সার্গেই পারাজানভ: কারান্তরীণ উন্মাদ ক্লান্ত চলচ্চিত্রকার

426
পারাজানভ

লিখেছেন । দৃষ্টি দিজা

কয়দিন আগেও গুরুত্ব ছিল না। চিনতাম না। দ্য কালার অব পোমাগ্রেনেটস দেখার সময় তো প্রথম ঘুমাই গেছি। এ রকম আমার হয়।

দ্য কালার অব পোমাগ্রেনেটসপারাজানভের কাজ হিসেবে প্রথম দেখা হইছিল। কী করে কোথা থেকে ডিরেক্টর পেয়ে বা মুভি পেয়ে ওয়াচ লেটারড করছিলাম, মনে নেই।

দ্যান দ্যান দ্যান, দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ মুভি– যথেষ্ট ইন্টারেস্টেড অ্যাবাউট সার্গেই পারানজভ এবং তার হেতু, বিলক্ষণ পরিমানে ঘাঁটাঘাঁটিও করে ফেলছি।

১৯৫৪ সালে সার্গেই আক্ষরিক অর্থেই সিনেমা নির্মাণ শুরু করলেও বলেন যে, ১৯৬৫-এর আগের নিজের সকল চলচ্চিত্রই গার্বেজ তৈরি হয়েছে।

যখন শ্যাডোজ অব আওয়ার ফরগোটেন অ্যানসেস্টরস সামনে আসে, একাধিক দেশে প্রথম মুক্তি পায়, তখন মুখামুখি দুই বিক্রিয়া চলছিল। তবে স্থিতি নয়। একাধিক দেশে মুক্তি পাওয়ায় একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলের আলাদা নজর পড়ে গেল, এবং সোভিয়েত প্রাগমাটিক অ্যাডমিনিস্ট্রেটেরও কু-নজরবন্দি হলেন পারাজানভ।

সার্গেই পারাজানভ

১৯৬৫-১৯৭৩, নির্দিষ্ট সাল পর্যন্ত তার সমস্ত প্রকল্প স্থানীয় [মানে, কিয়েভে ও ইয়েরেভানে] এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ বা বাতিল বা বন্ধ করে দেওয়া হলো।

এই হলো গিয়া শিল্পী হিসেবে, একটু পাগলা রকমের শিল্পী হিসেবে, পারাজানভের পর্যুদস্ত হওয়ার গোড়া। [কিন্তু এই পর্যুদস্ত অবস্থাকে কি আলটিমেটলি পর্যুদস্ত হওয়া বলে, পর্যুদস্ত হয়ে হয়ে সফল হইতে থাকা বলে, না খালি সফলতা বলে, ভাবার। যদ্যপি, ন্যায্য নাড়াচাড়া করতে সক্ষম শিল্পীর সঙ্গে এমন হবে না তো আর কার সঙ্গে!]

তারও আগে, ১৯৪৮ সালে প্রথম সমকামিতার অভিযোগ এনে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় পারাজানভকে। কিন্তু বিশেষ বিবেচনায় তিন মাসের দণ্ড ভোগের পরই তারে ছেড়ে দেওয়া হইছিল।

পাঁচ বছরের নিষিদ্ধকরণ বা ব্যানের মেয়াদ শেষ হইলে ১৯৭৩ সাল আসে। তখনো ‘সমকাম’ সোভিয়েতে নিষিদ্ধ ছিল। পারাজানভের ওপর নজরদারি বাড়তে থাকে। দ্বিতীয়বারের মতো সমকাম ও সমাজতন্ত্রী দলের এক কর্মীকে ধর্ষণের অভিযোগ এবং পর্নোসিনেমার সঙ্গে যুক্ত থাকার দাগে অভিযুক্ত করে পুনঃগ্রেফতার করান হয়।

১৯৮৩ সালে আবারও জালিয়াতি মামলা আর ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে গ্রেফতারির শিকার হন। এত এত গ্রেফতারির তথ্য খালি!

