লেভিয়াথন: চার্চ, প্রশাসন আর জনগণের গল্প, রাশিয়ার প্রেক্ষাপটে দুনিয়ার ছবি

299
লেভিয়াথন

লিখেছেন । আসিফ রহমান সৈকত

লেভিয়াথন

লেভিয়াথন
Leviathan [Leviafan]
ফিল্মমেকার । আন্দ্রেই জিয়াগিন্সাফ
প্রডিউসার । আলেক্সান্দার রদনিয়ান্সকি; সের্গেই মেলকুমভ
স্ক্রিনরাইটার । আন্দ্রেই জ্যভিয়াগিনস্তেভ; ওলেগ নেগিন
মিউজিক । আন্দ্রেই দেরগাচেভ; ফিলিপ গ্লাস
সিনেমাটোগ্রাফার । মিখাইল ক্রিচমান
কাস্ট [ক্যারেক্টার] । আলেক্সেই সেরেব্রিয়াকভ [কলিয়া]; রোমান মাদিয়ানভ [মেয়র ভাদিম]; ভ্লাদিমির ভদোভিচেঙ্কভ [দিমা]; ইলেনা লিয়াদোভা [লিলিয়া]; সের্গেই পখোদায়েভ [রোমা]; আন্না উকোলোভা [আঞ্জেলা]
রানিংটাইম । ১৪১ মিনিট
ভাষা । রুশ
দেশ । রাশিয়া
রিলিজ । ২৩ মে ২০১৪ [কান]
অ্যাওয়ার্ড: বেস্ট স্ক্রিনপ্লে [কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল; ২০১৪]


লেভিয়াথন বাইবেলে উল্লেখিত এক প্রফেটের সময়ের এক কাহিনির অতিকায় প্রাণী, যেখানে অবিশ্বাস্য বিশালতার কথা বলা আছে, যার সঙ্গে কোনো মানুষের পেরে ওঠার কথা না। রাশিয়ান পরিচালক আন্দ্রেই জিয়াগিন্সাফের [Andrey Zvyagintsev] লেভিয়াথন চলচ্চিত্রে রাষ্ট্রের প্রশাসন আর অর্থোডক্স চার্চের চাপে সাধারণ মানুষ কীভাবে তাদের সামান্যতম শেষ আশ্রয়স্থলও হারায়। রক্ষক এখানে মুখোশে ভক্ষকের ভূমিকায় থাকে, যে রক্ষককে সাধারণ মানুষ তার করের পয়সায় তার নিজের নিরাপত্তার জন্য, তার আবাসের মৌলিক চাহিদাকে রক্ষার জন্য আসীন করে মেয়রের অফিসে।

দেখা যায়, রাষ্ট্রের প্রশাসনের জায়গাগুলোতেই সাধারণ মানুষ হিসাবে তার অভিযোগগুলো তার দিকেই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। তাকেই দোষী সাব্যস্ত করে, তাকেই ভেঙেচুরে দেয়, তাকেই অপরাধী হিসেবে ১৫ বছরের জেল দিয়ে দেয়, তার ছেলেকে অনাথ করে ফেলে, তাকে জীবনের শুরুতেই কঠিন মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেয়। সেই মেয়র আবার নিয়মিত অর্থোডক্স চার্চের পাদ্রীর কাছে শান্তি আর পাপমোচনের রাস্তা খোঁজে, আর পাদ্রীও চার্চের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক হিসাবে তাকে কখনোই হাতছাড়া করতে চায় না; তার সব অন্যায়, তার সব অনৈতিক কাজের ইচ্ছা থেকেও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মেয়র ভাদিমের রোববার চার্চে আসা আর চার্চের ফান্ডে টাকা দেওয়া।


কর্মজীবী
মানুষ, মেয়র, প্রশাসন,
হাসি-কান্না-আনন্দের জীবনে
অতিবাহিত, ছোট ছোট আনন্দ,
ঝগড়া, আলাপ, আড্ডায় দিন
কাটানো, অল্পে সন্তুষ্টি, যা
আছে তা নিয়ে জীবন
কাটাতে চায়–
এমন
মানুষের গল্প এটি

