লিখেছেন । বিশ্বজিৎ মণ্ডল
অরণ্যের দিনরাত্রী
ফিল্মমেকার; স্ক্রিনরাইটার; মিউজিক । সত্যজিৎ রায়
উৎস-উপন্যাস । অরণ্যের দিনরাত্রি/ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সিনেমাটোগ্রাফার । সৌমেন্দু রায়
এডিটর । দুলাল দত্ত
কাস্ট [ক্যারেক্টার] । সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় [অসীম]; শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় [সঞ্জয়]; সমিত ভঞ্জ [হরি]; রবি ঘোষ [শেখর]; শর্মিলা ঠাকুর [অপর্ণা]; কাবেরি বসু [জয়া]; সিমি গারেওয়াল [দুলি]
রানিংটাইম । ১১৫ মিনিট
ভাষা । বাংলা
দেশ । ভারত
রিলিজ । ১৬ জানুয়ারি ১৯৭০

সত্যজিৎ রায় তার সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপস্থিতি ঘটিয়েছেন তার দুটি উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়িত রূপ দিয়ে। প্রতিদ্বন্দ্বী ও অরণ্যের দিনরাত্রি উপন্যাসে যুব সমাজের দুই ভিন্ন প্রেক্ষিত দর্শিত হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বীতে সত্তরের দশকের সমাজ, চাকরির প্রতিযোগিতা, যুবসমাজের পথভ্রষ্টতা, উত্তাল অধিকার আদায়ের রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার চিত্রটি প্রত্যক্ষ হয়। চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় সেই রূপই ধরে রেখেছেন।
এর ঠিক বিপরীত মেরুতে অরণ্যের দিনরাত্রি উপন্যাসটির অবস্থান। সেখানে একদল যুবক, যারা একেকটি ক্ষেত্রের টাইপ চরিত্র হিসেবে অবস্থান করে। শহরের ব্যস্ততা থেকে নিজেকে সরিয়ে বন্য আমাদের মধ্যে নিজেদের ডুবিয়ে রাখে। পেছনে ফেলে আসা জীবনের জন্য সদ্য আবির্ভূত গ্লানিগুলো তাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খায়; কিন্তু তাদের সেখানেই ফিরতে হয়!
সত্যজিৎ রায় অরণ্যের দিনরাত্রি [১৯৬৮] উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িত করেন ১৯৭০ সালে। এরই চলচ্চিত্র রূপের বিশ্লেষণ এই স্থলের আলোচ্য বিষয়।

ফিল্মমেকার: সত্যজিৎ রায়
উপন্যাসটি পাঠ প্রতিক্রিয়ার পরবর্তীকালে আমরা যদি চলচ্চিত্রটি খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তবে মূল উপন্যাসের সঙ্গে চলচ্চিত্রায়িত রূপের একটা মস্ত তফাৎ লক্ষ্য করি। সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত চলচ্চিত্র জগতে যে পরিশীলিত শহুরে সংস্কৃতির নিখুঁত পর্যবেক্ষণ এবং তাকে উপস্থাপন লক্ষ্য করি, সেখানে সচরাচর উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণি চোখে পড়ে।
উপন্যাসে চারজন বন্ধু বিনা রিজার্ভেশনের ট্রেনে উঠে প্রথম থেকেই নিয়ম ভাঙার একটা প্রবণতা তৈরি করে নিয়েছিল। তারা কোথায় যাবে, সেটাই ঠিক করেনি। সমস্ত চলচ্চিত্রজুড়ে একটা স্বচ্ছ কাহিনিকে সত্যজিৎ রায় তুলে ধরতে আগ্রহী ছিলেন। আসলে শহরের সভ্য সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ ছিন্নমূল হয়ে অরণ্যে সময়যাপন। সুতরাং এই বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে মূল উপন্যাসের অনেক টুকরো টুকরো শহুরে সভ্যতার আনাগোনা, সে আভাসে ইঙ্গিতে নিরব চিন্তাতে হোক না কেন, সেগুলো বাতিল করেছেন পরিচালক নির্দ্বিধায়। কিন্তু কাহিনির সঙ্গে এ সমস্ত কিছু বেমানান– এটি বলা দুষ্কর।
