দ্য প্যাসেঞ্জার: ঘর নেই, আছে ঘরের দিকে যাওয়া

376

লিখেছেন: জিম ইসমাইল

দ্য প্যাসেঞ্জার
Professione: reporter
ফিল্মমেকার:
মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি
স্ক্রিনরাইটার:
মার্ক পেপলো
এনরিকো সান্নিয়া
মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি
প্রডিউসার: কার্লো পন্তি
মিউজিক: ইভান ভান্দোর
সিনেমাটোগ্রাফার:
লুচিয়ানো তভোলি
কাস্ট [ক্যারেক্টার]:
জ্যাক নিকোলসন [ডেভিড লক]
মারিয়া স্নাইডার [‘মেয়েটি’]
ভাষা: ইংরেজি; জার্মান; স্প্যানিশ; ফ্রেঞ্চ
দেশ: ইতালি; স্পেন; ফ্রান্স
রানিংটাইম: ১২৬ মিনিট
রিলিজ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫


“শূন্য থেকে মুক্তি চাই।
শূন্য থেকে আমাদের পরিত্রাণ চাই।
আমাদের একটা কিছু গ’ড়ে যেতে হবে।”
–কয়েকজন কুমোরের কাহিনী/ প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত

শূন্য, অর্থাৎ একাকীত্ব; অস্তিত্বের অর্থহীনতা। মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনির প্রধান চরিত্রগুলো অধিকাংশ এক ধরনের আধ্যাত্মিক শূন্যতাবোধে আক্রান্ত। সেখান থেকে আসে বিচ্ছিন্নতাবোধ। বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রবাহই আন্তোনিওনির চলচ্চিত্রগুলোকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে বলে মনে হয়। এই মূল্যায়ন কতটা যথার্থ, তা আন্তোনিওনির দ্য প্যাসেঞ্জার ছবিটি আলোচনার সূত্রে ভেবে দেখা যেতে পারে।

ছবির প্রধান চরিত্র ডেভিড লক [জ্যাক নিকোলসন] একজন টেলিভিশন রিপোর্টার। লক ব্যক্তিজীবনে ব্যর্থ ও বিপর্যস্ত মানুষ। ছবির শুরুতেই দেখি, ডেভিড লক আফ্রিকার দরিদ্র এক শহর ছাদে [Chad] আসে। উদ্দেশ্য, ছাদে গেরিলা যুদ্ধের ওপর একটি তথ্যচিত্র তোলা। সে স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করে। প্রথমে ইংরেজিতে, তারপরে ভাঙা ফরাসিতে কথা বলে। কিন্তু কাজ হয় না বিশেষ। তারা লকের কথা বুঝতে পারে না। এদিকে লক স্থানীয় ভাষা বোঝে না। ফলে তাদের মধ্যে কোনোরকম ‘যোগাযোগ’ তৈরি হয় না। এরপরে একটি লং শটে দেখানো হয়, সাহারা মরুভূমির উপর দিয়ে লকের ল্যান্ডরোভার এগিয়ে চলেছে বিদ্রোহীদের আস্তানার খোঁজে। কিন্তু লকের গাইড তাকে মাঝপথে ফেলে চলে যায়।

লক হোটেলে ফিরে আসার চেষ্টা করে; কিন্তু তার গাড়ি মরুভূমির বালিতে আটকে যায়। লক আপ্রাণ চেষ্টা করে ফেঁসে যাওয়া গাড়ি উদ্ধার করতে, কিন্তু পারে না। আকাশের দিকে দু’হাত তুলে লক রাগে চিৎকার করে ওঠে। আর পাশেই বালিতে আটকে থাকা তার ল্যান্ডরোভার, লকের ব্যর্থ, দিকভ্রষ্ট জীবনের প্রতীক হয়ে পড়ে থাকে। এইভাবে, প্রায় সংলাপ ব্যবহার না করেই, কয়েকটা মাত্র দৃশ্যের মাধ্যমে আন্তোনিওনি-সুলভ দক্ষতায় ছবির প্রধান চরিত্রের রিক্ত জীবন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

লক হোটেলে ফিরে আসে। ক্যামেরা লকের সঙ্গ নেয়, হোটেলের দেওয়াল বেয়ে এগিয়ে যেতে থাকে তার সাদামাটা ঘরের দিকে। এই রুক্ষ মরুভূমি, বিবর্ণ ল্যান্ডস্কেপ, হোটেলের শাদা দেওয়াল এক বিশেষ মেজাজ সৃষ্টি করে। এ সবই যেন লকের বিবর্ণ জীবনের অনুষঙ্গ। এরপর দর্শককে কোনোরকম প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়ে, পরিচালক অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে একটি মৃত্যুদৃশ্য রচনা করেন।

দ্য প্যাসেঞ্জার। ফিল্মমেকার: মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি

লক তার হোটেলের প্রতিবেশী ডেভিড রবার্টসনের ঘরে তাকে মৃত অবস্থায় পায়। জীবনযুদ্ধে অবসন্ন লক এই সুযোগ গ্রহণ করে। নিজেকে হারিয়ে নিজেকেই খুঁজে পাবার বাসনা তৈরি হয় লকের মধ্যে। লক, ডেভিড রবার্টসনের মৃতদেহকে ডেভিড লক বলে ঘোষণা করে আর নিজেকে ডেভিড রবার্টসন বলে প্রতিপন্ন করে। আইডেন্টিটি শিফট ঘটে যায়।

ডেভিড লক এইভাবে একটি ব্যর্থ জীবন থেকে পালিয়ে একটি সার্থক জীবন খুঁজে পাবার অভিযান শুরু করে। হয়তো-বা, এই অদল-বদল প্রতিটা মানুষের মধ্যে ঘটে চলে প্রতিনিয়ত।


সাক্ষাৎকার
নেওয়ার সময়
সে শাসকের মিথ্যে
কথাগুলোর কোনো
কাউন্টার
করে
না

লকের জীবনের উপর কোনো আস্থা ছিল না। সে বিচ্ছিন্ন, একক। তার কোনো আদর্শ নেই। আফ্রিকার সেই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে তার কোনো পক্ষ নেই। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় সে শাসকের মিথ্যে কথাগুলোর কোনো কাউন্টার করে না। তার স্ত্রী রাচেল বলে, ‘You’ve got no real dialogue’; আর তাই লক একটি সার্থক জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল, আর সেই লোভেই তার রবার্টসনের স্কিনে ঢুকে পড়া। কারণ তার মনে হয়েছিল, রবার্টসনের একটি সুখী জীবন আছে।

কিন্তু রবার্টসনের জীবন যাপন করতে গিয়ে সে বুঝতে পারে, সার্থকতা ছিনিয়ে নেওয়া যায় না, নিজেকে অর্জন করে নিতে হয়।

দ্য প্যাসেঞ্জার

অন্যদিকে, এই ছবির নায়িকার [মারিয়া স্নাইডার] অবস্থান বিপরীত মেরুতে। তাকে ক্যামেরা যখন প্রথম ইন্ট্রডিউজ করে, আমরা দেখি সে একটি পার্কে বসে বই পড়ছে, তার চারপাশে গাছেদের সবুজ পাতা। একটি পবিত্র মুহূর্ত বলে মনে হয়। আর্কিটেক্টের ছাত্রী। অর্থাৎ, সে নির্মাণ করে। কিন্তু এহেন নায়িকাও ডেভিড লককে কোনো সার্থকতায় পৌঁছে দিতে পারে না।

নায়িকা, ডেভিড লককে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে লক অন্য উপলব্ধিতে পৌঁছেছে। লক ক্লান্ত– তার এই ক্লান্তি শুধু শারীরিক নয়; জীবনোপলব্ধির নাভিমর্মে পৌঁছে উপলব্ধির যে ভার, তা এই ক্লান্তির কারণ। সে নায়িকাকে একজন অন্ধ লোকের গল্প শোনায়। একজন অন্ধ হঠাৎ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছিল। প্রথমে তার খুব আনন্দ হয়। স্বাভাবিক। কিন্তু পরে যখন সে এই যন্ত্রণাক্লিষ্ট জান্তব বাস্তবকে প্রত্যক্ষ করে, তখন সে আত্মহত্যা করে।

”দিনের আলোর দিকে তাকালেই দেখা যায় লোক
কেবলি আহত হ’য়ে মৃত হ’য়ে স্তব্ধ হয়…”

আমরা প্রস্তুত হই ক্লাইম্যাক্সের জন্য ।

দ্য প্যাসেঞ্জার

নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তোনিওনিকে বিচার করলে তাকে কাব্যিক বলে মনে হয়। দ্য পাসেঞ্জার ছবির শেষ সাত মিনিট আমাদের চৈতন্যকে নিয়ে যায় কবিতার উপলব্ধিতে। অবশ্য পুরো ছবিতেই পাওয়া যায় অন্তর্লীন কবিতার স্রোত। রোপওয়েতে যেতে যেতে যখন নীল সমুদ্রের উপর দুহাত বাড়িয়ে লক ঝুঁকে পড়ে, তখন একটি ক্লান্ত মানুষের মুক্তির সন্ধানের দৃশ্যকল্প রচনা করে কবিতা– যা এই ছবির শেষ সাত মিনিটে আরও স্পষ্ট করে কবিতার দিকে ঝুঁকে পড়ে:


আন্তোনিওনি
গোধূলির
রঙ,
সংগীত
ও আঙ্গিক
ব্যবহার করে
দর্শককে ধাপে
ধাপে নিয়ে যান
অনুভূতির চরমে

