সাজানো নরক: মৃণাল সেনের কলকাতা

838
মৃণাল সেন

লিখেছেন । ঊর্ণনাভ

চলচ্চিত্র এমন একটি স্ট্রং ডিভাইস যা সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলোকে প্রতিবিম্বিত করে তোলার ক্ষেত্রে এক মারাত্মক অস্ত্র। ওয়াচডগ-ও বলতে পারেন। যার মাধ্যমে খুব সহজেই একটা গনচেতনার অভ্যুত্থান ঘটানো যেতে পারে

পোস্ট-কলোনিয়াল যাপ্যচিত্রের ওপর আধারিত এইরকম এক অনালোকিত ভৌত ধারা মৃণাল সেন অস্ত্র হিসাবে প্রয়োগ করেছেন তার ছবিতে। নানান পরিকল্পনা, ম্যানিফেস্টো, স্ববিরোধ এবং বহির্মুখিনতাসহ একঝাঁক সোশিও-পলিটিক্যাল কাট। নাগরিক চিন্তাধারায় যেসব গল্প-দ্বন্দ্ব-তর্ক ময়দানে, গলিতে, আড্ডায়, এমনকি বাঙালি মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুম অবধি ছড়িয়ে ছিল, সেগুলো একসূত্রে বেঁধে চীনা ফেরিওয়ালা সাংবাদিকের মতো তুলে দিয়েছেন তার ছবিতে। যার বেশিরভাগ ছবি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে অসফল তো বটেই, এমনকি সেন্সরবোর্ডও উৎরাতে পারেনি নাকি এতটাই উগ্র, অসামাজিক– তাতে মৃণাল সেনের মতো পরিচালকদের কিস্সু যায়-আসে না। এরা জন্মই নেন বিপ্লবের তপ্ত বীতশোক লোহা বুকে নিয়ে।

ছবি চলবে কি চলবে না– সে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার চেয়ে মানুষকে কীভাবে আরও সচেতন করা যেতে পারে, তাই নিয়ে ভাবা জরুরি মনে করেছেন। যদিও ভারতীয় চলচ্চিত্রের বর্তমান ধারা অনুসরণ করলে ব্যাপারটা কিছুটা ম্রিয়মাণ মনে হলেও কিছু কাজ হচ্ছে না– তা একেবারেই নয়; হচ্ছে, কমসংখ্যক। কারণ দর্শক নন্দনের কথা ভাবতে গিয়ে বেপরোয়াভাবে নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাস্তবতার ন্যারেটিভ রচনা করার ঋজু সাহস সবার থাকে না। তবু এই নির্ভয় দায়িত্ববোধ ছিল বলেই মৃণাল সেনের মতো কাল্ট পরিচালকে আমরা পেয়েছি। এ আমাদের সৌভাগ্য।

আকালের সন্ধানে

যে সময়ে খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকাররাও পলিটিকাল ইস্যুগুলোকে লার্জ স্কেলে তুলে ধরা থেকে বিরত থেকেছেন, সেই একইসময়ে তিনি অবলীলায় অ্যাড্রেস করেছেন– ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১, আকালের সন্ধানে, একদিন প্রতিদিন, পুনশ্চ চলচ্চিত্রের মত মধ্যবিত্ত শহুরে জীবদ্দশার যাপ্যচিত্র। একদিকে যেমন ধনতান্ত্রিক বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে যুবসমাজের তীব্র প্রতিস্পর্ধী জীবনচর্যা, অন্যদিকে ঔপনিবেশিকতার পাকে পাকে বাঁধা নাগরিক অস্থিরতা, দুর্ভোগ, আতঙ্ক ও সন্ত্রাস।

প্রসঙ্গত একটা প্রশ্ন আসে, মানুষ কি তবে রুখে দাঁড়াবে না? নাকি ডিফিটিজমের ঝোলা কাঁধে নিয়ে কপর্দকশূন্য দিগম্বরের মতো হাততালি দিতে দিতে বলবে– এ শহরের ফুটপাত কলোনি বস্তি আর ওই ধোঁয়ার আকাশটার নিচে একদিন ছিলাম আমরা। তারপর ফ্রাস্ট্রেশনে ভুগতে ভুগতে প্রশ্নহীন তলিয়ে গেছি; এখন শূন্যে অবলম্বমান। নাহ…


মধ্যবিত্ত
শ্রেণিকে নিরুত্তাপ
ক্ষমাবিশ্লেষণে প্রতি মুহূর্তে
ধরাশায়ী করে আমরা
জুড়ে দিয়েছি
এক
বৈপ্লবিক মাত্রা

