এরিক রোমের কহে, শোনে পূণ্যবান

362
এরিক রোমের

মূল: এরিক রোমের
ভূমিকা ও অনুবাদ: তানভীর পিয়াল

ভূ মি কা
এরিক রোমের [২১ মার্চ ১৯২০–১১ জানুয়ারি ২০১০]। ফরাসি নিউ ওয়েভ বা ‘নুভেলভাগ’ আন্দোলনের প্রতিভূদের একজন। নির্মাতা বন্ধুদের ভিড়েও তিনি স্বকীয়। স্টাইল ও ভাবনায় রেখেছেন মৌলিকতার স্বাক্ষর। তাকে আর তার সিনেমাকে বুঝতে, যুঝতে হলে আমাদের কান ও চোখ পাততে হবে তার কথায়, লেখায়। সারা জীবন ধরে নানান সাক্ষাৎকারে নিজেকে বিবৃত করেছেন তিনি। সেই অজস্র কথামালায় বর্ণিত রোমেরকে তুলে আনতে চেয়েছি এ গদ্যে। বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে তার নিজের সম্পর্কে, সমকাল সম্পর্কে, সর্বোপরি সিনেমা সম্পর্কে যে উজ্জ্বল উদ্ধৃতি, তারই কিছু নির্বাচিত অংশ ঈষৎ সম্পাদিতভাবে এখানে ভাষান্তরিত হলো।


সিনেমার ব্যাপারে কাইয়্যে দ্যু সিনেমার বন্ধুদের তুলনায় বেশ দেরিতেই আগ্রহ আসে আমার, তখন আমি ছাত্র। এর আগ পর্যন্ত সিনেমাকে যাচ্ছেতাই ভাবতাম; বরং পড়তে, আঁকতে ভালো লাগতো, পরে আগ্রহ আসে সংগীতে। থিয়েটারও করিনি কখনো, এমনকি খুব বেশি যাইওনি সেখানে। ক্লাসিকাল ফরাসি থিয়েটার, বলতে গেলে রাসিন, কর্নেইল, মলিয়ের আমার পছন্দ হয়েছিলো, তবে সেসব দেখার চেয়েও বেশি ভালো লাগতো পড়তে। সিনেমাকে আবিস্কার করি সিনেমাথিক-এ।* মুভিজে গিয়ে সিনেমা দেখার মাধ্যমে একে আবিস্কার করিনি।

সিনেমা ভালো লাগতে শুরু করলো, কারণ আমার নির্বাক ছবি বেশ ভালো লেগে গেলো। এ মুগ্ধতা থেকেই ইচ্ছে হয় সিনেমা তৈরির। কিছু শৌখিন ছবি করবার চেষ্টা করি, কিন্তু টাকা ছিলো না, কোনো আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম ছিলো না, আসলে কিছুই ছিলো না। ফলে, প্রতিবন্ধকতা ছিলো। জুটলাম গিয়ে ফিল্ম সোসাইটিতে, জড়িয়ে গেলাম এসব যোগাড়যন্তের কাজে এবং বন্ধু বানালাম, আমরা সবাই তখন যথেষ্ট জোয়ান এবং সকলে মিলে ঠিক করলাম ফিল্ম বুলেটিন করবো। এটি সেই সময়, যখন দ্য ফ্রেঞ্চ স্ক্রিন গুটিয়ে যায় এবং কোনো সাপ্তাহিক ফিল্ম জার্নাল আর ছিলো না।

আমাদের মধ্যে শ্যাব্রলই শুরু করেছিলো সবার আগে, নিজের টাকায় প্রযোজনা সংস্থা খোলে, কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই সফলভাবে সিনেমাও বানালো সে [Le Beau Serge]। যদিও সিনেমাটা আদৌ মুক্তি পাবে কি না, তা-ই নিয়ে খুব দুর্ভাবনায় পড়তে হয়েছিলো সেসময়, এবং মুক্তি না পেলে হয়তো নুভেলভাগ’ই আর হতো না। যদিও প্রথমটার প্রায় সাথে সাথেই আরও একটি সিনেমা [Les Cousins] বানিয়ে ফেললো সে। প্রথম ছবিটি দেখিয়ে এক জায়গা থেকে পরের সিনেমার জন্য ভর্তুকি পায় শ্যাব্রল। তাই দিয়েই প্রথম সিনেমাটা মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয় এবং পেয়ে যায় দুর্দান্ত সাফল্য।

