লিখেছেন । মেহজাদ গালিব
অ্যা সিরিয়ান লাভ স্টোরি
ডকুমেন্টারি
ফিল্মমেকার; স্ক্রিনরাইটার । শন ম্যাকঅ্যালিস্টার
প্রডিউসার । এলহাম শ্যাকারিফার; শন ম্যাকঅ্যালিস্টার
মিউজিক । টেরেন্স ডান
এডিটর । ম্যাট স্কলস
রানিংটাইম । ৭৬ মিনিট
দেশ । যুক্তরাজ্য; সিরিয়া
ভাষা । ইংরেজি
রিলিজ । ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫

এক সন্ধ্যায় বসে আছি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ওপরতলায়, ক্যান্টিনে। বাংলাদেশে তখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ডকুমেন্টারি ছবি নিয়ে কয়েকদিনব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান। আয়োজকরা সেদিন বিকালে একটি মাস্টার ক্লাস আয়োজন করেছেন একজন খুব বড় মাপের ডকুমেন্টারি ছবির নির্মাতার সঙ্গে। নামটা খুব খটমটে, বিশেষ করে শেষ অংশটা। ভালোভাবে উচ্চারণও করতে পারছিলাম না।
আমি বসে আছি; সবার সঙ্গে চা খাচ্ছি। চলচ্চিত্রপ্রেমী বন্ধুরা প্রায় সবাই আছেন। কিন্তু সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, মাস্টার ক্লাস আর শুরু হয় না! এক মাঝ বয়সী বিদেশি ভদ্রলোক, খুব সাদামাটা পোশাক, বয়স ৫৫ হবে– আমার পাশে বসে আছেন; ল্যাপটপে কাজ করছেন, আমার বিরক্তিটা টের পেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।
একটু পরে আয়োজকদের মধ্যে এক বন্ধুকে বললাম, কে মাস্টার ক্লাস নিচ্ছেন? এত দেরি হচ্ছে কেন?
জানতে পারলাম, আমার পাশে বসে থাকা, মুচকি হাসি দেওয়া লোকটাই ক্লাস নিবেন। আমার বন্ধুটা খুব বিস্মিত হলো, আমি এই চলচ্চিত্র নির্মাতাকে চিনি না দেখে। আমার খুব পছন্দের একটা ডকুমেন্টারি ছবির পরিচালক তিনি; অথচ তার এই খটমটে নামটা আমার জানা ছিল না, অথবা সেই মুহূর্তে মনে করতে পারছিলাম না।
ডকুমেন্টরারির জগতে এ সময়ের একজন অসাধারন নির্মাতা তিনি। আমি অবাক হয়ে গেলাম তার ব্যবহারে। নীরবে কোণায় বসে কাজ করছেন ল্যাপটপে। অনুষ্ঠান দেরি হচ্ছে বলে কোনো অস্থিরতা নেই। একজন অমায়িক মানুষ।

মাস্টার ক্লাসটা শুরু হবার পরপরই আমাকে বের হয়ে আসতে হলো। অন্য একটা কাজ ছিল; আমার বাড়িও অনেক দূরে, ফিরতে হবে। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমন একটা মানুষের কাছ থেকে কত কিছুই না শেখার ছিল! কিছুটা সময় যদি আরও থাকতে পারতাম!
