যেভাবে হয়ে উঠেছি গাঙকুমারী…

945
গাঙকুমারী

লিখেছেন । তাহুয়া তুরা

ঝড় আসার আগে যেমন সবাই টের পায় এবং সতর্ক হয়ে যায়, গাঙকুমারী চলচ্চিত্রে গাঙকুমারী হলো সেই ঝড়, যে আবহমান বাঙালি নারীর আত্মরক্ষা ও সংগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করে।

বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ২০১৯-২০ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত ছবি গাঙকুমারী নির্মাণ চলছে। ছবিটির গল্প, কাহিনি ও চিত্রনাট্য রচনা করেছেন সাধনা আহমেদ, নির্মাণ করছেন ফজলুল কবীর তুহিন।

করোনা মহামারির মধ্যেই ছবিটির অনুদানপ্রাপ্তির ঘোষণা আসে। যদিও গাঙকুমারীর কথা জানার সুযোগ হয়েছিল আরও আগেই। আমাকে বলা হয়েছিল ব্যাকগ্রাউন্ডে কাজের ব্যাপারে। একদিন ঢিলেঢালা গেঞ্জি-জিন্স পরে এবং আমার অবাধ্য-অগোছালো চুলগুলো কোনোমতে বেঁধে নিয়ে পরিচালকের অফিসে যাই। সেদিনই গাঙকুমারীর নির্মাতার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত হই। কিছু কথাবার্তা হয়। গাঙকুমারী নিয়ে তখন পরিকল্পনা চলছিল কেবল। চলে আসার পর নির্মাতা বললেন, ব্যাকগ্রাউন্ডে কিংবা ফোরগ্রাউন্ডেও কাজ করতে হতে পারে। আম্মুর ক্যানসারের চিকিৎসা চলছিল তখন। পারিপার্শ্বিক নানান সংকটের কারণে এবং অভিনয়ের ইচ্ছেটা তখনো তীব্রভাবে না জন্মানোর জন্য আমি কাজটা করতে পারব না মনে হতে থাকে এবং সেটা নির্মাতাকে জানিয়েও দিই।

কিন্তু সময় আমাদের কখন, কোথায় নিয়ে যাবে সেটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা মুশকিল।

গাঙকুমারী
অ্যাকট্রেস: তাহুয়া তুরা। ফিল্মমেকার: ফজলুল কবীর তুহিন

আমার সিনেমাযাপন শুরু হয় ২০১৭ সালে কাঁটায় যুক্ত হওয়ার পর। কাঁটার অভিজ্ঞতা প্রায় পুরোটাই নেপথ্যের। শিক্ষানবিশ এডি থেকে স্ক্রিপ্ট সুপারভাইজার, সেখান থেকে কতকিছু করে এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার। সে আরেক গল্প।


তবু সিনেমা এমন, একবার
ভর করে বসলে এর
থেকে বেরিয়ে
আসা কঠিন

তো, তখন থেকেই সিনেমা দেখাও শুরু। নানান ভাষার নানান দেশের অসংখ্য সিনেমা দেখতে দেখতে প্রিয় হয়ে ওঠে কিছু সিনেমা। বেলা ড্য র্জুর, পিয়েতা, দ্য ব্যো, ইভান’স চাইল্ডহুড, টেস্ট অব চেরি, ওসামা, কোল্ড ওয়ার, বার্নিং— এমন সিনেমা দেখতে দেখতে কেন যেন হতাশ হয়ে পড়ি। মনে হয়, কখনোই বাংলাদেশে এমন সিনেমা নির্মাণ সম্ভব নয়। কত স্বপ্ন, কত ভাবনা, কত সৃষ্টি যেন মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারবে না কিছু বাধ্যবাধকতা, সীমাবদ্ধতা এবং সমাজ ব্যবস্থাপনার ট্র্যাপে পড়ে। তবু সিনেমা এমন, একবার ভর করে বসলে এর থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন।

নির্মাণের সুপ্তবাসনা মনের একপাশে রেখে পড়াশোনায় মনোযোগের চেষ্টা করি। প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিচ্ছি, এরমধ্যে লকডাউন।

গাঙকুমারী
গাঙকুমারী

দুইমাস গৃহবন্দি সময়টায় পরিবারের সঙ্গে সময়টা ভালোই চলছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পাই, গাঙকুমারী অনুদান পেয়েছে। শুভকামনা জানাই পরিচালককে। উত্তরে তিনি জানতে চান, আমি ‘গাঙকুমারী’ চরিত্রে অভিনয় করব কি না?

এবার আমি সত্যিই অবাক হয়ে যাই। একটি সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ পাব– জীবনে কখনো ভাবিনি। তবু নিজের মধ্যে যা কিছু ঘটে যাচ্ছে, তা লুকিয়ে রেখে পরিচালককে জিজ্ঞাসা করি, ‘আমি কেন?’

