বের্নার্দো বের্তোলুচ্চি: সিনেমার আধুনিক নৈরাজ্যবাদী

478
বের্নার্দো বের্তোলুচ্চি

লিখেছেন । রুদ্র আরিফ

“এমনতর স্বপ্নই আমি দেখি : সিনেমার মধ্যে বাঁচা; সিনেমার মধ্যে বাঁচা সম্ভব– এমন জায়গায় পৌঁছানো; সিনেমার সঙ্গে ভাবা, সিনেমার সঙ্গে খাওয়া, সিনেমার সঙ্গে ঘুমোনো– ঠিক যেমন করে কোনো কবি, কোনো চিত্রকর চিত্রকর্মের সঙ্গে বাঁচে, খায়, ঘুমোয়।”
বের্নার্দো বের্তোলুচ্চি; সাক্ষাৎকারে

“আমি কোনো ইরোটিক সিনেমা বানাইনি, বরং সিনেমাটি বানিয়েছি স্রেফ ইরোটিসমকে ঘিরে। মানুষের বাদবাকি কর্মকাণ্ড থেকে ‘ইরোটিক’ আচার-আচরণকে আপনি কিছুতেই আলাদা করতে পারবেন না। ব্যাপারটি প্রায় সবসময় এমনই, সম্পর্কগুলো বিকাশের আগেই শুধু ‘ইরোটিক’ হয়ে উঠে; সম্পর্কের জন্ম যেহেতু পশুবৃত্তি থেকেই ঘটে, ফলে একটি সম্পর্কের সবচেয়ে প্রবল ইরোটিক মুহূর্তগুলো সবসময় [সম্পর্কের] শুরুতেই জাহির হয়। তবে সব যৌনসম্পর্কই নিন্দিত। এটি এর বিশুদ্ধতা খোয়ানোর দায়ে, এর পশুপ্রকৃতির দায়ে নিন্দিত; যৌনতা হয়ে ওঠে অন্য কিছু প্রকাশের একটি হাতিয়ার।”
বের্নার্দো বের্তোলুচ্চি; সাক্ষাৎকার, ১৯৭৩

বের্নার্দো বের্তোলুচ্চি
জন্ম । ১৬ মার্চ ১৯৪১; পার্মা, ইতালি
মৃত্যু । ২৬ নভেম্বর ২০১৮; রোম, ইতালি

নিজের সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত সিনেমা লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস [Ultimo tango a Parigi; ১৯৭২] প্রসঙ্গে আলাপে সিনেমা, সম্পর্ক ও যৌনতা ঘিরে এমনটাই জানিয়েছিলেন তিনি। বড়পর্দায় যৌনতা ও নৈরাজ্যপনার এক স্বেচ্ছাচারী কারিগর হিসেবে খ্যাতি ও কুখ্যাতি রয়েছে তাঁর। তিনি ২৬ নভেম্বর ২০১৮ চিরঘুমে নিমজ্জিত হওয়া বের্নার্দো বের্তোলুচ্চি।

এর একটা প্রচ্ছন্ন কারণও রয়েছে নিশ্চয়ই। যাঁর হাত ধরে সিনেমায় তাঁর যাত্রা, স্বদেশি সেই ফিল্মমেকার পিয়ের পাওলো পাসোলিনিকে (১৯২২-১৯৭৫) তো ধরা হয় সিনেমার ইতিহাসের সবচেয়ে নৈরাজ্যবাদী ফিল্মমেকারদের অন্যতম প্রধান পুরোধা। সেই অগ্রজের আক্কাত্তোনে [১৯৬১] সিনেমার ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবেই বের্তোলুচ্চির ক্যারিয়ার শুরু।

সময়, সমাজ, ধর্ম, বিশ্বাস, পুরাণ, বাস্তবতা, অবাস্তবতা… সবকিছুর এক অবিরাম বিশৃঙ্খল মিশ্রণ চূড়ান্ত রকমের নৈরাজ্যের ভেতর দিয়ে পাসোলিনি যেভাবে সিনেমায় ছড়িয়ে রেখে গেছেন, বের্তোলুচ্চি সেটিকে অবিকল অনুসরণ না করে, নিজের তরিকায় করে গেছেন প্রতিপালন। ফলে চার দশকেরও দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ফিল্মমেকার হিসেবে তিনি হয়ে উঠেছেন এক আধুনিক নৈরাজ্যবাদী।

১৬ মার্চ ১৯৪১, ইতালির এমিলিয়া-রোমাগ্না প্রদেশের পারমা শহরে তাঁর জন্ম। বাবা বিখ্যাত কবি, শিল্প-ইতিহাসবিদ ও সিনে-সমালোচক আত্তিলিও বের্তোলুচ্চি [১৯১১-২০০০]। মা নিনেত্তা জ্যুভানার্দি ছিলেন শিক্ষিকা।