তার নাম শন ম্যাকঅ্যালিস্টার। তার একটি ডকুমেন্টারি ছবি নিয়ে আমি একটু কথা বলতে চাই। ছবিটার নাম অ্যা সিরিয়ান লাভ স্টোরি। যদি বলা হয় আমার সবচেয়ে প্রিয় দশটি ডকুমেন্টারি ছবির তালিকা করতে, তার মধ্যে এই ছবিটা অবশ্যই থাকবে। সত্যি বলতে, আমার দেখা সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে এটা একটা।
শন ম্যাকঅ্যালিস্টার একজন বৃটিশ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা। শন ভ্রমণে গেছেন সিরিয়াতে। তখন সিরিয়াতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি থমথমে। ২০০৯ সালে সিরিয়াতে শুরু হয় স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পথ ধরে আসা আরব বসন্তের ছোঁয়া পরবর্তীকালে সিরিয়াতে একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে রূপ দেয়। স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের নেতা বাশার আল আসাদ তার সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে প্রতিবাদী জনগোষ্ঠিীকে দমন করেন। পুরো সিরিয়া একটি মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়। শত শত সিরিয়ান নাগরিক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই ঘটনাগুলো আমরা সবাই কম-বেশি জানি।
…
অনুসন্ধিৎসু
ডকুমেন্টারি নির্মাতা
শন তার ক্যামেরা দিয়ে
খুবই ক্যাজুয়ালি এই ভয়াল
পরিবেশটা তুলে
ধরেন
…
শন যখন সিরিয়ায়, তখন তিনি লক্ষ্য করেন, কেউ এ বিষয় নিয়ে তেমন কথা বলতে চায় না। বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখতে গিয়ে পুরো দেশে একটি থমথমে ভাব লক্ষ্য করেন তিনি। অনুসন্ধিৎসু ডকুমেন্টারি নির্মাতা শন তার ক্যামেরা দিয়ে খুবই ক্যাজুয়ালি এই ভয়াল পরিবেশটা তুলে ধরেন। খুঁজতে থাকেন এমন কাউকে, যে এই শহরের প্রতিবাদের সত্যকার চিত্রটি তার কাছে তুলে ধরবেন।
বেশ কয়েকবার বাধার সম্মুখীন হন তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। এক সন্ধ্যায় একটি বারে তার অলাপ হয় একজন সুদর্শন যুবকের সঙ্গে। ক্যামেরা অন করা। আর তাই দর্শক পুরো কথোপকথনটা দেখতে পান ছবিটিতে।

যুবকটির নাম আমের। তার স্ত্রী রাগদা একজন বিপ্লবী। বাশার আল অসাদের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে রাগদা তখন কারাগারে। দামাসকাসে ইয়ারমুক রিফিউজি ক্যাম্পে আমের আর তার ছেলেরা আশ্রয় নিয়েছেন। যারা নিয়মিত সিরিয়ার যুদ্ধের খবর পড়েন বা দেখেন, তাদের কাছে এটি একটি অত্যন্ত পরিচিত ক্যাম্প। হত্যাকাণ্ড, বোমা বিস্ফোরণ এখানে আশ্রয় নেওয়া ফিলিস্তিনি ও সিরিয়ান নাগরিকদের কাছে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আমের ও রাগদার দুই ছেলে বব আর কাকার কাছেও এ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তারা জন্মের পর থেকেই তাদের বাবা আর মাকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের করায় জেলে যেতে দেখেছে।
শন জানতে পারেন ওই দেশের মানুষের দুঃখ দুদর্শার কথা, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা। আমেরকে ফলো করে শন তার ক্যাম্পে যান এবং এরপর থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর তিনি আমের ও তার পরিবারের সঙ্গে মিশে থাকেন। টানা পাঁচ বছর এই পরিবারের গল্প ক্যামেরায় ধারণ করেন শন। আর সেই গল্পই রূপ নেয় একটি অসাধারণ চলচ্চিত্রে, যার নাম অ্যা সিরিয়ান লাভ স্টোরি।