শ্যাব্রলের পরপরই ত্রুফো নিয়ে এলো 400 Blows, যদিও এটা তার প্রথম নয়, এর আগেই ৩৫মিমি’তে স্বল্পদৈর্ঘ্য Les Mistons বানিয়েছিলো। আমিও বেশ কিছু ১৬মিমির ছবি করেছি, এবং আমার প্রথম সত্যিকারের সিনেমা প্রযোজনা করেছে শ্যাব্রলেরই প্রতিষ্ঠান, Les Cousins-এর পরের বছরই ১৯৫৯-এ, এবং সিনেমাটা ছিলো Le Signe du Lion। একই সময়ে গোদার বানাচ্ছে Breathless

তো, আমার শুরুটা এভাবেই, যে সময়টাকে বলা হচ্ছে নুভেলভাগ, তখনই।

ফুল মুন ইন প্যারিস। ফিল্মমেকার: এরিক রোমের

সার্বিকভাবে নির্বাক ছবি কতোটা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে, আমি জানি না। লোকে বলে আমার সিনেমায় নাকি প্রচুর কথা; আমি নাকি আমার বক্তব্য ইমেজের পরিবর্তে কথার মাধ্যমে প্রকাশ করি; অথচ আসল ব্যাপার হলো আমি সিনেমা সম্পর্কে যা জানি তার বেশিরভাগই জেনেছি গ্রিফিথ, স্ট্রোহাইম ও মুরনৌ, এমনকি নির্বাক কমেডি ছবি দেখে। এভাবেই সিনেমাটা শিখেছি।

নির্বাক যুগের পর দুজন নির্মাতার কথা বলতে পারি যাদের সিনেমা আমি প্রচণ্ডভাবে পছন্দ করি, জ্যঁ রেনোয়া আর রোবের্তো রোজেল্লিনি; এরাই আমাকে সবচেয়ে প্রভাবিত করেছে। বাকিদের ক্ষেত্রে, আমি আমেরিকানদেরও তারিফ করি, যেমন হিচকক, তবে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হই বলে মনে করি না; যদি হয়েও থাকি, তা অত্যন্ত অসচেতনে। কাকে আমার ভালো লাগে তা বলতেই পারি, কিন্তু প্রভাবের ব্যাপারটা ভিন্ন, অনেক সময় আপনি জানবেনই না কে আপনাকে প্রভাবিত করছে।


লোকে
আমার চেহারা
চেনে না, তাই আমি
গণপরিবহনে চড়তে পারি
অনায়াসে

মিডিয়াতে আমি চেহারা দেখাই না। লোকে আমার চেহারা চেনে না, তাই আমি গণপরিবহনে চড়তে পারি অনায়াসে। যদি আমি বড় হোটেলে থাকি এবং সাধারণের থেকে দূরে সরে যাই, তা আর পারবো না। এর সবচেয়ে বড় সুবিধাটা পাই যখন শ্যুটিংয়ে নামি। লোকজন আমাকে বা আমার অভিনেতাদের চিনতে পারে না বলে সহজেই রাস্তা-ঘাটে কাজ সেরে ফেলতে পারি।

আমি সবসময় নিজের মতো করে স্বল্পপরিসরে শ্যুটিং করতে পছন্দ করি, এবং সেসব মোটেই ব্যয়বহুল নয়। শ্যুটিং করতে আমি ভালোবাসি, এমনকি যখন স্টুডিওতে থাকি তখনও, প্রকৃতির ছবি নিতে ভালো লাগে এবং সিনেমাটোগ্রাফির কাব্যিকতায় খুব গুরুত্ব দিই।

কাজ করার একটা খুব ব্যক্তিগত পদ্ধতি রয়েছে আমার এবং ফ্রান্সে এক্ষেত্রে প্রচুর স্বাধীনতাও পাই। আমি একটি অত্যন্ত ছোট সহযোগী দল নিয়ে কাজ করি; আমার কোনো সহকারী পরিচালক নেই, স্ক্রিপ্ট লেখার জন্য কোনো লেখিকা নেই এবং কন্টিনিউটি দেখার কাজটাও নিজেই করি। হয়তো ভুল করি, হয়তো এখানে একটা অ্যাশট্রে রাখার কথা, অথচ রেখে দিচ্ছি অন্য কোথাও।

