লিখেছেন । প্রসূন রহমান
আমাদের চলচ্চিত্র যেদিন থেকে ফর্মুলার পথ ধরেছিল, সেদিন থেকেই নিম্নগামী হয়েছিল। শিক্ষাবঞ্চিত এবং চিন্তাশক্তিহীন নির্মাতাগোষ্ঠী বাজার ধরতে যেদিন থেকে ‘কাটপিস’ নামের অপ্রয়োজনীয়, বিদঘুটে শরীর প্রদর্শন জুড়ে দিতে শুরু করলো, সেদিন থেকেই আমাদের মধ্যবিত্ত দর্শক হলবিমুখ হয়েছিল। পারিবারিক বিনোদন হিসেবে নিজেদের চলচ্চিত্র তখন সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা হারায়। যার ক্রমাবনতির ফলাফল ১২০০ সিনেমা-হল থেকে নেমে ৭০, কয়েকটি সমিতি দ্বারা আগলে রাখা ইন্ডাস্ট্রি নামের কংকাল আর পরবর্তী দীর্ঘ শূন্যতা।
এখন প্রযুক্তির বিবর্তনে অডিও-ভিজুয়ালের কাহিনীচিত্র নানা চেহারা চরিত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে নানা মাধ্যমে। কমিউনিটি ভিউয়িংয়ের সংখ্যা সারা পৃথিবীতেই কমছে। বাড়ছে পার্সোনাল ভিউয়িং। ওটিটি, ভিওডি আর ইউটিউবের কালে ৮০০-১০০০ দর্শকের সিঙ্গেল স্ক্রিন আর ভরবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু বাড়তে হবে মাল্টিপ্লেক্স, থাকতে হবে সিনেপ্লেক্স। কারণ সিনেপ্লেক্সই বাঁচিয়ে রাখতে পারে আমাদের সিনেমা দেখার সম্মিলিত অভিজ্ঞতা। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে জাগ্রত রেখে জারি রখতে পারে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া।

আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ এবং মিলনায়তনগুলোই আমাদের সাংস্কৃতিক সম্মিলনের জায়গা, নিঃশ্বাস ফেলবার জায়গা। সারা পৃথিবীর সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলো যেখানে সিনেপ্লেক্স-মাল্টিপ্লেক্সে রূপান্তরিত হয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বিপণণ ও প্রদর্শন হচ্ছে। সেখানে আমরা এখনো পড়ে আছি সেই তিমিরেই। রাজধানীকেন্দ্রিক হাতে গোণা কয়েকটি সিনেপ্লেক্সে সীমিত হয়ে আছে সৃজনশীল সিনেমার প্রদর্শন ক্ষেত্র। অথচ নেপালের মতো একটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবকাঠামোর দেশেও ৭০টি সিনেপ্লেক্সে ‘বক্স অফিস’সহ ‘ই-টিকেটিং’ সিস্টেম চালু আছে। যেখানে একজন প্রযোজক ঘরে বসে নিজের মুঠোফোনেই দেখেতে পাচ্ছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন প্রেক্ষাগৃহের কোন প্রদশর্নীতে কতগুলো টিকেট বিক্রি হয়েছে।
চলচ্চিত্র যেহেতু একইসাথে শক্তিশালী এবং ব্যয়বহুল মাধ্যম, সেখানে প্রযোজকের বিনিয়োগ ফিরে আসার ব্যাপারটা নিশ্চিত করা গেলেই ইন্ডাস্ট্রির চাকা ঘুরতে শুরু করবে বলে মনে হয়। আশা করতে চাই, কোভিড পরবর্তী সময়ে সরকারি প্রণোদনা সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলোকে সিনেপ্লেক্সে রূপান্তরসহ ‘বক্স অফিস’ এবং ‘ই-টিকেটিং’য়ের বিষয়গুলো নিশ্চিত করেই কার্যকর হবে।
…
মগজেই
ফিল্টার করে
দিয়ে সেল্ফ-সেন্সর
আরোপ করে বসে আছেন
…
