সাক্ষাৎকার: ব্রোগেন হেইজ
অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
ব্রোগেন হেইজ :: সিনেমাটির সংলাপ সম্পর্কে একটু বলবেন? সবই কি স্ক্রিপ্টে লেখা ছিল? নাকি অভিনেতাদেরও ইমপ্রোভাইজ করতে দিয়েছেন?
নুরি বিলগে জিলান :: সিনেমাটির সূচনাবিন্দু আসলে চেখভের ছোটগল্প থেকে। এই সিনেমায় প্রচুর সংলাপ। সেগুলোর কিছু সরাসরি চেখভের লেখা থেকে নেওয়া, কিছু স্ক্রিপ্টরাইটারের লেখা। প্রচুর সংলাপে ভরা সিনেমা বলে আমি এখানে সত্যিকারের পেশাদারদের যুক্ত করতে চেয়েছিলাম; কেননা, আমার ধারণা, সংলাপ যদি যথেষ্ট ভারি হয়, সে ক্ষেত্রে অ্যামেচার অভিনেতাদের পক্ষে তা প্রকাশ করা বেশ কঠিন। এ কারণেই সত্যিকারের পেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলাম আমি।
ব্রোগেন :: সংলাপগুলো শুধু চমৎকারই নয়, তথ্যবহুলও। আগের সিনেমাগুলোতে তথ্য আটকে রাখতেন আপনি, সেই তুলনায় এটি আপনার জন্য একটি নতুন পথচলা বলে মনে হয়?
নুরি :: আসলে, সংলাপ আমি খুবই পছন্দ করি। আমার প্রথম সিনেমা [শর্ট ফিল্ম] কোকুন-এ প্রচুর সংলাপ ব্যবহার করেছি। তবে সেই সিনেমায় আমরা লাইভ-উইথ-সাউন্ডে শুট করিনি বলে কিছু ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। এরপর সংলাপের ব্যাপারে আমার মনে খানিকটা ভয় জন্মায়; এ কারণে প্রচুর পরিমাণ সংলাপ ব্যবহারের রাস্তা ত্যাগ করি। তবে মঞ্চনাটক আমার পছন্দ; এবং এই সিনেমায় আমরা প্রচুর সংলাপ, প্রচুর টেক্সট ব্যবহার করেছি। সাহিত্যে ও মঞ্চনাটকে এই ভাষা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়; কিন্তু সিনেমায় এটি বেশ বিপজ্জনক: এর ঠিকঠাক কাজ না করার ঝুঁকি থাকে; তবে আমি এই সিনেমায় এটি ব্যবহারের চেষ্টা করেছি।
নিজের প্রথম দিকের সিনেমাগুলোকে আরও বেশি বাস্তবধর্মী, আরও বেশি ন্যাচারাল করে তোলার ব্যাপারে আমি সতর্ক ছিলাম। এখন বুঝে গেছি, সিনেমায় এই ভিন্ন ভাষাটি আপনি চাইলেই ব্যবহার করতে পারেন; এমনকি বিজ্ঞাপনেও, টেলিভিশনের কাজেও। এ বেলা আমি সাহিত্যনির্ভর সংলাপে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এ অনেকটা শেক্সপিয়ার, দস্তোয়েভস্কির (নাটক ও সাহিত্যের সংলাপের) মতো। দেখতে চেয়েছি, সিনেমায় এ ধরনের ভাষা কাজ করে কি না।

ব্রোগেন :: এই মুহূর্তে তুরস্কে যে বাস্তবতা চলছে, আপনার সিনেমাটি কি ইচ্ছেকৃতভাবেই সেটির রেফারেন্স দেখিয়েছে?
