সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ এবং এই ধর্মান্ধ সময়

1540

লিখেছেন । জিম ইসমাইল

দেবী
ফিল্মমেকার; স্ক্রিনরাইটার; প্রডিউসার । সত্যজিৎ রায়
মূল গল্প । প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
সিনেমাটোগ্রাফার । সুব্রত মিত্র
মিউজিক । ওস্তাদ আলী আকবর খান
এডিটর । দুলাল দত্ত
কাস্ট [ক্যারেকটার] । শর্মিলা ঠাকুর [দয়াময়ী]; ছবি বিশ্বাস [কালীকিঙ্কর রায়]; সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় [উমাপ্রসাদ]; অনিল চট্টোপাধ্যায় [ভুদেব]; করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় [হারাসুন্দরী]
রানিংটাইম । ৯৩ মিনিট
ভাষা । বাংলা
দেশ । ভারত
রিলিজ । ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬০


১৯৬০। আজ থেকে ষাট বছর আগে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায়ের দেবী।প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ১৮৯৯ সালে লেখা ছোটগল্প দেবী অবলম্বনে একই নামে সত্যজিৎ রায় এই ছবিটি নির্মাণ করেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতা এই ছবির পশ্চাৎপট অথবা তারও বেশি কিছু।

ছবির প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের একটি জমিদার পরিবার। সময়কাল উনিশ শতকের মাঝামাঝি। সত্যজিতের প্রায় সবকটি পিরিয়ড-পিসের সময়কাল উনিশ শতকীয় বাংলা– সে জলসাঘর হোক, অথবা দেবী অথবা চারুলতা

এ এমন এক সময়, যখন আমাদের ঐতিহ্যে যা কিছু অন্ধকার তাকে উনিশ শতকীয় আধুনিকতার আলোতে দেখা হচ্ছে। মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক-পুরুষপ্রধান সমাজে নবজাগরণের আলো এসে পড়ছে।

কাহিনিতে ফেরা যাক। গ্রামের জমিদার কালীকিঙ্কর। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ। সত্যজিৎ তাকে নির্মাণ করেছেন পরম মমতায়। কালীকিঙ্কর যে নিষ্ঠাবান ধার্মিক, সেটা বিভিন্ন ডিটেলের মাধ্যমে শুরুতেই দর্শকদের সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তার ছোট পুত্র উমাপ্রসাদ শিক্ষিত নব্য যুবক। কলকাতাতে ইংরেজি পড়ে। জমিদারপুত্র হয়েও শিক্ষা শেষে বিদেশে চাকরির স্বপ্ন দেখে। উমাপ্রসাদের কথায়, তার বাবার বিদ্যে পুরনো, ‘তার আর আমার মধ্যে এক যুগের ব্যবধান।’

কালীকিঙ্করের পুত্রবধূ তথা উমাপ্রসাদের স্ত্রী দয়াময়ী এই কাহিনির কেন্দ্রবিন্দু। এক রাতে কালীকিঙ্কর স্বপ্ন দেখেন, দয়াময়ী স্বয়ং দেবী কালীর অবতার। এই স্বপ্নকে ঐশ্বরিক ইঙ্গিত ভেবে তিনি দয়াময়ীর আরাধনা শুরু করেন। তার ওপর দেবীত্ব আরোপ করেন। এই সময়টির নির্মাণ ভীষণ সুন্দর ও সাবলীল। আগের ঘটনাপ্রবাহে আমরা জেনেছি, জমিদার কালীকিঙ্কর দেবী কালীর বিশেষ ভক্ত; ধর্মাচরণ করেই তার সময় কাটে। দয়াময়ীকে তিনি বিশেষ স্নেহ করেন। পুত্রবধূকে তিনি ‘মা’ ছাড়া সম্বোধন করেন না।

কালীকিঙ্কর তার পুত্রবধূকে বলেন, ‘তুমি এলে, ঘর আমার আলো হয়ে উঠল। এই বুড়ো বয়েসে নতুন করে যখন এমন মা পেলাম, সেও অবশ্য তারই কৃপা; তখন তাকে ছেড়ে যাব কোথায়! কী বল মা?’