বিষয় নির্বাচনে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ বড় একটি প্রভাব ফেলছে, ফেলবে। অনেক বিষয় লেখক-নির্মাতাগণ ভাবতেই পারছেন না। মগজেই ফিল্টার করে দিয়ে সেল্ফ-সেন্সর আরোপ করে বসে আছেন। কোনো কোনো পেশাজীবী আপত্তি জানাচ্ছেন, তাদেরকে নেতিবাচক চরিত্রে দেখানো যাবে না। যে কারণে চলচ্চিত্রের বিষয় হিসেবে তেমন বৈচিত্র্যময় কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা কমছে। দক্ষ কলাকুশলি তৈরির কোনো ইনস্টিটিউট না থাকায়, যা নির্মিত হচ্ছে সেসবেও প্রযুক্তিগত মান তেমন ভালো জায়গায় পৌঁছাতে পারছে না।

আমাদের অনেকগুলো সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে চলচ্চিত্র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, কিন্তু সেখান থেকেও আমরা তেমন সম্ভাবনাময় কোনো নির্মাতা তৈরি হতে দেখছি না। স্বাধীন ধারায় নির্মিত কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রতি বছর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশগ্রহণ করছে, পুরস্কারও জিতে নিয়ে আসছে। কিন্তু অবকাঠামোগত অন্যান্য ব্যর্থতার কারণে সেসবের সুফল আমরা জাতীয়ভাবে উদযাপন করতে পারছি না।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ওপর ভর করে সৃজনশীল বেশির ভাগ শিল্প যেখানে এসে মিলিত হয়, সেটি চলচ্চিত্র। পৃথিবীতে এমন আর কোনো পেশা নেই, যে পেশায় রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, আইন, চিত্রকলা, জীবন, মনস্তত্ত্ব এবং তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহারসহ, একইসাথে শিল্প ও বাণিজ্য সবই বুঝতে হয়। সে অনুযায়ী একজন চলচ্চিত্র নির্মাতারও সবচাইতে শিক্ষিত, সবচাইতে স্মার্ট, মেধাবী এবং অগ্রসর চিন্তার মানুষ হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই ব্যাপারটি এখানে এখানো সেভাবে ঘটেনি।
…
চলচ্চিত্র
ইন্ডাস্ট্রি অন্য
যেকোনো সময়ের
চাইতে এ মুহূর্তে অনেক
বেশি চ্যালেঞ্জের
মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে
…
সাংগঠনিকভাবে যারা নানা সংগঠনে নির্বাচিত হয়ে আসছেন, তারাও কেউ যথেষ্ট প্রতিশ্রুতি নিয়ে সামনে আসতে পারছেন না। চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি অন্য যেকোনো সময়ের চাইতে এ মুহূর্তে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তাই গুরুত্ব দিয়ে ভাবলে, এই সময়ের ঘটে যাওয়া নিবার্চনও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চেয়ার তো কখনো শূন্য থাকে না। তাই এই চাওয়াটা আসলে যোগ্যতরকে পরিবর্তন আনবার চেষ্টায় সচেষ্ট দেখবার আকাঙ্ক্ষা মাত্র। আর কিছু নয়।
বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রে পারমাণবিক পরীক্ষা-নীরিক্ষা নিয়ে বলা গল্পে সেটিকে একটি দেশের সাফল্য হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু মানুষ মারার এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, সহিংসতা, নৃশংসতাকে আমার অশ্লীল মনে হয়। যেখানে উপজীব্য হিসেবে থাকে একে অপরের প্রতি ঘৃণা। রাস্তার উপর খোলা মাংসের দোকানকে আমার একইরকম অশ্লীল মনে হয়। যেখানে চামড়া ছিলানো গরুর পা আর ছাগলের কাটা মাথায় লোহার শিক ঢুকিয়ে ঝুলিয়ে রাখে প্রকাশ্য রাস্তায়। ঝুলন্ত মাংসের টুকরো থেকে টুপটুপ করে রক্ত ঝরতে থাকে।