নুরি :: আমার সিনেমাটিতে তুরস্কের বর্তমান পরিস্থিতির কোনো ইঙ্গিত দিইনি। এসব ঘটনা ঘটার আগে, জুনের ঘটনাগুলোর [‘গাজি পার্ক প্রোটেস্টস’: ২৮ মে–২০ আগস্ট ২০১৩; সরকার বিরোধী আন্দোলন] আগেই এই সিনেমার শুটিং শেষ হয়ে গেছে। আমার মনে হয় না দেশটির চলমান ঘটনাগুলোর ইঙ্গিত কোনো ফিল্মমেকারের রাখা উচিত। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি যদি কথা বলতে চাই, তাহলে এখন নয়, বরং তিন বছর পর মুখ খুলব। আমাদের দেশে যা কিছু ঘটছে, এবং অতীতে যা ঘটেছে– আপনি যদি মানব প্রকৃতি নিয়ে ভাবেন, তাহলেই সেগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব।
…
দর্শকের
আত্মার দিকে
আরও বেশি মনোযোগ
দেওয়াই একজন
ফিল্মমেকারের
দায়িত্ব
…
আমি বরাবরই বলে এসেছি, যখন সিনেমা বানাই, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভাবি না। একজন ফিল্মমেকারের আসলে একটি প্রশস্ত দৃষ্টিকোণ থেকেই কোনোকিছু দেখা উচিত বলে আমার বিশ্বাস। আমি মনে করি, দর্শকের আত্মার দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়াই একজন ফিল্মমেকারের দায়িত্ব। নিজের সিনেমাগুলোতে আমি কখনো কখনো হয়তো লোকজনকে আইডিয়া দেওয়ার চেষ্টা করি; আর সেটিকে সত্যিকারের সাফল্য বলেই মনে করি। আমি তাদের আত্মায় খোরাক জোগাতে পারি; ফলে কিছু ব্যাপারে দর্শক লজ্জিত হতে শেখেন। আমি মনে করি, একজন ফিল্মমেকারের আসলে এ পথেই আরও বেশি কাজ করা উচিত।
ব্রোগেন :: এই সিনেমার লোকেশনটি দারুণ। কীভাবে বেছে নিলেন? এটি আপনার কাহিনিকে কতটুকু সাহায্য করেছে?
নুরি :: আমি আসলে এই লোকেশন বেছে নিতে চাইনি; তবে লোকেশন স্কাউটিংয়ের পর এ ছাড়া উপায় ছিল না। আমি একটি সিম্পল জায়গা চেয়েছিলাম, তবে সেটির একটি পর্যটনী এলাকা হওয়ারও ছিল; কেননা, শহর থেকে বেশ দূরে, অনেকটা নির্জন জায়গায় একটি হোটেল থাকার দরকার ছিল আমার। আমি খুঁজে এমন জায়গা বলতে শুধু ওইটিই পেয়েছিলাম।

ওই লোকেশনে শুটিং করতে খানিকটা ভয় হচ্ছিল; কেননা, এটির পক্ষে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সুন্দর কিংবা বেশি ইন্টারেস্টিং হয়ে ওঠার ঝুঁকি ছিল। তবে আশা করছি, সেটিকে আমি খুব বেশি দেখাইনি… হা-হা-হা! আমি প্রথম তুষারপাতের মাধ্যমে সেটি দেখিয়েছি; কেননা, আবহাওয়া পরিবর্তন দেখানোর দরকার ছিলই আমাদের। মনস্তাত্ত্বিকভাবে কিছু ওয়াইড শটের দরকার ছিলই। খুব বেশি তুষারপাত ঘটেনি; তুষারপাতের শটগুলো খুবই অল্প সময়ের মধ্যে নেওয়া হয়েছিল, আর এর কিছু অংশের শট নেওয়া হয়েছিল তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে।
ব্রোগেন :: আপনার সিনেমাগুলোতে ফ্যামিলি ব্রেকডাউন থিমটি সদাউপস্থিত। এই সিনেমায় আপনার মূল আইডিয়া কী ছিল? চেখভই কি মাথায় এসেছেন আগে? নাকি আপনার নিজস্ব আইডিয়া এটিকে টেনে এনেছে?
…
সার্বিকভাবে জীবন সম্পর্কে
অপেক্ষাকৃত অধিক
দ্ব্যর্থক সিনেমাই
আমি পছন্দ
করি
…
নুরি :: সিনেমাটির সূচনাবিন্দুতে চেখভের বেশ কিছু গল্প মাথায় ছিল; তবে বাস্তবজীবনে সেগুলোর দেখা না পেলে কাজটি আমি নিশ্চিতভাবেই শুরু করতে পারতাম না। এই গল্পগুলো তুরস্কের জন্য, আমার জন্য লেখা; তবে সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু কিংবা কোনোকিছুর ওপর ভিত্তি করে সিনেমা বানাতে পছন্দ করি– এমন কথা বলতে পারব না। সার্বিকভাবে জীবন সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত অধিক দ্ব্যর্থক সিনেমাই আমি পছন্দ করি, যেগুলো শেষ পর্যন্ত এক ধরনের অনুভূতির ছাপ রেখে যাবে মনে।
ব্রোগেন :: আয়দিন চরিত্রটি কি আত্মজৈবনিক?
নুরি :: আয়দিন আংশিক আত্মজৈবনিক; তবে মোটেও আমার নয়। এ রকম পরিস্থিতির ভেতর রয়েছেন– এমন প্রচুর লোক আমার চেনা। তুরস্কে এমন অভিনেতারা রয়েছেন, যারা কাজ ছেড়ে দিয়ে ছোট ছোট শহরে হোটেল খুলে বসেছেন; ফলে এ ধরনের চরিত্রের সঙ্গে আমি পরিচিত, এবং আমার বন্ধুদের মধ্যেও কেউ কেউ এমন। এ এমনই এক দুনিয়া, যার সঙ্গে আমি ভীষণ পরিচিত; যদিও এটি আমার আত্মজৈবনিক নয়!