যদিও কিছু সমালোচক কালীকিঙ্কর ও তার পুত্রবধূর সম্পর্ককে জটিল ফ্রয়েডীয় যৌনতত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন, আমি এই লেখাতে সেদিকে যাচ্ছি না। কিন্তু প্রাথমিক ফ্রয়েডপাঠ না থাকলেও দর্শকদের বুঝতে অসুবিধে হয় না, জমিদার কালীকিঙ্করের কালীভক্তি এবং পুত্রবধূর প্রতি অপার স্নেহ– এই দুয়ের মিশেলেই তিনি দয়াময়ীকে দেবী কালী রূপে স্বপ্নে দেখেন।

প্রাথমিক পর্বে শ্বশুরের কাণ্ডকারখানায় হতবিহ্বল দয়াময়ীর পায়ের আঙুল গুটিয়ে আসে। তার হাত দেওয়ালে আশ্রয় খোঁজে। আনুষ্ঠানিক আরাধনা আর দেবত্ব তার ওপর নির্যাতন হয়ে নেমে আসে। এক রকম অসহায় হয়েই সে তার বৌদিকে বলে কলকাতাতে পাঠরত স্বামীকে চিঠি লিখে জানাতে।

উমাপ্রসাদ গ্রামে ফিরে আসে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের উমাপ্রসাদ মেরুদণ্ডহীন পিতৃভক্ত যুবক। এখানে মনে রাখা দরকার, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় গল্পটি লিখেছেন ১৮৯৯-তে আর তার গল্পের পটভূমি আরও ১০০ বছর আগের। কিন্তু সত্যজিতের উমাপ্রসাদ বাংলার নবজাগরণের ফসল। উচ্চ শিক্ষার আলো, রামমোহন-বিদ্যাসাগরের ভাবাদর্শ, আধুনিকতা তার চিন্তাকে তার বাবার প্রতিস্পর্ধী অবস্থানে নিয়ে আসে।

গ্রামে ফিরে উমা বাবার সঙ্গে তর্ক করে, প্রতিবাদ করে। সে সরাসরিই বলে, ‘এ পূজা আমি কিছুতেই হতে দেব না।’

দেবীতে সত্যজিৎ এভাবেই সংস্কারের সঙ্গে আধুনিক মননের দ্বন্দ্ব ভিজুয়াল ফর্মে ঢেলে সাজান। তার অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলোর মতো এই ছবিতেও পয়েন্ট এবং কাউন্টার পয়েন্টের দ্বন্দ্ব তৈরি করেন এবং এই দ্বান্দ্বিকতা থেকেই নির্মিত হয় তার চলচ্চিত্রের কাঠামো।

দেবীতে উমাপ্রসাদ এবং সমাপ্তিতে অমূল্য দুই আধুনিক বিদ্যার্থী শহর থেকে গ্রামে ফেরে বহমান নদীপথে। তাদের নৌকার পাল বাতাসে জেগে ওঠে। জীবনের এক নতুন মূল্যবোধ জন্ম নেয়। ক্রমে আকৃতি লাভ করে। প্রতিবাদ করে। দেবীর সেই ঋজু প্রকৃতির অধ্যাপক উমাপ্রসাদকে অনুপ্রাণিত করার জন্য আপন জীবন প্রসঙ্গে চিত্ত স্বাধীনতার কথা শোনান। নেপথ্যে বাষ্পীয় শকটের শব্দ প্রকাশিত হয়। একটা নতুন গতিবেগের আভাস মেলে।’

কাহিনিতে বাঁক আসে, যখন কাকতালীয়ভাবে এক মৃত্যুপথযাত্রী বালক চরণামৃত পান করে বেঁচে ওঠে। দয়াময়ী দ্বিধান্বিত হয়ে ওঠে, কালীকিঙ্করের ভ্রান্ত বিশ্বাস দয়াময়ীর মধ্যেও সংক্রামিত হয়। ভাবতে শুরু করে, ‘যদি আমি দেবী হই?’

ছবির এস্টাবলিশিং শটে সত্যজিৎ দর্শকদের সঙ্গে দয়াময়ীর পরিচয় করিয়ে দেন আনন্দমুখর কতকগুলো ডিটেলের মাধ্যমে– আকাশে অন্ধকার ভেঙ্গে আতশবাজির আলো ছড়িয়ে পড়ছে, দাম্পত্য প্রেম… ইত্যাদি। কিন্তু যে মুহূর্তে তার ওপর দেবীত্ব আরোপিত হয়, সে তার মানবীয় সজীবতা হারিয়ে ফেলে। ধর্মীয় কুসংস্কারের বদ্ধ জলাশয়ে দয়াময়ীও স্থানু হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত এই ভ্রান্তবিশ্বাসের ফাঁদে বিপর্যয় ঘটে যায় যখন আদরের ‘খোকা’কে সে বাঁচিয়ে তুলতে পারে না।