রাশিয়ার এক ছোট শহর, যেখানে বিশাল বিস্তীর্ণ এলাকা, সাগর মিশে একাকার– সেখানকার কর্মজীবী মানুষ, মেয়র, প্রশাসন, হাসি-কান্না-আনন্দের জীবনে অতিবাহিত, ছোট ছোট আনন্দ, ঝগড়া, আলাপ, আড্ডায় দিন কাটানো, অল্পে সন্তুষ্টি, যা আছে তা নিয়ে জীবন কাটাতে চায়– এমন মানুষের গল্প এটি। কিন্তু সেটাও যে সে ধরে রাখতে পারে না, সেখানেও যে বিপত্তি, সেই জায়গাটাই ফ্রেমে ফ্রেমে, শটের কারুকার্যে তুলে ধরেছেন পরিচালক আন্দ্রেই জিয়াগিন্সাফ, তার ১৪১ মিনিটের চলচ্চিত্র লেভিয়াথন-এ ।

লেভিয়াথন

কলিয়া, রোমা, লিলিয়া, দিমা, ভাদিম আর অর্থোডক্স চার্চের প্রধান পাদ্রী– এইগুলো মূল চরিত্র লাভিয়াথন-এ। কলিয়া মধ্যবয়সী পুরুষ। তার দাদা-বাবা বাড়ি বানিয়ে এইখানেই বসত গড়েছিল। সে এই জায়গাতে থাকতে চায়, মস্কোতেও যেতে চায় না। এখানকার সঙ্গে তার ভালোবাসা, স্মৃতি… সব জড়ানো।

ভাদিম এই শহরের মেয়র। তার চোখ পড়ে কলিয়ার পূর্বপুরুষের জায়গাটার দিকে। বলে টেলিকমিউনিকেশন ইত্যাদি উন্নয়নের কথা; কিন্তু আসলে সে মেয়রের ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজের জন্য একটা বাংলো বানাবে, সেজন্য ওই বাড়ির দিকে চোখ দেয়, সেজন্য মামলা, প্রশাসন সব কিছুকে, পেশীশক্তির গুন্ডা-মাস্তানকেও ব্যবহার করে। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ক্ষমতার ভারে অন্ধ হয়ে কলিয়ার পরিবারকে হুমকি দিতেও দ্বিধা করে না সে।

কলিয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী লিলিয়া সুন্দরী ও সহনশীলা। তবু সে এইসব ঘটনা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে না। রোমা– কলিয়ার প্রথম স্ত্রীর গর্ভের ছেলে; নিজের মতো ভালোই ছিল সে। বাবার সঙ্গে একরকম বন্ধুর সম্পর্ক তার। কিন্তু এইসব ঘটনা তার কিশোর মনে সারাক্ষণ আলোড়ন তুলতে থাকে; তার চিন্তার সীমায় এগুলো কিছুই আসে না। সব তছনছের জন্য, সংসারের অশান্তির জন্য, কিশোর রোমা দায়ী করে লিলিয়াকেই, যেটা লিলিয়াকে ভেতর থেকে একদম ভেঙে দেয়, আর সেই অসীম যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।


বুলডোজার
দিয়ে সুন্দর একটা
বাড়ি, সাধারণ মানুষের
স্বপ্ন, আশা, অস্তিত্ব, স্মৃতি–
সবটুকু ভেঙে তছনছ
করে দেয়
সে

সেখানেও শেষ হয় না। এই ঘটনাটাকে খুন হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে মেয়র আর প্রশাসন। ১৫ বছরের জেল হয়ে যায় কলিয়ার। সব বাধা চুকে যায় মেয়রের। বুলডোজার দিয়ে সুন্দর একটা বাড়ি, সাধারণ মানুষের স্বপ্ন, আশা, অস্তিত্ব, স্মৃতি– সবটুকু ভেঙে তছনছ করে দেয় সে।

চার্চের পাদ্রীকেও সুন্দর একটা চাকচিক্যময়, চোখ ঝলসানো গির্জা বানানোর স্বপ্ন দেখায় মেয়র। পাদ্রী সেটাকে পবিত্র কাজ বলেই গণ্য করে।

