মূল । সাহরা করিমি
গ্রন্থনা, ভূমিকা ও অনুবাদ । আবদুল্লাহ আল দুররানী সনি
ভূমিকা
এ লেখা যখন পড়ছেন, তখন তালেবানরা কাবুল দখল করে নিয়েছে। অনেকেই আফগানিস্তান ছেড়ে পালাচ্ছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে একের পর এক মেয়েদের স্কুল। অনিশ্চয়তায় সেখানকার শিল্প সংস্কৃতি, অনিশ্চয়তায় সেখানকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। তারপরও কেউ কেউ না পালিয়ে থেকে যাচ্ছেন নিজের কৃষ্টিকালচারকে রক্ষা করতে, সাংস্কৃতিক যুদ্ধ করতে।
এমনই একজন– আফগান নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা সাহরা করিমি। চাইলেই তিনি দেশ ছেড়ে নিরাপদে পারি জামাতে পারতেন ইউরোপে। কিন্তু যোদ্ধা কি কখনো ময়দান ছেড়ে পালায়? জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন ক্যামেরাবন্দি করছেন চারপাশে ঘটে যাওয়া যত অন্যায়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে চেষ্টা তাদের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্ববাসীকে জানিয়ে সমর্থন আদায়ের। তাই তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিশ্চুপ বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন তাদের ওপর হওয়া এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটু আওয়াজ তোলার জন্য।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া এই সাহসী ফিল্মমেকারের গত কয়েক দিনের ঘটনাবহুল জীবনের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।

একটি খোলা চিঠি
১৩ আগস্ট ২০২১
বিশ্বের সকল চলচ্চিত্র সম্প্রদায়ের প্রতি, যারা সিনেমাকে, চলচ্চিত্রকে ভালোবাসেন।
আমি সাহরা করিমি, একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ১৯৬৮ সালে নির্মিত রাষ্ট্র মালিকানাধীন একমাত্র আফগান চলচ্চিত্র সংস্থার বর্তমান সাধারণ পরিচালক।
আমি ভগ্নহৃদয় এবং গভীর আশা নিয়ে আপনাদের লিখছি। আপনারা আমাদের জনগণ, বিশেষ করে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের তালেবানদের হাত থেকে রক্ষা করতে আমার সঙ্গে যোগ দিতে পারেন। গত কয়েক সপ্তাহে তালেবানরা অনেকগুলো প্রদেশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। তারা আমাদের লোকদের হত্যা করেছে, অনেক শিশুকে অপহরণ করেছে, নাবালিকাদের পুরুষদের কাছে বাল্যবধু হিসেবে বিক্রি করছে।
তারা একজন নারীকে তার পোশাকের জন্য হত্যা করেছে, এক নারীর চোখ উপড়ে ফেলেছে। তারা আমাদের প্রিয় কৌতুক অভিনেতাদের একজনকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। তারা আমাদের একজন ঐতিহাসিক কবিকে হত্যা করেছে। তারা সরকারের সংস্কৃতি ও প্রচার বিভাগের প্রধানকে হত্যা করেছে। তারা সরকারের সঙ্গে যুক্ত লোকদের গুপ্তহত্যা করছে; প্রকাশ্যে কিছু লোককে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে।
তারা কয়েক হাজার পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করেছে। পরিবারগুলো এইসব প্রদেশ থেকে পালিয়ে কাবুলের শিবিরে অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় রয়েছে। শিবিরগুলোতে লুটপাট চলছে এবং শিশুরা দুধের অভাবে মারা যাচ্ছে।
এ এক মানবিক সংকট, এবং এখনো বিশ্ব নীরব।
