হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন [১]

500
হিচকক

অনুবাদ । রুদ্র আরিফ

অনুবাদকের নোট:
১৯৬২ সালের আগস্টের ঘটনা। হলিউডের বিখ্যাত ইউনিভার্সেল স্টুডিওর একটি কক্ষে, নিজেদের এক সপ্তাহ স্বেচ্ছাবন্দি রেখে, সিনেমা সংক্রান্ত নানা আলাপে মগ্ন হয়েছিলেন সিনেমার ইতিহাসের দুই স্বতন্ত্র মাস্টার ফিল্মমেকার। সে আলাপে মূলত ‘মাস্টার অব সাসপেন্স’খ্যাত আলফ্রেড হিচকক [যুক্তরাজ্য, ১৩ আগস্ট ১৮৯৯–২৯ এপ্রিল ১৯৮০] ছিলেন কথক, আর ‘ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ’ ফিল্ম মুভমেন্টের অন্যতম প্রবর্তক ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো [ফ্রান্স, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২–২১ অক্টোবর ১৯৮৪] ছিলেন শ্রোতার ভূমিকায়। দীর্ঘ সেই আলাপচারিতার শ্রুতিলিখন, হিচকক/ত্রুফো শিরোনামে, মহাগুরুত্বপূর্ণ এক টেক্সটবুকের মর্যাদা পাচ্ছে জগতের সেরা ফিল্মস্কুলগুলোতে। সে গ্রন্থের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন নামে ছাপা হয়েছে ঢাকা ও কলকাতা থেকে। সেই গ্রন্থ থেকেই প্রথম অধ্যায়ের প্রথমাংশ হাজির হলো এখানে…


আলফ্রেড হিচকক
আলফ্রেড হিচকক, শৈশবে

ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো :: মিস্টার হিচকক, আপনি তো ১৮৯৯ সালের ১৩ আগস্ট লন্ডনে জন্মেছেন। আপনার শৈশবের একটি মাত্র ঘটনার কথাই আমি শুনেছি– পুলিশ স্টেশনের ঘটনা। ঘটনাটি সত্য নাকি?

আলফ্রেড হিচকক :: হ্যাঁ, সত্য। আমার বয়স তখন চার কি পাঁচ বছর হবে। একটি চিরকুট লিখে দিয়ে, আমাকে পুলিশ স্টেশনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। পুলিশপ্রধান চিরকুটটি পড়লেন, আর আমাকে পাঁচ-দশ মিনিটের মতো আটকে রাখলেন এক গরাদে। বললেন, ‘দুষ্টু ছেলেদের সঙ্গে আমরা এমনটাই করি।’

ত্রুফো :: আপনার অপরাধ কী ছিল?

হিচকক :: এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই। এ কারণেই বাবা প্রায়শই আমাকে তার ‘নিষ্কলঙ্ক পুঁচকে শাবক’ বলে ডাকতেন। আমি ঠিক কী যে করেছিলাম, সত্যিকার অর্থেই মনে করতে পারি না।

ত্রুফো :: শুনেছি, আপনার বাবা খুব কড়া ছিলেন?


আমি ছিলাম–
যাকে বলে একজন
ভদ্র-শিষ্ট বাচ্চা। পারিবারিক
আচার-অনুষ্ঠানে কোনো একটা
কোণায় শান্তভাবে নিশ্চুপ বসে থাকতাম

হিচকক :: তাকে বরং একটা নার্ভাস লোক বলাই ভালো। এ ছাড়া আর কী-ই-বা বলতে পারি? দেখুন, আমাদের পরিবারে ছিল থিয়েটারপ্রীতি। এ বিষয়টির দিকে এখন ফিরে তাকালে মনে হয়, আমরা বোধহয় ছিলাম একটি খামখেয়ালি দল। যে কোনো বিবেচনাতেই, আমি ছিলাম– যাকে বলে একজন ভদ্র-শিষ্ট বাচ্চা। পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠানে কোনো একটা কোণায় শান্তভাবে নিশ্চুপ বসে থাকতাম। আমার দেখার ও পর্যবেক্ষণের চোখ ছিল ভালো। মানুষ হিসেবে আমি বরাবরই এ রকম ছিলাম, এবং এখনো। আছি যে কোনো প্রশ্নেই আমি অকপট। আমি ছিলাম নিঃসঙ্গ; ফলে আমার কোনো খেলার সাথী কখনোই আদৌ ছিল বলে মনে পড়ে না। একা একা খেলতাম, আর নিজে নিজে খেলা বানাতাম।