শিল্প-আবহে বেড়ে ওঠা বের্তোলুচ্চি বাবার মতো কবি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে অল্প বয়সেই লেখালেখি শুরু করেন। লক্ষ্যে স্থির থেকে, রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের মডার্ন লিটারেচার ফ্যাকাল্টি থেকে নিচ্ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ। এ সময়ে বাবার সূত্রেই পাসোলিনির সঙ্গে পরিচয় ঘটে তাঁর। ফলাফল, সহসাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েন। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে হাত পাকানোর পর, ২১ বছর বয়সে, পাসোলিনিরই ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মাণ করেন অভিষেক সিনেমা– দ্য গ্রিম রিপার [La commare secca; ১৯৬২]।

দ্য গ্রিম রিপার

আগাগোড়াই পাসোলিনি-ভঙ্গিমার এই সিনেমায় যৌনতা হয়ে ওঠে একটি প্রধান অনুষঙ্গ। রোমের তিবার নদীর তীরে এক পতিতার মৃতদেহের নৃশংস ছবি দেখিয়ে সিনে-জগতে নতুন নৈরাজ্যবাদী হিসেবে নিজের আবির্ভাব জানান দেওয়ার ইঙ্গিত রাখেন বার্তোলুচ্চি। খুনটি হওয়ার কালে, কাছের পার্কে থাকা সন্দেহভাজন লোকগুলোকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ, এবং তাদের সে সময়কার নিজ নিজ কর্মকাণ্ডের স্মৃতিচারণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়ার (১৯১০-১৯৯৮) বিখ্যাত সিনেমা ‘রশোমন’-এর (১৯৫০) কথা। তবু একটি থেকে আরেকটি জিজ্ঞাসাবাদে উপনীত হওয়ার মধ্যবর্তী মুহূর্তটিতে বজ্রঝড়ের ইমেজ ব্যবহার করে নিজের কাব্যরুচির ইঙ্গিত বের্তোলুচ্চি ঠিকই দিতে পেরেছেন এই প্রথম সিনেমাটিতে।


১৯৬০-এর
দশকের শেষভাগের
বিদ্রোহকে আলিঙ্গন করা
প্রজন্মটির এক নিখুঁত প্রতিকৃতি

এই মার্ডার মিস্টেরি দিয়ে যাত্রা শুরু করা তরুণ ফিল্মমেকার এরপর চোখ রাখেন রোমান্টিক ড্রামা ঘরানায়। পারমা শহরের আজন্ম বিদ্রোহী তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক ও রোমান্টিক অনিশ্চয়তাকে ঘিরে বিফোর দ্য রেভুলিউশন-এর [Prima della rivoluzione; ১৯৬৪] শুটিং শেষ হয়েছে মাত্র তিন মাসে; ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরে। ১০০১ মুভিজ ইউ মাস্ট সি বিফোর ইউ ডাই গ্রন্থে ব্রিটিশ সমালোচক কলিন ম্যাককেইব [১৯৪৯-] এটিকে ‘১৯৬০-এর দশকের শেষভাগের বিদ্রোহকে আলিঙ্গন করা প্রজন্মটির এক নিখুঁত প্রতিকৃতি’ হিসেবে চিহ্নিত করলেও, এবারও প্রভাবের দায় এড়াতে পারেননি এই ফিল্মমেকার। ‘ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ’ সিনে-আন্দোলনের এক তুখোড় ছাপ এর পরতে পরতে লেপ্টে রয়েছে।

বিফোর দ্য রেভুলিউশন

অল্প বয়সী ফিল্মমেকারের সিনেমায় এমন প্রভাব যে আশীর্বাদ হয়ে উঠবে, এই সিনেমা দেখে সাধারণ দর্শকরা তা উপলব্ধি না করলেও, কিছু সমালোচক ঠিকই আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। সেই আশাবাদের দাম পরবর্তীকালে ভালোভাবেই দিয়েছেন বার্তোলুচ্চি।

একটু দম নিয়ে, তৃতীয় ফিচার ফিল্ম পার্টনার [১৯৬৮] নির্মাণে তিনি হাত বাড়ান ফিওদর দস্তোয়েভস্কির (১৮২১-১৮৮১) দ্য ডাবল উপন্যাসের দিকে। এ বেলা মূলত প্রভাবের উর্ধ্বে উঠে নিজের সিনে-পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা চালান তিনি। আর তাতে সিনেমা ও থিয়েটারের মধ্যে চালিয়েছেন নিরীক্ষা। তবু, এখানেও ‘ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ’ মাস্টার জ্যঁ-লুক গোদারের [১৯৩০-] প্রচ্ছন্ন ছায়া খুঁজে পেয়েছেন অনেকে। আর, বের্তোলুচ্চির এই প্রচেষ্টাটি যে এক কথায় ব্যর্থ হয়েছে, তা তো বলা বাহুল্য!

