সাহিত্য ও চলচ্চিত্র

12878
তিতাস একটি নদীর নাম

লিখেছেন । আসাদুজ্জামান সবুজ

সাহিত্য ও চলচ্চিত্র সম্পর্ক সখা স্বরূপ। একটি আরেকটির পরিপূরক। মুহম্মদ খসরুধ্রুপদী থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায় চলচ্চিত্র ও সাহিত্য হচ্ছে ভাই। হলিউডে উইন্সটন গ্রুমের লেখা উপন্যাস ফরেস্ট গাম্প, গার্সিয়া মার্কেসের কালজয়ী লাভ ইন দ্য টাইমস অব কলেরা, নিকোলাস স্পার্কাসের নোটবুক, মারিও পুজোর গডফাদার, ই এল জেমসের ফিফটি শেড নামক এই উপন্যাসগুলো সাহিত্য ও সেলুলয়েড– দুই ক্ষেত্রেই বিখ্যাত ও জনপ্রিয় হয়েছে।

এই উপমহাদেশেও বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত পথের পাঁচালী পুরো দুনিয়া জানে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালিল্লাহ, সমরেশ মজুমদারদের উপন্যাসগুলোও পর্দায় এসেছে।

অনেকেই বলেন, শিল্পের সবচেয়ে বড় মাধ্যম– চলচ্চিত্র। আর চলচ্চিত্রের মূল হাতিয়ার– গল্প। আমাদের এখানেও বইয়ের পাতা বা উপন্যাসের পৃষ্ঠা থেকে লিখিত সাহিত্য পর্দায় দৃশ্যমান হয়েছে। একসময় এখানে সাহিত্যনির্ভর বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ হলেও এখন তেমন হয় না। যার প্রধান কারণ, ভালো প্রযোজক বা পরিবেশক ও নির্মাতার অভাব।


এখন
অনেকে
কাজ করতে
আসেন, যারা
শিল্প-সাহিত্য জ্ঞানহীন

শিশুশিল্পী স্বরূপ কাজ করেন

সেসময় যারা কাজ করতেন, তাদের প্রচুর পড়াশোনা এবং কাজের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল। এখন অনেকে কাজ করতে আসেন, যারা শিল্প-সাহিত্য জ্ঞানহীন ও শিশুশিল্পী স্বরূপ কাজ করেন। বাণিজ্যিক ধারার অধিকাংশ নির্মাতাই আশপাশ ভূখণ্ড থেকে জোড়াতালি বা কপি-পেস্টে ব্যস্ত। যার ফল, দর্শক হলে না যাওয়া এবং হল কমে যাওয়া।

দর্শক গতানুগতিক একই ধারা থেকে মুক্তি খোঁজেন। তারা ভালো, মৌলিক গল্প দেখতে চান। সাহিত্য ও মৌলিক গল্পের চলচ্চিত্র যা-ও দু’একটা হচ্ছে, তা সুবিধাবাদী সিন্ডিকেটের সঙ্গে পেরে উঠছে না। আর যারা এসব ছবি বানাচ্ছেন, তারা আর্থিক ক্ষতিকর হওয়ায় আর দ্বিতীয়বার সাহস করছেন না। অথচ সাহিত্য ও মৌলিক গল্পের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্র আবার ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব কিছু নয়। এক্ষেত্রে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার একযোগে কাজ করা প্রয়োজন। কিন্তু এখানকার মহানরা ৪ এপ্রিল নামক বিশেষ দিনে প্রতি বছর বেলুন ও পায়রা উড়াতে পছন্দ করেন! এসব থেকে বের হয়ে আসার সময় বোধহয় চলে এসেছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সাহিত্যনির্ভর কিছু সফল চলচ্চিত্রের উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:

তিতাস একটি নদীর নাম

তিতাস একটি নদীর নাম

অদ্বৈত মল্লবর্মনের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম অবলম্বনে এই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন ঋত্বিক ঘটক। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় ১৫৯ মিনিটের এই ছবি।

–কিরে গোলাম! বিয়া করবি?
–করমু।
–ক দেখি বিয়া কইরা কী করে?
–ভাত রান্ধায়!
–হি হি হি, কইতে পারলি না গোলাম, কইতে পারলি না। বিয়া কইরা লোকে বউয়ের ঠ্যাং কান্ধে লয়, বুঝলি হি হি হি।… আমারে বিয়া করবি?
মোটাসোটা ঠ্যাং দুটির দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাইয়া অনন্ত বলিল, না।