আমাদের সেন্সরবোর্ডের নীতিমালাও একইকম। চলচ্চিত্রে নৃশংসতা দেখানো যেতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা নয়। ঘৃণা সেন্সর করে না, সেন্সরড হয় ভালোবাসা। জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে আলো ফেলবার চেষ্টা করলেই, সবাই চোখ ছোটো করে খুঁত ধরতে বসে যায়, কী জানি বলে ফেলছে! কিন্তু জাতীয় পতাকা দেখানোর একটু পরেই ‘আইটেম গান’ দেখালে কোনো সমস্যা নেই। বলা বাহুল্য, নৃশংসতা যেমন বিনোদনের বিষয় হতে পারে না, তেমনি সভ্য সংস্কৃতিও কোথাও হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে না। এটা চর্চার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। চর্চার সুযোগ রাখতে হয়। সেন্সর একটি নিয়ন্ত্রণকামী সেকেলে শব্দ। অনাধুনিক ও অগণতান্ত্রিক।
…
আমাদের নির্মিত সিনেমা দেখে
নানা অযৌক্তিক কর্তনের
রায় দেন নূন্যতম
ফিল্ম
অ্যাপ্রিসিয়েশন
কোর্সটাও যাদের করা নাই, তারা
…
ডিভিডি ব্যবহার এবং উৎপাদন কমে এসেছে সারা পৃথিবীতেই। আমাদের ভিজুয়াল এডিটরদেরও এখন আর খুব একটা ডিভিডি রাইট করতে হয় না। অনেকে করতে জানেনও না। তবে সেন্সর বোর্ডে এখনো ডিভিডি সাবমিট করতে হয়। সেটাও এইচডি রেখে ডাটা ডিভিডি দিলে হবে না। লো-রেজ হলেও অটো-রান ডিভিডি ফরম্যাটে দিতে হবে। যার রেজুলেশন দাঁড়ায় ৭২০x৫৭৬-এর কম। বোঝাতে গিয়েও লাভ হয় না। এটা তাদের ট্রেনিং ছাড়া চাকরি। আর আমাদের নির্মিত সিনেমা দেখে নানা অযৌক্তিক কর্তনের রায় দেন নূন্যতম ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সটাও যাদের করা নাই, তারা।
শুরুতে বিরাট করে লিখতে হবে ‘ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’। কিন্তু তারাই অনেক সিনেমা সেন্সর দিচ্ছেন, যেখানে আসলে লেখা থাকা উচিত– ‘এই সিনেমার পুরোটাই সমাজের স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর’।
এখানে পেশাদারিত্ব কোনো জায়গাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নির্মাণ প্রক্রিয়াতেও নেই। বেশির ভাগ প্রডাকশনের ক্রেডিট টাইটেল দেখলেই বোঝা যায় নির্মাণ প্রক্রিয়ার বেসিক জব ডিভিশনটাই আমাদের জানা নেই। কিন্তু ভঙ্গিতে বিরাট নির্মাতা, বিরাট প্রতিষ্ঠান।
এখানে মান্ধাতা আমলের সেন্সর পদ্ধতি সার্টিফিকেশনে পরিবর্তনের খসড়া হয়ে ঝুলে আছে দীর্ঘদিন। আমরা জানি, আমলাতন্ত্র কখনো প্রকৃত সংস্কৃতি চর্চার পৃষ্ঠপোষক হয় না। তাদের আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টাও অবান্তর। সংস্কৃতি বহতা নদীর মতো আপন গতিতেই এগিয়ে চলে। তবু বলবার বিষয় এটুকুই, আমাদের চর্চায় সহযোগিতা না করুক, অসহযোগিতা যেন না করা হয়। আর প্রযুক্তির পরিবর্তন কালে, আমাদের নিজেদের পেশাগত নিরাপত্তাহীনতার বোধ যেন নিজেদের আত্মবিশ্বাসকেই আক্রান্ত না করে।
শিল্প চর্চার জন্যে যেমন একটা আদর্শিক জায়গা থাকবার প্রয়োজন পড়ে, তেমনি থাকতে হয় আত্মবিশ্বাস। একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবার চেয়ে নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও পরিশ্রম দিয়ে ভালো কাজ করেও এর জবাব দেওয়া যায়।
