সাক্ষাৎকার: রায়ান মোট্টেশিয়ার্ড
অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী
সাক্ষাৎকারকের নোট
আমি যখন কিম কি-দুকের সঙ্গে তাঁর ছবি বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত… এবং বসন্ত [Spring, Summer, Fall, Winter… and Spring] নিয়ে কথা বলার জন্য প্রথম দেখা করি, আমি তাঁকে ঠিক এমনটা দেখতে পাব বলে আশা করিনি…। মানে, আমাদের মতোই স্বাভাবিক এক মানুষ হিসেবে তাকে দেখার প্রত্যাশা ছিল না।
যদিও কোরীয় সিনেমার এই বিদ্রোহী বা রাগী শিশুকে ঠিক কেমনটা দেখতে হবে এমন কোনো ধারণা আমার ছিল না; তাই বলে সামনে বসা এই মৃদুভাষী, ভদ্র, বিনয়ী, তারুণ্যদীপ্ত চেহারার ভদ্রলোকটি যিনি কি না আমায় তাঁর আগের সিনেমাগুলো দেখার জন্যও ধন্যবাদ জানাচ্ছেন (যেন আমি তাঁকে বড় কোনো উপকার করেছি)– তেমনটা আদৌ হবেন বলে ভাবিনি
হাজার হোক, ইনিই ত’ সেই ব্যক্তি যাঁর ২০০১ সালে বানানো সিনেমা মন্দ মানুষ-এ [Bad Guy] পতিতালয়ের এক দালাল যে কি না এক তরুণী ছাত্রীকে জোর করে ক্রিতদাসত্বে বন্দি করে তাকে দিয়ে পতিতাবৃত্তি করায় এবং পরিচালকের হাতে সেই ‘মন্দ মানুষ’টির চরিত্রের এক ধরনের সহানুভূতিশীল রূপায়ণ তাঁর নিজের দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় নারীবাদী সমালোচকদের কাছে কঠোর সমালোচনাও কুড়িয়েছে। এই একই ব্যক্তির হাতে বানানো ছবি দ্বীপ -এ [The Isle] আমরা দেখতে পাই একজন খুনী, একটি বোবা নারী ও মাছ ধরার বড়শির খুব চমকপ্রদ কিছু ব্যবহার।
তবে তারপর যে কথাটি থেকে যায় সেটা হলো, কিম ত’ এমনই। তাঁর সম্পর্কে আগে থেকে কিচ্ছু নিশ্চিত করে বলা যায় না। রীতিমতো যেন অনিচ্ছুকভাবে তিনি যখন সিনেমা সম্পর্কে কথা বলা শুরু করেন এবং জানান যে আমেরিকান সিনেমায় কাঁপন তোলা মাইকেল মুরকে তাঁর ভালো লাগে, তখন কিমের সূক্ষ্ম, প্রায় বিমূর্ত নানা সিনেমায় আধুনিক কোরিয়ার প্রান্তবাসী মানুষের জীবনের একদম মেরু বিপরীত মুরের ঠিক যেন হাতুড়ি দিয়ে সব গুঁড়িয়ে দেওয়া সম সিনে নির্মাণ কৌশলের ভেতর কোনো সঙ্গতি আপনি পাবেন না। হতে পারে যে প্রান্তিক জীবন থেকে মুর উঠে এসেছেন তাঁকে কিম সম্মান করেন, যেহেতু কিম নিজেও প্রথাগত বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবটি বরং তাঁর জামার আস্তিন গুটিয়ে বেশ জাঁকালোভাবেই প্রদর্শন করেন।

হাই স্কুলের পড়া শেষ না করা কিম ১৬-২০ বছর বয়স অবধি কারখানায় কাজ করেছেন। তারপর পাঁচ বছর কোরীয় সামরিক একাডেমিতে কাটিয়ে ফ্রান্সে গেছিলেন রাস্তায় ছবি আঁকার কাজ করতে। সিউলে ফিরে আসার পরেই কেবল সিনেমাকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেবার কথা ভাবতে থাকেন তিনি।