তিতাস একটি নদীর নাম। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার তিতাস নদী আর তার আশপাশের মানুষদের, বিশেষ করে জেলেদের জীবনযাত্রা এই ছবির উপজীব্য। এতে অভিনয় করেছেন গোলাম মোস্তফা, কবরী চৌধুরী, রোজী সামাদ, প্রবীর মিত্রসহ গুণী শিল্পীরা। এছাড়া নির্মাতা নিজেও অভিনয় করেছেন।

ছবিটি সুরকার ওস্তাদ বাহাদুর খান, চিত্রগ্রাহক বেবী ইসলাম, সম্পাদক বশির হোসেন ও প্রযোজক হাবিবুর রহমান। ২০০৭ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের সেরা ১০ ছবি নিয়ে দুটি তালিকা প্রকাশ করে। যার একটি তালিকা চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের মতে, অন্যটি দর্শকদের মতে। দুই তালিকাতে তিতাস একটি নদীর নাম প্রথম স্থান অধিকার করে।

সূর্য দীঘল বাড়ী

গ্রন্থকার আবু ইসহাকের কালজয়ী উপন্যাস সূর্য দীঘল বাড়ী অবলম্বনে এই চলচ্চিত্র যৌথভাবে নির্মাণ করেন মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী। এটি বাংলাদেশের প্রথম সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত পূর্ণদৈঘ্য চলচ্চিত্র। ১৯৭৯ সালে মুক্তি পায় ১৩২ মিনিটের এই ছবি।

বাংলা ১৩৫০ সনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অবিভক্ত ভারতের বাংলায় ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ‘পঞ্চাশের আকাল’ নামে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তাতে কয়েক লাখ দরিদ্র মানুষ প্রাণ হারায়। যারা কোনোমতে শহরের লঙ্গরখানায় পাত পেতে বাঁচতে পেরেছিল, তাদেরই একজন এ কালের সময় স্বামী পরিত্যক্ত জয়গুন। সঙ্গে তার মৃত প্রথম স্বামীর ঘরের ছেলে ও দ্বিতীয় স্বামীর ঘরের মেয়ে। আরও আছে মৃত ভাইয়ের স্ত্রী-পুত্র। তারা গ্রামে ফিরে এসে এমন এক খণ্ড জমিতে ঘর তৈরি করে, যেটি অপয়া ভিটে বলে পরিচিত ছিল।

জীবনের যুদ্ধে যখন সে প্রাণপণ লড়ছে, তখন তার প্রতি গায়ের মোড়লের দৃষ্টি পড়ে। দ্বিতীয় স্বামীও তাকে আবার ঘরে তুলতে চায়। সে কারও প্রস্তাবেই সায় দেয় না। কিন্তু এ দুজনের সাক্ষাত ঘটে এবং মোড়ল তার প্রতিযোগীকে হত্যা করে। ঘটনার একমাত্র দর্শক হিসেবে জয়গুনকেও মূল্য দিতে হয় অন্যভাবে।

কুসংস্কার, সম্পদ, ধর্ম, প্রতিপত্তি, সামাজিক বাধা-নিষেধ, এমনকি জাতীয়তাবোধ– এ সবকিছুকেই কাজে লাগিয়ে শ্রমজীবী ক্ষুধার্ত মানুষকে ক্রমাগত শোষণ করা বিষয় তুলে ধরা ছিল এই গল্পের কাজ। ছবিতে প্রধান চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন ডলি আনোয়ার, রওশন জামিল, জহিরুল হক, আরিফুল হক, কেরামত মাওলা, এটিএম শামসুজ্জামান। সুরকার আলাউদ্দিন আলী, চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন, সম্পাদক সাইদুল আনম টুটুল।

সূর্য দীঘল বাড়ী ছবিটি ১৯৮০ সালে জার্মানিতে মানহাইম চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ এবং তিনটি বিভাগে পুরষ্কার লাভ করে। পর্তুগালের দা ফোড চলচ্চিত্র উৎসবের [১৯৮০] একটি বিভাগে অংশ নিয়ে পুরস্কার পায়। এ ছাড়াও দেশে ৮টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করে এ সিনেমা।

সারেং বৌ

সারেং বৌ

শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাস সারেং বৌ থেকে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। এটি মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে।