পেশাগত নিরাপত্তার অভাববোধ আত্মবিশ্বাসের অভাববোধ থেকেই আসে। যা নানারকম দুর্বল প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। যে দেশে জীবনের নিরাপত্তা থাকে না, সেদেশে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ বলে শ্লোগান তৈরি হয়। পেশাগত নিরাপত্তার বিষয় সেখানে দ্বিতীয় সারিতে থাকে।
আত্মবিশ্বাসের অভাব নিয়ে শিল্প চর্চা হয় না, সংস্কৃতি ও পাল্টানো যায় না। জীবন এবং সংস্কৃতি দুটোই প্রবাহমান এবং সামনের দিকে মুখ রেখে চলে।
সংস্কৃতির সাথে বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আদর্শের সংযোগ থাকে। সেই বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আদর্শ একজন কৃষককে যেমন প্রভাবিত করতে পারে, তেমনি একজন শিক্ষক, আমলা কিংবা উৎপাদনের প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত একজন শ্রমিককেও প্রভাবিত করতে পারে। তাই সরাসরি উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশ না হলেও ন্যাশনাল জিডিপিতে সংস্কৃতির কন্ট্রিবিউশন থাকে। কিন্তু সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ কখনোই বাড়ে না! পৃথিবীর সব দেশেই সংস্কৃতি সরকারি এবং বেসরকারি দুই রকমের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েই এগিয়ে চলে। সব বিষয়ে সরকারের আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা প্রয়োজন হলেও বেশিরভাগ উদ্যোগ হয় বেসরকারি।
যে কোনো প্রাইভেট বা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির মেমোরান্ডাম অফ আর্টিকেল-এ ‘সিএসআর’ বলে একটি বিষয় থাকে। (ভারতে এটি ‘কোম্পানি অ্যাক্টে’র অধীন।) যেখানে বার্ষিক লভ্যাংশের একটি অংশ সমাজ সংস্কৃতির কল্যাণ মূলক কাজে ব্যয় করতে হয়। কিন্তু এই দেশের কোম্পানিগুলোর নজর কেবল ব্যাংক-লোন আর মুনাফার দিকেই। সমাজ সংস্কৃতির জন্যে কোনো দায় তাদের নেই। সরকারের দিক থেকেও এসব দেখভালের কেউ নেই। এদের বাধ্য করবার কেউ নেই।

কিন্তু যে কথাটি লিখে ও বলে ক্লান্ত হওয়ার দশা, সেটি হচ্ছে– সমাজ যদি শরীর হয় সংস্কৃতি তার মুখাবয়ব। আমরা যদি একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ ও মূল্যবোধসম্পন্ন জনগোষ্ঠী আশা করি, তাহলে সংস্কৃতি খাতে আরেকটু বেশি মনোযোগ প্রয়োজন। সংস্কৃতির উন্নয়নে আরেকটু বেশি অবকাঠামোগত পরিবর্তন এবং সৃজনশীল কাজের পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি।
চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির বয়স ৬৫ হয়ে গেছে, অথচ আজও কোনো জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র নেই।
যখন কয়েকটি সমিতি মিলে এফডিসি নামের একটি কংকালকে আগলে রাখছে, তখনো সেখানে বাতিল হয়ে যাওয়া যন্ত্রপাতির ভাড়া বাড়াচ্ছে। যখন স্বাধীন নির্মাতা কোনো প্রয়োজনেই এফডিসিতে যেতে চাইছে না, তখনো সেন্সরে জমা দিতে যাওয়ার আগে ‘এনওসি’ আনতে যেতে বাধ্য করছে, আর তার জন্যে ফি বাড়ানো হচ্ছে। ১৫ শব্দের চিঠি ডেলিভার করতে লেগে যায় ১৫ দিন। গত ৭ বছর যাবৎ শোনা যাচ্ছে সারা দেশজুড়ে ১০০ সিনেপ্লেক্স হচ্ছে, হবে…। অথচ একটারও কোনো নামগন্ধ নেই।
