লিখেছেন । আরিফ আরমান বাদল
কমলা রকেট
ফিল্মমেকার । নূর ইমরান মিঠু
উৎস গল্প । শাহাদুজ্জামান
স্ক্রিনরাইটার। শাহাদুজ্জামান; নূর ইমরান মিঠু
প্রডিউসার। ফরিদুর রেজা সাগর
কাস্ট । তৌকীর আহমেদ; মোশাররফ করিম; জয় রাজ; সামিয়া সাঈদ; ফারিহা শামস সেওতি; ডমিনিক গোমেজ
রানিংটাইম । ৯৬ মিনিট
ভাষা । বাংলা
দেশ । বাংলাদেশ
রিলিজ । ১৬ জুন ২০১৮

কমলা রকেট সিনেমাটিকে যদিও বলা হচ্ছে শাহাদুজ্জামান রচিত দুটো ছোটগল্পের চলচ্চিত্র তরজমা; কিন্তু শুধু মৌলিক [১৯৯৬] গল্পটিকেই এর চিত্রনাট্যের জমিন বলা যেতে পারে। কেননা, আপাতদৃষ্টিতে সিনেমার প্রধান চরিত্র থেকে শুরু করে এর সেটিং [চলন্ত লঞ্চ], বেশিরভাগ ধারাবিবরণী এই গল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দ্বিতীয় গল্পটি, অর্থাৎ, সাইপ্রাস [২০১৪] থেকে শুধু একটি চরিত্র [যেখানে মোশাররফ করিম অভিনয় করেছেন] চিত্রনাট্যে সংযোজন করা হয়েছে।
এখন, এই দুটো ছোটগল্পকে চলচ্চিত্ররূপে ভাষান্তরিত করতে গিয়ে কিছু বিষয় একদমই হারিয়ে গেছে। এটি চিত্রনাট্যকার কিংবা চলচ্চিত্রকারের নিজস্ব/যৌথ বিচারের মাধ্যমেই যে হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তবে এই বিচার করতে গিয়ে যে শুধু গল্পের মেজাজাই বিগড়ে গেছে, তা নয়; উপরন্তু লেখকের নিরীক্ষাধর্মী লেখনির যে দারুণ সেলুলয়েড সম্ভাবনা ছিল, তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে।
অঙ্কুরেই বলছি এ কারণে, কেননা, কমলা রকেটই শাহাদুজ্জামান লিখিত প্রথম কোনো ফিকশনধর্মী রচনার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্ররূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা।

নিরীক্ষাধর্মিতায় গুড়েবালি
মৌলিক গল্পটির নিরীক্ষাধর্মিতার স্বরূপ বোঝা যাবে নিম্মোক্ত অনুচ্ছেদটি পাঠ করলে:
“আমি একটা রোটেশন তৈরি করলাম। প্রথমে ধানক্ষেত, তারপর আকাশ, তারপর নদী, শেষে মেয়ে। আবার নদী, ধানক্ষেত, আকাশ, মেয়ে– এভাবে দেখতে লাগলাম…”
[শাহাদুজ্জামান, ২১]
কল্পনা করে দেখুন, সাবজেক্টিভ পয়েন্ট অব ভিউ থেকে লং শটে প্রথমে ধানক্ষেত দেখছেন আপনি, এরপর ক্যামেরা টিল্ট আপ করে সোজা চলে যাচ্ছে নীল আকাশে, এরপর আবার নদীর দিকে, তারপর হয়তো মিড শটে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। এবং এখানেই শেষ নয়। ক্যামেরা আবারও উল্টো রোটেশনে এভাবেই ঘুরছে। ৯০ মিনিটের সিনেমায় এই ‘স্টাইল অব শটের’ পুনরাবৃত্তিই হয়তো রাখা যেতে পারতো একাধিকবার।
পাঠক, নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, হুবহু টেক্সট অনুবাদ করলেই কী দারুণ চলচ্চিত্র ভাষা তৈরি হয়ে যেতে পারতো এই সিনেমায়– যা বাংলা ভাষার সিনেমায় সচরাচর দেখা যায় না কিংবা আদৌ দেখা গেছে কি না সন্দেহ।