কদম জাহাজে কাজ করে অনেক দিন পর ফিরে আসে নিজ বাড়িতে, তারপর ভালোবেসে বিয়ে করে নবিতনকে। বিয়ের কিছুদিন পর আবার চলে যায় জাহাজের কাজে। কদম চলে যাওয়ার পর মাঝে মধ্যেই নবিতনের কাছে চিঠি ও টাকা পাঠায়। কিন্তু গ্রামের প্রভাবশালী মোড়ল ডাকপিয়নকে হাত করে সেইসব চিঠি ও টাকা নিয়ে নেয়, যাতে নবিতনের সংসারে অভাব নেমে আসে। আর এই অভাবের সুযোগে নবিতনকে তার লালসার শিকার বানাতে চায়।

কিন্তু নবিতন নিজে গায়ে খেঁটে ঢেঁকিতে ধান ভেনে কোনোমতে সংসার চালায়। এদিকে কদমকে মন্টু চাচা পকেটে অবৈধ মাল পুরে দিলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। সাজার মেয়াদ শেষ হলে সে ফিরে আসে নিজ গ্রামে।

ততদিনে চক্রান্তকারী মোড়ল কদমের চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে নবিতনের বিয়ে ঠিক করে; কিন্তু কদম ফিরে আসাতে সব ঠাণ্ডা হয়ে যায়। খুশিতে বুক ভরে ওঠে নবিতনের। এভাবে নানা ঘটনায় অতিবাহিত হলে কিছুদিন, হঠাৎ একদিন তীব্র বাতাস গণগণে শব্দে আতঙ্কিত উপকূলীয় অঞ্চলের সব মানুষ– এ যেন জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস। শুরু হলো উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রামের তড়িগড়ি, কিন্তু প্রলয়নকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বেঁচে থাকার লড়াই।

দীর্ঘ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর থমথমে অবস্থা, চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ: মানুষ, পশু, পাখি– কারওই রক্ষা হয়নি এই দুর্যোগে-দুর্ভোগে। বেঁচে থাকা কদম সারেংয়ের শরীরের বেশির ভাগই কাদামাটি ও বালির ভিতরে আটকে গেছে; আর পানি পানি করে কাতরাচ্ছে। এদিকে নবিতনও একই অবস্থা থেকে উঠে খুঁজছে আপনজনদের।

হঠাৎ শুনতে পেল, কেউ পানি খেতে চাইছে। কাছে গিয়ে দেখল, তার স্বামী হাতে করে পানি এনে খাওয়ানোর চেষ্টা করে না পেরে, কদমকেই টেনে নিয়ে গেল পানির কাছে। পানি মুখে দিতেই মুখ থেকে বের করে দিচ্ছে কদম; কারণ খুঁজতে নবিতন নিজেই একটু পানি মুখে দিয়ে দেখল- এ তো নোনাপানি।

স্বামীকে বাঁচানোর কোনো উপায় না দেখে মাতৃত্বকে জাগিয়ে স্বামীকে দুধের শিশুর মতো বুকে জড়িয়ে নবিতন নিজ স্তন থেকে দুধ পান করায়। স্বামী কদম চোখ মেলে চমকে উঠে বলে, ‘নবিতন তুই আমারে পর কইরা দিলি, নবিতন?’

না, জীবন বাঁচানোর প্রধান বিবেচ্য বিষয়।

এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন ফারুক, কবরী, গোলাম মোস্তফা, ডলি চৌধুরী। সুরকার আলম খান, চিত্রগ্রাহক রফিকুল বারী চৌধুরী, সম্পাদক আমিনুল মিন্টু। ছবিতে আবদুল জব্বারের কন্ঠে ‘ওরে নীল দরিয়া আমায় দেরে দে ছাড়িয়া’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন সংগ্রামের গল্পে নির্মাণ হয় এই চলচ্চিত্র।

শ্রাবণ মেঘের দিন

শ্রাবণ মেঘের দিন সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন জনপ্রিয় নির্মাতা ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯৯ সালে। তারই লেখা শ্রাবণ মেঘের দিন উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হয়েছে সিনেমাটি।

মতি একজন গাতক, মানে গায়ক। তাকে মনে মনে ভালোবাসে ঐ গ্রামেরই মেয়ে কুসুম। তার গানের গলাও খুব ভালো। মেয়েটি সবসময় ভাবে, মতি মিয়াকে নিয়ে একটা গানের দল করে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু ঢাকা থেকে আসা ওই গ্রামের জমিদারের নাতনি শাহানাকে ভালোবেসে ফেলে মতি; তবে জানে না শাহানা তাকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে মুল্যায়ন করে মাত্র।