উপন্যাসে সঞ্জয়ই প্রথম ট্রেন থেকে নেমে সঙ্গের সভ্য সমাজের শেষ চিহ্নটুকুও রাখল না। এই হেন সঞ্জয় কিন্তু জঙ্গলের শোষক ও শোষিতের এক খণ্ড প্রেক্ষাপটে শহুরে হয়ে গিয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে দ্বিধাবোধ করে না! বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র সে-ই উদাসীন নয়, উদ্বেগীও বটে।
উপন্যাসে সভ্যতার শেষ চিহ্ন (সঙ্গে আনা খবরের কাগজ) মোচনের গুরুভার তারই ছিল। কিন্তু তবুও বোঝা গেল না চার বন্ধুকে ট্রেনে না এনে চলচ্চিত্রকার ব্যক্তিগত গাড়ি করে কেন আনলেন? এটি কি সচেতনভাবেই করেছেন? হয়তো উচ্চ মধ্যবিত্ত মানসিকতা কাজ করেছে এখানে।
চারজন ছেলে-মেয়ের সাক্ষাৎ, বাদানুবাদ, অরণ্যে আসা আরেক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে তাদের সময় জড়িয়ে যাওয়া, সভ্য সমাজের প্রেমাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত যুবার এক আদিবাসিকে আঁকড়ে সমস্ত গ্লানি ভোলার কাহিনি আমরা চলচ্চিত্রে পাই। সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনটাও আছে। কিন্তু এই আখ্যানটুকু গড়ে তুলতে গিয়ে মূল কাহিনির সঙ্গে যে তফাৎটুকু তৈরি হয়েছে বা করেছেন, সেটি একটু দেখা যাক। রবির নাম বদলে হয়েছে হরি। গাড়িতে সমস্ত রাস্তাতেই সে মনমরা, সমস্তের প্রতি অনীহার ভাব চেহারায় স্পষ্ট। অসীমের ‘একটা মেয়েছেলে তোকে ল্যাঙ মেরে দিল’ [চলচ্চিত্র]— এই কথাতেই আমরা রবি সম্পর্কিত পূর্ব ঘটনার আভাস পাই। পরক্ষণেই রবির মগ্নতায় পশ্চাৎপট তৈরি করে পূর্ব ঘটনা দেখানো হয়। উপন্যাসে সেই তপতীর নামটি আমরা পাই অনেক পরে। তপতী-কৃত রবির প্রতি যে প্রতারণা, সে তো সভ্য সমাজেরই আঘাত। অরণ্য ঘুরতে এসে সেই সাঁওতাল সমাজই তার আঘাতের উপসম স্বরূপ।
উপন্যাসে আমরা প্রথমেই সাঁওতাল মহিলাদের পাই এইভাবে, ‘একটা বট গাছের নিচে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো অনেকখানি বেদি, সেখানে দশ-বারোটা আদিবাসী মেয়ে ঝুড়ি নিয়ে বসে আছে।’ চলচ্চিত্রে মহুয়া পানের একটি রাত্রিবেলার দৃশ্যে দুলু তাদের মহুয়া চাইছে– এই রকমভাবে তাদের সঙ্গে পরিচিতি। উপন্যাসেও এ অংশ আছে, তবে দৃশ্য দুটি আগে পরে উপস্থাপিত হয়েছে। যে বটগাছের নিচে সাঁওতাল মেয়েরা বসে ছিল, সেখানেই চতুর্মূতির সেখানকার তল্পীদার লখাকে পাচ্ছি ‘একটা হলুদ গেঞ্জি পরা ছোকরা ওদের দিকে ঘন হয়ে এসে শুনছিল ওদের কথা’ [উপন্যাস]।