ব্রোগেন :: দেখে মনে হয়, দুনিয়ার প্রতি একটি পরিহাসমূলক চাহনি রয়েছে সিনেমাটির; এটি কি নিজের সাম্প্রতিক কাজের মধ্যে জাহির করা আপনার নিজ অনুভূতিরই প্রকাশ?
নুরি :: আমি ঠিক জানি না… হা-হা-হা! আসলে, এভাবে লেখার সময়কালটি ইন্টারেস্টিংই ছিল। আমাদের মধ্যে প্রচুর কথা কাটাকাটি হয়েছে; তবে এটির দরকার ছিলই। কেননা, তর্ক হলে কাজেরই মঙ্গল।… কাজটি ১০ গুণ ভালো হয়ে ওঠে! আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। স্বাভাবিক কথাবার্তায় আমি যদি এই শব্দগুলো খুঁজে না পেতাম, ঝগড়া লেগে গেলে নিশ্চয়ই এরচেয়েও ভালো সংলাপ ধরা দিত আমার মনে! আমরা যখন ঝগড়া করি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলতেই থাকে; কখনো কখনো ভোর পর্যন্ত চলে। কেননা, আমরা প্রত্যেকেই চাই, ‘শেষ কথাটি আমারই হোক।’
যখন অন্যদের সঙ্গে কাজ করি, সাধারণত স্ক্রিপ্টিংয়ে, যেহেতু সিনেমায় তাদের চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা বেশি, তাই তারা আমার বিরুদ্ধে কিছু বলেন না। আমি যা-ই বলি, মেনে নেন; কিন্তু (এই সিনেমার কো-স্ক্রিনরাইটার এব্রু জিলান) যেহেতু আমার স্ত্রী, সে তা করে না, কেননা, তার অধিকার বেশি… হা-হা-হা! তবে আমিই যেহেতু ফিল্মমেকার, তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমিই নিই। আমরা যদি তার সিনেমায় কাজ করতাম, সেক্ষেত্রে শেষ কথাটি তারই হতো।
এই সিনেমায় কিছু কিছু সংলাপ এখনো মেনে নিতে পারছে না এব্রু; কিন্তু আমিই সেগুলো যুক্ত করেছি। এগুলোর এরকমই হওয়ার ছিল। তর্ক শেষ হলে আমরা দারুণ ইন্টারেস্টিং সংলাপ পাই, আর সেটা বরাবরই কাজে লাগাই আমি। নিজেকে বলি, ‘কেন এটা রেকর্ড করে রাখিনি!’ কিন্তু তর্কের শুরুতে আপনি তো জানবেন না, এটি এমন ফল বয়ে আনবে… হা-হা-হা!

ব্রোগেন হেইজ :: আপনি আপনার সিনেমার চরিত্রগুলোর জন্য আশার কোনো জায়গা দেখেন?
নুরি বিলগে জিলান :: বাস্তব জীবনে আশার যতটুকু জায়গা আছে, আমার চরিত্রগুলোর জন্য ততটুকুই রয়েছে। সিনেমার সমাপ্তিতে আশাবাদ জাগিয়ে তুলতে আমি পছন্দ করি না; কিছু মানুষ সেটা পছন্দ করেন: তারা আশাবাদের একটি ঝলক রেখে সিনেমার সমাপ্তি টানেন। আমি সেরকম নই; নিজেকে যথেষ্ট বাস্তবধর্মী ভাবি। আপনাকে কখনো কখনো নৈরাশ্যবাদী হয়ে উঠতেই হবে; তবে নিজের ক্ষেত্রে যেমনটা বলেছি, বাস্তবজীবনে যতটুকু আশার জায়গা আছে, ওদেরও [সিনেমার চরিত্রগুলোর] রয়েছে ততটুকুই।
সমাপ্তিটিকে আমি আরও বেশি দ্ব্যর্থক করে তুলতে চেয়েছিলাম; কিছু ভার আয়দিনের স্ত্রীর কাঁধেও চাপাতে চেয়েছিলাম। তাই এডিটিংয়ের মাধ্যমে (সিনেমার সমাপ্তিদৃশ্য) আমি খানিকটা পাল্টে নেওয়ার চেষ্টা করেছি।
ব্রোগেন হেইজ: লেখক, চলচ্চিত্র সমালোচক; আয়ারল্যান্ড
সূত্র: মুভিস। অনলাইন ফিল্ম জার্নাল; আয়ারল্যান্ড।। ২০১৪