আমি অল্প কয়েকজন টেকনিশিয়ান নিয়ে কাজ করি; কেননা ক্যামেরার গতিবিধি খুব বেশি থাকে না, কিন্তু তারা বেশ চৌকস। অন্যান্য দেশে ক্রু দল থাকে ভয়াবহ আকারের। আমি যেখানে কাজ করি পাঁচ থেকে ছ’জন নিয়ে, সেখানে ওদের থাকে ষাট! ব্যাপারটা আমার জন্য রীতিমতো ভয়ঙ্কর এবং আমি ওভাবে কাজই করতে পারবো না। আমি বিগ বস হয়ে ওদের শাসন করতে চাই না, বরং মিলেমিশে থাকতেই পছন্দ করি।

লোকে প্রায়ই বলে আমি নাকি এমন সিনেমা তৈরি করি যা পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ এবং তারা ঠিকই বলে; এটিই স্বাভাবিক, কারণ আমি পরিপূর্ণভাবেই একজন অথর, সেই ব্যক্তি যিনি সিনেমাটা নির্মাণ করেন, বিষয়ের দিকে নজর রাখেন, এবং একইসাথে ইমেজও তৈরি করেন। আমার সিনেমাগুলো সব পরপর দেখলেই ভালো। সবগুলো সিনেমার মধ্যেই রয়েছে আন্তঃসম্পর্ক, আর মজাটা সেখানেই। সিনেমাগুলো হয়তো ভালো বা খারাপ, কিন্তু তাদের বুঝতে সেই সম্পর্কের গুরুত্ব রয়েছে।

মাই নাইট অ্যাট মড’স। ফিল্মমেকার: এরিক রোমের

অভিনেতাদের ব্যাপারে আমি বেশ ভাগ্যবান। যা আমি লিখি, তাদের সাথে সেসব চমৎকার মানিয়ে গেছে। আমার বেশিরভাগ অভিনেতাই আদতে পরিচালক, থিয়েটারে বা সিনেমায়– এটকিন, দোম্বাসলে, রোজেট– তাদের বুদ্ধিমত্তা আমার কাছে বেশ আবেদনময়।

লোকে যখন ‘অভিনেতাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক’ বিষয়ে কথা বলে, কিছুটা বিব্রত হই, কেননা, ব্যাপারটা আপনাতেই ঘটে। এবং আমি মনে করি সিনেমায় এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে বরং স্বাভাবিক আচরণে আস্থা রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বেশিরভাগ সিনেমাতেই দেখি হস্তক্ষেপ করা, ক্যামেরার সামনে বেশি কিছু করতে চাওয়া, একটু বেশিই নির্দেশনা দেওয়া, অনেক বেশি বলা– এসবই স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। তো, এক্ষেত্রে, আমি অন্যদের মতোই ‘নিউ ওয়েভ’, যেমনটা ধরুন গোদার, তবে হ্যাঁ, তার চেয়ে কম পদ্ধতিগতভাবে।


গোদার
চলচ্চিত্রকার
হিসেবে বড় হয়ে
উঠলেও সাধারণের
কাছ থেকে দূরে সরে গেছে

সত্যি বলতে, গোদার চলচ্চিত্রকার হিসেবে বড় হয়ে উঠলেও সাধারণের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে, সেখানে শ্যাব্রল বরং আরও বাণিজ্যিক, জনতার। আমি মনে করি, যে মূল্যবোধ নিয়ে সেসময় আমরা সিনেমা করতে এসেছি, তার প্রতি এখনও প্রত্যেকেই কম-বেশি নিষ্ঠাবান।

আমার মতে সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো: আমরা একই অভিনেতাকে বারবার দেখাই, অনেকটা স্টার সিস্টেমের মতো। যদি একান্তই মৌলিক বলে কিছু দাবি করি কখনও, আমি বলবো, তা এসেছে সেসব স্টারদের ব্যবহারে আমার অস্বীকৃতি জানানো থেকে; তারা পয়সা এনে দেয় ঠিকই কিন্তু তাতে আমার সিনেমাই হারাতে বসবে। আরও জোরালোভাবে বলতে গেলে: এ সময়ে এসে আমার মনে হয়, হলে দেখানো সিনেমার তুলনায় টিভির জন্য বানানো সিনেমাগুলো ভালো। সামগ্রিকভাবে টিভির জন্য বানানো ছবিগুলোতে দেখবেন ফরাসি সমাজের প্রতিফলনের ক্ষেত্রে, নতুন অডিও-ভিজুয়াল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে, এমনকি আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে– সিনেমার চেয়ে টিভি শতগুণে ভালো।