লখাকে চলচ্চিত্রে শুরুতেই পেয়েছি। অপর্ণা ও জয়ার শেখরদের প্রথম দেখতে পাওয়ার যে চিত্ররূপ মূলে আছে তার বর্ণনা, ‘গেটের মধ্যে দিয়ে ভেতরটা দেখা যায়, বাগানের মাঝখানে পাথরের পরী বসান ফোয়ারা, বাগানের পথটুকু ব্যতীত বাকি অংশ ঘাসের বদলে লাল পটুলেকায় ছেয়ে আছে যেন টুকটুকে লাল রঙের বাগান, একপাশে নেট খাটিয়ে দুটি মেয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছে… বার বারান্দায় ইজিচেয়ারে এক পৌঢ় খবরের কাগজ নিয়ে ঝুঁকে বসা।’ [উপন্যাস]
…
সত্যজিৎ রায় অপরিচিত বাড়িতে
গিয়ে অযাচিত আলাপের
বিষয়টা বাদ দিয়ে
একটু সুশ্রী
বজায়
রাখতে চেয়েছেন
…
এই শেষ বর্ণনায় বোঝা যায়, সদাশিব প্রথম থেকেই মেয়েদের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু চলচ্চিত্রে সদাশিব আসেন একটু পরে। কৌতুহলী তাদের নিরীক্ষণের মধ্যে দূরে আকস্মিক আগমন, তারই আগ্রহে তাদের বাড়িতে প্রবেশ এবং আলাপ। সত্যজিৎ রায় অপরিচিত বাড়িতে গিয়ে অযাচিত আলাপের বিষয়টা বাদ দিয়ে একটু সুশ্রী বজায় রাখতে চেয়েছেন। উপন্যাসে রবি জোর করে সবাইকে মেয়েদের সঙ্গে পরিচয় করাবে বা করবে বলে নিজেই এলো। এখানেও সভ্যতাকে বাতিল করা হলো। কিন্তু সত্যজিৎ রায় এই চারজন ছেলেকে অতটাও অসভ্য করতে চাননি, যেহেতু শুরুতেই বোঝা গেছে, মেয়েগুলো কলকাতা স্থানীয়, তখন উঁকি-ঝুঁকি, দ্বিধা– এগুলো চলছিল।
তবে এ সমস্ত কিছুকেই ছোট ও অবজ্ঞা জ্ঞান করে রবি ওখান থেকে চলে যায়। আসলে প্রেম প্রত্যাখাত রবির নিজের ভিতরের সত্তাকে মোচড় দিয়ে তার বন্ধুদের সঙ্গে এক সুরে মিশতে অসুবিধা হচ্ছে। সেই অসুবিধার কারণ স্বরূপ তপতী তার চিন্তায় সদা জাগ্রত।
চলচ্চিত্রে সঞ্জয়-জয়ার মধ্যে, অপর্ণা-অসীমের মধ্যে একটা সম্পর্ক শুরু হচ্ছে– সেটি তাদের আলাপের পরে থেকেই বোঝা যায়। এবং এ সম্পর্ককে লালন করার বিভিন্ন সূত্রে কাহিনি এগিয়েছে। অপর্ণার মুখ দিয়ে তার নিস্তব্ধ ভাবের কারণ যখন শেখরকে জানান হয়, তখন বোঝা যায়, এই টুকরো কাহিনি সত্যজিতের নিজের, যা ওদের দুজনের সম্পর্ককে আরও নিবিড় করে।
উপন্যাসে ফিরলে সঞ্জয়কে জয়ার পাশে পাই না। সে সভ্যতার রশি অরণ্যে এসেও ধরে রাখে। ডিএফও রতিলালকে তাদের কারণে বরখাস্ত করতে পারে– এই অন্যায় সে মেনে নিতে পারেনি। অপর সঙ্গীরা যখন নতুন সম্পর্কের সমুদ্রে সাঁতার কাটছে, তখন সঞ্জয় রতিলালের অধিকার কায়েম রাখতে করণীয় সমস্তই করছে।

রতিলালের স্ত্রীর অসুস্থতায় শুধুমাত্র সঞ্জয়কেই মরমি হিসেবে পাই। শেখর শ্রেফ একজন ভাঁড় রূপে তাদের সবার মধ্যে বর্তমান। তার মধ্যে ছেলেমানুষি এবং কমিকের একটা মিশ্রণ চলচ্চিত্রজুড়ে তৈরি করা হয়েছে।
উপন্যাসে শেখর জয়াকে চেনে বলে সন্দেহ করেছিল এবং সত্যিই সে পরিচিত তারই কলেজ বন্ধু। আবার অপর্ণাকে তার মিল ম্যানেজারের মেয়ে অনুরাধার মতো দেখতে মনে হয়। এই সূত্রে দুটি উপকাহিনি মাঝেমধ্যে প্রসঙ্গক্রমে উত্তম পুরুষে এগোয় উপন্যাসে। রবিকে একটু বেশিই দায়িত্বশীল রূপে পাই যাবতীয় সমস্যায়। চেহারায় একটা ভারিক্কি এনে সেই-ই এগোয়। আবার অপর্ণাকে পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই হাত ধরে জঙ্গলে একটু সময় কাটানোর জন্য অনুরোধও করে।