আমরা এই নীরবতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি; যদিও জানি, এটা ঠিক নয়। আমরা জানি, আমাদের জনগণকে পরিত্যাগ করার এই সিদ্ধান্ত ভুল, তাড়াহুড়ো করে যে সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়েছে– তা আমাদের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, তথা আমরা সব করেছি যখন আফগানরা পশ্চিমের জন্য স্নায়ুযুদ্ধ জিতেছিল। আমাদের জনগণ ভুলে গিয়েছিল তালেবান অন্ধকার যুগের কথা এবং এই ২০ বছরে দেশ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম যতটুকু এগিয়েছে, এই পরিত্যাগের ফলে আবার সব হারিয়ে যেতে পারে।
…
প্রচার
মাধ্যম,
সরকার
এবং বিশ্ব
মানবতাবাদী
সংগঠনগুলো
সুবিধাবাদীদের মতো নীরব
…
আমাদের আপনার আওয়াজ দরকার। প্রচার মাধ্যম, সরকার এবং বিশ্ব মানবতাবাদী সংগঠনগুলো সুবিধাবাদীদের মতো নীরব, মনে হচ্ছে যেন এই ‘তালেবানদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি কখনো বৈধ ছিল।’ অথচ এটা কখনোই বৈধ ছিল না। তাদের স্বীকৃতি দেওয়াটাই তাদের ক্ষমতায় ফেরার আত্মবিশ্বাস দিয়েছে।
আলোচনার পুরো প্রক্রিয়াজুড়ে তালেবানরা আমাদের জনগণের ওপর বর্বরতা চালাচ্ছে। আমার দেশের একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আমি কঠোর পরিশ্রম করে যতটুকু গড়ে তুলেছি, তার সবকিছুই ধ্বংস হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। যদি তালেবানরা ক্ষমতায় আসে, তাহলে তারা সমস্ত শিল্প নিষিদ্ধ করবে।
আমি এবং অন্যান্য চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাদের পরবর্তী নিশানা হতে পারি। তারা নারীর অধিকার কেড়ে নেবে, আমাদের অন্দরমহলে ঠেলে দেওয়া হবে এবং নীরবে আমাদের কণ্ঠস্বর, আমাদের মতপ্রকাশের অধিকার দমিয়ে দেওয়া হবে।

যখন তালেবানরা ক্ষমতায় ছিল, কোনো মেয়ে স্কুলে যেত না। এখন প্রায় ৯০ লাখের বেশি আফগান মেয়ে স্কুলে যায়। তালেবানরা যে তৃতীয় বৃহত্তম শহর হেরাত দখল করেছে, সেখানে অবিশ্বাস্যভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধেক ছাত্রী ছিল। এই অবিশ্বাস্য অর্জনগুলো সম্পর্কে বিশ্ববাসী খুব কম জানে। এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, তালেবানরা অনেক স্কুল ধ্বংস করেছে এবং ২০ লাখ মেয়ে এখন আবার স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।
আমি এই পৃথিবী বুঝি না। আমি এই নীরবতার কারণ বুঝতে পারছি না। আমি (দেশেই) থাকব এবং আমার দেশের জন্য যুদ্ধ করব; কিন্তু একা এটা করতে পারব না। আমার আপনার মতো বন্ধু দরকার। অনুগ্রহ করে আমাদের সঙ্গে কী ঘটছে তা বিশ্ববাসীকে জানাতে সাহায্য করুন। অনুগ্রহ করে আফগানিস্তানে এখন কী হচ্ছে, তা আপনার দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রচার মাধ্যমকে জানিয়ে আমাদের সাহায্য করুন। আফগানিস্তানের বাইরে আমাদের আওয়াজ হয়ে উঠুন। যদি তালেবানরা কাবুল দখল করে নেয়, তাহলে আমাদের ইন্টারনেট বা যোগাযোগের কোনো সরঞ্জাম না-ও থাকতে পারে। অনুগ্রহ করে আপনার দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের, শিল্পীদের আমাদের সমর্থনে আওয়াজ তুলতে বলুন।
…
এটা ছায়াযুদ্ধ; এটা আরোপিত
যুদ্ধ– যা তালেবানদের
সঙ্গে মার্কিন
চুক্তির
ফল
…