আমের দাউদ আর রাগদা হাসানের পরিচয় কারাগারে। আমের আর রাগদা সিরিয়ার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে জেলে যান, সেখানেই তাদের হৃদয়ের সখ্য গড়ে ওঠে। তারা মুক্তি পান এবং বিয়ে করেন। এর ১৫ বছর পর আরব বসন্তের ছোঁয়া রাগদার হৃদয়কে আবার স্পর্শ করে যায়। বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। তিনি তার দেশকে ভালবাসেন। তার স্বামীর মতো, তার সন্তানদের মতো। রাগদা অন্দোলন করেন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য। যে রাষ্ট্রে তার পরিবার নিরাপদ। ঠিক সেই সময়ই, ২০০৯ সালে শন এই ছবি নির্মাণ শুরু করেন। পুরো সিরিয়া তখন বাশার আল আসাদের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠছিল।
জেল থেকে আবার ছাড়া পেয়ে পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমের আর রাগদা তার সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে বৈরুত চলে যান। কিন্তু রাগদার মন পরে থাকে সিরিয়ায়। যে আন্দোলন তিনি শুরু করেছিলেন, সেটা ছেড়ে পালিয়ে আসা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু আমের এই যুদ্ধ আর হানাহানির মধ্যে আর ফিরে যেতে চান না। তার ছেলেদের যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চান না তিনি বারবার।
…
তাদের
ভালোবাসার
সম্পর্কে চিড় ধরতে
শুরু করে, ঠিক একইসঙ্গে
তাদের প্রিয় স্বদেশ সিরিয়া
ধ্বংসস্তূপে পরিণত
হতে থাকে
…
এক পর্যায়ে তারা ফ্রান্সে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নেন। বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হয়ে একটি সাদামাটা পরবাসী জীবন শুরু করেন তারা। কিন্তু রাগদা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না নিজের দেশ থেকে দূরে এসে এই শরণার্থী-জীবন। শুরু হয় দ্বন্দ্ব। তাদের ভালোবাসার সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে, ঠিক একইসঙ্গে তাদের প্রিয় স্বদেশ সিরিয়া ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে থাকে।
রাগদার বিপ্লবী মন যখন দেশ ছেড়ে নির্বাসনে, তিনি মানসিকভাবে এমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, আত্মহত্যার পথ বেছে নিতেও দ্বিধা করেন না। ছেলেরা নিরাপদে বড় হতে থাকে। ধীরে ধীরে তারা মিশে যেতে থাকে একটি কসমোপলিটান কালচারে। কিন্তু আমের আর রাগদার মাঝে যুদ্ধ যেন আর শেষ হয় না, ঠিক তাদের মাতৃভূমি সিরিয়ার মতো।
শন যেভাবে এই ডকুমেন্টারি তৈরি করেছেন, সেটা আমার কাছে খুব ইনটেরেস্টিং মনে হয়েছে । এতে শন সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। ক্যমেরাটা একটা মাধ্যম মাত্র। শন নিজেই ক্যামেরা চালিয়ে পুরো ছবিটি শ্যুট করেছেন।

এ রকম যুদ্ধ শুরু হবার পূর্ব মুহূর্তে বা রাজনৈতিক অস্থিরতার ভেতর পুরো ইউনিট নিয়ে কাজ করার কোনো প্রস্তুতি শনের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এতে আমের আর তার পুরো পরিবারের সঙ্গে শনের একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। শুটিং করার জন্য তাদের আলাদাভাবে প্রস্তুত করার কোনো প্রয়োজন পড়েনি। ক্যামেরাটা কেবল একটা প্রপ্সের মতো শনের হাতেই ছিল। যার ফলে তাদের মধ্যে খুব সহজেই একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। যা অন্তত এই ছবির ক্ষেত্রে খুবই জরুরি।
আমের ও রাগদার জীবনের সংগ্রাম, তাদের দুই ছেলেদের বেড়ে ওঠা এই ছবিতে আমরা দেখতে পাই। শন গল্পটি তার চোখ দিয়ে আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। এই গল্প বলাটা আমাদের হৃদয়কে প্রবলভাবে নাড়া দেয় আর সেটাই অ্যা সিরিয়ান লাভ স্টোরিকে একটি খুবই বড় মাপের চলচ্চিত্রের মর্যাদা দেয়।
…
যে চলচ্চিত্র
মানুষের সূক্ষ অনুভূতিগুলো
খুব নিখুঁতভাবে পর্দায় তুলে
ধরতে পারে, সেই
চলচ্চিত্র ততটা
সফল
…