প্রায়ই, হলের জন্য বানানো সিনেমা যখন টিভিতে দেখায়, দেখি সেসব জঘন্য অভিনয়ে তৈরি। টিভিতে প্রচুর দুর্দান্ত অভিনেতা রয়েছেন, যারা তারকা নন। এছাড়া, টিভিফিল্মগুলোর এক ধরনের আকর্ষণ আছে যা হলের সিনেমাগুলোতে আর নেই; কারণ এসবের নির্মাণব্যয় যথেষ্ট কম এবং দ্রুত তৈরি হয়। এ ধরনের সিনেমার মান তার চিত্রনাট্য বা পরিচালকের নয়, বরং অনেকটাই এর অভিনেতা, এর বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে (অনেকটা ১৯৩০-এর দিকের ফরাসি বা মার্কিন সিনেমার মতো)।

রোমান্স অব অস্ট্রি অ্যান্ড সেলাডন। ফিল্মমেকার: এরিক রোমের

ফরাসি টিভিতে ‘আমাদের সময়ের চলচ্চিত্র নির্মাতারা’ সিরিজের জন্য কয়েকটা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছি আমি। এটি সমালোচক হিসেবে আমার কাজের চেয়েও বাড়তি কিছু, এবং নিশ্চিতভাবেই তা চলচ্চিত্র নির্মাণ ছিলো না। তবে শিক্ষাবিষয়ক টিভির জন্য বেশ কয়েকটা স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছি, যা আদতেই সিনেমা ছিলো এবং আমার বেশ ভালোও লেগে যায়। বা বলা যায়, অন্যান্য যেসব কাজ আমি করেছি সেসবের মতোই ভালো লাগে। কখনো কখনো একজন শিক্ষাবিদের সহযোগিতায় আমি কাজ করেছি স্রেফ একজন ‘পরিচালক’ হিসেবে, সেসব মূলত আমার রুটি-রুজির কাজ।

টেলিভিশন ‘পাঠযোগ্য’ ইমেজ তৈরি করতে শেখায়। যদিও বিস্ময়করভাবে, আমি লক্ষ্য করেছি সিনেমা হলের জন্য নির্মিত ছবিগুলো অনিবার্য ক্ষতির পরও টেলিভিশনের জন্য তৈরিকৃতগুলোর চেয়ে বেশি ‘পাঠযোগ্যতা’ সম্পন্ন। আপনি যখন কোনো সিনেমা টিভিতে দেখান, ফ্রেমিং নষ্ট হয়ে যায়, সরলরেখাগুলো বিকৃত হয়ে যায়, সেটের সজ্জাকে আর নিরেট ও ত্রিমাত্রিক মনে হয় না। এক্ষেত্রে La Carrière de Suzanne-এর মতো ছবির কথাই ধরা যাক, যার পুরোটাই একজন নারী সুন্দর নাকি রূপহীন– তা নির্ধারণের সমস্যা নিয়ে।

গড়পড়তা টিভিসেটের ছবির মান এতোটাই যাচ্ছেতাই যে আপনি কিছুই বুঝবেন না। ব্যক্তির সৌন্দর্য টিভিতে পুরোপুরি বোঝা যায় কেবল ক্লোজ-আপে, তাও প্রায়ই ভয়েস এক্ষেত্রে সহায়তা করে বলে সব মিলিয়ে খারাপ আসে না। কিন্তু মানুষ যেভাবে দাঁড়ায়, হাঁটাচলা করে– এই যে শারীরিক বহুমাত্রিকতা… তা হারিয়ে যায়।


সিনেমা?
এ এক অবিরাম
ও নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ

ব্যক্তিগতভাবে আমি টেলিভিশনকে ‘একান্ত’ মাধ্যম হিসেবে দেখি না। যখন কেউ টিভি দেখে, সে পুরোপুরি অন্ধকারে থাকে না, পুরো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্নও হয় না, সে স্ক্রিনের সামনে, এর ভেতরে কিন্তু নয়। কিন্তু সিনেমা? এ এক অবিরাম ও নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ।