খুব অল্প বয়সেই আমাকে স্কুলে দেওয়া হয়েছিল। লন্ডনের জেস্যু [পুরুষদের অংশগ্রহণে প্রতিষ্ঠিত ক্যাথলিক গির্জার সোসাইটি অব জিসাস নামের ধর্মসভার সদস্য] স্কুল– সেন্ট ইগনাসিয়াস কলেজে। আমরা ছিলাম ক্যাথলিক পরিবারের মানুষ; ইংল্যান্ডে, আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, এটি স্বয়ং একটি খামখেয়ালি বিষয়। তখনকার দিনে, জেস্যুদের মধ্যে আতঙ্কের এক শক্তিধর বোধ গড়ে উঠেছিল : নীতি-নৈতিকতার আতঙ্ক– খারাপ কোনোকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার আতঙ্ক। এ বিষয়টি আমি বরাবরই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। কেন? হয়তো শারীরিক আতঙ্কে। শারীরিক শাস্তি ভীষণ ভয় পেতাম আমি। তখনকার দিনে খুব শক্ত রবারে তৈরি চাবুক তারা ব্যবহার করতেন।

আমার ধারণা, জেস্যুরা এখনো এটি ব্যবহার করেন। বুঝতেই পারছেন, এটি দৈবক্রমে ব্যবহার করা হতো না; বরং এ ছিল যেন মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির মতো। সব ক্লাস শেষ হয়ে গেলে জানানো হতো, ফাদারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। তারপর তিনি [ফাদার] ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে আপনার নাম, অপরাধের শাস্তির ধরন রেজিস্টারে টুকে নিতেন, আর সেই শাস্তি ভোগ করার জন্য সারাটাদিন আপনাকে অপেক্ষা করতে হতো।

ত্রুফো :: পত্রিকায় পড়েছি, আপনি নাকি ছাত্র হিসেবে মাঝারি মানের ছিলেন, আর ভূগোল ছিল আপনার সবচেয়ে শক্তিশালী পয়েন্ট।

হিচকক :: ক্লাসের সেরা ছাত্রদের মধ্যে আমি সাধারণত চার-পাঁচ নম্বরেই থাকতাম। কখনোই প্রথম হইনি; দ্বিতীয় হয়েছি মাত্র দুয়েকবার; তবে সাধারণত হতাম চার নয়তো পাঁচ। তাদের [শিক্ষকদের] ধারণা, আমি নাকি অন্যমনস্ক থাকতাম।

হিচকক, তারুণ্যে

ত্রুফো :: সে সময়ে, আপনার জীবনে লক্ষ্য কি ইঞ্জিনিয়ার হওয়া ছিল না?

হিচকক :: দেখুন, বাচ্চাদের কাছে সবসময়ই জানতে চাওয়া হয়, ‘বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?’ তবে নিজের বেলায় নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমি কখনোই পুলিশ হতে চাইতাম না। যখন বললাম, ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই– বাবা-মা আমার দিকে সিরিয়াস চোখ-মুখ করে তাকালেন, আর আমাকে পাঠিয়ে দিলেন একটি বিশেষায়িত স্কুলে– দ্য স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড নেভিগেশন। সেখানে মেকানিকস, ইলেকট্রিসিটি, অ্যাকাস্টিকস ও নেভিগেশনের ওপর পড়াশোনা করেছি আমি।

ত্রুফো :: তার মানে, বিজ্ঞানবিষয়ক পড়াশোনা ছিল আপনার?