পত্রিকায়, বইয়ে মেয়রদের কথাই লেখা থাকবে, লেখা থাকবে সুন্দর একটা গির্জা বানানোর উদ্যোগের কথা, তাদের সম্পদের আলাপ, তাদের পরিবারের আলাপ; কিন্তু কলিয়াদের কথা, তাদের অল্প-অল্প আশা, ভালোবাসা আর স্মৃতির কথা মুছে যাবে। সেগুলোর কোনো চিহ্ন থাকবে না। কেউ রাখবেও না। এইসব সাধারণ মানুষের যেকোনো কাজ কোনো না কোনোভাবে কীভাবে যেন অন্যায় আর পাপ হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত করা যায় বা হয়ে যায়। কারণ কারওই ক্ষমতা নেই লেভিয়াথনকে কিছু করার, ধর্ম গ্রন্থেই সেটা বলা আছে। কারণ সেটা এত বড়ো যে, তাকে নিয়ে কিছু করার ভাবনাটাই আত্মবিনাশী; আত্মহত্যার শামিল।

লেভিয়াথন

যদিও বন্ধু কলিয়ার জন্য মামলা লড়তে মস্কো থেকে আসে দিমা, তবু সমাজের যে চরিত্র সেখান থেকে সেও খুব একটা বের হতে পারে না। দিন শেষে তারও স্খলন ঘটে। মেয়রকে সে আসলে হুমকি দেয়; কিন্তু সে দেখে তার কাছে বেশি লাভজনক আসলে মেয়রকে ভয় দেখিয়ে কোনো সুবিধা আদায় করা।

মেয়র যখন বুঝল, দিমা ঘাঘু আইনিজীবী; সে আর কিছু না পেরে জিজ্ঞাসা করল:
‘আপনি কি ব্যপটাইজড হয়েছেন?’
‘মানে?’
‘মানে… এই জানতে ইচ্ছা হলো আরকি!’
‘আমি আইনজীবী। আই বিলিভ ইন ফ্যাক্টস।’

আসলে সবদিক থেকে যখন সে দেখল দিমাকে কোনোভাবে বশে আনা যাচ্ছে না, তখন ধর্ম, অর্থ, পেশীশক্তি দিয়ে দমন করতে চাইল। দিমা প্রাণ নিয়ে মস্কোতে ফিরে গেল। মস্কো বার অ্যাসোসিয়েশনের একজন শক্তিশালী আইনজীবীও যে এইসব জায়গায় অসহায় হয়ে যেতে পারে, তার একটা কাহিনি আমরা দেখলাম।

একটা এলাকার প্রশাসনের সবাই যদি একসঙ্গে কোনো অন্যায়ের পক্ষে কাজ করে, তখন জনগণ কত অসহায় হয়ে পড়ে, সে কথা বলা হয়েছে এখানেও। কারণ একজন সাধারণ মানুষ সহজে মামলা করতে পারে না। তার পক্ষে এত প্রমাণ, প্রশাসনের এত জটিল প্রক্রিয়া, প্যাঁচ বোঝা সহজ নয়; সে বুঝতেও চায় না। সেই সুযোগটাই নেয় এলাকার ক্ষমতাশালীরা।


এটাকে
আপনি যেকোনো
মাত্রায় বড় বা ছোট বা
দুনিয়ার অনেক অংশেই ঠিকঠাক
বসিয়ে নিতে পারেন, শুধু
চরিত্র আর শহরের
বা
গ্রামের নামগুলো ভিন্ন হবে

রাশিয়ার ওই শহরের গল্পেও সেটাই দেখানো হয়েছে। এটা একটা শহরের গল্প হিসাবে ভাবলে ভুল হবে। এটাকে আপনি যেকোনো মাত্রায় বড় বা ছোট বা দুনিয়ার অনেক অংশেই ঠিকঠাক বসিয়ে নিতে পারেন, শুধু চরিত্র আর শহরের বা গ্রামের নামগুলো ভিন্ন হবে। এইরকম একটা সার্বজনীন গল্প বলেছেন পরিচালক আন্দ্রেই জিয়াগিন্সাফ।

পুরো সিস্টেমটাই যে একে অপরের সঙ্গে অন্যায়ে জড়িত, তা ফুটে উঠে যখন, পুলিশ, এলাকার সরকারি উচ্চপদস্থ– সবাইকে ডেকে মেয়র হুমকি দেয়, এর পরেরবার সে আবার মেয়র নির্বাচিত না হলে তাদের অবস্থাও ভালো থাকবে না। পরোক্ষ হুমকি। বিদেশ ভ্রমণ, টাকা-পয়সা, আনন্দ-ফূর্তি সব লাটে উঠবে, যা সরকারি আমলা, পুলিশ, জাজের অনেকের পরম আরাধ্য রাশিয়ার সেই শহরে।