এটা কোনো গৃহযুদ্ধ নয়, এটা ছায়াযুদ্ধ; এটা আরোপিত যুদ্ধ– যা তালেবানদের সঙ্গে মার্কিন চুক্তির ফল। দয়া করে এই সত্যটা যতটা পারেন আপনার প্রচার মাধ্যমে প্রচার করুন এবং আপনার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের সম্পর্কে লিখুন।
বিশ্ব যেন আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয়। আফগান নারী, শিশু, শিল্পী এবং চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পক্ষ থেকে আমাদের আপনার সমর্থন ও আপনার আওয়াজ প্রয়োজন। এই সমর্থনই এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় সহায়তা করবে।
দয়া করে আমাদের দেশত্যাগ না করার জন্য সহায়তা করুন। তালেবানরা কাবুল দখল করার আগে আমাদের সাহায্য করুন। আমাদের হাতে খুব কম সময়, হয়তো দিন কয়েক। আন্তরিক ধন্যবাদ জানুন।
–ইতি,
সাহরা করিমি

কিছু টুকরো বার্তা
১৩ আগস্ট ২০২১; রাত ১১:১৯
আমার ভাই স্বল্পভাষী মানুষ। শান্ত ও চুপচাপ। আমি আজ রাতে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। ভেজা চোখে আমার দিকে অঘোরে তাকালেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে কেঁদে ফেললেন। আমি প্রথমবার আমার ভাইকে সশব্দে কেঁদে চোখের পানি ফেলতে দেখলাম। অনেক ভাই ও বাবা প্রচণ্ড ঘৃণা আর অশ্রু নিয়ে দিন পার করছেন।
১৪ আগস্ট ২০২১; রাত ১২:৫৫
আমি বিশ্ব চলচ্চিত্র নির্মাতা সম্প্রদায়ের কাছে যে বার্তা পাঠিয়েছি, তা সকল বিদেশি গণমাধ্যম প্রচার করেছে– শুধু আমাদের নিজেদের চলচ্চিত্র নির্মাতারা, বিখ্যাত বন্ধুরা, সাংবাদিকরা ছাড়া। আমরা কখনোই ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি। এই কারণেই আমাদের জন্মভূমি বিভক্ত ছিল। আমরা সংনির্ণয় এবং প্রেম-ঘৃণায় পরিপূর্ণ। না; এভাবেই আমাদের একাকীত্বের ভেতর দিন কেটে যায়।
১৪ আগস্ট ২০২১; সকাল ৮:৪৯
আহা, আত্মার জন্মভূমি, তোমার বিভাজনের শোক হৃদয়বিদারক! গতকাল পর্যন্ত আমি ভেবেছিলাম, এটা শুধু আমার বাবার মৃত্যু; কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, তোমার একাকীত্ব, তোমার বিভাজন তোমার সন্তানদের জন্য সবচেয়ে নশ্বর দুঃখ। হে স্বদেশ, হে মা, হে নবজাতক, হে প্রতিটি শহিদ…
১৪ আগস্ট ২০২১; সকাল ৮:৫২
বিশ্ব চিত্রগ্রাহকদের উদ্দেশ্যে আফগান চলচ্চিত্র নির্মাতা সাহরা করিমি: আপনার নীরবতা ভেঙে আমাদের জনগণকে রক্ষা করুন।
১৪ আগস্ট ২০২১; দুপুর ১২:০৬
তাদের ধিক্কার জানাই, যারা এই দেশকে নিয়ে ব্যবসা করেছ, চুরি করেছ, একে কলুষিত করেছ, নিজ স্বার্থে এ জাতির রক্ত বিক্রি করেছ। তুমি এই জাতিকে উৎখাত করেছ। না, তুমি জীবনের সেই মুহূর্তগুলোর দিকে তাকাবে না– যখন এই পরিস্থিতির ভেতর নিজেই নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং তরুণদের ছুঁড়ে ফেলেছিলে। যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাকে ধিক্কার জানাই। এই জন্মভূমি বিক্রি হয়ে গেছে।
১৪ আগস্ট ২০২১; রাত ৮:১৪
আমি সেই ক্লান্ত সৈনিকের মতো রয়ে গেলাম, যিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেলা পর্যন্ত কাজ করেন… এবং আশা করি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পতাকার সম্মান রাখব। কিন্তু যখন শুনি তারা চুরি করেছে, ব্যবসা করেছে, শুষে নিয়েছে এবং নিষ্ঠুরভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তখন আমার ভেতর আগুন জ্বলে ওঠে। ব্যবসায়ীরা আমাদের কোথায় নিয়ে গেছে!