বিগড়ে যাওয়া মেজাজ
প্রত্যেকটি গল্পেরই একটি নিজস্ব মেজাজ থেকে। মৌলিক গল্পটি যথেষ্ট ধীর মেজাজের। এ ধরনের ঢঙে বানানো সিনেমার ইতিহাসও কিন্তু বেশ পুরনো। রুশ পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কি থেকে শুরু করে হালের তূর্কি পরিচালক নুরি বিলগে জিলান পর্যন্ত অনেক পরিচালকই এই ধীর মেজাজের সিনেমা ভাষাকে সম্পদশালী করেছেন।
…
অনেক
শটই ঠিকমতো
বুঝে ওঠার আগেই
পর্দা থেকে উধাও
হয়ে গেছে
…
অথচ মৌলিক গল্পে থাকা এই ধীর প্রকৃতিকে একদমই নাকচ করে দিয়েছেন কমলা রকেট সিনেমার স্রষ্টা। সিনেমাটির কোথাও খুব বেশিক্ষণ ধরে চলা কোনো শটই আপনার চোখে পড়বে না। উপরন্তু অনেক শটই ঠিকমতো বুঝে ওঠার আগেই পর্দা থেকে উধাও হয়ে গেছে।
অথচ, গল্পের মধ্যে থাকা এই অংশটি একবার পড়ে দেখুন:
“দুপুর গড়িয়ে আসছে। নদীর পানি চিকচিক করছে। চরের বালিতে বাধা পেয়ে নদীর স্রোত বদলে যাচ্ছে। স্রোতে কী যেন একটা ভেসে আসছে। কাছে আসতে দেখি একটা ছেঁড়া বালিশ। তুলো বের হওয়া ছোট একটা বালিশ। কোনো বাচ্চার হবে হয়তো। তাকে অনুসরণ করে ভেসে আসছে ওটা কী? হ্যাঁ, চেনা যাচ্ছে, বেশ হৃষ্টপুষ্ট একখণ্ড মল। মানুষের মল…”
[শাহাদুজ্জামান, ২৪]
নদীর স্রোতে ভেসে আসছে একটা ছোট ছেঁড়া বালিশ আর এক টুকরো মানুষের মল– এটাই হয়তো বেশ কিছুক্ষণ ধরে পর্দায় দেখতে পারতাম আমরা। তাতে যেমন আমাদের এখানকার পারিপার্শ্বিক বাস্তবতাটাও উঠে আসতো, ঠিক তেমনি সিনেমার প্রকৃতি এবং এতে অভিনীত এক বা একাধিক চরিত্রসমূহ ব্যাখ্যা করার দারুণ উপমাও তৈরি হতো।
শুধু বস্তুগত উপকরণের গতিবিধি দিয়েই চলচ্চিত্র শৈলী নির্মাণের দারুণসব উদাহরণ আমরা পূর্বে দেখেছি। ইরাni চলচ্চিত্রাচার্য আব্বাস কিয়ারোস্তামি নির্মিত দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস [১৯৯৯] সিনেমায় দীর্ঘক্ষণ ধরে দোতলা থেকে নিচে আপেল পড়ার শটটি কিংবা নুরি বিলগে জিলানের ওয়ানস আপোন অ্যা টাইম ইন আনাতোলিয়ায় (২০১১) একইরূপে গাছ থেকে আপেল গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যটি ধীর মেজাজের সিনেমায় অনন্যতা দিয়েছে বলে আমি মনে করি।