বোধ হয় এ কারণেই আবারও নৈরাজ্যবাদের দিকে সরাসরি হাঁটা দিয়েছেন তিনি। বানিয়েছেন, দ্য কনফরমিস্ট [Il conformista; ১৯৭০]। প্রবল রাজনৈতিক এই সিনেমাটি আলবের্তো মোরাবিয়ার [১৯০৭-১৯৯০] একই শিরোনামের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি। মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুম আর শাসক-অভিজাতশ্রেণির অতিকায় হলরুমের মধ্যকার সম্পর্ক ও সংঘাতের মাধ্যমে এই সিনেমায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলোতে ফ্যাসিবাদ আমলের রগরগে চিত্র এঁকেছেন বের্তোলুচ্চি।

১৯৭০-এর দশকের এক্সপ্রেশনিস্ট মাস্টারপিস হিসেবে খ্যাত দ্য কনফরমিস্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালিয়ান সিনেমার আগল খুলে দিয়ে, সে সময়কার যুক্তরাষ্ট্রের উদীয়মান ‘নিউ হলিউড’ মুভমেন্টের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছে।

দ্য কনফরমিস্ট

নিজেরই ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রাক্তন শিক্ষককে খুনের নীল-নকশা নিয়ে প্যারিসে হাজির হওয়া রোমের এক হতোদ্যম তরুণের গল্প এটি। সময়কাল ১৯৩৮। এই তরুণ বস্তুত যৌনতাকেন্দ্রিক দ্বিধায় বাতিকগ্রস্ত ও আত্মঘৃণাকারী মানুষ হতে হতে পরিণত হয়েছে ফ্যাসিবাদীতে।

এ বেলা বের্তোলুচ্চি সত্যিকারঅর্থেই নিজের সিনে-রাস্তা খুঁজে পেয়েছিলেন। কেননা ফ্যাসিবাদের বিচ্ছুরণ ঘটাতে চাওয়া ব্যক্তিত্বটির বিধ্বংসী প্রতিকৃতি খুব ধীরতালে, অথচ নিগূঢ়ভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি কম্পোজিশন, ডিজাইন ও ক্যামেরাওয়ার্কের ওপর গভীরভাবে জোর দিতে গিয়ে সিনেমাটিকে রূঢ় করে তোলেননি; বরং ঘটিয়েছেন নান্দনিকতার দারুণ সন্নিবেশ। এভাবে নাটকীয়তাকে অহেতুক উসকানি দেওয়ার লোভ দারুণভাবে সামলিয়ে তিনি তাঁর এই অ্যান্টিহিরো চরিত্রের পাশবিক সত্যটির ভাঁজ সতর্ক মনোযোগে খুলেছেন। ফলে চরিত্রটি হয়ে উঠেছে ফ্যাসিবাদের জ্বালানিকে উসকে দেওয়া লোকগুলোর একজন সত্যিকারের প্রতিনিধি।

অন্যদিকে, ক্যামেরাকে অতন্দ্রপ্রহরীতে পরিণত করে, ছায়া ও গরাদের ব্যবহারে নিজের ক্যানভাসকে একটা কারাগারে পরিণত করেছেন বের্তোলুচ্চি। দ্য কনফরমিস্ট-এর ফিল্মি-ল্যাংগুয়েজ ও সিনেমাটিক টেকনিকের প্রভাব এরপর পড়তে দেখা যায় তাঁর সমকালীন ও অনুজ অনেক ফিল্মমেকারের কাজে।

সাড়া ফেলা এই সিনেমার পর, সাহিত্য ভাণ্ডারে হাত বাড়ানো অব্যাহত রাখেন বের্তোলুচ্চি। আর্হেন্তাইন সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেসের [১৮৯৯-১৯৮৬] থিম অব দ্য ট্রেইটর অ্যান্ড দ্য হিরো ছোটগল্পটিকে পরিণত করেন দ্য স্পাইডার’স স্ট্র্যাটেজেম [Strategia del ragno; ১৯৭০] সিনেমায়। এখানেও ফ্যাসিবাদ হাজির; তবে দূরবর্তী অনুষঙ্গ হয়ে।


টের পায়,
সহসাই মৃত কিংবা
অন্তত উন্মাদ হয়ে ওঠার
আশংকা রয়েছে
তার

নিজের জন্মেরও আগে ফ্যাসিবাদীদের হাতে খুন হয়ে যাওয়া বাবার স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো এক যুবকের গল্প এটি। বহুকাল বাদে, বাবার শহরে এসে চেষ্টা করে সে সেই খুনের রহস্য উদ্ঘাটনের। বাবার পুরনো জীবনসঙ্গিনী ও বন্ধুদের সান্নিধ্যে সময় কাটাতে কাটাতে এই যুবকের জানা হয়ে যায় বুড়ো উন্মাদে ভরা শহরটির রাজনীতি ও ইতিহাস বৃত্তান্ত। ধীরে ধীরে টের পায়, বিভ্রান্তি ও প্রবঞ্চনার এক চক্রব্যুহে পড়ে গেছে সে। টের পায়, সহসাই মৃত কিংবা অন্তত উন্মাদ হয়ে ওঠার আশংকা রয়েছে তার।