অন্যদিকে, শেখর অপর্ণাকে একা অরণ্যে ভালোবাসার কথা বললে তা অপর্ণার ভালো লাগে। জঙ্গলে নিয়ে যাবার মুহূর্তের রবির হাতের নিবিড় বাঁধন যেন আরও শক্ত হয়ে ওঠে, যখন আহত রবিকে অপর্ণা দেখে। শেষ পর্যন্ত অপর্ণার যাবতীয় ভালোবাসা রবির প্রতি বাঁক নেয় উপন্যাসে।
চলচ্চিত্রে সঞ্জয়ের মোহ কেটে ওঠা এবং এক অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত সামনে আসায় তার সবটাতেই একটা দ্বিধা মেশানো ভয়ের প্রলেপ চোখে-মুখে পড়ে। এক বুক শূন্যতা নিয়ে একে অপরের বিচ্ছেদ ঘটে। জয়ার ভেতরের কামনা স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে অন্তর্হিত হয়নি, তুষের আগুনের মতো ভেতরে কোথাও গনগনে ভাবটুকু ছিল। সঞ্জয়ের সংস্পর্শে এসে তা-ই যেন মুহূর্তে বহিঃপ্রকাশ হলো, যা স্বাভাবিক।
চলচ্চিত্রকার শেখরের ছাঁচে সঞ্জয়কে ফুটিয়ে তুলেছেন, কিন্তু উপন্যাসের সঞ্জয়কে– যে সঞ্জয় লখাকে মারার প্রতিবাদ করেছিল, রতিলালের দুঃখ বুঝেছিল– তাকে আমরা চলচ্চিত্রে কোথাও পাইনি। তার মুখ থেকেই শুনি, ‘আমরা মানুষকে মানুষ বলেই গণ্য করি না’। [উপন্যাস]

স্টেশন মাস্টারের কথাতে উঠে এলো, তাদের গন্তব্যের জায়গা তারা জানে না। চলতে চলতে কোথাও ভালোলেগে গেলে তারা ভেবে দেখবে। অবশ্য এক সহযাত্রীর কথায় তারা ধলভূমগড়ে নামল।
চলচ্চিত্রের সূচনায় সঞ্জয় সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ পাঠে ব্যস্ত ছিল। পরে শেখরও বলে, তারা পালামৌ যাবে বলে ভেবেছিল; কিন্তু জায়গাটি তাদের ভালোলেগে গেল, তাই এখানেই তারা স্থির করে। অর্থাৎ, তারা নিজের ইচ্ছেতেই ধলভূমগড়ে উপস্থিত হয়। শেখর নয়, রবিই গেস্ট হাউসে ঢোকার সময় রতিলালকে মিথ্যে বলে স্টেশন মাস্টারের রসিদ দেখিয়ে ওই মুহুর্তে সে কাজ হাসিল করে। কিন্তু সত্যজিৎ শেখরকে দিয়ে কাজটি করালেন এবং মিথ্যে রসিদের বদলে সে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়। সঞ্জয়ের মুখে শোনা যায়– ‘থাঙ্কস ফর দি কোরাপশন’। [চলচ্চিত্র]
কলকাতার সভ্যরাই এসে সাদা মানুষগুলোর দুর্বলতার সুযোগের অসদ্ব্যবহার করবে এবং এই কর্মকাণ্ডের জন্য ধন্যবাদও দেবে– এ তাদের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত কিছু নয়! কার্যকারণহীন সন্দেহে রবি লখাকে মারবে, সাঁওতাল মেয়েটির সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত হবে, মুখে যতই ভালোবাসার বুলি আওড়াক– মিথ্যার মাধ্যমে যে এই ব্যাভিচার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই সাঁওতাল পরগণারই কয়েকটি শিক্ষিত ছেলে লখার সঙ্গে গিয়ে এর প্রতিবাদ করেছে, রবিকে শাস্তিও দিয়েছে। তাদের একজনের মুখে ইংরেজি বুলি, ব্রিটিশ উচ্চারণ [লেখকের কথায়]– ‘ইউ বাস্টার্ড, ইউ সান অব এ বীচ’ শুনে যেন মনে হয়, এদের ওপর শিক্ষিত সভ্য-সমাজের আধিপত্য কায়েকের সময় আর নেই। এরই প্রতিধ্বনি অন্য একজনের মুখে শুনি, ‘আমাদের মেয়েদের কোনো ইজ্জত নেই? আমাদের মেয়েদের নিয়ে যা খুশী করবেন?’ [উপন্যাস]