দ্য লিজেন্ড অব সুরাম ফরট্রেস

এই সমস্যায় গ্রেফতার করা-ছাড়া-করা-ছাড়া, এবং চলচ্চিত্রের মেকিংয়ে অমুক-তমুক পাবন্দী চলতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে আর পাঁচরকম স্বাভাবিক যাপন, উদযাপন, চলচ্চিত্র তৈরিও চলছিল।

শুভাকাঙ্ক্ষী ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ, যেমন, তারকোভস্কি, ফরাসি উপন্যাসিক ও কবি আঁরাগ, রুশ কবি এলসা ট্রিওলেট, বিখ্যাত অভিনেতা ডোডো আবাশিজে প্রমুখ শিল্পীরা পারাজানভরে ক্রমাগত কারান্তর জীবন থেকে মুক্ত করা, সিনেমা-মুক্তির পারমিশন গ্রহণ ইত্যাদিতে সহায়তা করে গেছেন।

এইটাও বলা হয়ে থাকত যে, হি ওয়াজ অ্যা পার্সোনা-নন-গ্রাটা অব সোভিয়েত ফিল্ম সোসাইটি। মানে, যেখানে থাকলাম পিনলাম, সেখানকার জীবজগতের বিরক্তিভাজন।

***

পারাজানভের পুরা নাম ছিল, সারকিস হোভসেপি পারাজানিয়ান্তাস। মা বাবা এবং পরিবারের বেষ্টনেই শুরু থেকে শিল্প-মহল শোভামান ছিল। তিবিলিসের আর্মেনিয় একটা পরিবার।

ছোটবেলা থেকে সার্গেই আর্ট গ্যালারিতে যাতায়াত করতেন। এমনিতে নিজে ফিল্ম নিয়ে পড়লেও [তৎকালীন নামী গেরাসিমভ চলচ্চিত্র পরিচালনা বিভাগ। মস্কো, ১৯৪৫], তিনি ভাবতেন যে, সিনেমা-তৈরি আসলে প্রতিষ্ঠানে গিয়া শিখে ফেলার বিষয় নয়; কোনো জন্মগতভাবে পেয়ে যাওয়া বা প্রাকৃতিক বিদ্যমান ব্যাপার। তোমার ‘করতেই হবে’, এরকম যখন বমিটিং আসবে, তখন করে দেবে।

১৯৫০-এ পারাজানভের, তার প্রথম স্ত্রী নিগিয়ার কেরিমোভার সুঙ্গে বিয়ে হয়। বিবাহবন্ধন এক বছর অব্যাহত থাকে। মহিলা, পারাজানভের স্ত্রী, ছিলেন তাতার মুসলিম। সার্গেইর সঙ্গে বিয়েকালীন সময়ে কেরিমোভা, ইস্ট অর্থোডক্সিয় খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। পরে, ধারণা করা হয়, তার আত্মীয়স্বজন, ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে তারে হত্যা করে।

স্ত্রী সভিতলানার সঙ্গে

দ্বিতীয় বিবাহ ১৯৫৬-তে। স্ত্রীর নাম সভিতলানা ইভানিভনা শেরবাতিউক। এই বিবাহোত্তর কেউ না মরলেও, টেকে প্রায় তিন বছর। পারাজানভ সম্পর্কে ইভানিভনার একটা ভালো ইন্টারভিউ-ডকুমেন্টারি এমনিতে সহজেই খুঁজলে পাওয়া যায়।

বেশ এঙ্গেইজিং। বিশেষত, আমি যেখানে খু্ঁজছিলামই!

ইভানিভনা কৈশোর থেকে থিয়েটার করতেন। তার যখন পনের বছর বয়স, ত্রিশ বয়সী পারাজানভের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। পারাজানভ বলেছিলেন নাকি, ‘তোমার বয়স কত?’

‘পনের’ শুনে বলেন, ‘হায়! আর আমি ত্রিশ!’