এই যুবকের বাহ্যিক ও অন্তস্তলীয় দ্বিধা ও ধোঁয়াশার কাহিনিতে সাজানো এই সিনেমা বের্তোলুচ্চিকে অবশ্য স্বস্তি দেয়নি খুব একটা। সমালোচক কিংবা দর্শক– কারও মনেই তেমন ঢেউ তোলেনি এই নির্মাণ।

দ্য স্পাইডার’স স্ট্র্যাটেজেম

কিঞ্চিৎ অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলা যেতে পারে, আলফ্রেড হিচককের [১৮৯৯-১৯৮০] দ্য থার্টি-নাইন স্টেপস [১৯৩৬] সিনেমাটির রিভিউতে স্বয়ং বোর্হেস লিখেছিলেন, ‘জন বুচানের [১৮৭৫-১৯৪০] একেবারেই নিরস কাহিনি দ্য থার্টি-নাইন স্টেপসকে একটি ভালো সিনেমায় পরিণত করেছেন হিচকক। উৎস-কাহিনিটিতে শুধুই হিরোইজমের ব্যাপার থাকলেও, তিনি রসিকতা ও দুষ্কর্ম জুড়ে দিয়ে ঘটনাগুলোকে উদ্ভাবন করে নিয়েছেন। পরম আনন্দে নিরাবেগ ইরোটিক উপশমে ছুড়ে দিয়ে তিনি (কেন্দ্রীয় চরিত্রটিকে) আপাদমস্তকই মনোমুগ্ধক একটি নতুন চরিত্র করে তুলেছেন।’

খুব বেশি মনোযোগ না পেলেও, বোর্হেসের গল্পটি নিরস না হলেও, দ্য স্পাইডার’স স্ট্র্যাটেজেম-এ বের্তোলুচ্চি ঠিক একই কাজটি করতে পেরেছেন বলে মনে হয়।

এরপরই তিনি নির্মাণ করেন সেই বিধ্বংসী সিনেমা– লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস। যৌন-সহিংসতা ও আবেগাত্মক উন্মত্ততার এই ‘অমার্জিত’ প্রতিকৃতি সিনে-দুনিয়ায় মারাত্মক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।

শহরের এক অ্যাপার্টমেন্টের একটি রুমে, আলাদাভাবে ভাড়াটিয়া হিসেবে ঢুকে পড়া দুই পরস্পর অচেনা মানুষ– মধ্যবয়সী লোক ও সদ্য কৈশোর পেরোনো তরুণীর বিধ্বংসী সম্পর্ক ঘিরে এই ইরোটিক ড্রামা ফিল্ম। লোকটির স্ত্রী আত্মহনন করেছে, অন্যদিকে তরুণীটির রয়েছে প্রেমিক। তবু তারা সেই রুমটিতে নিজেদের মত্ত করে আদিমতায়। পরস্পর পরিচয় জানে না, তবু যৌনসম্পর্কে ভাসতে থাকে। আর সেটি কখনো হয়ে ওঠে সঙ্গম, কখনোবা প্রায়-ধর্ষণ।

কাহিনির উৎস প্রসঙ্গে প্রচলিত আছে, রাস্তায় অচেনা এক নারীকে দেখে, তার নাম-পরিচয় না জেনেই, উদ্দাম যৌনসম্পর্কে মেতে ওঠার কল্পনা একবার বের্তোলুচ্চিকে পেয়ে বসেছিল। সেটিরই ‘চরিতার্থ’ তিনি নাকি এই সিনেমায় করেছেন! এর জন্য ঝক্কি কম পোহাতে হয়নি তাঁকে। নানা দেশের সেন্সরবোর্ড তো বটেই, কোনো কোনো আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছে এই সিনেমা।

লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস

অন্যদিকে, এটির ‘কুখ্যাত’ ধর্ষণ বা প্রায়-ধর্ষণ দৃশ্যে অভিনয়ের পর, হোক সেটি বানোয়াট, তবু ভয়াবহ প্রভাব পড়েছিল তরুণীটির চরিত্রে অভিনয় করা, সে সময়ে মাত্রই ১৯ বছর বয়সী ও পরবর্তীকালে বিখ্যাত অভিনেত্রী মারিয়া স্নাইডারের [১৯৫২-২০১১] ওপর। তিনি মানসিকভাবে এতই ভেঙ্গে পড়েছিলেন, নিজেকে ঠেলে দিয়েছিলেন মাদকাসক্তিতে; চলে গিয়েছিলেন আত্মহননের দ্বারপ্রান্তে। আমৃত্যু সেই ট্রমা কাটেনি তাঁর।