যাহোক, ইতোমধ্যে করা সিনেমাগুলোর তুলনায় কিমের বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরত, শীত…এবং বসন্ত তার এতদিনের কাজের গণ্ডি থেকে আরও বহু দূর প্রসারিত একটি পদক্ষেপ বলেই মনে হয়। যদিও আগের সিনেমাগুলোয় তাঁর কৃত ভিজ্যুয়াল এবং চিন্তাগত আগ্রহের জায়গাগুলো এই সিনেমায় তিনি পুরোপুরি বর্জন করেননি, তবু বসন্ত, গ্রীষ্ম… যেন আরও বেশি তুরীয় অনুভূতির জন্মদানকারী, এটা দর্শক হিসেবে আপনার মনে আরও অনেক বেশি সময় থেকে যাবে।
সিনেমাটির অত্যাশ্চর্য নান্দনিক সৌন্দর্য ত’ এর একটি বড় দিক বটেই। তবে এর আগের সিনেমাগুলোয় কিমের যে একটি সহজ যৌনতা ও সন্ত্রাস গুলে মলোটভ ককটেল বানানোর প্রবণতা দেখা গেছে যা বলতে গেলে চলচ্চিত্রকার হিসেবে কিমের ক্রাচের মতো ছিল, সেই প্রবণতা এই সিনেমায় তিনি অতিক্রম করতে পেরেছেন। এই সিনেমায় নতুন এক এলাকায় পা রাখা, অতীতে তাঁর বিতর্কিত ছবিগুলো এবং বর্তমান তপ্ত-লোহিত কোরীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে অনেক কথা হয় কিমের সঙ্গে।

বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত…এবং বসন্ত: আখ্যানরেখা
এই সিনেমার গল্পটি মূলত: এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাহিনি যে তাঁর জীবনের শৈশব থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত একটি বৌদ্ধ মন্দিরে কাটিয়েছে। সু ওহ-ইয়োং, কিম ইয়ং-মিন, সিও জে-কিয়ুং এবং কিম জং-হো অভিনীত এ সিনেমায় বৌদ্ধ ভিক্ষুর শেষ জীবনের চরিত্রে পরিচালক নিজেই অভিনয় করেছেন। পাঁচ পর্বে বিভক্ত এই ছবিতে প্রতিটি পর্ব কিশোর ভিক্ষু ও তাঁর শিক্ষক বা গুরুর জীবনের এক-একটি পর্ব তুলে ধরে। প্রতি দশ বা কুড়ি বছর পর আর একটি পর্ব বা অধ্যায় শুরু হয়।
বসন্ত
বৌদ্ধ নানা প্রতীকচিহ্নে আচ্ছন্ন এই ছবিতে দেখা যায় বালক ভিক্ষু তার শিক্ষকের সাথে জলের উপরে ভাসমান এক মন্দিরে বাস করে। কোরিয়ার অরণ্যঘেরা এক পাহাড়ের পাশে কোনো হ্রদে এই ভাসমান মন্দির। বালক ও তার শিক্ষক প্রার্থনা ও ধ্যানে দিন কাটায়, একটি পুরনো নৌকায় করে অনেক সময় হ্রদের ওপারে যায় হাঁটা, ব্যায়াম ও নানা লতা-পাতা সংগ্রহের জন্য। একদিন বালক ভিক্ষু একটি ছোট পাথরের গায়ে দড়ি দিয়ে একটি মাছ বেঁধে হাসতে থাকে, যেহেতু মাছটি সাঁতারের জন্য চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর একই নিষ্ঠুরতা সে একটি ব্যাঙ ও সাপের সাথেও করে।
একটু দূর থেকে বর্ষীয়ান ভিক্ষু সব দেখে একটি পাথরের উপর ঘুমিয়ে পড়া বালককে দড়ি দিয়ে পাথরের সাথে বেঁধে ফ্যালেন। বালকের ঘুম ভাঙলে ভিক্ষু তাকে বলেন মাছ, ব্যাঙ ও সাপটিকে ছেড়ে দিতে।