বরং মৃণাল সেন হয়তো তার জবানিতে বলবেন– ভুল, মস্ত ভুল! আমরা নিরব থাকিনি। মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে নিরুত্তাপ ক্ষমাবিশ্লেষণে প্রতি মুহূর্তে ধরাশায়ী করে আমরা জুড়ে দিয়েছি এক বৈপ্লবিক মাত্রা। চারদেয়ালের ভেতরের হোক বা হাটে-বাজারে মানুষ যেখানেই ন্যায্য অধিকারের দাবিতে উচ্চস্বরে বিপ্লব ঘোষণা করেছে, আমরা জুড়ে দিয়েছি তারস্বর। ক্যামেরা লেন্স হাতে গলি থেকে রাজপথ মেপে দেখেছি শোষণ আর অবক্ষয় ঠিক কতটা সংকীর্ণ এবং আড়ষ্ট করে তুলেছে আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোটাকে। ভেবেছি, ব্রেখটের ভাষাতেও ভেবেছি, লুকাচের ভাষাতেও। শিল্পকে নন্দনতত্ত্বের বাইরে এনে সোশ্যাল ডায়ালেক্টস্-এর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে একমেবাদ্বিতীয়ম খোলস গা থেকে নামিয়ে দেখিয়েছি যা বাস্তব। এখানে জাতির গর্ব হওয়া উচিত। হতে পারে ‘ডিফারেন্ট ফর্ম’, হতে পারে ‘আনইভেন’; তারপরেও আমি অবসাদগ্রস্ত নই, –আই স্টিল রিমেইন ভেরি ইয়্যুথফুল।

ভুবন সোম

তার ছবিতে একটানা গল্প বলার ন্যারেটিভ টেকনিককে তিনি বারবারই ভেঙেছেন এবং সচেতনভাবেই সিনেমার ভাষা নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সত্তরের কলকাতা ট্রিলজিতে সময়ের ক্ষোভ-যন্ত্রণাকে তুলে আনতে তিনি যেমন সফল, তেমনি ভুবন সোম-এ সচেতনভাবে অ্যারিস্ট্রোকাট ব্যুরোক্রেসির চকচকে আদলটিকে ভেঙে ফেলতেও পারদর্শী।

একদিন প্রতিদিন বা একদিন আচানক-এ যথাক্রমে এক যুবতি মেয়ে ও এক বৃদ্ধ অধ্যাপকের বাড়ি না ফেরা নিয়ে নানা কথা ভাবনার সূত্রে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের সমস্যাগুলোকে তিনি যেভাবে উন্মোচিত করেছিন, তা অভাবনীয়। মূলত দর্শক এবং অভিনেতার মধ্যবর্তী যে দৃশ্যগত গ্যাপ, সেটাকে টপকে গিয়ে সোজা দর্শকের মুণ্ডু নিয়ে খেলেছেন তিনি। কলকাতা ট্রিলজির কথাই ধরা যাক–

কলকাতা ট্রিলজি

ঔপনিবেশিক আমলের শেষের দিকে বাংলা যখন তার নবজাগরণের গৌরবময় দিনগুলোর প্রমাদ গুনতে শুরু করে এবং জাতীয় স্তরে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে হতে এমন একটা পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়, যেখানে রিফিউজি ক্রাইসিস, ম্যান-মেড দুর্ভিক্ষের প্রভাব বাংলার আর্থ-সামাজিক আকাশটাকে একভাবে দমবন্ধ অবস্থায় আটকে রাখে। ফলতঃ ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, আদর্শ এবং নৈতিকতার চূড়ান্ত অধঃপতন, কলকাতার ভেতরের পরিবেশটাকে এক্কেবারে ভয়াবহ করে তোলে। ঠিক যেন সাজানো নরক।

কলকাতা ‘৭১

আর এই নিত্যকার নারকীয়তা হাত থেকে মুক্তি পেতে শুরু হলো পিপল’স ওয়ার। সাধারণ বেকার যুব-সমাজের এই যে স্বপ্নভঙ্গ অস্থিতিশীলতা তারই একটা ডিসাল্যুশনমেন্ট স্পেস মৃণাল সেনের ছবিগুলোতে উঠে আসতে থাকে। একইসঙ্গে বেকারত্ব, শিল্প ও সাহিত্যে চূড়ান্ত হতাশা, অসাম্যতা, ধড়-পাকড়, গণহত্যা– এই আনরেস্টফুল সমাজচিত্রটাকেই মৃণাল সেন ছবিতে বার্তাবহ মিডিয়াম হিসেবে ব্যবহার করলেন।

যেখানে তিনি পদাতিক ছবির শুরুতেই বলছেন– ‘ফিরে ফিরে কলকাতা যতবার আসি, ততবার মনে হয় কলকাতা বোধহয় একেবারে থেমে যাবে, আর চলবে না। তবু কলকাতা চলেই চলেছে। এক-একটা বছরের ফারাক আর দেখি কলকাতা আরও দুঃসহ; আরও যন্ত্রণাময়। মনে হয় নোংরা যেন আরও বীভৎস, দারিদ্র আরও মারমুখী, হতাশা আরও মরিয়া। যতবার কলকাতার মুখোমুখি হই, মনে হয় এ এক নারকীয় শহর কলকাতা। যার উত্থান নেই। যার শিয়রে হয়তো সমূহ সর্বনাশ।’