দর্শকের মনে পড়বে, ছবির শুরুতেই বলিদানের যূপকাষ্ঠ, ছাগশিশু,উদ্যত খড়গ, নেপথ্যে শিশুকণ্ঠ– কালীকিঙ্করের নাতি যে ধর্মান্ধতার বলি হবে, এই ইঙ্গিত ছিলই।

দয়াময়ীর দেবীত্ব মিথ্যে হয়ে যায়। পড়ে থাকে শুধু প্রতিমার কাঠামো।

শেষ দৃশ্যে দয়াময়ী উন্মাদগ্রস্ত হয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন নদী-প্রান্তরে মিলিয়ে যায়। এক দেবীর বিসর্জনে কাহিনির শুরু, অন্য দেবীর বিসর্জনে কাহিনির শেষ।

দেবীজলসাঘর শেষ হয় সরাসরি মৃত্যুদৃশ্যের যতি চিহ্নে। দুই মৃত্যু-দৃশ্যই প্রাসাদ থেকে সরে এসে নদীর কোলে। যেন জীবনচক্রের মূল স্রোতের সঙ্গে চরিত্র দুটি মিলিত হতে চায়।মৃত্যুর পূর্বে দুই চরিত্রের মধ্যে অনুভূত রিজেনারেশনের আর্তি।’


জীবনবিমুখ ভক্তিত্বে কুসংস্কারাচ্ছন্ন
মন কীভাবে ট্রাজেডি নিয়ে
আসতে পারে, এই
ছবিতে সেটিই
দেখানো
হয়েছে

অনেকে দেবীর সমাপ্তিকে ওপেন এন্ডেড মনে করেন। অর্থাৎ হয়তো দয়াময়ী দেবী কালীরই অবতার এবং আরও কিছু। স্বপক্ষে কিছু সমালোচক ভারতীয় ভক্তিদর্শনকেও এনে থাকেন। আমার মনে হয়, জীবনবিমুখ ভক্তিত্বে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন কীভাবে ট্রাজেডি নিয়ে আসতে পারে, এই ছবিতে সেটিই দেখানো হয়েছে। সত্যজিৎ অন্ধ কুসংস্কারকে পরিস্কারভাবে আক্রমণ করেছেন। শেষ দৃশ্য এই মূল সুরই বহন করছে। এর বাইরে জোর করে অন্য কোনো অর্থ খুঁজতে যাওয়ার মানে হয় না।

তাছাড়া চণ্ডী মুখোপাধ্যায়ের লেখা সাহিত্যের সিনেমায়, সিনেমায় সাহিত্য বই থেকে জানতে পারি [পাতা ১৩৫]– শোনা যায় যে, শেষ দৃশ্যে দয়াময়ীর জলে ডুবে আত্মহত্যার দৃশ্য শুট করা হয়েছিল; কিন্তু যান্ত্রিক গোলমালে সেই দৃশ্য ঠিকঠাক না হওয়ার কারণেই, দয়া কুয়াশায় মিলিয়ে যাচ্ছে– এখানেই ছবি শেষ করেন সত্যজিৎ। এই ছবি একটি অসাধারণ ট্র্যাক্ট ফিল্ম, ‘প্রতিবাদ চলচ্চিত্র’। এবং এই প্রতিবাদ ভীষণ শিল্পিত; চিৎকৃত বা সশব্দ নয়।

সত্যজিৎ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার নিজের অনুভূতি হচ্ছে, মানুষই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে। অবশ্যই প্রাণের শুরুর ব্যাপারটা নিয়ে রহস্য আছেই, কিন্তু আমার মনে হয় ঈশ্বর তেমন কিছু একটা ব্যাপার নয় যাতে আমি বিশ্বাস করতে পারি।’


যুক্তি
ও ধর্মের
সংঘাতে সত্যজিৎ
মানুষের পক্ষ নিয়েছেন,
জীবনের পাশে
দাঁড়িয়েছেন

তার কমিটমেন্ট মানুষের প্রতি। যুক্তি ও ধর্মের সংঘাতে সত্যজিৎ মানুষের পক্ষ নিয়েছেন, জীবনের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