তার উত্তর পেয়ে আমি চূড়ান্তভাবে অবাক হয়ে যাই। অফিসে প্রথম যেদিন আমাকে দেখেন, তখনই তিনি আমার মধ্যে গাঙকুমারীকে দেখে পেয়েছেন। তবু নানান যাচাই বাছাই এবং আরও আরও অপশন দেখছেন। ভাগ্য বলি আর যাই বলি না কেন, এখন আমিই গাঙকুমারী।

গাঙকুমারী
গাঙকুমারী

আয়নায় নিজেকে কখনো সময় নিয়ে দেখিনি। চেহারা, আউটফিটের সচেতনতা আমার কখনোই ছিল না। নিজের শরীরকে খুব কম সময় দিতাম। কিন্তু যখন একটা ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রের ভার আমার কাঁধে, তখন অনেক কিছুই পাল্টে যেতে লাগল। চরিত্র ধারণ করতে গাঙকুমারীর আদ্যোপান্ত নখদর্পণে নিয়ে আসতে চেষ্টা করি। কথা বলি, এই চরিত্র যিনি সৃষ্টি করেছে, সাধনা আপার সঙ্গে।

তিনি আমায় অফুরন্ত ভালোবাসায় আদরমাখা কণ্ঠে বললেন, গাঙকুমারী খুব সহজ-সরল মেয়ে। শান্ত নদীর মতো। কিন্তু বেঁচে থাকার লড়াইয়ে, অন্যায়ের মুখোমুখি হলে গাঙকুমারী কিংবা অঞ্জলী হয়ে ওঠে দেবীর মতো কিংবা দেবী।

পরিচালকের নির্দেশে শুরু হয় চরিত্র নির্মাণের প্রস্তুতি। সাঁতার শিখতে চলে গেলাম নানুর বাড়ি। আমার ছোটবোন অনেক আগেই সাঁতার জানত; কিন্তু আমি পানির প্রতি ভয় কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সিনেমাকে ভালোবেসে শিখে ফেললাম সাঁতার। সুনামগঞ্জে গিয়ে শিখলাম লাঠিখেলা, নৌকা চালানো। নরসিংদী থেকে ঢাকায় এসে শুরু করলাম জিমে যাওয়া। শরীরে, মননে ধারণ করতে শুরু করলাম গাঙকুমারীকে।

শুটিংয়ের সময় যখন কাছে আসছে, তখন জানতে পারি লুক সেট হবে। সিনেমায় আমাকে কখন কেমন দেখা যাবে– তা নির্ধারণ করা হবে। লুক সেটের পর স্ক্রিপ্ট রিডিং। এই সময়টায় মনে হচ্ছিল, যা হচ্ছে সব সত্যি তো? নাকি ঘুম থেকে উঠে দেখব সব স্বপ্ন? আসলে স্বপ্নই আমার বর্তমানে ঘটে যাচ্ছে। জানতে পারি, ছবিতে অভিনয় করবেন তারিক আনাম খান, মোশাররফ করিম, শাহাদাৎ হোসেনের মতো অভিনেতা। যাদের সব ছবি আমার দেখা। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের সঙ্গে অভিনয় করতে পারাটা একই সঙ্গে যেমন আনন্দের, তেমনি প্রচণ্ড ভয়েরও। পরিচালক সাহস দেন, আরও মনোযোগ দিতে বলেন, আরও পরিশ্রম করতে বলেন।

গাঙকুমারী
গাঙকুমারী

ঢাকা থেকে দশ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে সুনামগঞ্জের হাসাউড়ায় শুরু হয় শুটিং। আমাদের বাড়ির অংশ প্রথম ধাপে শুট করা হয়। এ ধাপে অভিনেতা ছিলেন আমার বাবা দিবাকর চরিত্রে শাহাদাৎ হোসেন, আমার মা লক্ষ্মীরাণি চরিত্রে রোবেনা রেজা জুঁই, আমার ভাই উপল চরিত্রে সামির পল্লব এবং ছবিতে যিনি আমাকে ভালোবাসবেন, যাকে আমি ভালোবাসব– বরুণ চরিত্রে মীর নওফেল আশরাফী জিসান।


এত
আয়োজন
করে, এত বড়
ডাক আসবে– ভাবিনি

থাকার জায়গা থেকে শুটিং স্পটে অটো-ট্রলার-সিএনজি দিয়ে যাওয়া আসার তিন ঘণ্টা সময় লাগত। প্রতিদিন শুটিংয়ে যেতে যেতে ভাবতাম আমার ছোটবেলার কথা। কালিতারা বলে ডাকত। আট বছরের থিয়েটারের অভিজ্ঞতায় দেখতাম, দলের ফর্সা মেয়েটিই মূল চরিত্র পাচ্ছে। তবু সবসময় সাবস্টিটিউট থাকতাম। আর ভাবতাম, ডাক আসবে। এত আয়োজন করে, এত বড় ডাক আসবে– ভাবিনি।