অন্তঃসারশূন্য চরিত্র
আগুন লেগে যাওয়া গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক গা ঢাকা দেওয়ার জন্য এসে উঠেছেন লঞ্চে। সবার ধারণা, মোটা অঙ্কের ইন্স্যুরেন্স পাওয়ার জন্য তিনি নিজেই পরিকল্পিতভাবে নিজ ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগিয়েছেন। গণশত্রু বনে যাওয়া সিনেমার এই প্রধান চরিত্রের সঙ্গেই পুরোটা সময় কাটাতে হচ্ছে আপনাকে।
অথচ, মৌলিক গল্পে থাকা এই চরিত্রকেই আপনার রাজনীতি এবং সাহিত্য সচেতন সমাজের তথাকথিত উচ্চশ্রেণির মানুষ বলেই মনে হবে, যার স্বগোক্তি শুনে ভারি মজাও লাগবে আপনার। কেননা, সেখানে তার চারপাশ দেখার ভঙ্গি, নাক উঁচু স্বভাব, সাহিত্য দর্শনগুলো মিলেমিশে এক বহুমুখী চরিত্র হিসেবে হাজির হয়।
গল্পের শেষের দিকে এই চরিত্রকেই যখন ডাল-ভাত খাওয়ার জন্য সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষের সঙ্গে শামিল হতে হয়, তখনই পাঠক মনে এক দোদুল্যমান অবস্থার সৃষ্টি হয়।
…
এই
চরিত্রের
সিনেমাকে দেওয়ার
মতো আর কোনো বিশেষ
যাপন
নেই
…
এই দোদুল্যমান অবস্থা সিনেমার দর্শকের ওপর ভর করবে না। কেননা, উঁচুশ্রেণির তকমা ছাড়া সিনেমার চরিত্রের সঙ্গে গল্পের চরিত্রের আর কোথাও যে মিল নেই! এই চরিত্রের সিনেমাকে দেওয়ার মতো আর কোনো বিশেষ যাপন নেই।
এমনকি সাইপ্রাস গল্প থেকে নেওয়া চরিত্রটির সেলুলয়েড উপস্থাপনও পাঠক মনে স্বপ্নভঙ্গের স্বাদ দিতে পারে। সদা হাস্যোজ্জ্বল গ্রামীণ এই লোককে দেহব্যবসার দালাল হিসেবে মেলানো কঠিন। কাহিনি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে সিনেমার প্রধান এই দুই চরিত্রের এমন আমূল পরিবর্তন পাঠক মনে এক নৈতিক হাহাকার তৈরি করতে পারে।
পুনশ্চ: শতবর্ষী পুরনো কমলা রকেট নামের এই বিশেষ স্টিমারটি একসময় ঢাকা থেকে কলকাতায় যাতায়াত করত। বর্তমানে এর রুট ঢাকা-বরিশাল-খুলনা। যদিও নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে অনেক সময় বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জে গিয়েই থেমে যায় এই স্টিমার।
সেক্ষেত্রে স্টিমারে সওয়ার হওয়া বেশিরভাগ যাত্রীই যে দক্ষিণাঞ্চলের উপভাষায় কথা বলবে, এটাই স্বাভাবিক। বৃহত্তর খুলনা এবং বরিশালের উপভাষা আবার এক নয়। এই দুই অঞ্চলের ভাষার ভেতরে ব্যাপক পার্থক্য আছে। অথচ পুরো সিনেমাজুড়েই চরিত্রগুলোর সংলাপে বরিশাল অঞ্চলের উপভাষার আধিক্য রয়েছে।
সেটা থাকাটাই স্বাভাবিক; কেননা, স্টিমারটি প্রথমে ভিড়ছেই বরিশালে। কিন্তু একটা চরিত্রকেও খুলনা অঞ্চলের ভাষায় কথা বলতে দেখা গেল না!
নিম্মবর্গীয় মানুষের স্থানিকতার চিত্রায়নে ভাষা যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চরিত্রগুলো মুখ দিয়ে বলছে তারা মংলা/সুন্দরবন যাচ্ছে বা তাদের বাড়ি সেখানে। অথচ তাদের সংলাপে একবারও সেই অঞ্চলের ভাষার স্বরূপ ফুটে উঠলো না!

দোহাই: ১। শাহাদুজ্জামান, কয়েকটি বিহ্বল গল্প, ঢাকা, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৬ ২। শাহাদুজ্জামান, অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প, ঢাকা, মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৪ ৩। নূর ইমরান মিঠু, কমলা রকেট, ক্যালিফোর্নিয়া, নেটফ্লিক্স, ২০১৮ ৪। ওয়াক ডেস্ক, রকেট স্টিমার সার্ভিস | ইতিহাস ঐতিহ্যে অন্যরকম নৌ-ভ্রমণ, ওয়াক বাংলাদেশ ৫। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন, ঢাকা, ২০১৭
ছবির গল্পের প্রেক্ষাপট একটি ভালো ছবির উদাহরণ হতে পারতো কিন্তু (মোশাররফ করিম ছাড়া) সব অভিনেতারা ছবিটিকে গলা টিপে হত্যা করেছে, তৌকির আহমেদ এই ছবিতে উনার জীবনের অভিনীত ছবির সবচেয়ে খারাপ অভিনয় করেছেন আমার অভিমত। পরিচালক এই দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না, ক্যামারার কাজ ভালো লেগেছে।