সাম্প্রতিক সময়ে নারীনিগ্রহের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী উচ্চারিত আন্দোলন ‘#মিটু’তে এই প্রসঙ্গটি বারবার ঘুরে-ফিরে এসেছে, এবং বার্তোলুচ্চি, ও মধ্যবয়সী লোকটির চরিত্রে অভিনয় করা মারলন ব্র্যান্ডো [১৯২৪-২০০৪] হয়েছেন নিন্দিত।

ধর্ষণতুল্য সেই দৃশ্যটির শুটিং-স্মৃতি মনে করে, ২০০৭ সালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মারিয়া ঘৃণাভরে আবারও বলে গেছেন, সিনেমাটির স্ক্রিপ্টে দৃশ্যটি ছিল না: “শুটিং শুরুর স্রেফ আগমুহূর্তেই আমাকে তাঁরা [মারলন ও বের্তোলুচ্চি] দৃশ্যটি বলেছিলেন। ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম আমি। আমার উচিত ছিল নিজের অ্যাজেন্টকে ফোন করা কিংবা নিজের আইনজীবীকে সেটে ডেকে আনা; কেননা স্ক্রিপ্টে নেই– এমন কিছুতে অভিনয় করার জন্য আপনি নিশ্চয়ই কাউকে জোর করতে পারেন না। কিন্তু সেই সময়ে আমি এসব জানতাম না। মারলন আমাকে বললেন, ‘মারিয়া, চিন্তা করো না, এটা তো স্রেফ একটা সিনেমাই’; কিন্তু দৃশ্যটির শুটিং যখন চলছিল, যদিও মারলন কাজটি [ধর্ষণ] বাস্তবিক করছিলেন না, তবু আমার কান্না কিন্তু বাস্তবই ছিল। নিজেকে অপদস্থ মনে হচ্ছিল আমার; সত্যি কথা বলতে, মনে হচ্ছিল, মারলন ও বের্তোলুচ্চি– দুজনেই আমাকে যেন খানিকটা ধর্ষণ করছেন। দৃশ্যটির শুটিং শেষ হওয়ার পর মারলন আমাকে সান্ত্বনাও দেননি কিংবা ক্ষমাও চাননি। ভাগ্য ভালো, স্রেফ ওয়ান-টেকেই শেষ হয়েছিল সেটা।”

সিনেমাটির কাজ শেষ হওয়ার পর বের্তোলুচ্চির সঙ্গে ১৫ বছর কথা বলেননি মারিয়া; এবং আমৃত্যু কোনো সম্পর্ক রাখেননি। অন্যদিকে, মারিয়ার প্রতি এ রকম আচরণের জন্য নিজেকে বের্তোলুচ্চি দোষী মনে করলেও অনুশোচনায় ভোগেননি। ২০১৩ সালে ফ্রান্সের একটি ফিল্ম আর্কাইভে মাস্টার ক্লাস নিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘অভিনেত্রী হিসেবে নয়, বরং একটি মেয়ে হিসেবে তার [মারিয়া] রিঅ্যাকশন দেখতে চেয়েছিলাম আমি। দেখতে চেয়েছিলাম, অপদস্থ হলে প্রতিক্রিয়া কেমন হয় তার।’

মুক্তির পর থেকে নানা তর্ক-বিতর্ক সত্ত্বেও, লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস হয়ে আছে বের্তোলুচ্চির তো বটেই, সিনেবিশ্বের এক ‘নৈরাজ্যবাদী’ মাস্টারপিস।

এরপর রবার্ট ডি নিরো [১৯৪৩-], জেরার্ড ডিপার্ডিও [১৯৪৮-], ডমিনিক সান্ডার [১৯৪৮-] মতো আন্তর্জাতিক সিনে-তারকাদের কাস্ট করে, এপিক হিস্টোরিক্যাল ড্রামা ফিল্ম ১৯০০ [Novecento; ১৯৭৬] নির্মাণ করেন এই ফিল্মমেকার। সিনেমার ইতিহাসে, বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পাওয়া সবচেয়ে দীর্ঘ সিনেমাগুলোর অন্যতম এই ৫ ঘণ্টা ১৭ মিনিটের কাল্ট ক্ল্যাসিক। যদিও বারবার কাটাছেড়া করে এর দৈর্ঘ্য কমিয়ে আরও কয়েকটি ভার্সন করা হয়েছে। ১৯০০ সাল থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এর প্রেক্ষাপট।