আমি মনে করি, যে চলচ্চিত্র মানুষের সূক্ষ অনুভূতিগুলো খুব নিখুঁতভাবে পর্দায় তুলে ধরতে পারে, সেই চলচ্চিত্র ততটা সফল। শন একটি ইন্টারভিউতে বলেছেন, খুব ছোট একটি ক্যামেরা দিয়ে তিনি এই গল্প শুট করেছেন, যেন পরিবারটি ক্যামেরার উপস্থিতিতে অস্বস্তিতে না পড়ে। তিনি খুব ভাবনায় ছিলেন, বড় পর্দায় দেখানো হলে এটাকে সিনেমাটিক মনে হবে কি না। আপনারা ছবিটা দেখলে বুঝতে পারবেন, বড় পর্দায় তা কোনোভাবেই ছবিটির গুণগত বা কারিগরি মান ব্যাহত করেনি। সিনেমার যে নিজস্ব ভাষা, সেটা খুব ভালোভাবই ছবিটাতে এসেছে।
কাজেই, একটা ভালো গল্প বলতে গেলে, বিশেষ করে ডকুমেন্টারি ছবির ক্ষেত্রে কতটা উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে, বা কতটা প্রোডাকশন ভ্যালু আছে– এইসবের চেয়ে কীভাবে গল্প বলার কৌশলটা মানুষের মনকে ছুঁয়ে যাবে, সেটাই বড়। অ্যা সিরিয়ান লাভ স্টোরি তেমনই একটা ছবি।
শন যে স্টাইল ফলো করে ছবিটি নির্মাণ করেছেন, সেটাকে পারটিসিপেটরি ডকুমেন্টারি স্টাইল বলা হয়ে থাকে। পারটিসিপেটরি স্টাইলে ফিল্মমেকার নিজেই প্রত্যক্ষভাবে ছবির একটা অংশ হয়ে যান। এটা অনেকটা ইনভেস্টিগেটিভ ফিল্মমেকিংয়ের মতো, যেখানে কোনো একটি কন্ট্রোভার্সিয়াল বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে রেখে ফিল্মমেকার তার ফিল্মমেকিংয়ের যে ন্যারেটিভ বা গল্প, তার মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেন। ফিল্মমেকার নিজেই ছবিটার অংশ হয়ে দাঁড়ান।
শনের চোখ দিয়েই আমরা সেই সময়কার সিরিয়ার রাজনৈতিক অবস্থাটা জানতে পারি। বাশার আল আসাদের একনায়কতন্ত্রের ফলে সিরিয়ায় সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল, যা পরবর্তীকালে ভয়াবহ যুদ্ধে রূপ নেয়। শত শত সিরিয়ান নাগরিক প্রাণপণে বাঁচার আশায় পরিবার নিয়ে পালিয়ে যান।

শন পাঁচ বছর তার ক্যামেরা নিয়ে এমনই একটি পরিবারের গল্প তুলে ধরেছেন এই ছবিটিতে। লুকিয়ে শরণার্থী শিবিরে শুটিং করার সময় তাকেও আসাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। তার ক্যামেরাসহ শুটিংয়ের ফুটেজ জব্দ করা হয়। ছাড়া পেয়ে অমের আর রাগদার বৈরুতের আবাসস্থল থেকে আবার ছবির কাজ শুরু করেন শন। এরপর তাদের প্যারিসের শরণার্থী জীবনের শুরু থেকে তারা সেখানে থিতু হওয়া পর্যন্ত পুরো গল্পটাই আমরা শনের ক্যামেরা দিয়ে দেখতে পাই।
রাগদার জেল থেকে মুক্তির পর পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার যে আনন্দ, আবার সিরিয়া ত্যাগ করার পর থেকে তার ভেতরের যে দ্বন্দ্ব, তার যে পাল্টে যাওয়া, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম– তা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া, এই সবকিছুই ধারাবাহিকভাবে শনের ক্যামেরায় ধরা পড়ে। স্ক্রিনে দেখতে পাই বাচ্চার সঙ্গে খেলতে খেলতে রাগদার অন্যমনষ্ক হয়ে যাওয়া। রাগদা অন ক্যামেরায় বলতে থাকেন তার দেশ, সেখানকার তৈরি হাতের রুটি, এমনকি তাদের গাছের লেবুটা পর্যন্ত খুব মিস করছেন।
এই যে একটা অকুতি, ছোট ছোট ডিটেইল– এটা অ্যা সিরিয়ান লাভ স্টোরিকে একটা অন্য মাত্রা এনে দেয়, যা দিনের পর দিন ধরে নির্মাতার সেখানে অবস্থানের ফলেই সম্ভব। নির্মাতা নিজে চলচ্চিত্রর অংশ না হয়ে উঠলে এই ছোট ছোট হৃদয় কাড়া মুহূর্ত তৈরি সম্ভব নয়।
এ রকম আরও অনেক ছোট ছোট মুহূর্ত অ্যা সিরিয়ান লাভ স্টোরিতে আমার মন কেড়ে নিয়েছে। তেমনই আরেকটি ছোট মুহূর্তের কথা বলি: আমেরের বড় ছেলে তার ল্যাপটপে সিরিয়ার যুদ্ধে মৃতদের লাশের ছবি দেখতে থাকে, ঠিক সেই সময় আমরা স্ক্রিনে দেখতে পাই– আমের আর রাগদার ছোট ছেলে কাকার চোখ দিয়ে নীরবে জল গড়িয়ে পড়ছে। চার-পাঁচ বছরের একটি শিশুর মনে যুদ্ধের ভয়াবহতা কতখানি দাগ কাটতে পারে, এই দৃশ্যটা দেখলে তা অনুধাবন করা যায়।