দেবীর এক বিশেষ মুহূর্তে ঘটনার আকস্মিকতায় উদ্ভ্রান্ত উমাপ্রসাদ বাড়ির জীবনহীন পরিবেশ থেকে পালিয়ে আসে নদীর কূলে। তখন সন্ধ্যায় জেলের দল মাছ ধরে ফিরছে।অন্ধকার নদীর বুকে নৌকার সারিতে আলো জ্বলে উঠেছে। চিরন্তন জীবনপ্রবাহ চলেছে নীরবে। আবদ্ধ সময় থেকে সরে এসে যেন তার প্রতি চলচ্চিত্রকারের শ্রদ্ধা নিবেদন এখানে।

১৯৬০ সালে দেবী মুক্তির পরে গোঁড়া হিন্দুদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয় সত্যজিৎ রায়কে। হিন্দুধর্ম অবমাননা করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সত্যজিৎ হয়ে ওঠেন সে সময়ের ‘গণশত্রু’। দর্শকদের মনে পড়ে যায় ছবির এক বিশেষ মুহূর্তের কথা, যেখানে উমাপ্রসাদের অধ্যাপক তাকে বলছেন, ‘সংস্কার-বিরুদ্ধ কোনো কিছু করতে যাওয়া মানেই চোট খাওয়া– এটা নিয়ম, এটা হবেই।’

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই অধ্যাপক চরিত্র প্রভাতকুমারের মূল গল্পে ছিল না। সত্যজিৎ এই নতুন চরিত্র তার চিত্রনাট্যে এনেছেন। অধ্যাপক চরিত্রটি দেবী চলচ্চিত্রের বিবেক, এই চরিত্রই সত্যজিতের বক্তব্য ব্যক্ত করে। তিনি উমাকে বলেন, ‘যে জিনিসটা এত জোর গলায় তুমি মিথ্যে বলছ, সেটাকে প্রতিরোধ করার শক্তি বা সৎসাহস তোমার নেই?’

সত্যজিৎ দেবীতে এই সৎসাহস দেখিয়েছিলেন।

শুরু থেকেই চলচ্চিত্র ধর্মকে গৌরবান্বিত করে এসেছে। ভ্রান্তবিশ্বাস, অন্ধভক্তি ও পুরুষতন্ত্রকে মর্যাদা দিয়ে এসেছে। যে অন্ধ ধর্মীয় ভাবনা বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে, তাকে বানিয়া চলচ্চিত্রকাররা তুষ্ট করতে চেয়েছেন। ফলে ধর্মের বাস্তববিমুখতার লক্ষণকে চলচ্চিত্র বাস্তব বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু দেবীতে সত্যজিৎ প্রথমবারের মতো বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।

‘ধর্ম, দেবতা, ঈশ্বর– এসবের অস্তিত্ব প্রমাণসিদ্ধ নয়; তা কেবল বিশ্বাসনির্ভর। কোনো প্রত্যক্ষ সমালোচনা বা বিরুদ্ধতা ছাড়াই সত্যজিৎ দেখিয়ে দেন সেই বিশ্বাস বা দৈবী লীলার চেহারাটা; বুঝিয়ে দেন ধর্ম কীভাবে মানুষের বিচার বুদ্ধিকে পঙ্গু করে দেয়, অযৌক্তিক ও অসম্ভব ক্রিয়াকলাপের দিকে তাকে টেনে নেয়, তৈরি করে মিথ্যার আশ্রয়। সত্যজিৎ নাড়া দেন অনেক গভীরে; ব্যক্তি দয়াময়ী নয়, ধর্ম আসলে ঘনিয়ে তোলে মানবিকতার সংকট। সত্যজিৎ এভাবে দেখিয়ে দেন ধর্ম কেমন করে মানবিকতার শত্রু হয়ে ওঠে।’

এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না, একটা ছায়াছবি সমাজকে বদলে দিতে পারে।’

দেবীও পারেনি। দেবীর পর মহাপুরুষ [১৯৬৫] এবং গণশত্রু [১৯৯০] পেরিয়ে এসেও এই সময়ে আমরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে– এই একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল ভারতবর্ষে ধর্মকে কেন্দ্র করে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। বহু বছরের সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির গভীরে ঢুকে আছে, ধর্ম যার নিয়ন্ত্রক। দেব মাহাত্ব্য, আদারাইজেশন, ধর্মীয় আধিপত্যবা– এসবই এখন ভারতীয় সংস্কৃতি। এমনকি দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের মাপকাঠিও হয়ে উঠেছে ধর্ম।