পারাজানভ
স্বভাবগতভাবে,
মেতে থাকা আর মাতাইয়া
রাখার মতো
পাবলিক

ইভানিভনার মতে, পারাজানভ স্বভাবগতভাবে, মেতে থাকা আর মাতাইয়া রাখার মতো পাবলিক। বাড়িতে সবসময়ই কোনো না কোনো এক-একাধিক পরিচিত-স্বল্পপরিচিত মানুষের উপস্থিতি লেগে থাকত।

মূলত, বসে পরিবার করায় মন-টন না থাকার কারণেই ইভানিভনা আর পারাজানভের বিচ্ছিন্নতা হইছিল। ১৯৫৮ সালে ‘সুরেন’ নামে তাদের এক পুত্র সন্তান জন্মায়।

পারাজানভ, সুরেনকে নিয়া বেশ ব্যাকুল থাকতেন। ইভানিভনাকে লেখা তার চিঠিতে, সুরেনকে নিয়ে পিতার টেনশন বেশ বোঝা যায়। এটা আমার ধারণা, বেকার বসে কোনো যুবক-শিল্পীর ‘হায়! কিছুই তো করতেছি না কর্তব্য’ যেমন চিন্তা, পারাজানভের চিন্তাও সুরেন নিয়ে তেমন।

দ্য কালার অব পোমাগ্রেনেটস

আমার আরেকটা ধারণা, পরের মুভিতে শিশু, শৈশব ব্যাপারগুলো বিশেষ প্রাধান্য পেয়ে সময় দখল করে রাখছে, একটা মুভি ডেডিকেটেডও ছিল সমগ্র শিশুকূলের নামে, তা সুরেনকে ভালোবাসার আর একইসঙ্গে দূরে থাকার প্রতিক্রিয়া স্বরূপই।

***

এগুলো যা বলা, সব এমনি জ্ঞাতব্য টুকটাক তথ্য। এই ইনফরমেশন অতিশয় বেহুদা, যদি কী কেন্দ্র করে, ‘ব্যক্তি’ কে, কী করেছে, কেমন করেছে, এসব, মানে, পারাজানভের ‘সিনেমা’/আর্ট প্রসঙ্গ সুন্দর করে না-ই বিস্তার করা হলো।

গ্রেট আর্ট-সিনেমাকে সহজ করে কম সময়ে বলার জন্য অনেকে বলে যে, পোয়েটিক সিনেমা।

এক সময়, মানে ১৯৬৫ পর থেকেই ধরা যায়, পারাজানভের সিনেমায় ফোক কিংবদন্তি চরিত্রগুলো বা লোক গল্পগুলো বা মহাকাব্যগুলো প্রভাব রাখা শুরু করে। ধর্মীয় রিচুয়াল, নবান্ন, বলি উৎযাপন, এসব। যেন একদল হিপনোটাইজড লোক পারাজানভের সুতার পুতলা। আদতে কী রকম? পুরা পৃথিবীর যত কর্মকাণ্ড, যত গল্প গোল, সব তা সময়ের প্রয়োজনেই ঘটে চলে না? সময় আমাদের হিপনোটাইজড করে রেখেই চালায় না?

মাখমালবাফ, বেলা তার কয়েকজন বলেছেন এরকম, পারাজানভ সিনেমায় গল্প বলার থেকে সেটাকে দেখার বস্তু করে তুলতে বেশি মনোযোগী।

বটে।

আমার লাগে, পারাজানভ তো গল্প বলেন, কিন্তু নিজের উন্মাদ মতো করে। নিজের মতো উন্মাদ করে বলিনি।

চরিত্রগুলো যেন, ভিনজগতের কোনো। একটু নাট ঢিল। তা তো ঠিকই। কার নয়? এক হলো, দুনিয়ার সবারই কারোর না কারোর কাছে নিজের নাট-ঢিল। আবার সবারই সিচুয়েশনের সামনে পড়ে সিচুয়েশনের কাছে নিজের নাট-ঢিল।