হোটেল লা গ্লোরিয়ার ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে লক। ক্যামেরা একটি ছেদহীন শটে ট্র্যাক করে নায়কের ঘর থেকে জানালার বাইরে চলে যায়– বাইরে এক বৃদ্ধ, অট্টহাস্যের শব্দ, গোধূলি নামছে, ক্লান্ত নায়ক– এই শ্রান্তি, এই গোধূলি, এই বিষাদ, এখানেই তো কবিতা! এই মুহূর্তগুলো অন্যরকম একটা গাঢ়তা এনে দেয় গল্পে। এইভাবে আন্তোনিওনি গোধূলির রঙ, সংগীত ও আঙ্গিক ব্যবহার করে দর্শককে ধাপে ধাপে নিয়ে যান অনুভূতির চরমে।

ক্যামেরা প্যান করে আবার হোটেল লা গ্লোরিয়ার সেই ঘরে ফিরে আসে। আমরা দেখি, বিছানার উপর লকের মৃতদেহ পড়ে আছে, দুই হাত দু দিকে প্রসারিত– ক্রুশবিদ্ধ যিশু যেন! মনে হয় জীবনানন্দের কবিতার মুখোমুখি আমরা:

‘কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম– অবিরাম ভার
সহিবে না আর…’

ছবির প্রাথমিক অধ্যায়ে আমরা দেখেছিলাম একটি মৃত্যু, ছবির শেষেও একটি মৃত্যু। দুই মৃত্যুই নির্জন হোটেলের একটি ঘরে। প্রথম মৃত্যুতে শুরু হয় একটি জীবন, দ্বিতীয় মৃত্যুতে সেই জীবনের সমাপ্তি ঘটে। দুই মৃত্যু একে অপরের পরিপূরক।


আজকের সময়ের মানুষের
একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতার
অনুভবকে এই
ছবিতে টের
পাই, যা
আসলে
কবিতার
অনুভব, কিন্তু
উচ্চারিত হয়েছে ফিল্মের ভাষায়

শেষ দীর্ঘায়িত দৃশ্যে, ক্লান্ত বিষণ্ণতার অনুভব আছড়ে পড়ে দর্শকচৈতন্যে। আজকের সময়ের মানুষের একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতার অনুভবকে এই ছবিতে টের পাই, যা আসলে কবিতার অনুভব, কিন্তু উচ্চারিত হয়েছে ফিল্মের ভাষায়। আধুনিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্যেকার যে বহুব্রীহি আন্তঃসম্পর্ক, তা উন্মোচিত হয়েছে। আন্তোনিওনি জীবনের অলিগলি পেরিয়ে এসে পৌঁছে যান জীবনসত্য উপলব্ধির একাকীত্বে। আর তাই আমরা দেখি, আন্তোনিওনির প্রধান চরিত্ররা একা– জীবন থেকে নির্বাসিত– আউটসাইডার।

শুরু থেকেই আমরা দেখি, সংলাপে লকের অনাগ্রহ। আন্তোনিওনির ছবিতে সংলাপের এই যে ডিট্যাচমেন্ট বা নিরাসক্তি তার ফলে তার ছবিতে ল্যান্ডস্কেপকে হয়ে উঠতে হয় একটি চরিত্র। এই প্রসঙ্গে একটি দুর্দান্ত কম্পোজিশনের উল্লেখ করা যায়। বার্সেলোনাতে একটি হোটেলের ছাদের দৃশ্য। দৃশ্যটির ফোরগ্রাউন্ড ও ব্যাকগ্রাউন্ডে আমরা দেখি অসংখ্য গম্বুজ, উঁচু-নিচু সিঁড়ির ধাপ, এদিক সেদিক ভেন্টিলেটর। বোঝা যায়, লকের সামনে এগিয়ে যাবার সহজ কোনো পথ নেই। লোকেশনের ও ক্যামেরার এই মননশীল ব্যবহারে কম্পোজিশন বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

দ্য প্যাসেঞ্জার

দ্য প্যাসেঞ্জার ছবির অধিকাংশ ব্যাকগ্রাউন্ডে স্থিতির অভাব দেখি। ছবির ঘটনাগুলো ঘটছে প্রধানত কোনো হোটেলে, ক্যাফেতে অথবা রাস্তায় অথবা গাড়িতে। মনে পড়ে যায় কবি অমিয় চক্রবর্তী একবার তার কোথায় চলেছ পৃথিবী কবিতায় উচ্চারণ করেছিলেন:

‘কোথায় চলেছ পৃথিবী।
আমারও নেই ঘর
আছে ঘরের দিকে যাওয়া।’

আমাদের প্যাসেঞ্জারেরও আছে অস্তিত্বের খোঁজে ছুটে যাওয়া। শূন্য থেকে সে পরিত্রাণ চেয়েছিল।…

Print Friendly, PDF & Email