১৫ আগস্ট ২০২১; রাত ১২:৩১
পৃথিবীটা খারাপ জায়গা ছিল না, আমরা দুর্ভাগা! পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ অংশে, এবং সবচেয়ে খারাপ মুহূর্তে জন্মগ্রহণ করেছি। আমরা এমন পাপের শাস্তি ভোগ করছি, যেটাতে আমাদের কোনো ভূমিকা ছিল না, এবং এটা কোনো সুখকর ব্যাপার নয়…। আমরা শুধু কষ্ট করতে এসেছি; বাঁচতে আসিনি…।
১৫ আগস্ট ২০২১; রাত ১:৩৪
যেসব প্রচার মাধ্যম এত বছর ধরে তালেবানদেরকে তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য ব্যবহার করেছে, তারা যতটা সম্ভব অগ্রগতি উপেক্ষা করেছিল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কালিমা ও কণ্ঠরোধ করার জন্য (তাদের) অভিনন্দন! আমরা মুদ্রার অপর পিঠও দেখব, যদি না আপনি সম্পূর্ণ তালেবান পন্থা অবলম্বন করেন। নিজেদের যা ছিল, তার প্রশংসা না করার জন্য আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত।
১৫ আগস্ট ২০২১; সকাল ৭:০৭
আমার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে; এবং চিরকালের জন্য দুঃখ, উদ্বেগ ও অনুশোচনার ভারে ডুবে গেছে। যদি একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন কী? উত্তর দেব: আমি আন্তরিকভাবে আমার দেশকে ভালোবাসতাম। বিশ্বাসঘাতকতা করিনি, চুরি করিনি। এত খারাপ লোকের মাঝেও আমি বিশ্বস্ত ছিলাম।
১৫ আগস্ট ২০২১; সকাল ৮:৩৭
তারা আমাদের কাজ করতে করতে দেয়নি। তারা ছোট-বড় রাষ্ট্রদ্রোহ ও ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলাম এবং প্রতিদিন সকালে অফিসে গিয়েছি। কিছু না হলেও ফুলগুলোকে দেখতে যেতাম। ওদের সম্ভাষণ জানিয়ে বলতাম, ‘আমি আপনাদের পানি দিতে এসেছি।’
১৫ আগস্ট ২০২১; সকাল ৯:৩৭
আমি মাকে ডাকলাম, মা কাঁপছিলেন। আমি ঘৃণা নিয়ে বললাম: মা আমার জন্য দোয়া করো। তিনি কেঁদেছিলেন। তুমি আমার মাকে কতটা ভালোবাসো! কাঁপানো কণ্ঠে মা, একজন দুঃখী ও নিঃসঙ্গ মা। যুদ্ধের মাঝখানে ফেলে আসা আমার মায়ের জীবন উৎসর্গ করুন। তুমি যে মাতৃভূমি নিয়ে ব্যবসা করেছ এবং তাকে বিক্রি করেছ, তারজন্য স্রষ্টা তোমাকে কখনো ক্ষমা করবেন না।
১৫ আগস্ট ২০২১; সন্ধ্যা ৬:৪৯
তালেবানরা কাবুল ঘিরে ফেলেছে। আমি কিছু টাকা তোলার জন্য ব্যাংকে যাচ্ছিলাম। তারা ব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছিল এবং সব কিছু খালি করে দিচ্ছিল। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না এমনটা ঘটেছে। দয়া করে আমাদের জন্য দোয়া করুন, আমি আবার আসব। হে বিশ্ববাসী, দয়া করে চুপ থাকবেন না, ওরা আমাদের হত্যা করতে আসছে।
১৫ আগস্ট ২০২১; সন্ধ্যা ৭:০৩
যারা কাবুলে তাদের প্রাসাদে দেহরক্ষী ও চাকর-বাকর নিয়ে বাস করছেন, তারাই শুধু সাঁজোয়া যানে পাহারা দেওয়া রাস্তাগুলো চেনেন। কাবুল! এগুলো শুধু তাদেরই অট্টালিকা। ধিক্কার দালালদের।
১৫ আগস্ট ২০২১; সন্ধ্যা ৭:১২
রাজনীতিবিদরা প্রতারণা করে. তারা ব্যবসা করে; ক্ষমতা ভাগাভাগি করে, আমাদের জীবন নিয়ে খেলে। তারা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই প্রতারক এবং মিথ্যা স্লোগান দেয়। তারা কখনোই বুঝতে পারবে না, আমি আজ ব্যাংক থেকে বাসায় দৌড়ে এসেছি; কারণ আমাকে ব্যাংকে বলা হয়েছিল, তালেবানরা এসে পড়েছে।
১৫ আগস্ট ২০২১; সন্ধ্যা ০৭:১৮
তার ছেলে কোথায়? তার বাচ্চারা সুন্দর; কিন্তু কীভাবে সে তাদের নিষ্পাপ মুখগুলো ব্যবহার করে। তুমি সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী। তুমি এমন একটি নোংরা খেলা খেলছ, যা তুমি ভালোই জানো। আমরা তোমাকে কখনো ক্ষমা করব না। এই শিশুরা এখনই বুঝবে না, তাদের বাবা এই জাতির সঙ্গে কী করেছিল।
১৫ আগস্ট ২০২১; রাত ৮:০৯
যারা আমাদের প্রতারিত করতে চায়, তারা তালেবান সরকারের ছায়ায়ও সৃষ্টিশীল কাজ করতে পারার ধারণা দেয়। শিল্প সৃষ্টি? সৃষ্টি? নিষিক্ত সংস্কৃতি? যারা এমন ভাবেন, তারা নির্বোধ। হ্যাঁ, আমরা বন্দি বা ভাড়াটে হয়ে তালেবান শাসনের অধীনে একটি সাধারণ জীবনযাপন করতেই পারি। রাজনীতিবিদদের তো কোনো মৃত্যু নেই!