গ্রীষ্ম
বালক ভিক্ষু এখন কৈশোরে উপনীত। এক মা তার কিশোরী কন্যাকে নিয়ে এসেছে মেয়েটির আরোগ্য লাভের আশায়। মেয়েটির পরনে আধুনিক পোশাক বলে দেয় যে গল্পটি আধুনিক সময়েরই। মেয়েটি ও মেয়েটির মা বনপথে যখন বিহারের খোঁজ করতে থাকে, তখন কিশোর ভিক্ষু নীরবে তাদের স্বাগত জানায় ও নৌকা করে বিহারে নিয়ে যায়– যেখানে একটি উজ্জ্বল মোরগ দেখা যায়। বৌদ্ধ ধর্মে উজ্জ্বল মোরগ বাসনা ও আকাঙ্খার প্রতীক।
মেয়েটির অদ্ভুত এক জ্বর আছে এবং মা মেয়ের আরোগ্য প্রার্থনা করে। ভিক্ষু মেয়েটিকে রেখে মাকে চলে যেতে বলেন। মেয়েটি বিহারে থেকে যায় ও কিশোর ভিক্ষু তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। মেয়েটির প্রতি আকর্ষণ বোধ করলেও খুব লাজুক বলে কিশোর ভিক্ষু কিছু বলতে পারে না। তবে একদিন মেয়েটির নিদ্রিত অবস্থাতেই, বুদ্ধের বিগ্রহের সামনেই কিশোর ভিক্ষু তার স্তন মর্দন করে। মেয়েটি ঘুম ভেঙ্গে উঠে ছেলেটিকে চড় মারে। ভয়ে ও অপরাধবোধে ছেলেটি জোরে জোরে প্রার্থনা মন্ত্র আওড়াতে শুরু করে এবং সেটা শুনে বর্ষীয়ান ভিক্ষু অবাক হন। মেয়েটি কিশোরের কাঁধ ছুঁয়ে তাকে ক্ষমার ইঙ্গিত করে।
তিনি আরও বলেন, মেয়েটিকে এখন মন্দির ছেড়ে যেতে হবে। হতাশ কিশোর মেয়েটির পিছু পিছু রাতের বেলা দৌড়ায়। তার সাথে সেই উজ্জ্বল মোরগ ও বুদ্ধের একটি বিগ্রহ– যা প্রমাণ করে, সে একইসাথে পার্থিব বাসনা ও শিক্ষাগুরুর দীক্ষায় প্রভাবিত।
ধীরে ধীরে এই দুই কিশোর-কিশোরী বনে ঘুরে বেড়ায় ও দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। কয়েক রাত পরপর তারা দৈহিক প্রণয়ে লিপ্ত হয়; তবে বর্ষীয়ান ভিক্ষুর কাছ থেকে লুকোতে ওরা বনে পালিয়ে যায়। একদিন বর্ষীয়ান ভিক্ষু ওদের নগ্ন ও নিদ্রিত অবস্থায় হ্রদে ভাসমান নৌকায় আবিষ্কার করেন। ওদের ঘুম থেকে তুলে বকাবকি না করলেও শান্তভাবে বলেন যে, ‘কামনা অধিকারবোধের জন্ম দেয় এবং অধিকারবোধ ডেকে আনে হত্যা।’

শরৎ
বহু বছর পরে বয়সে ন্যূব্জ হতে থাকা বৃদ্ধ ভিক্ষু একটি স্থানীয় গ্রাম থেকে কাঁধের ঝোলায় একটি বিড়াল নিয়ে ফিরছেন। পূর্ব এশিয়ায় বিড়াল হলো গণিকাদের প্রিয় পোষা প্রাণী। বৃদ্ধ ভিক্ষুও কি তবে কামতাড়িত হয়েছিলেন, এমন এক ইঙ্গিত রয়ে যায়। তবে, কোরীয় লোককাহিনীতে বিড়ালকে মন্দ বা অশুভ তাড়ানোর প্রতীকও মনে করা হয়।
এরই ভেতর বৃদ্ধ ভিক্ষু সংবাদপত্রে তার অতীতের ছাত্রের হাতে স্ত্রী হত্যার খবর পড়েন। খুনিকে খোঁজা হচ্ছে। ছাত্রটি জীবনে বাঁচাতে এখানে আসবে বুঝে কিশোর ছাত্রের পরনের কাপড় তিনি সেলাই করতে থাকেন। এরই ভেতর যুবক ছাত্র এসে উপস্থিত হয়। ক্রুদ্ধ ছাত্রের হাতে রক্তাক্ত ছুরি। স্ত্রী অন্য কারও সাথে প্রেম করছে, এমন সন্দেহে তাকে সে খুন করেছে।
বর্ষীয়ান ভিক্ষু ছাত্রকে খুব পেটান এবং বলেন, সে যত সহজে তার বউকে খুন করেছে, ভিক্ষু সেটা করবেন না। রক্তাক্ত ছাত্রকে ঘরের সিলিংয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে দড়িতে মোমবাতির আগুন জ্বালিয়ে দেন এবং তারপর বিহারের বেদিতে ‘অন্তর সূত্র’ লেখা শুরু করেন। ধীরে ধীরে ছাত্রটি অনুতাপ বোধ করতে শুরু করে। খুনের তদন্তে দুই গোয়েন্দা এসে ছাত্রটিকে নিয়ে যায়।
নিজের জীবন শেষ হয়ে আসছে বুঝতে পেরে বর্ষীয়ান ভিক্ষু নৌকাতেই নিজের চিতা সাজান ও আত্মাহুতি দেন।
শীত
কারাগারে দীর্ঘ প্যারোল থেকে মুক্তি পেয়ে মধ্যবয়সী সেই ছাত্রটি শীতে বরফ জমাট হ্রদে আবার আসে। হ্রদের বরফজলে জমাট নৌকা থেকে মৃত শিক্ষকের দাঁত সে উদ্ধার করে। অনুতপ্ত এই হত্যাকারী কঠোর প্রায়শ্চিত্ত পর্ব শুরু করে। সেদিন রাতে এক নারী এসে এক পরিত্যক্ত শিশুকে রেখে চলে যাবার পথে বরফে জমে মারা যায়।
…এবং বসন্ত
পরিত্যক্ত শিশুটি এখন এক বালক এবং বৃদ্ধ শিক্ষক তাকে শিক্ষা দেন। বালকটি তবু একদিন দেখা যায় একটি কচ্ছপকে পীড়ন করছে। ঠিক আমাদের পুনরাবৃত্ত জীবনচক্রের মতোই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রদর্শনের সময় অবশ্য শেষ দৃশ্যটি বা ‘এবং বসন্ত’ অংশটি বাদ দেওয়া হয়।

সাক্ষাৎকার
রায়ান মোট্টেশিয়ার্ড :: বসন্ত, গ্রীষ্ম… আপনার অতীতের চিত্রভাষার সাথে আপনার বিচ্ছেদ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে, অথবা এটুকু বলা যায় যে আপনার কাজে এক নতুন পর্দার উন্মোচন হলো। আপনি কি এ কথার সাথে একমত?
কিম কি-দুক :: স্বীকার করি, এই সিনেমা আলাদা। আমার আগের সিনেমাগুলোয় প্রচুর নিষ্ঠুরতা এবং অন্তর্নিহিত ক্রোধ ছিল। তবে বসন্ত, গ্রীষ্ম… সিনেমায় আমি ক্ষমা ও সহনশীলতার উপশমকারী গুণের দিকটিই দেখাতে চেয়েছি।
রায়ান :: ভেতরের ঠিক কোন আবেগ আপনাকে এই সিনেমায় নতুন পথে চালিত করল?
কিম :: জানি না! আমার মনে হয় সেটাই বড় বিষয় যে আমার কোনো নির্দিষ্ট ভাবনা ছিল না। যখন প্রথমবারের মতো জুসান হৃদ দেখতে যাই [বসন্ত, গ্রীষ্ম…] ছবির লোকেশনের সেটিং, আমি সাথে সাথে কাগজে কয়েকটি চিন্তা লিখে ফেলি। তবে সিনেমাটি বানিয়েছিলাম কোন স্ক্রিপ্ট ছাড়াই।
রায়ান :: আপনার প্রতিটি সিনেমাতেই লোকেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ; তবে এই সিনেমায় জুসান হ্রদের ওপর এক ভাসমান বৌদ্ধ বিহার আপনার লোকেশন। কীভাবে এই জায়গাটা খুঁজে পেলেন অথবা আপনি জানতেন যে এমন একটি জায়গা আছে এবং একে কেন্দ্র করেই একটি গল্প তৈরি করলেন?
কিম :: শুরুতে আমার মাথায় জলে ভাসমান কোনো মন্দিরের কল্পনা ছিল না এবং তেমনটা আমি দেখিওনি। শুরুতে সিনেমার জন্য কোনো পাহাড়ের ওপরই একটি মন্দিরের সেট বানাতে চেয়েছিলাম; তবে তেমন ভালো কোনো জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কী করা যায়– ভাবতে ভাবতেই জুসান হ্রদের ওপরই ভাসমান মন্দিরটি বানাব বলে ভাবনা এলো।
কোরিয়ায় অনেক সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য আছে; তবে জুসান হ্রদ সত্যিই এক অনন্য জায়গা, যেহেতু এখানে জল থেকে জন্ম নেওয়া বা ভেসে ওঠা ৩০০ বছরের পুরনো গাছও রয়েছে। আর তখন আমার মনে হলো, একটি ভাসমান মন্দির গড়া বেশ দারুণ এক চ্যালেঞ্জ গ্রহণের কাজ হবে।
রায়ান :: মন্দিরটি এখনো আছে?
কিম :: না, শুটিংয়ের পরে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। তবে আশা করি, সিনেমাটি দেখার পর এই মন্দিরের ছবি দর্শকের মনে থেকে যাবে।
রায়ান :: আপনার সিনেমায় নির্দিষ্ট একটি লোকেশন বা স্থান কেমন ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন?
—
একটি যথাযথ লোকেশন খুঁজে পাবার পরই কেবল আমি উদ্দিষ্ট সিনেমার গল্পটি নিয়ে ভাবি
—
কিম :: আমার ত’ মনে হয় আমার সিনেমায় লোকেশন বা স্থান এবং পরিসর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটি যথাযথ লোকেশন খুঁজে পাবার পরই কেবল আমি উদ্দিষ্ট সিনেমার গল্পটি নিয়ে ভাবি বা একজন অভিনেতাকে কাজে নেবার কথা ভাবি। গোটা কোরিয়া আমি ঘুরে বেড়াই একটি নির্দিষ্ট স্থান খুঁজে পেতে এবং একবার খুঁজে পাবার পর, আমি আমার সিনেমা বানানোর কাজ শুরু করি।

রায়ান :: আপনাকে প্রায়ই এক ‘ভয়ানক শিশু’ বা উত্তেজনা সৃষ্টিকারী হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। আপনার নিজের কী ধারণা?
কিম :: আমি বুঝি, কেন মানুষ আমাকে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী বলে। তবে আমার মনে হয় মানুষ আমাকে ‘বহিরাগত’ ভাবে বলে এমনটি ভাবে। তারা যদি সত্যিই আমাকে এবং আমার সিনেমাগুলো দ্যাখে, তবে বুঝবে, উত্তেজনা সৃষ্টির বাইরে আরও কিছু বিষয় আমার ছবিতে আছে। আমি মানুষের বিষয়ে খুব আগ্রহী এবং একটি ভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে বিচিত্র ধরনের মানুষ দেখতে চাই। মানুষ যদি সত্যি সত্যি এগুলো দ্যাখে, তবে তারা আমার ভিন্নতর ভাবনাগুলো বুঝতে পারবে।
রায়ান :: তবু আপনার কিছু সিনেমা প্রায়ই বেশ বিতর্কিত হয়েছে। মন্দ মানুষ বিশেষ করে। আপনি কি কখনো টানা বিতর্ক সহ্য করেছেন?
—
আমি কখনো কিন্তু বিতর্কিত হবার চেষ্টা করিনি
—
কিম :: আমি কখনো কিন্তু বিতর্কিত হবার চেষ্টা করিনি। আমার ছবিগুলোকে ‘উত্তেজনা সৃষ্টিকারী’ বলা হয়েছে, তবে আমার সেরকম করার ইচ্ছা ছিল না। মন্দ মানুষ সিনেমায় যেমন, এটা আমার জন্য আদৌ ‘বিতর্কিত’ হবার মতো কিছু ছিল না। আমি খুব সততার সাথে সিনেমাটি বানাতে চেয়েছি, ঠিক যেমনটি আমি জানতাম।
মন্দ মানুষ-এ আমি একটি চরিত্র পরীক্ষা করতে চেয়েছি [এক বোবা, তবে নিষ্ঠুর বেশ্যাবাড়ির দালাল] এবং চেষ্টা করেছি তাকেও বুঝতে যে, সে আসলেই মন্দ ছিল কি ছিল না। মানুষ যদি এই সহজ সত্যটুকু মেনে নেয় যে, মন্দ মানুষ-এর মানুষটির মতো অনেক মানুষ আসলে আছে, শুধু তখন তারা এই সিনেমা বুঝতে পারবে। তবে নীতি নিয়ে যাদের ভাবনা খুব কঠোর, তারা এই সিনেমা ঘৃণা করবে।

রায়ান :: কোরীয় সংবাদপত্রে মন্দ মানুষ বিষয়ে তীব্র ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার পর আপনি বেশ কিছুদিন কোনো সাক্ষাৎকার দেননি। আপনার সিনেমার প্রতি কোরীয় ও আন্তর্জাতিক দর্শকের প্রতিক্রিয়ার ভিন্নতার কারণ কী?
কিম :: ইউরোপীয় দর্শক কিন্তু সত্যিই মন্দ মানুষ পছন্দ করেছে এবং কোরীয় জনতার মতো এতটা আহত তারা বোধ করেনি। তবে মজার বিষয় হলো, কোরিয়ায় নারী দর্শকেরা কিন্তু পুরুষ দর্শকদের চেয়ে এই ছবি ঢের বেশি পছন্দ করেছে। আমার মনে হয়, কোরীয় পুরুষ সিনেমার নাম চরিত্রে নিজের প্রতিফলন দেখতে পেয়েই এত ক্রুদ্ধ হয়েছে।
রায়ান :: বসন্ত, গ্রীষ্ম… কোরিয়ায় মানুষ কেমন নিয়েছে?
কিম :: কোরিয়ায় আমার কখনোই সত্যি বলতে তেমন বড় কোনো সাফল্য কখনো ছিল না। বসন্ত, গ্রীষ্ম… দেড় লাখ দর্শক টেনেছে [সাম্প্রতিক কোরীয় ব্লকবাস্টার ছবি সিলমিডো এক কোটি দর্শক ছাড়িয়েছে] এবং আমার সাম্প্রতিকতম ছবি সামারিতান গার্ল ইতোমধ্যে দুই লাখ দর্শক টেনেছে। তবে আমি মনে করি না কত মানুষ বসন্ত, গ্রীষ্ম… দেখেছে– সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়; বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো, কারা এটা দেখেছে। আমার কথা হলো, বরং কম মানুষ এই সিনেমা দেখুক, তবে দেখে যেন তারা বোঝে। উল্টো সিনেমাটি না বুঝে অনেক মানুষ দেখল, তার কোনো অর্থ নেই।
আমার কাছে আরও মজার বিষয় হলো, কোরীয় জনতা আমার সিনেমাগুলোর একটি অন্তত দেখবে এবং তারপর বাকিগুলো দেখতেও আঠার মতো এঁটে– যাবে যদিও তারা আমার সিনেমা পছন্দ করে না। যদিও অন্য কোরীয় সিনেমা পরিচালকদের চেয়ে আমিই অনেক বেশি দ্রুতগতিতে আন্তর্জাতিক সুনাম সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছি।
রায়ান :: গত কয়েক বছরে কোরীয় সিনেমা ঘরে বাইরে বেশ মনোযোগ পাচ্ছে। আপনার সতীর্থ নির্মাতা, যেমন পার্ক চ্যান-উক [জেএসএ, বুড়ো খোকা বা ওল্ড বয়] অথবা সান-উ জাংয়ের [মিথ্যা বা লাইস]– এদের সাথে কি কোনো আত্মীয়তা বোধ করেন?

কিম :: ঐ দুই পরিচালকের চেয়ে আমি একেবারেই আলাদা। হতে পারে ক্যারিয়ারের শুরুতে আমি ঐ আন্দোলনে তুলনামূলক বেশি সম্পৃক্ত ছিলাম; তবে বতর্মানে যেসব কোরীয় ছবি বানানো হচ্ছে, সেসবের সাথে নিজের কোনো আত্মীয়তা খুঁজে পাচ্ছি না।
রায়ান :: আপনার ছবিগুলো যেহেতু বেশি বিখ্যাত হয়েছে, আন্তর্জাতিক দর্শক কি আপনার সিনেমা নির্মাণ রীতিকে বেশি প্রভাবিত করেছে?