ধর্মকে কেন্দ্র করে সংখ্যাগুরু দেশবাসী জিঙ্গো-জাতীয়তায় উদ্বুদ্ধ। সংখ্যালঘুদের অভারতীয় বলে ‘অপর’ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চরম সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে।সাম্প্রতিক নিজামুদ্দিন মার্কাজ নিয়ে দুর্ভাগ্যজনক সাম্প্রদায়িক ঘটনাটি এর জলজ্যান্ত উদাহরণ। এই করোনাকালীন আবহে করোনা সারাতে নেতামন্ত্রীরা গোমূত্র পান এবং গোবরস্নানের দাওয়াই দিচ্ছেন। আশ্চর্যের বিষয়, লোকে গোমূত্র পান করছে এবং অসুস্থ হচ্ছে।

বিজ্ঞানবিরোধী ছবি তৈরি হচ্ছে এবং জনপ্রিয়ও হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ওপর দেবত্ব আরোপ করে নিকৃষ্ট ছবি তৈরি হচ্ছে। টিভিতে ধর্মীয় সিরিয়ালের আস্ফালন– অবাস্তব কাণ্ডকারখানা এবং অযৌক্তিক ভক্তি যার উপাদান। এই ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সরকারি অনুষ্ঠান হয় পঞ্জিকা দেখে, ধর্মীয় নির্দেশ মেনে। চলচ্চিত্র বা সিরিয়ালের মহরৎ হয় এবং হচ্ছে নারকেল ফাটিয়ে পূজো দিয়ে।

প্রধানমন্ত্রী কুম্ভমেলায় স্নান করছেন, কপালে বীভৎস লাল তিলক দিয়ে নেতারা ঘনঘন মন্দিরে দৌড়াচ্ছেন। জ্যোতিষীদের কাছে আত্মসমর্পণ করছেন। সাধু-সন্তদের পদযুগল মাথায় ধারণ করছেন। ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সরকারি দপ্তরে, স্কুলে-কলেজে কোনো না কোনো দেব-দেবীর প্রতিমা অথবা তাদের মুখসহ একটি বা দুটি ক্যালেন্ডার ঝুলছে।রেলওয়ে স্টেশনের ভেতরে প্ল্যাটফর্মের অতি নিকটে একটি গাছ বা পাথরকে কেন্দ্র করে গজিয়ে উঠছে মন্দির। আফিমের নেশা কাটানোর বদলে আফিম যোগান দেওয়াতেই রাষ্ট্রের উৎসাহ। চলচ্চিত্র এবং মিডিয়াও নির্লজ্জভাবে এই কাজটি করে চলেছে।

ছায়াছবি বিপ্লব আনতে পারে না ঠিকই, কিন্তু মুক্তির ষাট বছর পরেও দেবীর প্রাসঙ্গিকতা এবং তাৎপর্য যে আরও গভীর– এটাও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। অথচ নব্বই মিনিটের প্রায় নিখুঁত এই ছবি, সত্যজিৎ রায়ের একটি আন্ডার-রেটেড চলচ্চিত্র। তার অন্যান্য চলচ্চিত্রের মতো দেবী নিয়ে খুব বেশি চর্চা হয় না।

শেষ করব দেবী সম্পর্কে উৎপল দত্তের বক্তব্য দিয়ে। বিদ্রোহী সত্যজিৎ নামের প্রবন্ধে তিনি বলছেন, ‘আমার হিসেবে দেবী একটি বৈপ্লবিক চলচ্চিত্র। আজ পর্যন্ত এ দেশে যত ছবি তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে প্রচণ্ড ,আপসহীন এবং সুদূরপ্রসারী। এখানে শিল্পী হেঁচকা টান মেরেছেন মনের সবচেয়ে গভীরে রোপিত ও রক্ষিত মূলটি ধরে– ধর্ম।’


তথ্যসুত্র
১. দিলীপ মুখোপাধ্যায়, ১৯৮৬,সত্যজিৎ ,বাণীশিল্প,কলকাতা
২. ঐ
৩. ঐ
৪. ইরাবান বসুরায়, ২০১৮, 'ধর্ম ও চলচ্চিত্র', সিনেমা ও কিছু অনান্দনিক ভাবনা, বৈভাষিক প্রকাশনী, হুগলী
Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here