সিচুয়েশনে ব্যথা আছে, হাসি, মরা জন্ম, ক্ষুধা, হত্যা, নিষ্ঠুরতা আছে।

পারাজানভ এসবের সামনা-সামনি করেন। রাষ্ট্র কার্যের, সিস্টেমের মুখোমুখি করেন। ‘শিল্পী’ জীবন, এবাদর জীবন কবি গায়ক জীবনের মুখোমুখি করেন। ধর্ম ডগমা, সংবিধান ডগমার মুখোমুখি করেন।

এবং, আমার সহজতমভাবে প্রথম দর্শনে ডিরেক্টর, স্টোরি টেলার, কবি, অলওভার আর্টিস্টকুলের মধ্যে তারাই টানেন, যাদের দৃষ্টি বেশি। পারাজানভকে অবশ্যই তা-ই হতে হবে, প্রেমিকের প্রেম তো দেখাবেই, অন্যর প্রেম ছিনতাই করতে চাওয়া ছিনতাইকারীর প্রেম, বিট্রেকারীর কান্না, খুনীর দুঃখ, সব দেখাইতে হবে।

এবার যে বললাম, পারাজানভকে তার ফোক ট্রেডিশন, টেলস, রিচুয়াল, ধর্ম প্রভৃতি প্রভাবিত করেছে, যে ব্যক্তির তিনটা দেশ আছে, তার ইতিহাস, এপিক, শিল্প ইত্যাদির প্রভাবের পরিমাণও তুলনামূলক বেশি হবে!

পারাজনভ বলছিলেন, ‘সবাই জানে, আমার তিনটা মাতৃভূমি। আমি জন্মাইছি জর্জিয়ায় [তিবিলিসি], কাজ করছি ইউক্রেনে, এবং মরব আর্মেনিয়ায়।’

বৃহৎ ঐতিহ্য বৈচিত্র্য। আমার ধারণা, সে সঙ্গে ইরানও মিশেছে।

শ্যাডোজ অব আওয়ার ফরগোটেন অ্যানসেস্টরস

যখন শ্যাডোজ অব আওয়ার ফরগোটেন অ্যানসেস্টরস মুক্তির আন্তঃদেশীয় একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটছিল, বেশ একটা কঠিন পাবন্দীও লেগে যায় পারাজানভের সিনেমা মেকিংয়ে।

সায়াৎ নোভা তৈরির পর তা আবার নিষিদ্ধ হলে, এডিটিং করে আপত্তির জায়গা কেটে বাদ দিতে হয়। এবং নাম বদলে রাখেন, দ্য কালার অব পোমাগ্রেনেটস। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে একটু সদয় দৃষ্টি পাওয়ার কথা সোভিয়েতের এবার। বেশ ইন্টারন্যাশনালি মুক্তি দেওয়া হলো। কিন্তু আন্তঃ তেমন কোনো পুরষ্কারে মনোনীত করা হলো না।

পারাজানভের এ রকম বারবার বিপত্তিতে পড়ার মূল কারণই ধারণা করা হয়, সোভিয়েতের কাছে ওর কাজকে ইনফ্লামেটরি, জ্বলনও’লা হিসেবে পাওয়া।

পারাজানভ বলেন, তারকোভস্কির প্রথম সিনেমা, ইভান’স চাইল্ডহুড তাঁকে প্রথম, সিনেমায় নামতে মুগ্ধতা দেখায়।

পরে তারকোভস্কির সঙ্গে পারাজানভের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। তারা প্রতিনিয়ত একে অন্যের ওপর প্রভাব রেখেছিলেন।

পারাজানভের চার বছরের কারাদণ্ডে যাওয়ার তিনদিন আগেও তারকোভস্কি, ইউক্রেনের সমাজতান্ত্রিক দলের কাছে একটা চিঠি পাঠান:

‘…শৈল্পিক মানে গোটা দুনিয়ায় অল্প কিছু মানুষ পারাজানভের সমতুল্য। সে দোষী– সে নিজের একাকিত্বে দোষী। আমরা নিয়মিত তার কথা মনে না করার জন্য ও তার শৈল্পিক ক্ষমতার গুরুত্ব আবিষ্কার না করার জন্য দোষী।’

পারাজানভ

তবু জটিল একটা সাইবেরিয়ান স্বশ্রমে থাকতে হলো।

অল্পই সই, কিন্তু কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী শিল্পী চলচ্চিত্র-নির্মাতা ও কর্মী তখন পারাজানভের হয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। জ্যঁ-লুক গোদার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, লুইস বুনুয়েল, ফেল্লিনি, মিকেলাঞ্জেলো, তারকোভস্কি প্রমুখ।

কারাবাসে থাকার সময় পারাজানভ, তার গড়া পুতুলগুলো, ক্ষুদ্র মূর্তি, কোলাজগুলো বানাইতেন। সেগুলো এখন ইয়েরেভানের পারাজানভ জাদুঘরে প্রদর্শনীর জন্য সংরক্ষিত আছে।

কারারক্ষীরা উন্মাদ ভেবে হাসাহাসি করত। দরকার মতো উপকরণ সরবরাহ করত না। তারপর মস্কো থেকে একটা চিঠি পাঠান হয়, যে, ‘এই পরিচালক অনেক মেধাবী।’ ক্যাম্পরক্ষীরা পারাজানভের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়।

তার কোলাজগুলো অদ্ভুত। জটিলও বটে। ভিঞ্চির মোনালিসাকে কেটেকুটেই আছে অনেকগুলা কোলাজ। এক-একটার সামনে বসে বিস্তর বর্ণনা ভাবা যায়।

আছে আর্মেনিয়া ইউক্রেনের লোকজ নিদর্শনের ভিত্তিতে করা আর্ট। তার সিনেমায় যেমন পাওয়া যায়, কার্পেট, ঐতিহ্যবাহী কার্পেট-তৈরি দৃশ্যপট, এন্টিক, জাদুঘরেও এইসমস্ত সংরক্ষিত আছে। তারপর সিনেমার চরিত্রগুলো কেমন হবে, সে মাফিক করা পূর্বোক্ত পুত্তলিকা, পেইন্টিং। যেমন আশিক কেরিব সিনেমাটার প্রেমিকার ধনাঢ্য বাপ।

একটা সচল স্ক্রিনে, পোমাগ্রেনেটের লাল-রস চাকু ইত্যাদি সিনগুলা চলতে থাকে।

কতগুলো প্লাস্টিকের পুতুল আছে। নাঙ্গা, কারোর চোখ নাই, কারোর খালি মাথা, এ রকম। আছে একটা আলমারি, প্যারাজনভের ব্যবহৃত জিনিসপাতি।

আন্দ্রেই তারকোভস্কির নামে আর শিশুদের নামে জাদুঘরের দুইটা পরশন করা।
পারাজনভের মতে, নতুন শিশুদের আকাশ দেখার সময়, নেচার দেখার সময়। তারা আমার জাদুঘরে আসবে। দেখে যাবে। আমি দক্ষ পেইন্টার নই। দক্ষরা আমায় নিয়ে হাসাহাসি কইরেন না। আমি ডিরেক্টর। এইসব আমার কাজেরই অংশ। ডিরেকশনের প্রয়োজনেই আমাকে এসব করতে হয়েছে।

তারকোভস্কির সঙ্গে

একের পর এক প্রায় দুই দশকের ধকলে পারাজানভের শরীর দুর্বল হতে থাকে। সব শেষ কাজ, নিজের বায়োগ্রাফিকাল সিনেমা কনফেশন শুরু করতে না করতেই তার ক্যানসার আক্রান্ত শরীর দুর্বলতর হয়ে পড়ে। শ্বাসকষ্টের কারণে হাসপাতাল ভর্তি করা হয়।