শন তাকে প্রশ্ন করলে জবাব দেয়, সে প্রেসিডেন্ট বাশারকে মেরে ফেলতে চায়! কারণ জানতে চাইলে বলে, সে সিরিয়ায় ফিরে যেতে চায়। বাবা-মায়ের অশান্তি, শরণার্থী জীবন– এই সবকিছু ছোট্ট শিশু কাকার মনে নিদারুণ রেখাপাত করে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অস্থির হতে থাকেন রাগদা। ফিরে যেতে চান সিরিয়ায়। কিন্তু আমের কিছুতেই তার ছেলেদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চান না। বরং ফ্রান্সের শরণার্থী জীবনে মানিয়ে নিতে চান। বাড়তে থাকে তাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব। বিশ্বাসে চিড় ধরতে থাকে ধীরে ধীরে। রাগদা জীবনের প্রতি নিরাসক্ত হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। আমের আর রাগদার ছেলেরা মানিয়ে নিতে থাকে নতুন জীবনে।
তাহলে আসুন দেখি, এই গল্পে কী কী আছে। আছে দেশপ্রেম, আছে বিদ্রোহ, আছে দুই বিদ্রোহী নারী-পুরুষের কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় প্রেমের গল্প, আছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, আছে পরনারী আসক্তি। আছে যুদ্ধ। সব মিলিয়ে একটি জমজমাট গল্পের প্লট। আছে জমজমাট এবং নাটকীয় পরিসমাপ্তি। মোট কথা, অ্যা সিরিয়ান লাভ স্টোরি একটি হৃদয় কাড়া প্রেমের এবং একইসঙ্গে একটি রাজনৈতিক মুক্তির ছবি।
দেশপ্রেম কখনোই মানুষের ব্যক্তি প্রেমের চেয়ে আলাদা সত্তা নয়, এই ছবি সেই গল্পই বলে। সবচেয়ে বড় কথা, এই সবকিছুর চিত্রায়ন ছবিতে দেখতে পাই ঠিক যেমনভাবে আমরা নন-ফিকশনে এমন একটা গল্প দেখি।
…
কোথাও
এসে ফিকশন
আর নন-ফিকশনের
সীমারেখাটা ব্লার হয়ে যাওয়া
খুবই দরকার
…
আমি সবসময়ই মনে করি, ছবি দেখার সময় এটা ফিকশন না ডকুমেন্টারি, তা নিয়ে ভাবনা যেন ছবির আনন্দকে নষ্ট না করে। ডকুমেন্টারির ক্ষেত্রে এটা একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ বলে আমার মনে হয়। কোথাও এসে ফিকশন আর নন-ফিকশনের সীমারেখাটা ব্লার হয়ে যাওয়া খুবই দরকার। কেবলই মনে হবে, একটা ভালো ছবি দেখছি। অ্যা সিরিয়ান লাভ স্টোরি ঠিক তা-ই। আর এই ডায়াজেসিস বা স্টোরি লাইনটা তৈরি করতে না পারলে অ্যা সিরিয়ান লাভ স্টোরি একটি ভালো নিউজ কন্টেন্টের চেয়ে বেশি কিছুই হয়ে উঠত না।
অ্যা সিরিয়ান লাভ স্টোরি বিশ্ব চলচ্চিত্র অঙ্গনে একটি সাড়া জাগানো প্রামাণ্যচিত্র। গুগল করলে অনেক তথ্য পাবেন আপনারা। অবশ্যই সময় পেলে দেখবেন ছবিটা। আরব সংগীতের পরিমিত ব্যবহার ছবিটাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

শন ম্যাকঅ্যালিস্টার একজন সমাজ সচেতন অথবা অ্যাক্টিভিস্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা। তার মতো একজন বড় নির্মাতাকে নিজের চোখে ঢাকায় দেখতে পাওয়া আমার জন্য বিশাল ব্যাপার; কারণ আমি ডকুমেন্টারি নিয়ে আরও কাজ করতে চাই। আমি আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই। তবে সময়ের স্বল্পতার জন্য তাকে প্রশ্ন করতে পারিনি সেদিন। এমন সুযোগ আবার আসবে, আশা করি হয়তো। অনেক কিছু জানবার আছে আমার নিজেরও। যতটুকু মনে হলো, আপনাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিলাম।
পরিশেষে বলি, আলান কুর্দি বলে একটি ছোট্ট সিরিয়ান শিশুর সাগর তীরে মৃত পড়ে থাকার ছবিটা আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়? সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসার সময় নৌকাডুবিতে শিশুটার মৃত্যু হয়। পত্র-পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়াতে ঝড় তোলে ছবিটা। সেই ছবি দেখলে আমার কেবলই নিজের ছোট ভাইয়ের শিশুটার কথা মনে পড়ে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড আঘাত লাগে।
রাজনৈতিক ফায়দা লুটবার জন্য শাসকগোষ্ঠীর এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাই। এই যুদ্ধ আর মানবহত্যার মাঝে একটা ভীষণ আশা জাগানিয়া গল্প অ্যা সিরিয়ান লাভ স্টোরি।