এদিকে কুসুমের বাবা উজান থেকে একটি ছেলে– সুরুজকে নিয়ে আসে কুসুমের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য। ওই গ্রামের বাসিন্দা পরানের স্ত্রী প্রসব বেদনায় ছটফট করছিল। জমিদারের নাতনি শাহানা একজন ডাক্তার, এই ভেবে মতি মিয়া তাকে ডেকে আনে। শাহানা এসে বুঝতে পারে, ওই নারীর পেটের বাচ্চা উল্টে আছে। সে বইয়ে পড়েছে এর চিকিৎসার ব্যাপারে; কিন্তু বাস্তবে কখনো করেনি। তবু কোনো উপায় না দেখে সাহস করে সেই সন্তান স্বাভাবিকভাবে ডেলিভারি করাতে সক্ষম হয়। যে জমিদারকে এলাকার সবাই ঘৃণার চোখে দেখত, তারা সবাই এখন তাকে সম্মান করে।

একদিকে কুসুমের বিয়ের আয়োজন চলছে, অন্যদিকে জমিদারের নাতনিরা ঢাকায় ফিরে যাচ্ছে জমিদারসহ। জমিদার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মিলিটারিদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছিল; তাই গ্রামের সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে তার জমিদার বাড়ি একটি হাসপাতালের জন্য দান করে বিদায় নেয়। আর তাই গ্রামের প্রায় সবাই চলে আসে তাদের বিদায় জানাতে।

কুসুম বাড়িতে একা, মতিকে না পাওয়ার কষ্টে বিষ পান করে। কুসুমের মা টের পেয়ে সবাইকে ডাকে এবং তাকে নিয়ে মতি ও সুরুজ নৌকায় ছোটে ডাক্তার শাহানাকে ধরতে; কিন্তু মাঝপথেই সোয়া চান পাখি চিরনিদ্রায় শায়িত হয়। আর মতি গাতক গেয়ে উঠে, ‘শুয়া চান পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছো নাকি…।’

সে সময় চলচ্চিত্রটির গান মানুষের মুখে মুখে ছিল। অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান, শাওন, মাহফুজ আহমেদ, আনোয়ারা, ডা. এজাজসহ অনেকে।

শ্রাবণ মেঘের দিন মোট ৬টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পেয়েছে।

গেরিলা

২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত গেরিলা। নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত এই চলচ্চিত্র মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির। এটি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক রচিত নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাস থেকে নির্মিত।

বিলকিস এই গল্পের মূল চরিত্র। শিক্ষিত-সংস্কৃতিমনা-বলিষ্ঠ চিত্তের অধিকারী বিলকিসের স্বামী প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক হাসান ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে নিখোঁজ হন। আপনবোধ আর হাসানের সান্নিধ্যে বাঙালির স্বাধীনতা মন্ত্রে উজ্জীবিত বিলকিস অসুস্থ শাশুড়ির দেখাশোনা, নিজের ব্যাংকের চাকরি, নিখোঁজ হাসানের খোঁজ নেওয়ার পাশাপাশি ঢাকার গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেয়।

তার মতোই আরও অনেক নারী চাকরি বা নিজ সামাজিক অবস্থানের ছত্রছায়ায় গেরিলা যুদ্ধের নানা সাংগঠনিক যোগাযোগ ও পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে নিয়োজিত থেকে গেরিলা যুদ্ধকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। এ সময় হাসানের দুধভাই তসলিম সর্দার আর সে সময়ের কিংবদন্তি সুরকার আলতাফ মাহমুদ অভিভাবকের মতো স্নেহে-পরামর্শে বিলকিসকে ছায়া দেন। পাকিস্তানি বর্বরতা, বাঙালির প্রতিরোধ আর স্বাধীনতার দাবি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিতে সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি বিলকিস সহযোদ্ধাদের সঙ্গে একটি পত্রিকার কাজেও জড়িয়ে যায়, যার নাম ‘গেরিলা’।