প্রথম ধাপের শুটিংয়ের পর পরিচালকের কাছে জানতে চাই, কেমন হচ্ছে? উনি ভালো-খারাপ কিছু না বলে শুধু জানান, ’হচ্ছে’। কী যে হচ্ছে, তা তার কথায় ধরতে পারি না।

প্রথম ধাপের পর দ্বিতীয় ধাপের শুটিংয়ে ছিলেন ইব্রাহীম দেওয়ান চরিত্রে তারিক আনাম খান, তার প্রথম স্ত্রী জয়তুন চরিত্রে নাজনীন হাসান চুমকি, দ্বিতীয় স্ত্রী রুশনাই চরিত্রে সুষমা সরকার, লতিফ চরিত্রে উজ্জ্বল, মহাদেবের চরিত্রে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রশীদ হারুন। এত এত গুণী মানুষদের সঙ্গে থেকে প্রতি মুর্হূতেই শিখছিলাম।

গাঙকুমারী
গাঙকুমারী

আমার কঠিন কিছু দৃশ্যের শুটিং হয় এ ধাপে। খুব নার্ভাস হয়ে পড়ছিলাম। কাছের মানুষদের কথা খুব মনে হচ্ছিল। সাধনা আপার সঙ্গে ফোনে কথা বললাম। বললেন, আমি পারব। পরিচালক আমার টেনশনকে সেভাবে পাত্তাই দিচ্ছিলেন না। শুধু বলে দিচ্ছিলেন, ‘এটা এভাবে করো।’ তারিক ভাই প্রতিটি দৃশ্যে আমাকে ভীষণভাবে সহযোগিতা করছিলেন। বিয়ের দৃশ্যে টিকলি থাকবে না জানার পর কেন যেন খুব মন খারাপ হলো। মেকআপ, গেটআপ আমি তেমন বুঝি না, তাই এসব নিয়ে কখনো তেমন ভাবিনি। কিন্তু সামান্য একটা টিকলির জন্য চোখ ভরে আসছিল কান্নায়। এসব কিছুর মধ্যে শেষ হলো দ্বিতীয় ধাপের শুটিং। এখন শেষ ধাপের শুটিংয়ের অপেক্ষা।

আমাদের কাস্টিং কো-অর্ডিনেটর প্রফেসর ড. ইউসুফ হাসান অর্ক, সিনেমাটোগ্রাফার সাহিল রনি, গ্যাফার মোহাম্মদ মোফিকুল, বিহাইন্ড দ্য সিন করছেন জায়েদ মালেক অনন্য, পোশাক পরিকল্পনা করছেন সামিউন জাহান দোলা, শ্রাবন্তী গুপ্ত, শিল্প নির্দেশক শাহীন ভাই, মেকাপ আর্টিস্ট ফরহাদ রেজা মিলন, প্রধান সহকারী পরিচালক রাশেদুর ইসলাম রাশেদ, সহকারী পরিচালক রহমান রাহুল, গাজী আব্দুল খালেক, প্রোডাকশন ম্যানেজার ফিরোজ ভাই এবং ক্রিয়েটিভ সেক্টরে মেহেদী হাসান সোমেন, ইউরেকা রেজোয়ান, হাদি উদ্দিনসহ আরও যারা রয়েছেন, তাদের ছাড়া গাঙকুমারী পথ চলতে পারত না।

গাঙকুমারী
গাঙকুমারী

একটা ছবি হয়ে ওঠার পেছনে থাকে অসংখ্য গল্প। সেসব গল্প অনেক সময় ছবির গল্পকেও হার মানিয়ে দেয়। কিন্তু দিন শেষে ছবিটাই মানুষ দেখবে। কত মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে ছবিটা হয়ে ওঠে– সেটা কেউ দেখবে না। ভালো হলে গ্রহণ করবে, খারাপ হলে বাদ দিয়ে দেবে।

কতটা কী করে উঠতে পারছি, সেটা জানতে পারব যখন দর্শকের কাছে যখন গাঙকুমারী পৌঁছুবে। সেদিনের অপেক্ষায়…আপাতত বিদায়।

Print Friendly, PDF & Email
থিয়েটার ও ফিল্ম অ্যাকটিভিস্ট; বাংলাদেশ। স্ক্রিপ্ট সুপারভাইজার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর : কাঁটা । অ্যাকট্রেস: গাঙকুমারী। প্রতিষ্ঠাতা, স্ট্রিট চিলড্রেনস্ থিয়েটার । ইয়ুথ ভেঞ্চার, অশোকা [ইউএস] । সাবেক চাইল্ড পার্লামেন্ট মেম্বার, এনসিটিএফ, সেভ দ্য চিলড্রেন । শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়