মস্কোতে এবং প্যারিসে রে ট্রিটমেন্ট, অপারেশন ইত্যাদির পরও তারে বাঁচান যায়নি।
১৯৯০ সালে পারাজানভ মরে যান।

মূলত বর্তমান সময়েই পারাজানভের ওপর পাশ্চাত্যসহ গোটা আন্তর্জাতিক বোদ্ধাদের একটা পোক্ত দৃষ্টি পড়েছে। সিনেমার সঙ্গে আছে তার করা ভালো ভালো ডকুমেন্টারিগুলো। কিছু কিছু, রাষ্ট্রীয় কারণে ডেস্ট্রয়েড। কিছু জীবিত।

২০১০ সালে পারাজানভ-ভার্তানভ যৌথ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়, যাতে করে তাদের নিয়া চর্চা বজায় থাকে।

***

যখন সার্গেই পারাজানভের সিনেমা দেখি, ব্যক্তি সার্গেইকে এত চিনি না। লিখব কী করে?
ঘাঁটাঘাঁটির পরও মনে হয়, কমই জানলাম। কী লিখব, সার্গেইকে তো চিনি না!

আমি তো সে নই!

পারাজানভ মিউজিয়াম নিয়ে সার্গেইয়ের একটা স্পিচ আছে। ইংরেজিতে সম্ভবত ট্রান্সলেটেড। খুঁজে বের করেছি। নিচে তা [বাংলায় অনুবাদ করে] সংযুক্ত করতে মন চাইল:

বায়োগ্রাফি… নিজের বায়োগ্রাফির কথা মনে করতে পারি না। আমার বায়োগ্রাফি কী?

দর্দ [দুঃখ]-এই এর শাশ্বত গড়ন।

এখন, আমার তৃতীয় গ্রেফতারির পর মনে হয় এক রকম নতুন সারাংশ উপলব্ধি করতে পারি– ঘুইরা দাঁড়ালে, মূলত দেখি, আমি বৃদ্ধ। ৬৩-তে এসে আজ এইরূপই অনুভূত হয়। আমার এক শিক্ষক ৪৩-এ মৃত্যুবরণ করছেন। আমার আরেক শিক্ষক, সভচেনকো, সোভিয়েত চলচ্চিত্রাঙ্গনের এক গ্রেট মাস্টার, তিনিও ৪৩ বছর বয়সে মারা যান। আমাদের, স্টুডেন্টদের কাছে তিনি তখন বৃদ্ধই ছিলেন। আমরা, আমার বন্ধুরা, অ্যালভ, নাওমভ, খুতযিয়েভ, মিরোনার, বেরেযিনিখ, আমরা সবাই তখন কেবল বিশে।

ইউক্রেন আমার উপরে একাধিকবার অনুরোধের গোলা দাগছে, দ্য টেল অব ইগর’স ক্যাম্পিং শুট করার জন্য। আমার জন্য এটা সত্যকার বৃহৎ পাওনা।

আমি এই বিষয়ে এর আগে দীর্ঘদিন ধরেই চিন্তা করছিলাম। স্বপ্ন দেখছিলাম, আমি আর গারাসিমভ [চলচ্চিত্রকার], দুইজনে মিলে একটা সিনেমা শুট করব। সে ‘রিয়েলিজম’ শুট করে, আর আমি ‘সুররিয়ালিজম’। আমাদের দুইজনের হাতে দুইটা আলাদা আলাদা পুর ভরা বাকরখানি।

আমার যবে থেকেই রিটায়ারমেন্টের বয়স আসছে, তত আমার জন্মভূমিটার প্রতি আরও কোমল মায়াটান অনুভব করে যাচ্ছি; যেখানে আমি জীবনেও একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য অবস্থান করি নাই!