১৫ আগস্ট ২০২১; রাত ৯:০৬
কাবুলের যে আকাশ সন্ধ্যায়, রাতে নীরব ছিল, গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় জানালা খুলে দিলে শীতল হাওয়া বইত, এখন তা হেলিকপ্টার, যুদ্ধবিমানের শব্দে ভরা, গোলাগুলির শব্দে মানুষের হৃদয় ভেঙে যায়। আমরা বিক্রি হয়ে গেছি!
১৫ আগস্ট ২০২১; রাত ৯:০৯
তারা পরিস্থিতিটিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, যেখানে রাজনীতিবিদরা সব সময় ব্যবসায়ীদের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকে, যাতে তালেবান ও অসভ্যদের চুরির রাস্তাঘাট তৈরি হয়, যাতে আমাদের সমস্ত পরিচয়, সংস্কৃতি, শিল্প ও ইতিহাস লুণ্ঠন করা যায়। বড় চোর, ছোট চোর– সব মিলেমিশে একাকার। আমরা জাতি হিসেবে সব সময়ই উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক, ধ্বংস ও শূন্যতার ভেতর রয়েছি।
১৫ আগস্ট ২০২১; রাত ১১:৫৬
আমি এখন এমন দৃশ্য দেখছি, যা এর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সিনেমায় দেখেছি। আমি আমার মোবাইল ফোনে ভিডিওগুলো ধারণ করছি। হে স্রষ্টা রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও চোরদের ঘর পুড়িয়ে দাও, যারা প্রতি মুহূর্তে এই শহিদ জাতিকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে। স্রষ্টা সবার মঙ্গল করুন।
১৬ আগস্ট ২০২১; রাত ১:২২
আমি আমার লোকদের মধ্যে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা দেখতে পাচ্ছি। এ এক মানবিক শোকাবহ ব্যাপার। মানুষ কাবুল বিমানবন্দরে ভিড় করেছে, হাজার হাজার মানুষ। যদি কেউ বলে তালেবানরা কাবুলে আসেনি এবং জনগণ ভয় পায় না, এবং এসবই গুজব– তাদের বিবেককে ধিক্কার জানাই। স্রষ্টা আপনার মঙ্গল করুন। আমি এইসব দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করছি।
১৬ আগস্ট ২০২১; সকাল ৮:৪৩
সকাল হয়ে গেল। সকালটা রাতের চেয়েও অন্ধকার। হতাশায় ভরা এক সকাল; যন্ত্রণাময় সকাল।
১৬ আগস্ট ২০২১; দুপুর ২:১২
আমার সমস্ত চিন্তা এক করে ভেবেছি, আমরা কেন এই অবস্থায় এসেছি। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার বোঝাপড়া সম্পূর্ণভাবে অচল। পৃথিবী কত সহজে পিছিয়ে গেল, তার দুঃখ তীব্র; এর দংশন মানুষের মস্তিষ্কে আঘাত করে এবং সত্যের সন্ধানকারী এবং অন্বেষকে চিরতরে অন্ধ করে দেয়!