আমি দর্শকসংখ্যা নিয়ে ভাবি না। তবে যতো যাই বলি, সিনেমার যে বাণিজ্যিক দিক আছে এবং এর সাথে পুঁজি উদ্ধারের বিষয় জড়িত– তা অস্বীকার করবার জো নেই। কিন্তু যেহেতু আমার ছবি স্বল্প খরচের, মনে হয় না আমার খুব বড় দর্শকশ্রেণি প্রয়োজন, এবং আমি সবসময়ই এই ছবিগুলো ছোটো হলে দেখানোই উচিত বলে ভেবে এসেছি।

দ্য সাইন অব লিও। ফিল্মমেকার: এরিক রোমের

আমার ছবির একান্ত চরিত্রগুলো বড় থিয়েটার বা বিপুল দর্শকের জন্য বেমানান। আমি এও মনে করি না, তারা সামষ্টিক বা গণপ্রতিক্রিয়ার সাথে যায়। বরং যদি কোনো দর্শকের এর প্রতি খুবই ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া অনুভবের অভিজ্ঞতা হয়, সে-ই ভালো। প্রতিটা প্রতিক্রিয়াই মৌলিক, ব্যক্তিগত ও ভিন্ন হওয়া চাই।

আমি মনে করি, যদি হল পরিপূর্ণ না হয় এবং দর্শকেরা পরস্পর দূরে বসে, এবং একে অপরকে যদি না চেনে, তবেই সিনেমাটা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করা যায়। তখন প্রত্যেকের প্রতিক্রিয়াই ভিন্ন হয়। থিয়েটারে, যেখানে সকলের প্রতিক্রিয়া অভিন্ন, তার চেয়ে এটিই বরং ভালো।


আমার
সিনেমা দেখার
চেয়েও অনেক বেশি
পড়ার
মতো

জনসমক্ষে নিজের কোনো ছবি দেখতে আমারই ভালো লাগে না এবং যদি একই জায়গায় সব দর্শক একসাথে হেসে ওঠে– তা আমাকে পীড়া দেয়, কারণ এই বিষয়টা মাথায় রেখে তো সিনেমাটা বানানো হয়নি। সব দর্শককে একইসাথে হাসানোর জন্য কখনোই লিখিনি। যে কেউ হাসতেই পারে, কিন্তু তা সিনেমার একই জায়গাতেই হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এর কারণ সম্ভবত, আমার সিনেমা দেখার চেয়েও অনেক বেশি পড়ার মতো; এসব তৈরিই হয়েছে বইয়ের মতো করে পড়বার জন্য, মঞ্চে ঘটমান কিছু দেখবার মতো করে নয়। তাই সামষ্টিক প্রতিক্রিয়া দেখাটা আমার জন্য পীড়াদায়ক।

যে ধরনের সিনেমা আমি করি সেসবেরও আগ্রহীগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে ইদানিং, একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির দর্শক জানেন কী ধরনের ছবি এগুলো। আলাদা করবার নিশ্চয়ই কোনো প্রক্রিয়া আছে। চিত্রকলা, সংগীত, বই– সবক্ষেত্রেই নানান ধরনের রুচির গ্রাহক আছে, তবু কেন লোকজন মনে করে সিনেমার এক ধরনেরই বৃহৎ দর্শকশ্রেণি থাকবে? সাধারণ দর্শকরা টেলিভিশন, বৈচিত্র্য, রোমাঞ্চে আগ্রহী। এবং এজন্যেই তাদের ওপর জোর খাটানোর চেষ্টা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু আমি যে ধরনের সিনেমা করি তা একটি নির্দিষ্ট ফিল্মিক ও শিল্পরুচিসম্পন্ন দর্শককেই আকর্ষণ করে, এবং এখন এসে বুঝতে পারি এই সংখ্যা আমি যতোটা ভাবতাম তারচেয়েও অনেক বেশি।

দ্য গ্রিন ডে। ফিল্মমেকার: এরিক রোমের

কেউ কেউ হয়তো আছেন যারা ‘নতুন’ ধরনের সিনেমা করছেন, কিন্তু সেসব আসলে কতোটা নতুন তা আমাদের জানতে হবে, যদি না তা ‘চিরন্তন আভাঁ-গার্দ’-এরই এক ধরনের বিস্তৃতি হয়, যা সময়ে সময়ে কয়েক বছর আগেকার আভাঁ-গার্দের আইডিয়াগুলোই পুনরাবিস্কার করে কেবল। আমার কাছে নতুন হলো সেসব আইডিয়াগুলো যা কখনোই তার সময়ে স্থির নয়। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বেশ কিছু নতুন আইডিয়া নিজের পথ খুঁজে নেয় সিনেমায় যা কখনোই দর্শক পর্যন্ত পৌঁছায় না।