আর চলচ্চিত্র যেহেতু তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে তাই আদতে এটিকে হয়তো সংস্কৃতি বলেই মনে করা হয় না। যেহেতু গোড়াতেই গলদ নিয়ে আমরা পথ চলছি, যেহেতু লড়াই করতে গেলে শূন্য থেকেই শুরু করতে হবে, তাই অনেকের হয়তো আর এসব বিষয়ে কথা বলবারও আগ্রহ অবশিষ্ট নেই।

তবু পরিবর্তনের প্রত্যাশা থাকবেই। একদিন নিশ্চয়ই অবকাঠামোর পরিবর্তনসহ সংস্কৃতিখাতে পৃষ্ঠপোষকতা আরও বাড়বে, সেই আশাবাদ রাখতে চাই।
আশা রাখতে চাই, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকল পদ-পদবী’র অধিকারীগণ চলচ্চিত্র বিষয়ে বাধ্যতমূলক অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স করবেন। অনুদানপ্রাপ্ত খেলাপি নির্মাতাসহ চলচ্চিত্র বিষয়ে ন্যূনতম কোর্স করা নেই– এমন কেউ অনুদান কমিটিতে, সেন্সরবোর্ডে, জুরি বোর্ডে থাকবেন না।
নতুন প্রজন্মের ভাবনা ও প্রযুক্তির পরিবর্তনটুকু বোঝার সক্ষমতা নেই– এমন অগ্রজ মানুষজন নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকলে, কেবল চেয়ারটাই দখল করে থাকা হয়। সংস্কৃতির যাত্রাপথে কোনো কিছু যোগ করতে সমর্থ হন না।
…
সত্যিকারের শিল্প
কখনোই
শ্লোগান
নির্ভর
নয়
…
দেশটাকে যে যার মতো করে সবাই ভালোবাসে। অন্যের দেওয়া ফরমুলা অনুযায়ী বাসতে না পারলেই মতানৈক্য ঘটে। সৃজনশীলতার চর্চাও যে যার মতোই করে যায়। অন্যের দেওয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী করতে গেলে কিছু হয় না। আর্ট মানে ফাইট, ক্যামেরা যখন রাইফেল, কলম যখন বন্দুক, নাটক যখন দর্পণ, এইরকম শ্লোগানগুলোকে লিটারেলি নিয়ে ফ্রেমে বাঁধাই করে ফেললে খুব হাস্যকর লাগে। পোস্টার প্লে’র কথা জানা আছে। কিন্তু ঐসব শ্লোগানের সাথে সৃজনশীলতার আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। সত্যিকারের শিল্প কখনোই শ্লোগান নির্ভর নয়। কোনোদিন ছিল না। ক্লিশে হয়ে যাওয়া পুরনো কোটেশনগুলোর সাথে আমরা যখন বর্তমানের ভাবনা মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তখনি আসলে মিস করে ফেলি আগামী দিনের ট্রেন। প্রতিটি দিনই নতুন একটি দিন। প্রতিটি সময়ই যেমন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে, তেমনি নিয়ে আসে নতুন সম্ভাবনা।
এখানে সৃজনশীল কাজের জন্যে অনুপ্রেরণা বা উদ্দীপনা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যারা কাজ করছেন, তারা কোনো প্রাপ্তিযোগের আশা ছাড়াই ‘সেল্ফ মোটিভেটেড’ বা স্বপ্রণোদনায় কাজ করছেন। আশা করতে চাই, কোভিডকালীন সময় পেরিয়ে আমাদের চলচ্চিত্র নতুন আলোয় নতুন করে প্রস্ফুটিত হবে। পরিবর্তন দেখবার প্রত্যাশাতেই আমাদের আগামী দিনের জন্যে বেঁচে থাকা।
প্রথম প্রকাশ: বাংলা ট্রিবিউন; ৩ এপ্রিল, ২০২১ [লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত]