মৃণালের ভুবন সোম: বাঙালির বুলিও প্রতিনিধি

1077
ভুবন সোম

লিখেছেন: দৃষ্টি দিজা

ভুবন সোম
ফিল্মমেকার, স্ক্রিনরাইটার, প্রডিউসার । মৃণাল সেন
উৎস গল্প । বনফুল
সিনেমাটোগ্রাফার । কে. কে. মহাজন
ন্যারেটর । অমিতাভ বচ্চন
মিউজিক । বিজয় রাঘব রাও
এডিটর । রাজু নায়েক; গঙ্গাধর নস্কর; দিনকর শেঠি
কাস্ট [ক্যারেকটার] । উৎপল দত্ত [ভুবন সোম]; সুহাসিনী মুলে [গৌরি]
রানিংটাইম । ৯৬ মিনিট
ভাষা । হিন্দি
দেশ । ভারত
অ্যাওয়ার্ড । বেস্ট ফিচার ফিল্ম, বেস্ট ডিরেক্টর (মৃণাল সেন), বেস্ট অ্যাকটর (উৎপল দত্ত) [ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, ভারত]


ভুবন সোম

ওয়েল, মৃণাল সেন না হয় ধ্যান-জ্ঞান সিনেমা তৈরিতে লাগাইয়া এ সমস্ত তৈরি করেছেন, ন্যাচারালি! সেজন্যই ভুবন সোম-টোম তৈরি হয়েছে। কিন্তু উৎপল দত্ত শুনি এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, সিনেমা মূলত মূল আগ্রহর জায়গা ছিল না। ছিল মঞ্চ। বোঝো! এইসব কাজ করার পর!

যাকগা।
১৯৬৯-এর ভুবন সোম মৃণাল সেনের প্রথম ব্যবসাসফল সিনেমা। মানে, আমার ধারণা, উৎরে গেছিল। বনফুলের একটা গল্প অবলম্বনে।

এবার গোড়ায় বলে দিই, সিনেমা নিয়ে কবিতা নিয়ে, উপন্যাস নিয়ে, পেইন্টিং নিয়ে এমনি ছেদাছেদি করা বেশ ঠিক আছে। কিন্তু আমার কাছে কেমন জানি একটা বন্দিদশা বন্দিদশা লাগে।

যেন, এই তুমি এক পয়েন্ট-অফ-ভিউতে দেখলা, এই তোমার একটা মাত্র মাত্রিক-ভিউ, সবাই জেনে গেল! স্যাড।

আদতে তা নয়; কিন্তু, লাগে। অমুক দার্শনিকের নির্দিষ্ট তমুক দর্শনের মতো। ‘কোটস্ সমগ্র’র মতো।

বিশ্লেষকরা নিজেরে প্রেজেন্ট করার জন্য যত জটিলতার মধ্য দিয়া যান, মূল শিল্প তৈরি হওয়ার সময় শিল্পীর মাথায় তত জটিলতা সম্ভবত কাজ করে না। ডিরেকশনের সময় বুঝাইতে বুঝাইতে বা একটা পারফেক্ট টেক নিতে হয়তো ডিরেক্টরের চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, পাদ বের হচ্ছে, কিন্তু আমি যা যাপন করছি বা উপলব্ধি করছি বা দেখেছি, তা দেখানোই মূল লক্ষ্য হয়। এবার, আদতে আমি যা দেখছি, তা দেখানো কিন্তু মোটেই সরল বিষয় না, যতই বলি। আদতে সবচে কঠিন আর ইমপারফেক্ট বিষয়।


তার মানে, শিল্প দাঁড়াইল, সরলতম জটিল ব্যাপার

তার মানেই শিল্প। তার মানে, শিল্প দাঁড়াইল, সরলতম জটিল ব্যাপার। আর সার্থক হলে, যা ডেফিনেটলি ইমপারফেক্টও।

যার ধারকাছ, বিশ্লেষক, ডোম, বোদ্ধার শীর্ষাসনে একমাস হেঁটে করা ব্যবচ্ছেদের গাট্টিও নিতে পারবে না।

এই কথা বললাম ঠিক, তারপর সঙ্গে সঙ্গে কী মনে পড়ল বলি, বুদ্ধদেবের অনুবাদ করা মেঘদূত-এর ভূমিকাটা! বুদ্ধদেব বসুরই নিজের লেখা।

যখন পড়ি, কী অনবদ্য লাগছিল! হলো তো নিজেরে নিজে পরাস্ত করা? কিন্তু যতই যা অসাধারণ হোক, তা মেঘদূতম তো আর হয়নি! মেঘদূতম-এর ‘ভূমিকাই’ হইছে।

***

ব্যক্তি ভুবন সোম একজন রেলওয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বিপত্নিক। বাইরে থেকে একাকিত্ব, ফ্রেকচার, বোঝা যায় না। পাইপ সানগ্লাস স্যুট; লোয়ার র‌্যাঙ্কে যা সমস্ত অসঙ্গতি হবে, তাদের বকে ঠিক রাখার জন্য পারফেক্ট ফরমাল অফিসার।

একজন বাঙালির, হিন্দুস্তানের যেকোনো পর্যায়ে উচ্চপদে থাকলে যে পরিমাণ সুষ্ঠু এক্সেন্টের হিন্দি বলতে পারা সম্ভব, সিনেমায় ভুবন সোম হিসেবে উৎপল তা দারুণভাবে পারেন।

নিচু স্তরের সব কর্মচারী, বিশেষ করে যারা নৈতিকতা-অনৈতিকতা থেকে সাবলীল ঘোরের মতো দূরে থাইক্যা একটু নিরাপদ সচ্ছলতা চায়, তারা ভুবন সোমকে ভয় এবং অশ্রদ্ধা করে।

ঘোড়ার গাড়িতে যাওয়া আসার দৃশ্য থেকে ভুবন সোমের সম্পর্কে ন্যারেটিভ করা হয়।

মৃণালের এই কাজটা দারুণ– কোনো চরিত্রকে ক্লোজ শটে এনে পজ করে ঐ চরিত্রের মনে চলতে থাকা আলাপ বক্তব্য ব্যাকগ্রাউন্ডে শুনান। একে নাকি ট্যাবল্ ইফেক্ট বলে। দারুণ। যখন প্রথম উৎপলের উপর ট্যাবল্ ইফেক্ট হয়, আমি গুরুত্ব দিয়ে শুনি, এই হিন্দি উৎপলের নিজের স্বরই কি না। তারপর দেখলাম, উৎপলেরই তো। দারুণ।

ঘোড়ার গাড়ি চলা শুরু হয়, ন্যারেটর আসেন। তরুণ ক্লিন বাচিক শৈল্পিক কণ্ঠ।
শুরুতে, ইন্ট্রডিউসিংয়ে একটা নাম দেখা গেছিল, খালি ‘অমিতাভ’। অমিতাভ বচ্চনই। পরে জানলাম, মূলত অভিনয় নয়, ন্যারেটর হিসেবেই অমিতাভের সিনেমায় কাজ শুরু।

আর তা মৃণাল সেনের ভুবন সোম থেকেই।
ভালো ন্যারেটর।

আখ্যানে, মূল চরিত্রের স্ট্রিকটনেস, ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া হয়।
বাংলা থেকে বাইরে থাকার পরও ভুবন সোমের বাঙালপনা কেমন সাবলীলভাবে টিকে আছে, অনিয়মে নিজের পুত্রকেও কর্মক্ষেত্রে ছাড় দেননি– এইসব।

ভুবন সোম ঘুম থেকে ওঠেন, চুরুটের পর চুরুট খান, খেয়ে খেয়ে বারান্দায় শরীরচর্চা হিসেবে বিক্ষিপ্ত হাঁটাহাঁটি করেন।

একঘেঁয়ে কর্মজীবন থেকে বাইরে যেতে ভুবন সোম একসময় ভাবেন, ছুটি নিয়ে শিকারে যাওয়ার কথা। দেখানো হয় শ্যুটার্স বাইবেল বই-টই। ভুবন সোম কী শিকার করবেন, ভাবতে গিয়ে ভাবেন, বাঘ? না, বাঘ থাক! কী আর হবে এসব…!

মানে, বাঙালির ভয়ংকর রকম গা বাঁচানো স্বাভাবিক ভীতি! মানে, মোটামুটি ধরা যায়, চ্যালেঞ্জিং ব্যাপারদের এড়িয়ে যাওয়া।

পাখি শিকার? পাখি শিকারই ফাইনাল হয়।

ভুবন সোম পারফেকশনিস্ট ঘরানা। এবার তিনি মন দিয়া পাখি শিকার বিষয়ক বই আত্মস্থ করতে থাকেন।

ভুবন সোম

এইসমস্ত কিছু ক্ষেত্রে খুব ভালো করে অ্যানিমেশনের ব্যবহার হয়েছে। যেমন, পাখি শিকার সম্বন্ধীয় বই পড়ার সময় দেখা যায়, অ্যানিমেটেড পাখিরা ভুবন সোমের শিকার বিষয়ক অজ্ঞতা বা ভীতিকাতরতা নিয়ে ঠাট্টার সুরে হাসিমজাক করে করে মাথার ওপর গোল গোল উড়তে আছে! মজার।

কমেডি বেইজড বলব না। কমেডি ঘেঁষা, তবে।

এর আগে, মূল চরিত্রের দৈনিক কর্ম রুটিন দেখাতে গিয়ে অফিসিয়াল কর্মচাঞ্চল্য তৈরি করতে, ব্ল্যাক ব্যাকগ্রাউন্ড রেখে একটা খালি চেয়ার, অসংখ্য বাড়তে কমতে থাকা ফাইলের সারি, চলমান কলম আর রিং হতে থাকা ফোন, বারবার দরজার খোলা এবং বন্ধ হওয়া, প্রভৃতি অ্যানিমেটেড আকারে দেখানো হয়। এটা ভুবন সোমের উপস্থিতি ছাড়াই কেমন সুন্দর মতো ভুবন সোম বা যেকোনো ব্যস্ত উচ্চপদস্থ কর্মঠ কর্মীরে রিপ্রেজেন্ট করছে!

অ্যানিমেটর হলেন, রাম মোহন।

মৃণাল সেন, ভুবন সোমকে সাদা পোশাক পরিয়ে কালোতে পায়চারি করান। বোঝা যায়, লোকটা আলাদা।
এবং লোকটা একা। মানে, ভুবন সোম!

এবার ডিরেক্টরের এই যে ‘বঙ্গাল’ চরিত্রকে মূল চরিত্রের মাধ্যমে আজব কিছিমের এবং বৈচিত্র্যমণ্ডিত করে পেশ করার ইচ্ছা, তার পারফেকশনের দিকে খেয়াল রেখে, ভুবন সোমের ফাঁকে আন্তঃবাংলা বিস্তৃতি থেকে চষা মূল কিছু ব্যাপার ক্লোজ-স্থির-শটে দেখানো হয়।

কমিউনিস্ট পতাকা, নারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ, কুশপুত্তলি, ইনকিলাবের ভাষণ, সিনেমাকর্মীদের দাবি-দাওয়ার নোটিশ, ইত্যাদি। সাথে রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ, রবিশংকরেরা। ব্যাকগ্রাউন্ডে ন্যারেটর ক্রমান্বয়ে দাড়ি দিয়ে দিয়ে বলছেন, ‘সোনার বঙ্গাল, মহান বঙ্গাল, বিচিত্র বঙ্গাল।’

দর্শক মনে করতে পারেন, মৃণাল সম্ভবত অ্যাডমায়ারার অফ দোজ আর্টিস্ট, সো দ্যাট এই ক্রমান্বয়।

আমার কাছে এরকম ভাবতে ভালো লাগল না, সস্তা লাগল। মূলত, ভুবন সোম’কে আলটিমেট বিচিত্র বাঙালির রিপ্রেজেন্টেটিভ করে দেখাতে গেলেও, তার সঙ্গে বাঙালির বিচিত্রতার একটা উপরি-নমুনা দেখান দরকার হয়ে পড়ে, সে হেতুই এই ব্যক্তিবর্গ, মুহূর্ত আর দৃশ্যপটের উত্থাপন। নির্দিষ্ট করে কিছুর সাথে/কারোর সাথে কোনো নির্দিষ্ট ন্যারেটিভের যোগসূত্র নাই।


শিল্পী– তুমি যদি তাকে আলটিমেট ঘটমান অথবা নিকটে ঘটেছে এমন রাজনৈতিক প্রেক্ষাচিত্রর সাথে সত্যকার অর্থপূর্ণ জুড়া জুড়ে দিতে পার, তা মহাকালে টিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে এক ধাপ সম্ভাবনাময়তা বেশি রাখে

অথবা আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, গল্প বা থিম বা মূল ফোকাস যা-ই হোক না কেন, শিল্পী– তুমি যদি তাকে আলটিমেট ঘটমান অথবা নিকটে ঘটেছে এমন রাজনৈতিক প্রেক্ষাচিত্রর সাথে সত্যকার অর্থপূর্ণ জুড়া জুড়ে দিতে পার, তা মহাকালে টিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে এক ধাপ সম্ভাবনাময়তা বেশি রাখে; মৃণাল সেন তা অল্প বিশ্বাস করেন, বা ধরি, অভ্যন্তরে কোথাও একটা দায় রাখেন। রাখা থেকে এমন করা।

জানি না! আমার ধারণা, এটা বেশ আগে থেকেই শিল্পের অপেরায় সুপারলেটিভ একটা ধারণা।

***

তারপর ভুবন সোম শিকারের জন্য সুসজ্জিত হয়ে রওনা দেন। গুজরাটের একটা গাঁয় হাঁস শিকারের উদ্দেশ্য। পথে গুজরাটি গাড়োয়ানের সাথে কথা হয়।

ডায়লগ চলাচলি খুব ভালো এখানে। গাড়োয়ানের সুন্দরতম গুজরাটির র্ আর সরল এক্সেন্ট ভবিতব্য সম্পর্কে একটু আঁচ দেয়।

গাড়োয়ান বলে, সে হিন্দি জানে, রাজস্থানি গানও পর্যন্ত জানে। কর্মসূত্রে জানতে পারা হয়েছে।

ভুবন সোম

ভুবন সোম জিজ্ঞেস করেন, বাংলা জানো?

এবার তো গাড়োয়ান পুরা পাংশা মুখে বিব্রত হয়! টোটালি আনজান।
ভুবন সোম হাসেন৷

বিচিত্র বাঙালি। ব্যবসায়, দরবারে বা চিনাইতে পারার উতল আবেগ বা এক্সটেরিয়র বুদ্ধি তেমন করে কখনোই কোনোদিন হয় নাই, খাটায় নাই কেউ– এরকম বুঝাতে চেষ্টা করা হয়েছে, মনে করি।

তারপর ভুবন সোম ঘুমান, ঝাঁকানিতে জেগে, ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে প্রকৃতি দেখেন। পানির কলসি মাথায় গ্রামের নারীদের দল বেঁধে রাস্তা পার হওয়া দেখেন।

‘নারী’ দেখছেন ভেবে গাড়োয়ান গাড়ি থামায়। বিপত্নীক ভুবন সোম, নারী দেখেন? না নারীদের নিপুণভাবে দুইটা করে কলসি মাথায় সাবলীলভাবে ব্যালেন্স করে চলতে থাকা দেখেন? নাকি এমনি একটা প্রবাহমান গতি তারে তাকাই থাকতে ক্ষণিক বাধ্য করে, বোঝা যায় না।

***

সিনেমা যেখানে মূল মোড় ঘুরায়, মূল চরিত্র যেখানে এসে চরম ধাক্কা খেতে বাধ্য হয়, অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র– গৌরি।

নিজের খেয়ালে, সরল প্রবাহে বাড়তে থাকা গ্রাম্য, পশুপ্রেমি, young-dona.

গুজরাটের গ্রাম্য সরল আথিতেয়তার খাতিরে সে একরকম হাতে পেয়ে বসে মধ্যবয়স্ক বিপত্নীক, পুত্র বিচ্যুত মূল চরিত্রকে।

ভুবন সোম

তার বাবা জানায়, চতুর বালিকা, হিন্দিও পর্যন্ত জানে। কিন্তু খামখেয়ালির চলন। দুনিয়ায় চলার মতো তামাম জটিলতা সম্পর্কে ধারণা নাই মেয়েটার।

গৌরির একটা ষাঁড় আছে। কুড়িয়ে পাওয়া ময়না আছে৷ আর অনেক দূরে রেলের টিকেট কালেক্ট করা একটা বর আছে।

ভুবন সোমকে পরিচালক, প্রকৃতির মুখোমুখি করান। বিস্তৃত বনবাদাড়, অঢেল ডার্ট, ষাঁড়ের দৌড়ানি।

তার থেকেও বেশি মুখোমুখি করান গৌরির wing-এর সাথে।

সে ভুবন সোমকে কাপড়ের পুতুলের মতো খেয়ালখুশিতে সঞ্চালন করে।

বাবা বলেছে, খেয়ে তারপর শিকারে যেতে, সুতরাং, খান। ভুবন সোম, নিজের লাঞ্চবক্স ফেলে রেখে কাঁচা পেয়াজ কাঁচা রসুন সহযোগে শুকনা রুটি খেয়ে শেষ করেন।

পাখি উড়ে যাবে, সুতরাং হাত থেকে চুরুট ফেলুন। পাখিরা যাতে আপনাকে তাদের আপন লোক ভাবে, সেজন্য আমার বাবার পোশাক পরুন।


যেন ইন্দ্রজালে পড়া আনাড়ি হিপনোটাইজ

ভুবন সোম এসব অস্বাচ্ছন্দ্য মেনে নিয়েও ক্রমান্বয়ে করতে থাকেন। যেন ইন্দ্রজালে পড়া আনাড়ি হিপনোটাইজড।

একপর্যায়ে জানতে পারেন, গৌরি মূলত, তার অধীনে কাজ করা এক ঘুষখোর, স্বহস্তে রিপোর্টেড অনৈতিক টিসি’র বিয়ে করা বধূ।

তার আত্মা আনছান করে উঠে। অস্থির বোধ হয়।

ভুবন সোম

তিনি এখানে কী করতে এসেছেন! কেনই করছেন, এই ক্ষীণ পরিচিত বালিকার কথা কেনই-বা শুনে চলেছেন, বুঝতে পারেন না!

এবং বাধাদানের ক্ষমতাও একই সঙ্গে করে হারাতে থাকেন।

গৌরি বলে– পরুন পরুন, কিচ্ছু হবে না। বলে, হাসে। হাসতে থাকে। পাগড়ি বেঁধে দেয়।

বলে, ‘বাপু কেহতে হেয়, ইহা কা শিকার কা ঢং জুদাই হে।’
কী চমৎকার!
মানে, এখানে একাকিত্বই শিকারের নিয়ম।

মানে আমার কাছে, নিঃসঙ্গ ভুবন সোম অজান্তে, গৌরিরও অজান্তে, গৌরির সারল্যের শিকার হতে চলেছেন। এমন শিকার, যেখানে ভবিতব্য হলো, নৈতিকতায় খানিক ঢিলা দিয়ে করাপশনকে মেনে নিয়ে হলেও মনের শান্তি বজায় রাখা! আর কিছু স্বাধীনতা।

ভুবন সোম শিকারে অপটু। সাইকেলে না চড়ে সাইকেল বিষয়ক ভটলা বই পড়েই বাহক হওয়া যায় না।

ভুবন সোমকে গৌরি কখনো গ্রামীণ নেটিভ বানাতে চেষ্টা করে। কখনো শুকনা পাতা জড়ো করে গায়ে লাগাইয়া গাছ বানায়। বলে, এবার পাখি উড়বে না। ভয় পাবে না। বলে, আপনি আমার ষাঁড়টার মতো। সবাই ভয় পায় আপনাকে।

ভুবন সোম, bureaucratic ভুবন সোম, ভয়েস অফ কনশেন্স ভুলে গিয়ে ‘গৌরি’ দেখতে থাকেন।

গৌরি মরুভূমিময় বইতে থাকে। ফুটপ্রিন্ট করতে থাকে। ভুবন সোম তাতে হাঁটেন। পরিত্যক্ত ভূত-বাংলোতে নিয়ে গিয়ে রাজা-রানির কিচ্ছা শোনায়। নদীর পাড়ে অজস্র পাখি দেখায়। এবং হাসে।

ভুবন সোম

ভুবন সোম বন্দুক চালান। কিন্তু গাছ সেজেও, পাখি মারতে পারা হয় না। কিন্তু, বন্দুকের শব্দে দুর্বলচিত্ত হইয়া একটা পাখি অতঃপর মাটিতে পড়ে।

মানে, বন্দুকের ন্যাচারাল স্ট্রিক্টনেস শিকারে শেষেতক কাজ করল না। করল শব্দ। করল আনএক্সপেক্টেড কিছু একটা।

***

মূল চরিত্র ছুটি কাটিয়ে শেষে নিজ কাজে ফিরে আসেন। একটু অন্য মানুষ হয়ে, আর অন্য মানুষ হওয়া নিয়ে একটু খুঁতখুঁত নিয়ে।

গৌরির বর, টিসি, পেটেলকে তিনি রিপোর্ট থেকে অতঃপর ছাড়ান দেন। আর শুধরে যেতে বলেন।

মানে পেটেলের চাকরি বেঁচে যায়। ট্রান্সফার হয় গৌরির নিকটবর্তী আরেক বড় স্টেশনে।

আর বড় স্টেশন মানে যাত্রী বেশি। আর যাত্রী বেশি মানে, ঘুষপানির পরিমাণ বেশি। পেটেল খুশি হয়।

করাপশন শেষ হয় না। সারল্য, কঠোর-নিঃসঙ্গ-পরাধীন নৈতিকতাকে একটু ভেঙে দেয়।

আর নিয়ম ভাঙা-স্বাধীনতার স্বাদ রিলিফের স্বাদ দেয়।

সবশেষে দেখায়, ভুবন সোম অফিসে পেটেলকে ছাড়ান দিয়ে একটা জংলী আনন্দ পেতে শুরু করেছেন। প্রথমবার।

তার চোখের সামনে ভাসে, গৌরী। পোষ্য ষাঁড়টা চড়ে মনের খেয়ালে হেঁসে গ্রামের ধূলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

***

ভুবন সোম-এর মিউজিক অনিন্দ্য। উৎকৃষ্টতম। করেছেন, বিজয় রাঘব রাও। ভুলে না যাওয়ার মতো ইনস্ট্রুমেন্টাল।

তবলা, সন্তুর, বাঁশির কম্বিনেশন, সাবজেকটের সঞ্চলনের সাথে ইনস্ট্রুমেন্টের সমবায়– যেমন, পাখির উড়ে চলা, ষাঁড়ের ছুট্, পানি বওয়া নারীদলের ছন্দ, গাড়োয়ানের গাড়িরচাকা, আর যা না বললেই নয়, তা, গৌরি আর তার পাওয়ের বিন্যাস।

সিনেমার বহির্ভূত আলাদা ভবে পরে খোঁজ করার মতো অর্কেস্ট্রা।
দারুণ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here