আর্মেনিয়া, আমার ইতিহাস, আমার শিল্প। আমার বন্ধু, আমার আনন্দ, আমাদের সৃজনশীল লোকসান।

দেখ, আমি আদতে পেশাদার নই, এবং এ নিয়া কখনো উচ্চাভিলাষীও ছিলাম না। আমার প্রদর্শনী গ্যালারিটা আমার মূল ঝোঁক নয়; এটা আমার নিজের পেশারই একটা দরকারি অংশ মাত্র। আমি একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। আমি আমার জীবনে সভচেনকো, দভচেঙ্কোর মতো শিক্ষকদের থেকে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাইছি। তারা দুইজনেই আঁকতেন। আইজেনস্টাইনও [রাশিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক] আঁকতেন।

দ্য কালার অব পোমাগ্রেনেটস

সুতরাং আমিও নিজের থেকে নিজে বাধ্যতামূলক আঁকতে শুরু করি। কোলাজ বানানো, ফেব্রিক জমিন জিনিসপত্র জোড়া লাগান, প্লাস্টিক-শিল্প খুঁজতে থাকা, ইত্যাদি।

আমি চাই বাচ্চাকাচ্চারা আমার এক্সিবিশনে আসুক। কারণ এখনই তালাশির সময়। এখনই সুন্দরকে খোঁজার সময়; দেখা, কী কী আজব সুন্দর, আমাদের পাহাড়-আকাশ, আমাদের চারপাশে ছিটিয়ে আছে।

আমাদের নিজের পছন্দ আসক্তি খুঁজে বের করার ক্ষমতা থাকতে হবে। দেখার, ভালোবাসার, আনত থাকার ক্ষমতা থাকতে হবে।

সেজন্যই ছোটদের জন্য আলাদা রুম বানাইছি আমি। যেখানে আছে, পাপেট আর প্লাস্টিক পুতুল, আছে যুদ্ধের শোক। নিষ্ঠুর খেয়ালখুশি মতো রেখেছি, কারমেন এবং জোস’কে [কারমেন নভেলার দুই চরিত্র]। এমনকি রেখেছি, ‘টার্ক’, যে, ‘ক্যর্’-এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তাদের। এই সবকিছু শিশুকিশোরদের উপলব্ধির জন্য।

আমার সুটকেস হইছিল বৃহৎ ঐরাবত, আর ঐরাবত হইছিল সুটকেস। যেন, এই ছোট পৃথিবীটা আর্মেনিয়ার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যারা বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে, তাদের সামনে মুখরোচক রূপে দৃশ্যমান হয়।

কারণ আর্মেনিয়াকে, কালচারকে আরও সুন্দর রূপে প্রত্যর্পণ করা দরকার। করা দরকার, ভবিষ্যৎ ভোক্তাদের চাহিদার সঙ্গে ভারসাম্য তৈরি করার জন্য। করা দরকার, দেশজ লোকাল সাধারণ রুচির সঙ্গে সমকক্ষ রূপে গড়ে তোলবার জন্য।

আরেকটা রুম আছে, ‘অ্যা রুম ইন দ্য মেমোরি অব তারকোভস্কি’। আমি তার উদ্দেশ্যে দুইটা পুত্তলি, নাম, ‘পিয়েতা’ [Pieta, মাদার মেরির ক্রোড়ে মৃত যিশু] রাখছি। এবং বিশেষত একটা কোলাজ, যা, ‘দ্য নাইটবার্ড’-এর স্মৃতিতে তৈরি, তা-ও রাখছি।

‘রুম অব রেডিয়েন্স’-এ আছে অপশক্তি– আছে কুসুমস্তবক– উৎসর্গ– আছে জীবনের প্রশংসা।

আরেকটা রুম আছে, ‘রুম অব ফেইথ’। ফেইথ, ভাগ্য। আমার ভাগ্য, আমার বন্ধুদের ভাগ্য, আমার প্রতি আমার বন্ধুদের আচরণ, ইত্যাদি।

কোলাজ, পারাজানভ

এখানে আমি তুলে ধরেছি, আর্মেনিয়ান আর জর্জিয়ান শিল্পীদের কাজের মধ্যকার হারমনিকাল সেতুবন্ধন।