হিচকক :: সম্ভবত। ইঞ্জিনিয়ারিং, বল ও গতিসূত্রের তত্ত্ব, ইলেকট্রিসিটি সম্পর্কে কিছু ব্যবহারিক জ্ঞান আমি অর্জন করেছিলাম– তত্ত্বগত ও প্রয়োগিক জ্ঞান। এরপর আমাকে যেহেতু পেট চালাতে হবে, হেনলি টেলিগ্রাফ কোম্পানিতে চাকরি নিলাম। তখন আমি এর পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে পড়াশোনা করছিলাম, আর্টে। হেনলিতে ছিলাম ইলেকট্রিক ক্যাবলের বিশেষজ্ঞ। ১৯ বছর বয়সেই একজন টেকনিক্যাল এস্টিমেটর হয়ে উঠি আমি।

ত্রুফো :: এ সময়েই কি সিনেমার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠলেন?

হিচকক :: হ্যাঁ, বেশ কয়েক বছর ধরেই আগ্রহ ছিল। সিনেমা ও থিয়েটারের প্রতি আমার ছিল প্রবল কৌতূহল। প্রায়শই আমি রাতের প্রথম শো দেখতে যেতাম। ১৬ বছর বয়স থেকে জার্নাল পড়ার অভ্যাস হয় আমার। কোনো ফ্যান বা ফান ম্যাগাজিন নয়, বরং সবসময় প্রফেশনাল ও ট্রেড পেপারগুলোই পড়তাম। আর, যেহেতু আমি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে আর্টে পড়ছিলাম, হেনলি কোম্পানি আমাকে অ্যাডভারটাইজিং ডিপার্টমেন্টে বদলি করে দিলো। সেখানে ড্রয়িং করার একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম আমি।

ত্রুফো :: কী ধরনের ড্রয়িং ছিল সেগুলো?

হিচকক :: ইলেকট্রিক ক্যাবলের বিজ্ঞাপনের ডিজাইন। এ কাজটিই ছিল সিনেমার প্রতি আমার প্রথম পদক্ষেপ। সেই [সিনেমার] ময়দানে আমাকে ঢুকে পড়তে সাহায্য করেছিল এটি।

ত্রুফো :: সে সময়ে যে সিনেমাগুলো আপনার মনে বিশেষভাবে আবেদন জাগাতে পেরেছিল, কয়েকটির নাম মনে আছে কি?


ব্রিটিশ
ফিল্মের তুলনায়
আমেরিকান ফিল্মই
আমাকে বেশি আকৃষ্ট করত

হিচকক :: থিয়েটারে যদিও আমার নিয়মিতই যাওয়া-আসা ছিল, তবে সিনেমা দেখতেই ভালোলাগত বেশি; আর ব্রিটিশ ফিল্মের তুলনায় আমেরিকান ফিল্মই আমাকে বেশি আকৃষ্ট করত। চ্যাপলিন, গ্রিফিথ, প্যারামাউন্ট ফেমাস প্লেয়ারস-এর সব সিনেমা, বাস্টার কিটন, ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস, ম্যারি পিকফোর্ডের সিনেমাগুলোর পাশাপাশি ডেকলা-বায়োস্কোপ নামের সেই কোম্পানিটির জার্মান সিনেমাগুলোও আমি দেখেছি– যেটির নাম ছিল তখন ইউএফএ। মুরনৌ তাদের হয়ে কাজ করেছেন।

ত্রুফো :: আপনার মনে বিশেষ দাগ কেটে গিয়েছিল, এমন একটি সিনেমার নাম বলতে পারবেন?

ডেসটিনি
ফিল্মমেকার । ফ্রিৎস্ লাং

হিচকক :: ডেকলা-বায়োস্কোপ কোম্পানির সবচেয়ে বিখ্যাত সিনেমাগুলোর একটি ছিল ডের মুডে টড [Der mude Tod; ১৯২১]।

ত্রুফো :: এটা কি ফ্রিৎস্ লাংয়ের বানানো না? ফিল্মটির ব্রিটিশ শিরোনাম, আমার ধারণা, ডেসটিনি

হিচকক :: আমারও তা-ই মনে হয়। কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনেতা ছিলেন, যদ্দূর মনে পড়ে, বের্নহার্ড গেৎস্কে।

ত্রুফো :: মুরনৌর ফিল্ম ভালোলাগত আপনার?