১৯০০

কেমন ছিল এই সিনেমার প্রতিক্রিয়া? জানা যাক আমেরিকান সমালোচক রজার ইবার্টের [১৯৪২-২০১৩] স্মৃতিচারণা থেকে: ‘১৯৭৬ সালের মে মাসে, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ১৯০০-এর ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার দেখার আগমুহূর্তের রোমাঞ্চ আমার মনে আছে। টিকেট আর পাসগুলো মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়েছিল কালো বাজারে; সকালের প্রথম শোতে উপচে পড়া ভীড় এতটাই বেসামাল হয়ে গিয়েছিল, ধাক্কার চাপে কাচের দেয়াল ভেঙে ঢুকে পড়েছিল এক লোক। বিকেল ফুরিয়ে এলে, দুইভাগে বিভক্ত প্রায় ৩২০ মিনিটের সেই সিনেমাটির প্রেস স্ক্রিনিং শেষে, পরিবেশ হয়ে উঠেছিল একেবারেই উল্টো। লোকেরা হয়ে পড়েছিল শান্ত, হতবাক ও সন্ত্রস্ত: কী করে এতটা ভুল করে বসলেন বের্তোলুচ্চি?… বলতে খারাপ লাগছে, তবু বলাটা শাপে বর হবে বলেই মনে করি: সিনেমার ইতিহাসে এটি সম্ভবত একটি গ্রেট লস্ট ক্ল্যাসিক হিসেবেই পরিগণিত হবে।… কেননা, ১৯০০ একটি নিয়ন্ত্রণ হারানো সিনেমা। এ এমনই এক এপিক স্কেলের সিনেমা, যেটি কোনোভাবেই স্রেফ সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারেনি। এ এমনই এক সিনেমা যেখানে বের্তোলুচ্চিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছে ইতালির শ্রেণিসংগ্রামের ব্যাপারে নিজের বিবৃতি জাহির করতে, যেটি শেষ পর্যন্ত স্রেফ শূন্যগর্ভ বিজ্ঞাপনেই হয়েছে পর্যবসিত।”

লা লুনা

এই ধাক্কা সামলিয়ে বের্তোলুচ্চি বানিয়েছেন লা লুনা [La Luna; ১৯৭৯]। এখানে আবারও নৈরাজ্যবাদ হাজির, যেন ফ্রয়েডীয় তরিকায়! বাবা-মায়ের সঙ্গে এক কিশোরের ঝামেলাপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে এর কাহিনি, যেখানে মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্কটি এক ধরনের ‘পাপাচারী’! সমালোচক কিংবা সাধারণ দর্শক– কেউই সিনেমাটিকে ভালোভাবে নেননি।

সিনেমার আধ্যাত্মিক কবি হিসেবে খ্যাত আন্দ্রেই তারকোভস্কি [১৯৩২-১৯৮৬] তো তাঁর ডায়েরিতে [তারকোভস্কির ডায়েরি], ১৯৭৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ক্ষুব্ধ হয়ে লিখে গেছেন: ‘বের্তোলুচ্চির লা লুনা দেখলাম। ভয়ঙ্কর, সস্তা, কুরুচিপূর্ণ ফালতু (সিনেমা)।’

এর পরের নির্মাণ ট্র্যাজেডি অব অ্যা রিডিকুলাস ম্যান [La tragedia di un uomo ridicolo; ১৯৮১] কমিক ঘরানার। এর গল্প ইতালিয়ান একটি ছোট্ট গ্রামকে ঘিরে। সেখানকার একটি পনির কারখানার মালিক নিজের সন্তানকে সন্ত্রাসীদের হাতে অপহৃত হতে দেখে ফেলে। গল্প যত ভাঁজ খুলতে থাকে, দুটি সমস্যা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে তাকে। অপহরণকারীদের হাতে মুক্তিপণ তুলে দেবে? নাকি সেই টাকা দিয়ে দেউলিয়া হওয়া থেকে কারখানাটিকে বাঁচাবে? খুব বেশি মনোযোগ না পাওয়া এই সিনেমাটিকে ১৯০০-এর একটি স্পিরিচুয়াল সিকুয়েল হিসেবে গণ্য করে গেছেন বের্তোলুচ্চি।

ট্র্যাজেডি অব অ্যা রিডিকুলাস ম্যান

টানা কয়েকটি সিনেমায় পতনের কালো মেঘ যখন আচ্ছন্ন করে ফেলছিল এই মাস্টার ফিল্মমেকারের সিনে-রাস্তা, তখন তিনি উত্তরণের পথ খুঁজলেন এপিক বায়োগ্রাফিক্যাল ড্রামা ঘরানায়। চীনের শেষ সাম্রাজ্যবংশীয় শাসনব্যবস্থার সর্বশেষ সম্রাট পুয়ির [১৯০৬-১৯৬৭] আত্মজীবনী নিয়ে বানালেন দ্য লাস্ট এম্পারার [L’ultimo imperatore; ১৯৮৭]।