সময়ের আবর্তে ১৯৭১-এর আগস্ট মাসের শেষ দিকে একটি বড় অপারেশনের পর ঘটনা পরিক্রমায় ঢাকা ছাড়তে হয় বিলকিসকে। তসলিম সর্দার নিহত হন, আলতাফ মাহমুদ মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র রাখার দায়ে পাকিস্তানি আর্মির হাতে আটক হন। একাকী বিলকিস নিজগ্রাম রংপুরের জলেশ্বরী যাবার জন্য ট্রেনে পাড়ি জমায়। কিন্তু তারই ছোটভাই খোকনের দল ওদিকে একটি রেলব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ায় তার ট্রেনযাত্রা ব্যাহত হয়।

দৃঢ়চিত্ত বিলকিস হেঁটেই এগিয়ে চলে বাড়ির পথে। খোকন বাহিনীর এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ বিলকিসের যাত্রাসঙ্গী হয়। বাড়ির পথে নানা ঘটনার পাশাপাশি নিজের বাড়ি লুট হওয়া আর আপন মামার ওপর মিলিটারি-রাজাকারদের নির্যাতন দেখে শিউরে উঠে সে। অতপর একমাত্র ভাই খোকনকে দেখবার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় যুদ্ধের ডামাডোলে জীবনের সকল সূত্র হারানো এক নারী, বিলকিস।

কিন্তু দুর্ভাগ্য, এরইমধ্যে জবাই করা হয়েছে খোকনকে। ভাইয়ের লাশ দাফন করতে গিয়ে বন্দি হয় পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে। তবে শেষ পর্যন্ত বীরের মতো আত্মাহুতি দেয় বিলকিস। নিজের সঙ্গে উড়িয়ে দেয় একটি গোটা মিলিটারি ক্যাম্প।

যৌথভাবে চিত্রনাট্য লিখেছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও এবাদুর রহমান। গেরিলা ছবিটিতে অভিনয় করেছেন সহস্রাধিক শিল্পী। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান, ফেরদৌস, এটিএম শামসুজ্জামান, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শতাব্দী ওয়াদুদ, শম্পা রেজা, গাজী রাকায়েত, কচি খন্দকার, মোস্তফা মনোয়ার, শ্যামল মাওলা প্রমুখ।

চলচ্চিত্রটি ২০১১ সালে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অংশ নেয় এবং ১৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নেটপ্যাক বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে। মেরিল প্রথম আলো সমালোচক পুরষ্কার ২০১১-সহ গেরিলা ছবিতে অভিনয়ের জন্য বিচারকমণ্ডলির বিশেষ পুরস্কার পেয়েছেন এটিএম শামসুজ্জামান। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ছবিটি বিভিন্ন বিভাগে সর্বোচ্চ ১০টি শাখায় পুরস্কার পেয়েছে।

ফাগুন হাওয়া

আরও…

এছাড়াও আমজাদ হোসেনের লেখা অবলম্বনে তৌকির আহমেদের জয়যাত্রা, মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলামের দীপু নাম্বার টুআমার বন্ধু রাশেদ, শাহরিয়ার কবিরে লেখা অবলম্বনে নাসির উদ্দিন ইউসুফের একাত্তরের যীশু, কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটগল্প রেইনকোট অবলম্বনে জাহিদুর রহিম অঞ্জনের মেঘমল্লার, সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে আখতারুজ্জামানের পোকা মাকড়ের ঘরবসতি, মানিক বন্দোপধ্যায় কালজয়ী উপন্যাসে গৌতম ঘোষের পদ্মা নদীর মাঝি, টিটু রহমানের ছোটগল্প বউ কথা কও অবলম্বনে ভাষা আন্দোলন প্রেক্ষাপটে তৌকির আহমেদের ফাগুন হাওয়া, হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস নিয়ে আনাম বিশ্বাসের দেবী-সহ সাহিত্যনির্ভর আরও কিছু চলচ্চিত্র সমালোচক ও দর্শকের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।

আশা করছি, আগামিতে আরও বেশি সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্ সহ ও অন্যন্য মৌলিক গল্পে ভালো চলচ্চিত্র এ দেশে তৈরি হবে। সময় এখন সামনে চলার। তারেক মাসুদের কথায়, সেদিন খুব দূরে নয় যেদিন আমাদের চলচ্চিত্র বিশ্ব দরবারে সফলতা বয়ে আনবে।

বাংলা চলচ্চিত্রের জয় হোক।

Print Friendly, PDF & Email

2 মন্তব্যগুলো

  1. লেখাটি বেশ তথ্যবহুল।
    পুরো আলোচনাটি আরেকটু গভীর হলে উপভোগ্য হতো।

    এই প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ।

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here