—
কখনোই ‘কোরীয় ছবি’ বানানোর কথা ভাবিনি
—
কিম :: এটা আমার দশম ছবি; তবে আমি কখনোই ‘কোরীয় ছবি’ বানানোর কথা ভাবিনি। বরাবরই আমার আন্তর্জাতিক সিনেমার সাথে পরিচয় ছিল এবং সম্ভবত সেজন্যই আমি অন্যান্য কোরীয় পরিচালকদের চেয়ে দ্রুতগতিতে খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।
রায়ান :: আপনার জীবনের প্রেক্ষিত চিন্তা করলে সিনেমা কিন্তু আপনার জন্য সবচেয়ে যৌক্তিক জায়গা নয়, যেহেতু আপনি আগে কারখানায় শ্রমিক হিসেবে এবং সৈনিক হিসেবেও কাজ করেছেন। ভেতরের ঠিক কোন তাগিদ আপনাকে সিনেমার দিকে টানল?
—
সিনেমা বিষয়ে কোনো শিক্ষা বা পড়াশোনা ছিল না বলেই আমি এত দ্রুত চলচ্চিত্রকার হতে পেরেছি
—
কিম :: এক সকালে ঘুম ভেঙ্গে আমার কেন জানি মনে হলো বা আমি স্পষ্ট করে বুঝতে পারলাম, সিনেমা নির্মাতা হব। কৌতুককর শোনালেও এটা সত্যি যে, সিনেমা বিষয়ে কোনো শিক্ষা বা পড়াশোনা ছিল না বলেই আমি এত দ্রুত চলচ্চিত্রকার হতে পেরেছি। কত মানুষ যে আছে, যারা কি না চলচ্চিত্রকার হবার জন্য কঠোর পড়াশোনা করে এবং হয়তো সেজন্যই বাস্তবে সিনেমাটা তারা আর বানাতে পারে না।
আমার মনে হয়, পরিচালক হলেন তিনি, যিনি জীবনকে সেলুলয়েডে বন্দী করেন এবং চলচ্চিত্রের ছাত্রের জীবনে প্রধানতম প্রতিবন্ধকতা হলো এটাই যে, সে সিনেমা পড়তে বিস্তর সময় খরচ করেছে, অথচ যথেষ্ট মাত্রায় জীবন পড়েনি।
রায়ান :: আপনার মতে কোরীয় ছবির এই পুনরুজ্জীবনের কারণ কী? ২০০৩-এ বৈশ্বিক প্রবণতা উপেক্ষা করে কোরিয়ায় সবচেয়ে বেশি দর্শকপ্রিয়তা পাওয়া ১০টি ছবির আটটিই দেশীয় ছবি ছিল।
কিম :: আমার মতে এর দুটো প্রধান কারণ আছে। প্রথমত, কোরিয়ার আছে দীর্ঘ সরকারি নিয়ম-কানুন ও সেন্সরশিপের ইতিহাস; আর এজন্য আমরা কিছু বিষয়ে খোলামেলা কাজ করতে পারিনি। এটা বরাবরই একটা প্রতিবন্ধকতা ছিল। কিন্ত এখন সবকিছু বদলে গেছে এবং পরিচালকরা স্বাধীনভাবে নিজেদের প্রকাশ করতে পারেন এবং নিজেদের অনবদ্য সব ভাবনার ছবি তাঁরা বানাতে পারেন।

এবং দ্বিতীয়ত, কোরিয়ায় প্রচুর ছাত্র আছে যারা ফিল্ম বা চলচ্চিত্র পড়েছে। এটা এখন রীতিমতো একটি জোয়ারের মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আমি মনে করি না, কোরীয় সিনেমা পৃথিবীর সেরা সিনেমা… অন্তত এখনো পর্যন্ত নয়।
হতে পারে লি চ্যাং-দংয়ের মতো একদম নতুন কৌশল ও প্রকরণে কোরীয় ছবি বানানোর মত দুয়েকজন পরিচালক তৈরি হচ্ছেন [২০০০২-এর মরুদ্যান বা ওয়েসিস]।
রায়ান :: পত্রিকায় পড়লাম, আপনি হলিউডে সিনেমা বানাতে আগ্রহী। এটা কি সত্যি?
কিম :: [হাসি] হ্যাঁ, আমি বলেছি সত্যিই। হলিউডে আমি মন্দ মানুষ বানাতে চাই এবং ব্র্যাড পিটকে চাই এই চরিত্রের রূপায়ণে। তবে আমার মনে হয় না হলিউড মন্দ মানুষ রিমেক করতে খুব আগ্রহী।
মূল লেখাটি ইন্ডিওয়্যার পত্রিকায় ইংরেজিতে ছাপা হয়েছিল