‘বেস্ট পিচকার’, ‘বেস্ট ডিরেক্টর’, ‘বেস্ট আর্ট ডিরেকশন’, ‘বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফি’, ‘বেস্ট কস্টিউম ডিজাইন’, ‘বেস্ট ফিল্ম এডিটিং’, ‘বেস্ট অরিজিনাল স্কোর’, ‘বেস্ট সাউন্ড’ ও ‘বেস্ট স্ক্রিনপ্লে বেইজড অন ম্যাটেরিয়াল ফ্রম এনাদার মিডিয়াম’– নয় ক্যাটাগরিতে নমিনেশন পেয়ে নয়টিতেই ‘অস্কার’ জিতে নিলো এই সিনেমা।

দ্য লাস্ট এম্পারার

অল্পবয়সে ক্ষমতায় আরোহণ, তারপর শুধু নিজেরই নয়, বরং দীর্ঘদিনের সাম্রাজ্যবংশীয় শাসনেরও পতন দেখা, কারাবন্দি দিনক্ষণ… পুয়ির একান্ত ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় জীবনযাপনের নানা বাঁক পেরিয়ে এই সিনেমাটি হয়ে উঠেছে চীনের যেন এক পর্যটনীয় বিজ্ঞাপন! সেই কারণে এটিকে অনেকেই ‘টুরিস্ট সিনেমা’ হিসেবে গণ্য করেন।

এরপর দ্য শেলটারিং স্কাই [১৯৯০] দিয়ে আবারও সাহিত্যের কাছে ফেরেন বের্তোলুচ্চি। পল বোলের [১৯১০-১৯৯৯] উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমার কাহিনি ভাঙতে বসা দাম্পত্যজীবন পুনরুজ্জীবিত করার আশায় এক দম্পতি ও তাদের এক বন্ধুর আফ্রিকা ভ্রমণকে ঘিরে, যেখানে তারা মুখোমুখি হয় নানা বিপদের।


রোমান্সের
প্রশ্নে এই ফিল্মমেকার
যে যৌনতাকে কী রকম
উন্মত্ততায় পরিণত করতে
পারেন, সেই সাক্ষ্য তো
আগেও বহুবার
দিয়েছেন

উৎস-উপন্যাসটিতে পল বিকারগ্রস্ততার তরিকায় অন্তর্জাগতিক টানাপড়েন জাহির করলেও, সিনেমার পর্দায় বের্তোলুচ্চি সেটিকে আরও বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে দিয়ে চরিত্রগুলোকে করে তুলেছেন মানবিক, এবং ওদের সামনে হাজির করেছে রোমান্সের সম্ভাবনা। আর রোমান্সের প্রশ্নে এই ফিল্মমেকার যে যৌনতাকে কী রকম উন্মত্ততায় পরিণত করতে পারেন, সেই সাক্ষ্য তো আগেও বহুবার দিয়েছেন!

অন্যদিকে, সিনেমায় যাঁরা ল্যান্ডস্কেপের সৌন্দর্য দেখতে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্যও এই সিনেমা একটি দারুণ খোরাক হতে পারে।

অন্যদিকে লিটল বুদ্ধ [১৯৯৩] সিনেমাটি দিয়ে অনেককেই চমকে দিয়েছেন বের্তোলুচ্চি। কেননা এমন একজন নৈরাজ্যবাদী ফিল্মমেকার এমন আদর করে বুদ্ধকে নিয়ে সিনেমা বানাবেন– এ কথা তাঁরা ভাবতে পারেননি। আড়াই হাজার বছরের পুরনো পৌরাণিক ভারতের প্রেক্ষাপটে ফিরতে গিয়ে, দীর্ঘ এই সিনেমায় রঙ নিয়ে বেশ খেলা করেছেন এই ইতালিয়ান মাস্টার। প্রাচ্যের লোকেশনগুলোতে ব্যবহার করেছেন রেড-অরেঞ্জ কালার স্কিম; অন্যদিকে পাশ্চাত্যের লোকেশনগুলোর কালার স্কিম এখানে ব্লু-গ্রে। সিনেমাটি বিশেষত ফ্রান্সে ব্যাপক বাণিজ্যিক সাফল্য পায়।

স্টিলিং বিউটির [Io ballo da sola; ১৯৯৬] গল্প মায়ের আত্মহননের পর ভালোবাসা, সত্য ও গভীর আত্মযোগাযোগের বাসনায় এক তরুণীর ইতালিতে ঘুরে বেড়ানো ঘিরে। অন্যদিকে বিসিজড-এ [L’assedio; ১৯৯৮] দেখা মেলে ইতালিতে নির্বাসিত এক আফ্রিকান নারীর। সে ফিরতে চায় দেশে; চায় বন্দি স্বামীকে মুক্ত করতে। আর এই প্রচেষ্টা একমাত্র যে মানুষ তাকে সাহায্য করতে সক্ষম, তারই প্রেমে পড়ে যায় ভীষণভাবে।