এ একজন সাধারণ মানুষের জমি দখলের সরকারি দুর্নীতির এক সহজ, চাছাছোলা দৃষ্টান্ত, যৌথ, দলীয় অন্যায় প্রক্রিয়া। মামলা লড়ার জন্য মস্কো থেকে যে আইনজীবী এসেছে, তাকে আগে সামলাতে হবে; তাহলে বাকি সব সহজ হয়ে যাবে। এই লক্ষ্যে সবাইকে কাজ করার জন্য বলে সে। নিজে মেয়র না হতে পারলে সবাইকে নিয়ে চার্চে যেতে হবে ধ্যান করতে, সবাই ঝামেলাতেও পড়বে– এই বলে সতর্ক করে সবাইকে এক জায়গাতে নিয়ে আসে লোভী মেয়র।

সাধারণ মানুষ, এমনকি পুলিশের ক্ষোভ দেখাতেও এই চলচ্চিত্রে অনেক রূপক ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। কলিয়া যখন তার এলাকার পুলিশ বন্ধুর জন্মদিন পালনের জন্য দূরে এক জায়গাতে বনভোজনে যায়, সেখানে শুটিং প্র্যাকটিসের এক পর্যায়ে টার্গেট হিসাবে সে নিয়ে আসে রাশিয়ার প্রাক্তন কিছু নেতার ছবি। যেন এই খেলা দিয়ে সে তার কিছু ক্ষোভ প্রশমিত করতে চায়।

এর মধ্যে দিমা আর লিলিয়ার মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে। কলিয়ার ছেলে সেটা দেখে কান্না শুরু করে দেয়। আরেকটা বাচ্চা ছেলে এসে বলে, দিমার জন্য লিলিয়ার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সবাই বুঝে, একটা বাজে ঘটনা ঘটে গেছে। মারামারি পর্যন্ত। বনভোজনের আকস্মিক সমাপ্তি।

লেভিয়াথন

লেভিথিয়ন ছবিতে ছোট একটা শহরের গল্পের মধ্য দিয়ে অনেক বড় একটা গল্প বলতে চেয়েছেন পরিচালক। প্রশাসন আর চার্চের অতি নিয়ন্ত্রণ আর সম্পদ আত্মসাতের চেষ্টা এবং সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের কথা ফ্রেমে ফ্রেমে বলা হয়েছে এখানে। মানুষের আবেগ আর অনুভূতিকে পরিচালক তুলে ধরেছেন সিনেমাটিক জায়গা থেকে। বিশাল বিশাল ল্যান্ডস্কেপে ক্ষুদ্র মানুষের উপস্থিতি ফ্রেমে অধিকতর শূন্যতার বোধ তৈরি করেছে।

বুলডোজার দিয়ে ঘর ভাঙ্গার দৃশ্যটি এমনভাবে করা হয়েছে, যেখানে ঘরের ভেতর থেকে সেটার ছবি নেওয়া; তাতে মনে হয়েছে, যেন একটা বড় হিংস্র প্রাণী সব লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। এই দৃশ্য দর্শককে আরও আঘাত করে, তাকে অসহায়ত্বের অনুভূতি দেয়। বাড়ির বাইরে থেকে ঘর ভাঙার এই দৃশ্য হলে তা কখনোই এ রকম হতো না। এখানেই পরিচালকের কৃতিত্ব, দৃশ্যগত ভাষা ব্যবহারে।

ছবিতে চার্চের শেষ দৃশ্যে দেখা গেল, পাদ্রী অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের বিজয়ের কথা বলছেন, আর মেয়র নিজ পরিবার নিয়ে প্রার্থনায় রত। বাংলো হবে মেয়রের, চার্চ হবে পাদ্রীর– এটাই আসল পূণ্যের কাজ, তার জন্য ‘শয়তান’ নাগরিকের বাড়ি ভাঙাও নৈতিক!

লেভিয়াথন-এ বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয় হলো, এটি রাশিয়ান সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের অনুদানও পেয়েছে আর প্রতিটা সরকারি অফিসের ইমেজে সুন্দরমতো উল্লেখ হিসেবে রাশিয়ান নেতা পুতিনের ছবি প্রদর্শন করেছে। পুরো গল্পে সবাই উপস্থিত। এর পাশেপাশেই বাস্তবতাকে তুলে ধরার পুরো চেষ্টা অব্যাহত থেকেছে।

Print Friendly, PDF & Email