আমার মতে, তরুণদের হাত ধরে যা কিছু হচ্ছে সিনেমায় তার সবটা দেখার বন্দোবস্ত হওয়া কাম্য, নতুন সেই প্রচেষ্টা যদি পুরোপুরি সার্থক না হয়, তাও। ফ্রান্সের মতো দেশে, যেখানে প্রচুর সিনেমা হয়, আমার ধারণা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিশেষত্বপূর্ণ সিনেমা এই দেশেই হয়, সেখানেও যা কিছু নতুন হচ্ছে তা দেখানোর সুযোগ নেই, এখানে সত্যিকারের নিরীক্ষামূলক সিনেমা দেখানোর জন্য সিনেমাথিক ব্যতীত আর কোনো জায়গা নেই। তাই আমার পক্ষে এই নতুন সিনেমাগুলো সম্পর্কে মন্তব্য করা সম্ভব না।

আমার সিনেমাগুলো পুরোপুরিই ফিকশন, আমি নিজেকে সমাজবিজ্ঞানীও দাবি করি না, এবং অনুসন্ধান বা উপাত্তও সংগ্রহ করি না। কেবল নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা নিয়ে কাজ করি যা আমি নিজেই উদ্ভাবন করেছি, সেসব বিজ্ঞানসম্মত হতে হবে এমনও নয়, বরং নিতান্তই কাল্পনিক। মানুষের মাঝে যা কিছু পরিবর্তনশীল তারচেয়েও যা স্থায়ী ও চিরন্তন, বদলে যায় না– তাতেই আমার আগ্রহ, আমি সেসবই দেখাতে চাই। চরিত্রগুলোকে দেখাতে চাই বাস্তব পরিস্থিতিতে, বিশেষত সমকালীন প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিনেমাগুলোয়। এবং আমার সিনেমাগুলোতে কোনোভাবেই আভাঁ-গার্দ বলতে যা বুঝায়, তা নয়। আমি মনে করি ‘প্রথাগত আভাঁ-গার্দ’ এমন কোনো পথ নয় যে সিনেমাকে তা অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু আমি আজকালকার সিনেমাগুলো সম্পর্কে খুব বেশি জানি না, বিশেষ করে আমেরিকান সিনেমা। এ নিয়ে মন্তব্যও করতে চাই না, আমার সাথে যায় এমন ছবিই করি আমি, আর বাকিরাও করছে নিজস্ব পথে। প্রত্যেকেই তার নিজের পথ করে নেবে এবং দর্শক খুঁজে নেবে– এটাই চাওয়া।

ক্লেরা’স নি। ফিল্মমেকার: এরিক রোমের

আজকালকার সিনেমা রঙিন হওয়াটাই স্বাভাবিক, এবং সাদা-কালো সিনেমা করার চেষ্টা সেকেলে বলেই ধরা হবে। কিন্তু তা আমি পুরোপুরি মানি না। দর্শকের সাদা-কালোর প্রতি এক ধরনের পক্ষপাত আছে, তা যে কেবল ফটোগ্রাফিতে, এমনটা নয়, আঁকাআঁকি আর খোদাইয়েও– চিত্রশিল্পীরা রঙের ব্যবহারেই ছবি আঁকেন ঠিক, তবু সাদা-কালোতেও তারা কাজ করেন, নির্দিষ্ট কিছু অনুভূতি সৃষ্টিতে। ফলে, সাধারণের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, এবং এজন্যেই, যারা বলেন আজকাল সাদা-কালোতে সিনেমা করা সম্ভব নয়, তারা ভুল। এটা বেশ কৌতুহলী ব্যাপার। আমার মনে হয় সাদা-কালো সবসময়ই থাকবে, যদিও এ কথা সত্য যে রঙিন ছবিই হবে স্বাভাবিক আর সাদা-কালো হবে ব্যতিক্রম।


সাদা-কালো এক ধরনের
বুনিয়াদ দেয় ছবিতে,
এক ধরনের
অখণ্ডতা,
যা
সিনেমায়
রঙের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ

আমার ক্ষেত্রে রঙ যদি নতুন কিছু যুক্ত করে ছবিতে, অবশ্যই ব্যবহার করবো, অন্যথায় সাদা-কালোই আমার পছন্দ। সাদা-কালো এক ধরনের বুনিয়াদ দেয় ছবিতে, এক ধরনের অখণ্ডতা, যা সিনেমায় রঙের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।

একেকটা সিনেমা লিখতে আমার কয়েক বছর সময় লেগে যায়। সবগুলো সিনেমাই পুরনো। প্রত্যেকটার বিষয়ই পুরনো, এবং আমি সবসময় এদেরই ব্যবহার করবো। এদের শেকড় প্রোথিত আমার যৌবনে।

নিজেকে কখনোই আমি নাট্যকার হিসেবে দাবি করি না, এমনকি আমি লেখকই নই। বলা যায়, আমি সংলাপ লিখতে পছন্দ করি। আমি সংলাপকার। অবাক হয়ে যাই, যখন লোকে সংলাপ লেখার ক্ষেত্রে আমার সাহায্য খোঁজে! আমার ক্ষেত্রে, প্রারম্ভিক বা আইডিয়ার সময়টাই সবচেয়ে কঠিন এবং শ্রমসাধ্য, কিন্তু যখনই আমার চরিত্রদের পেয়ে যাই, তারা আপনাতেই কথা বলে ওঠে এবং বলতেই থাকে। তাদের দিয়ে বলিয়ে নেবার মতো বেশি কিছু আমার কাছে নেই, এবং এ নিয়ে আমি শঙ্কিত নই; কেবল এটুকুই জানি যে তাদের অনেক কিছু বলার আছে এবং আমার কাজ হলো তা নিয়ন্ত্রণে রাখা।

বিশেষজ্ঞ লেখক নন– এমন অনেকের মতো আমিও রাইটার্স ব্লক নিয়ে আতঙ্কিত, তাই আমি লেখা না থামানোর চেষ্টা করি। আমি নোট নিই আর বারবার সেসবের প্রতিলিখনই আমার কাজ। কিন্তু সংলাপের ক্ষেত্রে এতো দ্রুত সবকিছু চলতে থাকে যে কী লিখছি তা নিয়ে ভাবিই না এবং মাঝেমাঝে নিজের লেখাই এতো দুর্পাঠ্য ঠেকে, কারণ, যখন দ্রুত লিখি আমার হাতের লেখা খুবই বাজে হয়ে যায়, আর আমি টাইপ করতে পারি না।

অটাম টেল। ফিল্মমেকার: এরিক রোমের

অনেকেই বলে থাকেন, আমার ছবির শেষটা সবসময় দুখী দুখী। কারণ, আসলে যেমনটা হবে বলে ভাবা হয়, শেষটা তেমন না, বরং ব্যক্তির ইচ্ছেরও অতীত। যা হয় তা চরিত্রের ইচ্ছের বিপরীতে হয়, এক ধরনের বিভ্রান্তি, বিরোধ– তার দিক থেকে ঠিক ব্যর্থতা নয়, তবে এক ধরনের পতন। চরিত্রটি ভুল করে, সে বুঝতে পারে নিজের জন্য এক ধরনের বিভ্রম সে তৈরি করে ফেলেছে। নিজেকে কেন্দ্র করে নিজেরই একটা জগৎ সে তৈরি করে নিয়েছে, এবং মনে হবে যৌক্তিকভাবে সে-ই ঐ জগতের সর্বেসর্বা অথবা ঈশ্বর।

সবকিছুই মনে হবে খুব সহজ আর আমার সব চরিত্রেরই কিছুটা ঝোঁক থাকে যুক্তির প্রতি। তাদের নিজস্ব নিয়ম ও নীতি রয়েছে, এবং তারা এমন এক জগৎ তৈরি করে যা সেই নিয়মেই কেবল ব্যাখা করা যায়। আর সিনেমার শেষটুকু তাদের সেই নিয়মকে ভেঙে দেয়, তাদের বিভ্রম চুরমার করে দেয়। এটি খুব আনন্দের নয় ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই নিয়েই আমার সিনেমা।


* সিনেমাথিক ফ্রান্সের প্যারিসে স্থাপিত অলাভজনক চলচ্চিত্র সংস্থা। সিনেমা দেখানো, সংরক্ষণ এবং এ বিষয়ক আলোচনার জন্য খ্যাত।

Print Friendly, PDF & Email