এরপর আরেকটি বিধ্বংসী সিনেমার জন্ম ঘটে বের্তোলুচ্চির হাতে। দ্য ড্রিমারস [২০০৩]। গিলবার্ট অ্যাডেয়ারের [১৯৪৪-২০১১] উপন্যাস অবলম্বনে এই সিনেমা।

প্যারিসে পড়তে আসা এক আমেরিকান তরুণ দেখা পায় দুই উদ্ভট স্বভাবের ভাই-বোনের। এই ত্রিমুখী প্রেমের উন্মত্ত যৌনাচার ও দৃশ্যত ‘বিকৃত’ কর্মকাণ্ড ধরে এগিয়ে যেতে থাকে কাহিনি। নেপথ্যে উঁকি দেয় ১৯৬৮ সালের বিখ্যাত ছাত্রবিদ্রোহ। যৌনতা, রাজনীতি ও সিনেমা এখানে একাকার হয়ে গেছে।

দ্য ড্রিমারস

লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস-এ মারিয়া স্নাইডারের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতায় আশংকিত হয়ে এই সিনেমার অল্পবয়সী অভিনেত্রী ইভা গ্রিনের [১৯৮০-] বাবা-মা ও অ্যাজেন্ট আঁতকে উঠেছিলেন। মেয়েকে তাঁরা অনেক বুঝিয়েছিলেন– নগ্নতা ও যৌনতায় ঠাসা বের্তোলুচ্চির এমন সিনেমায় যেন অভিনয় না করেন। সেই অনুরোধ ইভা না মানলেও, সিনেমাটির রাফকাট দেখে শিউরে উঠেছিলেন! বিশেষ করে, নিজেরই অভিনীত যৌনদৃশ্যগুলোর দিকে তাকাতে পারছিলেন না তিনি– এমন কথা জানিয়েছেন পরবর্তীকালে, সাক্ষাৎকারে।

আবারও নানা আলোচনা-সমালোচনা, প্রশংসা-নিন্দায় বের্তোলুচ্চিকে ভাসিয়ে নেওয়া, জীবনের শেষদিকে বানানো এই সিনেমা তাঁর একটি মাস্টারপিস কাজ হিসেবেই গণ্য।

চিরতরে চোখ বোঝার আগে আর একটি ফিচার ফিল্মই বানাতে পেরেছিলেন এই মাস্টার ফিল্মমেকার। মি অ্যান্ড ইউ [Io e te; ২০১২]। বাবা-মাকে স্কি-ট্রিপে পাহাড়ে যাওয়ার কথা বলে, বেজমেন্টে লুকিয়ে একার জীবন কাটাতে থাকা এক অন্তর্মুখী কিশোরের কাহিনি এটি। তার সেই একলা পৃথিবীতে আচমকাই হাজির হয় এক অচেনা তরুণী। সেই কিশোরের কল্পনা আর বাস্তবতা একাকার হয়ে যেতে থাকে।

উদ্দাম যৌনতা এখানেও মেলে ডানা। নিজের আলোচিত-সমালোচিত অন্য সিনেমাগুলোর মতো না হলেও, প্রচ্ছন্নভাবে এখানেও বের্তোলুচ্চি জাহির করেছেন তাঁর প্রিয় প্রবণতা– ‘নৈরাজ্যবাদ’! আর সেটি এ বেলা অনেকটাই অন্তর্জাগতিক।

সিনেমায় দীর্ঘজীবন কাটানো, অনারারি ‘পাম দি-অর’জয়ী এই নির্মাতা নিজেকে ‘শিল্পের সন্তান’ দাবি করতেন। বলতেন, ‘সিনেমায় বার্তা দেওয়া আমার কাজ না। সে কাজের জন্য পোস্ট অফিস রয়েছে।’ তাই তিনি নানা তরিকায় ইমেজের পর ইমেজ, ফুটেজের পর ফুটেজ গেথে সিনেমায় বানিয়ে রেখে গেছেন শিল্পের এক নিজস্ব বাগান; যে বাগানে একই সঙ্গে ফুল ও ভ্রমর, সবুজ বৃক্ষ ও বিষাক্ত সাপ সমানে খেলা করে।

এভাবেই বের্নার্দো বের্তোলুচ্চি হয়ে আছেন সিনেমার এক দারুণ খেলোয়াড়, কিংবা খেলারাম!

প্রথম প্রকাশ
মাসিক কৃত্তিবাস; কলকাতা, ভারত
Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

2 মন্তব্যগুলো

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here