১৬ আগস্ট ২০২১; দুপুর ২:৪০
আমি প্রতিদিন চিৎকার করতে চাই: সেই দিনকে অভিশাপ দেই, যেদিন বিশ্ব, অভ্যন্তরীণ এবং অপরিচিতরা চারদিক থেকে আমাদের ছুরিকাঘাত করেছে; সেই উৎখাত, গৃহহীনতা এবং দ্বারে দ্বারে যাওয়া আমাদের নিয়তি। তারা হত্যা করেছে, খেয়েছে এবং বিক্রি করেছে। আমরা একা, অসহায়, নিরাশ; আশাহীন হয়ে পড়েছিলাম।
১৬ আগস্ট ২০২১; দুপুর ২:৪৫
পৃথিবীর কোথাও আসা-যাওয়ার পথ আমাদের জন্য বন্ধ। যেখানে বিশ্ব দিন দিন অগ্রসরমান, সেখানে আমরা প্রতিদিন প্রতি সেকেন্ডে ফিরে যাই এ প্রমাণ করতে– আমরা এখনো বর্বরতা, অনগ্রসরতা ও গোঁড়ামির প্রতি আন্তরিকভাবে অনুগত। যে জাতি নিজের প্রশংসা করে না, স্রষ্টা তার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেন।
১৭ আগস্ট ২০২১; রাত ৩:৩৭
প্রিয় বন্ধুরা, চিন্তা করবেন না। আমি ভালো আছি, নিরাপদে আছি।

১৭ আগস্ট ২০২১; দুপুর ২:১০
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে পেশাদারিত্বের মোকাবেলা করতে সক্ষম হওয়ার জন্য আমি ২০ দিনের জরুরি ছুটির জন্য আবেদন করেছিলাম, যা গৃহীত হয়েছিল; যাতে আমি আমার ভাই ও তার মেয়েদের বাঁচাতে পারি। আমার ভাই গত ২৪ ঘণ্টা ধরে আমার চোখের সামনে ধুঁকে ধুঁকে মরছিলেন; তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন।
১৭ আগস্ট ২০২১; দুপুর ২:১৬
আমার ভাইয়ের পরিবার এবং আমার সহকর্মী ভোদোকে আটক করা হয়েছিল। গত তিন রাত আমরা বিমানবন্দরের গাছের আড়ালে, মাটিতে লুকিয়ে রয়েছি। স্লোভাক ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন একাডেমি, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তুর্কি দূতাবাস এবং স্লোভাকিয়ান রাষ্ট্রদূত– এদের সহায়তায় অবশেষে, ওরা আমাদের সাহায্য করার জন্য সামরিক ঘাটিতে নিয়ে যায়।
১৭ আগস্ট ২০২১; দুপুর ২:৩২
যারা মনে করে, আমার ভাতিজিদের উদ্ধার করা মানে হলো (আমার) পালানো, আমি এটা তাদের বিবেকের ওপর ছেড়ে দিলাম। আমি পালাইনি এবং পালাব না। প্রশাসনিক সংস্কার আইন অনুযায়ী আমি ২০ দিনের জন্য ছুটির আবেদন করেছি। আমি আমার ভাইয়ের সন্তানদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে কাজে ফিরব।

১৭ আগস্ট ২০২১; দুপুর ২:৩৬
এই তিন দিন ও রাতের মধ্যে আমি আমার ভাইয়ের ছয় সন্তানকে রক্ষা করেছি, যাদের সবাই মেয়ে। আমার কী হয়েছে, তা কেউ জানে না। আমার ভাই এখনো অসুস্থ। কিন্তু আমি শুটিং করতে ভুলিনি। যতদূর সম্ভব শুট করেছি, যেন ওরা আমাদের সঙ্গে যা করেছে– তা আমরা ভুলে না যাই।
১৭ আগস্ট ২০২১; সন্ধ্যা ৬:৩৩
আমি আমার সহকর্মীদের অফিসে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু অফিসে তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, শনিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, এবং শনিবারই নির্ধারিত। স্রষ্টার ওপর ভরসা রাখুন।
টুইটারে এরপর সাহরা করিমির আর কোনো বার্তা পাওয়া যায়নি এখনো। আমরা জানি না তিনি কেমন আছেন। শুধু এটুকু জানি, যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে নিজ দায়িত্বটা ঠিকই পালন করে যাচ্ছেন।
.