হিচকক :: হ্যাঁ, তবে সেগুলো পরে এসেছে। ১৯২৩-২৪ সালের দিকে।

ত্রুফো :: ১৯২০ সালে কোন ফিল্মগুলো দেখানো হতো?

হিচকক :: মসিঁয়ে প্রিন্স নামের একজনের [ফিল্মগুলোর] কথা মনে পড়ছে। ইংল্যান্ডে তাকে আমরা হুইফেলস নামে ডাকতাম।

ত্রুফো :: আপনি প্রায়ই বলে থাকেন, ‘বাকি সব ফিল্মমেকারের মতো আমাকেও প্রভাবিত করেছিলেন গ্রিফিথ’।

হিচকক :: ইনটলারেন্স [১৯১৬] ও দ্য বার্থ অব অ্যা ন্যাশন-এর [১৯১৫] কথা আমি বিশেষভাবে স্মরণ করি।

ত্রুফো :: হেনলির চাকরি ছেড়ে একটি ফিল্ম কোম্পানিতে আপনার যোগ দেওয়ার ব্যাপারটি কীভাবে ঘটল?

হিচকক :: একটি ট্রেড পত্রিকায় আমি পড়েছিলাম, প্যারামাউন্ট’স ফেমাস প্লেয়ারস লাস্কি নামের এক আমেরিকান কোম্পানি লন্ডনের ইজলিংটনে শাখা খুলবে। তারা এখানে স্টুডি নির্মাণ করতে যাচ্ছে, এবং একটি প্রোডাকশন সিডিউলের ঘোষণা দিয়েছে। অন্য অনেককিছুর সঙ্গে বিশেষ এক বইয়েরও একটি ছবি ছিল সেই সিডিউলে। বইটির নাম আমার মনে নেই। হেনলিতে চাকরি করার সময়েই বইটি অবশ্য আমার পড়া হয়ে গিয়েছিল। এরপর সেটি নিয়ে কিছু ড্রয়িং করলাম– যা কি না নানা টাইটেলের ইলাস্ট্রেশন হিসেবে পরে কাজে দিলো।

ত্রুফো :: টাইটেল বলতে আপনি ক্যাপশনের কথাই বলছেন তো– যা নির্বাক সিনেমাগুলোতে সংলাপের অভাব পূরণ করত?

হিচকক :: ঠিক ধরেছেন। তখনকার দিনে এই টাইটেলগুলো ইলাস্ট্রেশন করা হতো। একেকটি কার্ডের মধ্যে ন্যারেটিভ টাইটেল, সংলাপ, আর থাকত একটি ছোট্ট ড্রয়িং। সেইসব ন্যারেটিভ টাইটেলের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল– কেম অ্যাট ডন। আরও ছিল, দ্য নেক্সট মর্নিং…। যেমন ধরুন, যদি কোনো লাইনে লেখা থাকে : ‘জর্জ এখন খুবই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে’, তাহলে বাক্যটির একেবারেই নিচে আপনাকে শিখা সহকারে একটি মোমবাতির ড্রয়িং করে দিতে হবে। একেবারেই অতি সরলভাবে।

ত্রুফো :: তার মানে, আপনি এসব উদ্যোগ নিলেন, তারপর নিজের কাজ ফেমাস প্লেয়ারসের কাছে জমা দিলেন?

হিচকক :: ঠিক তাই। তাদেরকে আমি আমার ড্রয়িংগুলো দেখালাম, এবং সঙ্গে-সঙ্গেই তারা আমাকে চাকরি দিয়ে দিলেন। পরে আমি টাইটেল ডিপার্টমেন্টের প্রধানও হয়েছিলাম। আমি গিয়েছিলাম স্টুডিওটির এডিটোরিয়াল ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে। সেই ডিপার্টমেন্টের প্রধানের অধীনে দুজন আমেরিকান লেখক চাকরি করতেন; যখন কোনো সিনেমার কাজ শেষ হতো, এডিটোরিয়াল ডিপার্টমেন্টের প্রধান সেটির টাইটেল লিখতেন অথবা অরিজিনাল স্ক্রিপ্টটির এসব [টাইটেল] রি-রাইট করতেন। কেননা, তখনকার দিনে ন্যারেটিভ টাইটেল ও স্পোকেন টাইটেলের মাধ্যমে কোনো স্ক্রিপ্টের মর্মার্থ সম্পূর্ণভাবে উল্টে দেওয়া সম্ভব ছিল।

ত্রুফো :: কীভাবে?

হিচকক :: দেখুন, যখন অভিনেতাটি কথা বলার ভঙ্গি করতেন, এবং তার পরপরই পর্দায় সংলাপটি ভেসে ওঠত, ফলে তার মুখে নিজেদের পছন্দসই কথা পুরে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল তাদের। এভাবে কত বাজে সিনেমাকে যে বাঁচানো গেছে! যেমন ধরুন, যদি কোনো ড্রামার শুটিং খুবই বাজে ও হাস্যকর হতো, আর তারা যদি সেগুলোর মধ্যে কমেডি টাইটেলস ঢুকিয়ে দিতেন, তাহলে সিনেমাটি চরম ব্যবসা-সফল হয়ে যেত। কেননা, সেটি তো তখন স্যাটেয়ার ফিল্ম হয়ে ওঠত। যে কারও পক্ষে সত্যিকারঅর্থেই যা খুশি করা সম্ভব ছিল– কোনো সিনেমার প্রথম দৃশ্যটিকে তুলে নিয়ে শেষ দৃশ্য হিসেবে জুড়ে দেওয়া– একদমই যা খুশি তাই!

ত্রুফো :: এ বিষয়টি আপনাকে ফিল্মমেকিংয়ের ভেতরটা দেখার সুযোগ করে দিলো?


কখনো
যদি এমন
কোনো এক্সট্রা
দৃশ্যের প্রয়োজন
পড়ত– যেগুলো অ্যাকটিং
দৃশ্য নয়, তারা [স্টুডিও কর্তৃপক্ষ]
আমাকে সেটির শুটিং করতে দিতেন

হিচকক :: হ্যাঁ। এ সময়ে আমি বেশ কয়েকজন আমেরিকান লেখকের সঙ্গে দেখা করেছিলাম; স্ক্রিপ্ট কীভাবে লিখতে হয়– তাদের কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলাম। কখনো যদি এমন কোনো এক্সট্রা দৃশ্যের প্রয়োজন পড়ত– যেগুলো অ্যাকটিং দৃশ্য নয়, তারা [স্টুডিও কর্তৃপক্ষ] আমাকে সেটির শুটিং করতে দিতেন। অবশ্য ইংল্যান্ডে যে সিনেমাগুলো ফেমাস প্লেয়ারস কোম্পানি বানিয়েছিল, সেগুলো আমেরিকায় সাফল্য পায়নি। ফলে এটি ব্রিটিশ প্রডিউসারদের কাছে ভাড়া খাটানো একটি স্টুডিওতে পরিণত হয়েছিল।

এরইমধ্যে, এক ম্যাগাজিনে আমি একটি উপন্যাস পড়লাম। স্রেফ অনুশীলন হিসেবে, সেই কাহিনিটি অবলম্বনে একটি স্ক্রিপ্ট লিখে ফেললাম। আমি জানতাম, বিশ্বব্যাপি একচেটিয়া কপিরাইট ছিল আমেরিকান কোম্পানির, তবু আমি সেটি লিখলাম– স্রেফ অনুশীলনের জন্যই।

ইজলিংটন স্টুডিওটির দায়িত্ব যখন ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো নিয়ে নিলো, তাদের কাছে চাকরির ধর্ণা দিলাম; এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ পেয়ে গেলাম।

ত্রুফো :: মাইকেল ব্যালকনের অধীনে?