এ বলিষ্ঠ উচ্চারণ, সভ্য-সমাজের প্রতি এই কুঠারাঘাত সত্যজিতের হাতে পুরোটাই বাতিল। শুধুমাত্র প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠা লখার ওঁত পেতে বসে থাকা আর সেইদিনের সুযোগে তার প্রতিশোধ নেওয়া। সেইসঙ্গে মানিব্যাগ চুরি করিয়ে তাদেরকে ছোটলোক করেই আঁকলেন।
…
তাদের
অভাব, তাদের
ইচ্ছে, সততার ছবি,
তাদের গর্জে ওঠার প্রতিবাদের
ছবি শুধুমাত্র নিছক
প্রতিহিংসাতেই
সীমিত
রেখেছেন সত্যজিৎ রায়
…
উপন্যাসে লখার ব্যবহারে কোথাও অশ্লীলতা প্রকাশ পাইনি। সে বকশিস পেয়ে সন্তুষ্ট থেকেছে। তার একান্ত ইচ্ছা, এদের মাধ্যমে সে কলকাতায় যাবে, পয়সা রোজগার করে সিগারেট খাবে, ঘড়ি পরবে মুলিয়ার মতো: ‘বকশিস চাই না বাবু, আমাকে কলকাতা নিয়ে গিয়ে একটা নকরি দিন, এখানে কিছু মেলে না।’ একমাত্র সঞ্জয়ই তাকে ভরসা দিয়েছিল। এই লখাকে স্রেফ আমরা চোর ধূর্ত রূপে পাই চলচ্চিত্রে। তাদের অভাব, তাদের ইচ্ছে, সততার ছবি, তাদের গর্জে ওঠার প্রতিবাদের ছবি শুধুমাত্র নিছক প্রতিহিংসাতেই সীমিত রেখেছেন সত্যজিৎ রায়।

অরণ্যের ভেতরের বাংলোগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়োজিত কর্মচারীরা কেমন যেন অসহায়। আপন পদের শেকড় মজবুত করতে সদা সচেষ্ট। আর যখন শুনি, কয়েকজন মিলে রতিলালরা টাকা জোগার করে কনজারভেটরদের জন্য তাদের আয়ত্ত্বের অতীত খাবারগুলো রান্না করেছে। শুধুমাত্র সাহেবদের মন রাখার জন্য রেঞ্জার সুখেন্দু তাদেরকে এ ব্যবস্থা করতে বলেছে, তখন সে অসহায়ত্ব আরও স্পষ্ট হয়। তারা যে বিনা অনুমতিতে বাংলোতে এসেছে এবং এর ফল ভুগতে হবে রতিলালকে। সমস্যার সমাধান সুখেন্দুর দ্বারা সম্ভব হলেও তার অধঃতন কর্মচারীর হয়ে সে সুপারিশ মোটেই করবে না।
চলচ্চিত্রে আমরা দেখি, কনজারভেটর বাঙালি আর অপর্ণাদের সঙ্গে পরিচিতি বেশ ভালোই; তাতেই কনজারভেটর আর বিরুদ্ধতা না করে চলে যায়। শুধুমাত্র পরিচিতিটুকু আছে বলে নিয়ম ভাঙা সম্ভব, এই বিষয়টুকু অতিরিক্ত সংযোজিত। পরিচালক এই সত্যটা আমাদের দেখিয়ে দিলেন।
এত কিছু সত্ত্বেও এই চিত্রনাট্য নিছক চার বন্ধুর শহুরে একঘেয়েমিতা কাটানোর জন্য জঙ্গলে আসার এক প্রকার আমোদের গল্প হয়ে উঠেছে সত্যজিতীয় বিশিষ্টতায়। সেখানে কোনো সোশ্যাল ইমোশন ‘অন্যের’ উপস্থিতি একেবারে বাতিল। সে ‘অন্যরা’ বন্যেরা হোক বা শহুরেরা। এই কারণে ফ্ল্যাশব্যাকের একাধিক দৃশ্য, যেগুলো সঞ্জয়ের মাধ্যমে এসেছে বা সেই অরণ্যের টুকরো টুকরো ‘অন্যের’ সত্যতা, সে সাঁওতালদের প্রতিবাদ বা লখার সততা বা রবির ব্যাভিচারিতা– সবই ঠুনকো, মূল্যহীনভাবেই চলচ্চিত্রে স্থান পেয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অরণ্যের দিনরাত্রি, আনন্দ, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ১৯৬৮