ক্যামেরাটি বুকে নিয়ে পুলিশের
ভ্যান থেকে অন্ধকার
গলিপথের মধ্যে
হাঁপাতে
হাঁপাতে
ছুটে চলেছে
কোনো পলায়নপর যুবক

তারপর ক্যামেরাটি বুকে নিয়ে পুলিশের ভ্যান থেকে অন্ধকার গলিপথের মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে চলেছে কোনো পলায়নপর যুবক। এক্কেবারেই ভিন্নধর্মী এক দৃশ্য। তখন নকশালবাড়ির রাজনীতির প্রথম পর্বটি ধাক্কা খেয়ে গেছে। পরবর্তীকালে আশ্রয় পায় এক পাঞ্জাবি মহিলার অ্যাপার্টমেন্টে। এখান থেকে শুরু হয়েছে রাজনীতির নতুন চিন্তাভাবনা।

ছবির মূল চরিত্রে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে নিজেকে এবং পার্টির নেতৃত্বদের: কেন, কীভাবে পার্টির ভেতরে মতাদর্শের বিশৃঙ্খলতা দেখা দিল? এই নিয়ে চিন্তা, চিন্তা এবং চিন্তা– একটা ইন্ট্রোস্পেকটিভ সমীক্ষা বার্তা, যা এই ছবির মূল বক্তব্য।

পদাতিক

পাঞ্জাবি ডিভোর্সি মেয়ের সাথে একটা প্লেটোনিক রিলেশনশিপ ছবিতে সমান্তরালভাবে প্রতীয়মাণ, যা এক্কেবারেই রাজনৈতিক বহির্ভূত চিত্র। ছবিটির আর একটি দিক, একজন তরুণ রাজনৈতিক কর্মীকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা এবং বিচ্ছিন্নতার মধ্যে তার একটা নৈতিক পরাজয়।

এভাবেই পদাতিক ছবিটা শেষ হচ্ছে সুমিতের [ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়] মায়ের শেষকৃত্যের মধ্যে দিয়ে, যেমনটা সত্যজিৎ রায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছবিতে ব্যবহার করেছেন। কিছুটা সিম্বলিক এই মৃত্যু। সুমিত ও তার বাবার [বিজন ভট্টাচার্য] পুনর্মিলন ঘটাতে এই দৃশ্যের সংযোজন। এককালের স্বাধীনতা সংগ্রামী পিতা বরাবর যে তার ছেলের আদর্শ কর্তব্যজ্ঞানকে বিপথগামী ভেবে এসেছে, সেই পিতাই তাকে জীবন বিপ্লব জারি রাখার পরামর্শ দিচ্ছে।

Mrinal Sen
ইন্টারভিউ

এইভাবে ইন্টারভিউ শেষ হচ্ছে সামগ্রিক পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে, কলকাতা ৭১ শেষ হচ্ছে অডিয়েন্সের উত্তেজনা প্রতিক্রিয়ার প্রশ্ন নিয়ে এবং পদাতিক প্রগতিশীল শক্তিকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে– যা নির্দয়ভাবে বিদ্রূপ করলেন কলকাতার বুর্জোয়াদের। এবং স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন, আসলে তারা কাগুজে বাঘ। ওদের ভয় পাওয়ার কিছু নাই।

১৯৭৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আরও একটি রাজনৈতিক ছবি কোরাস-এ নিওরিয়ালিজম এবং ডকুমেন্টারি ছবির আঙ্গিককে এখানে মেলাতে চেয়েছেন ব্যাঙ্গাত্মক ঢঙে। দেবতাদের অধিপতি চাহিদার সমস্যার ব্যাপারটা বুঝে শয়ে শয়ে চাকরির বন্দোবস্ত করেন, কিন্তু হাজারে হাজারে চাকরিপ্রার্থী জুটে যায়। অনেক মানুষ, অনেক মুখ, অনেক সমস্যা। ক্রমেই জনতার মোহভঙ্গ হয়। ক্যামেরাকে সরাসরি লক্ষ্য করে রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দেওয়াই এ ছবির উদ্দেশ্য এবং সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করা। এবং সমাধানের প্রশ্নে মৃণাল সেনের জবাব– ‘It is not a responsibility of the artist to reach a definite conclusion… my job is to analyze the reality and put it in a proper perspective…’

সুতরাং মৃণাল সেন যে আদতেই কলকাতার নাড়িস্পন্দ অনুভব করেছেন, তাপমাত্রা মেপে দেখেছেন– এ কথা বলা বোধহয় ভুল হবে না। কাঁচ কাটা হীরের মতো সদর্পে কলকাতার অস্বচ্ছ যবনিকা সরিয়ে মধ্যবিত্তের নিষিদ্ধ অঞ্চলে প্রবেশ করেছেন বারবার। সত্তা ও অস্ত্বিত্বের বিরোধ খাড়া করে তুলেছেন, চৌরাস্তার মাঝখানে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে এনেছেন ঘরবন্দী চরিত্রগুলোকে।

Print Friendly, PDF & Email