অলওয়েজ টেল ইওর ওয়াইফ-এর শুটিংয়ে হিচকক

হিচকক :: না, তখনো না। তার আগে অলওয়েজ টেল ইওর ওয়াইফ সিনেমায় কাজ করেছি আমি, সেটিতে লন্ডনের খুবই বিখ্যাত অভিনেতা সিম্যুর হিকস অভিনয় করেছিলেন। একদিন ডিরেক্টরের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধালেন তিনি, আর আমাকে বললেন, ‘চলো, ফিল্মটির কাজ তুমি আর আমি মিলেই শেষ করে ফেলি।’ ফলে তাকে আমি সহযোগিতা করলাম; আর এভাবেই ফিল্মটি সম্পন্ন করেছিলাম আমরা।

ইতোমধ্যেই স্টুডিওটি ভাড়া নিয়েছিল মাইকেল ব্যালকন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি, এবং নতুন এই উদ্যোগটিতে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত হলাম আমি। কোম্পানিটি ব্যালকন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভিক্টর স্যাভিল ও জন ফ্রিডম্যানের সঙ্গে যৌথভাবে। তারা একটি মঞ্চনাটকের কপিরাইট কিনেছিলেন। সেটির নাম ছিল, ওম্যান টু ওম্যান। এরপর তারা বললেন, ‘এখন আমাদের একটি স্ক্রিপ্ট দরকার’; জবাবে বললাম, ‘আমি লিখতে চাই।’

‘তুমি? তোমার কোনো কাজ আছে এমন?’

বললাম, ‘একটি জিনিস আপনাদের আমি দেখাতে পারি।’

অনুশীলন হিসেবে যে স্ক্রিপ্টটি লিখেছিলাম, সেটি দেখালাম। তারা খুব খুশি হয়ে গেলেন। কাজটি পেয়ে গেলাম আমি। এটি ১৯২২ সালের ঘটনা।

ত্রুফো :: আচ্ছা! আপনার বয়স তখন ২৩ বছর। সে সময়ে নাম্বার থার্টিন নামে একটি ছোট্ট সিনেমা আপনি নির্মাণ করেছিলেন, তাই না?

হিচকক :: দুই রিলের সিনেমা। সেটি কখনোই সম্পন্ন হয়নি।

ত্রুফো :: ডকুমেন্টারি ছিল, তাই না?

হিচকক :: না। চ্যাপলিনের সঙ্গে কাজ করেছেন– এমন এক নারী তখন স্টুডিওটিতে চাকরি করতেন। তখনকার দিনে, যারা চ্যাপলিনের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাদের অবস্থান ছিল বেশ উঁচুতে: এই নারীটি একটি গল্প লিখেছিলেন, আর আমরা যোগাড় করেছিলাম সামান্য কিছু টাকা। সত্যিকার অর্থে, খুব ভালোমানের কোনো কাহিনি ছিল না সেটি। তাছাড়া এটি ঠিক সে সময়কার ঘটনা, যখন আমেরিকানরা তাদের স্টুডিওটি বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

ওম্যান টু ওম্যান
ফিল্মমেকার । গ্রাহাম কাট

ত্রুফো :: ওম্যান টু ওম্যান ফিল্মটি কখনোই দেখিনি। বস্তুতপক্ষে, এর কাহিনিটিও জানা নেই আমার।

হিচকক :: আপনি যেমনটা বললেন, আমার তখন ২৩ বছর বয়স, এবং আমার জীবনে তখনো কোনো নারী আসেনি। জীবনে তখনো এক ফোঁটা মদও খাইনি আমি। যে নাটকটি থেকে এ কাহিনিটি নেওয়া হয়েছিল, সেটি তখন লন্ডনে বেশ জনপ্রিয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক ব্রিটিশ আর্মি অফিসারের কাহিনি ছিল এটি। প্যারিসে পাড়ি জমানোর পর এক নর্তকীর সঙ্গে প্রেম হয় তার, তারপর সে চলে যায় যুদ্ধক্ষেত্রে। গোলার আঘাতে স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যায় তার। সে ইংল্যান্ডে ফিরে আসে এবং একজন ‘সামাজিক’ নারীকে বিয়ে করে। আর তারপরই সেই নর্তকী এসে হাজির হয় সন্তানসহ। তারপর দ্বন্দ্ব…।