আর সেল্ফ-পোর্ট্রেট।

আমি দেখিয়েছি আমার মাকে। মায়ের প্রতি সশ্রদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিকে। আমার মা– এক আর্মেনিয়ান, যে তার গোটা জীবন তার সন্তানদের পালন করতে করতে কাটিয়ে দিছে। যে, কখনো আর্মেনিয়ায় থাকতেই পারেনি। এর জন্য সে কখনো সময়ই করে উঠতে পারেনি। সে হয় তার বর’কে হাজত থেকে ছাড়াইতে দৌড়াইত, নইলে সন্তানদের লালন-পালনে কাটাইত।

এখানে আরও আছে, দভচেঙ্কোর সাইন করা আমার ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট, আমার স্কুলত্যাগের সার্টিফিকেট, আমার পিতামহের বিক্রি করা ওয়াইন আছে, আমার কাকা আছে। আছে ‘আমরা’, আমাদের ইনস্টিটিউট। মেলিক-এভাকাইয়ান, খুতযিয়েভ, আর আমি, তিন আর্মেনিয়ান, যারা একসঙ্গে মস্কোর সিনেমা ইনস্টিটিউটে পা রেখেছিলাম। যা কিছু এখনো আমাকে চনমনে করে রাখে।

‘দ্য রুম অব গ্রাফিক-আর্ট’– যার পুরাটা আমি বাকু [আজারবাইজানের রাজধানী] প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে স্থাপন করেছি– ‘দ্য এলিজি ওয়াল’, পুষ্পস্তবক এবং সেখানের পেইন্টিং সব আমার আদরের ভাইয়ের জন্য। যে, যুদ্ধে তো গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি।

আবার বলছি, আমি পেশাদার নই, সমালোচকরা তা বিবেচনা-মার্জনা করে দেখবেন। আমি একজন শিল্পপ্রেমি এবং চলচ্চিত্র পরিচালক।

এবং তোমরা এখন সেখানেই দাঁড়িয়ে, যেখানে আমার চলচ্চিত্রের চলার পথের সকল গতি দৃশ্যমান– যেখান থেকে আমি আমার প্রাপ্ত সব অর্জন করেছি।

আমি ষাটটা সোনার মেডেল পেয়েছি। কেন? আমার উপাদেয় রুচির কারণে, নন্দনকান্তিরে ফুটাইয়া তোলবার দক্ষতার কারণে।


আমি
সবসময়
খুঁজেছি, প্রকৃতিতে
কী ঘুমাইয়া
আছে

কোনো মিরাকলের প্রকট হয় নাই। আমি সবসময় খুঁজেছি, প্রকৃতিতে কী ঘুমাইয়া আছে। এ ব্যাপার, আমাকে সাহায্য করেছে, ধারণ করতে, দৃঢ় করতে, আমার শিল্প। সাহায্য করেছে, আনত হতে।

প্রদর্শনীটা মূলত আমার কাছে এক উদযাপন।

আমার জন্য, আমার জীবনে সদাসর্বদাই জাতিয় লোকজ চরিত্ররা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্যই সবসময় আমি ফোক-আর্ট গ্যালারি বেছে নিতাম। আমি সেজন্যই সরে দাঁড়াই। ক্রিটিকদের, আমাকে পেশাদার শিল্পী ভাবতে বারণ করি। আমি একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, এবং আমি আমার পেশা নিয়া গর্ববোধ করি।

পারাজানভ

এবং আমি নিজেরে অমর করে তুলতে কখনো আমার নিজের সিনেমায় ঢুকে পড়বার কথা চিন্তা করিনি।

সবাই জানে, আমার তিনখানা মাতৃভূমি। আমি জন্মেছি জর্জিয়ায়, কাজ করেছি ইউক্রেনে, এবং মৃত্যুবরণ করব আর্মেনিয়ায়।

–১৯৮৮
ইয়েরেভেন, আর্মেনিয়া।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here