিপল [২০২০]; এই পুরাতন আখরগুলি [২০২০] ।। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান: ইমেশন ক্রিয়েটর ।। উপন্যাস: ধূলার অক্ষর [২০০৯]। কাব্যগল্প: ঈশ্বরের ইচ্ছে নেই বলে [২০০৯]। কলাম সংকলন: সৃজনশীলতার সংকটে স্যাটেলাইট চ্যানেল [২০১২]। ফিল্ম-বুক [সম্পাদনা]: চলচ্চিত্রযাত্রা [তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখার সংকলন]। ওয়েবসাইট: www.imationcreator.com