নর্তকীটির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কাহিনির সমাপ্তি ঘটে।

ত্রুফো :: এই ফিল্মটির ডিরেক্টর ছিলেন গ্রাহাম কাটস। স্ক্রিপ্ট ও সংলাপ রচনার পাশাপাশি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবেও তো আপনি কাজ করেছিলেন এখানে?

আলফ্রেড হিচককঅ্যালমা রিভিল

হিচকক :: আরও অনেককিছু হিসেবে কাজ করেছি! ফিল্মটির আর্ট ডিরেক্টর ছিল আমার বন্ধু। শেষ পর্যন্ত কাজটি সে করতে পারেনি। ফলে আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে হয়েছে আমাকে। ফলে আমি এগুলো তো করেছিই, পাশাপাশি সাহায্য করেছি প্রোডাকশনেও। আমার ভবিষ্যৎ-স্ত্রী– অ্যালমা রিভিল ছিল এই ফিল্মের এডিটর ও স্ক্রিপ্টগার্ল। তখনকার দিনে স্ক্রিপ্টগার্ল ও এডিটরের দায়িত্ব একজনকেই সামলাতে হতো। আপনি তো জানেন, এখনকার দিনে স্ক্রিপ্টগার্ল এতগুলো বই নিয়ে ঘুরে। সে সত্যিকার অর্থেই একজন হিসাবরক্ষক। এই সিনেমাটিতে কাজ করতে গিয়েই নিজের স্ত্রীর সঙ্গে আমার ঘটেছিল প্রথম পরিচয়।

এরপর আরও বেশকিছু সিনেমায় আমি এ রকম নানাবিভাগে কাজ করেছি। দ্বিতীয় সিনেমাটি ছিল, দ্য হোয়াইট শ্যাডো [গ্রাহাম কাট; ১৯২৪]; তৃতীয়টি দ্য প্যাসোনেট অ্যাডভেঞ্চার [গ্রাহাম কাট; ১৯২৪]; চতুর্থটি দ্য ব্ল্যাকগার্ড [গ্রাহাম কাট; ১৯২৫]; এবং এরপর পঞ্চমটি– দ্য প্রুড’স ফল [গ্রাহাম কাট; ১৯২৫]।

ত্রুফো :: সেগুলোর কথা এখন মনে পড়লে, আপনার কি মনে হয়– সবগুলো সিনেমা একই রকম ছিল; নাকি কোনোটিকে আপনি এগিয়ে রাখতে চান?

হিচকক :: নানাদিক থেকেই ওম্যান টু ওম্যান ছিল শ্রেষ্ঠতম এবং সবচেয়ে ব্যবসাসফল। এই সিরিজের শেষ সিনেমা– দ্য প্রুড’স ফল যখন আমরা বানিয়েছি, ডিরেক্টর তার বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন লোকেশনে। আমরা ভেনিস গিয়েছিলাম। এ ছিল সত্যিকার অর্থেই ভীষণ ব্যয়বহুল ব্যাপার। দৃশ্যতই ডিরেক্টরের প্রেমিকার একটি লোকেশনও পছন্দ হয়নি; ফলে কোনো দৃশ্যের শুটিং না করেই স্টুডিওতে ফিরে আসতে হয়েছিল আমাদের। ফিল্মটির কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রডিউসারকে ডিরেক্টর বলে দিয়েছিলেন, আমাকে তিনি আর কিছুতেই চান না। ইউনিটেরই কারও ‘রাজনীতি’র শিকার যে আমি হয়েছিলাম, সেই সন্দেহটি আমার মনে এখনো রয়ে গেছে।

ত্রুফো :: এই সিনেমাগুলো বানাতে সময় লেগেছিল কতদিন?

হিচকক :: একেকটির ক্ষেত্রে দেড় মাস করে।

ত্রুফো :: আমার ধারণা, সবচেয়ে কম টাইটেল ব্যবহার করে সিনেমা বানাতে পারাটাই তখন কারও মেধার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতো; তাই না?

হিচকক :: ঠিক তাই।

ত্রুফো :: তারপরও প্রচুরসংখ্যক স্ক্রিপ্টই তো তৈরি হয়েছিল মঞ্চনাটক থেকে?

দ্য ফারমার’স ওয়াইফ
ফিল্মমেকার । আলফ্রেড হিচকক

হিচকক :: দ্য ফারমার’স ওয়াইফ নামে একটি নির্বাক সিনেমা বানিয়েছিলাম আমি– সংলাপে ভরা একটি মঞ্চনাটক অবলম্বনে; তবে আমরা চেষ্টা করেছিলাম টাইটেল এড়িয়ে গিয়ে তার বদলে যখনই সম্ভব– পিক্টোরিয়াল এক্সপ্রেশন ব্যবহার করতে। আমার ধারণা, কোনো রকম টাইটেলের ব্যবহার না করেই একমাত্র যে সিনেমাটি বানানো হয়েছিল, সেটির নাম দ্য লাস্ট লাফ [Der letzte Mann; এফ. ভি. মুরনৌ; ১৯২৪]; অভিনয় করেছিলেন এমিল ইয়ানিংস।

ত্রুফো :: অসাধারণ সিনেমা, মুরনৌর অন্যতম সেরা সিনেমা।

হিচকক :: আমি যখন ইউএফএ’তে কাজ করতাম, তখন তারা এটি বানিয়েছিলেন। এক ধরনের ‘এসপেরান্তো’ [আন্তর্জাতিকভাবে সহজবোধ্য কৃত্রিম ভাষা বিশেষ] ব্যবহারের মাধ্যমে এ সিনেমায় একটি সার্বজনীন ভাষা প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টাও ছিল মুরনৌর। সকল স্ট্রিট সাইন, পোস্টার, শপ সাইন ইত্যাদি এই কৃত্রিম ভাষায় লেখা হয়েছিল।

ত্রুফো :: তাই তো এমিল ইয়ানিংসের [হোটেলের দ্বাররক্ষক] বাড়ির কিছু সাইন ছিল জার্মান ভাষায়, তবে গ্র্যান্ড হোটেলের সাইনগুলো লেখা হয়েছিল এই এসপেরান্তোতে। আমি ভাবতে পারছি, ততদিনে ফিল্মমেকিংয়ের টেকনিক্যাল দিকগুলোর প্রতি আপনার আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছিল, এবং আপনি গবেষণা এগিয়ে নিচ্ছিলেন।…

হিচকক :: ব্রিটিশ ফিল্মগুলোর তুলনায় আমেরিকান ফিল্মের ফটোগ্রাফির অপেক্ষাকৃত উন্নতর মানের ব্যাপারে আমি ভীষণ অবগত ছিলাম। ১৮ বছর বয়সে, স্রেফ শখের বশে ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম আমি। যেমন ধরুন, খেয়াল করে দেখেছি, ব্যাকলাইটের সাহায্যে ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ইমেজকে যেখানে আলাদা করে দেওয়ার চেষ্টা সবসময়ই আমেরিকানদের মধ্যে দেখা যেত, সেখানে ব্রিটিশ সিনেমাগুলো ব্যাকগ্রাউন্ডের মধ্যে ইমেজকে একাকার করে দিতো। কোনো সেপারেশন, কোনো রিলিফের বালাই ছিল না তাতে।


উৎস-গ্রন্থ

হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন
মূল: Hitchcock/Truffaut
অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৮
বাংলাদেশি সংস্করণের প্রকাশক: অগ্রদূত
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৪৪৮
মূল্য: ৫০০ টাকা
ভারতীয় সংস্করণের প্রকাশক: প্রতিভাস
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৩৯২
মূল্য: ৫০০ রুপি


পরের কিস্তি, আসছে শিগগিরই…

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here