হাত ধরাধরি করে বেড়ে ওঠা ইরানি সিনেমা ও আব্বাস কিয়ারোস্তামি [৪/৬]

347
আব্বাস কিয়ারোস্তামি
তেহরানে থাকা কিয়ারোস্তামির একটি ভাস্কর্য অবলম্বনে

মূল: হামিদ দাবাশি ।। অনুবাদ: রুদ্র আরিফ

আগের কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন: প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তিতৃতীয় কিস্তি


কিস্তি-৪


জানুয়ারি ১৯৭৯, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে, শাহতন্ত্রের নিপাত চেয়ে বিপ্লবী জনতার বিক্ষোভ

বিপ্লবের দিনগুলো

১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯– এই সময়কালটি আধুনিক ইরানি ইতিহাসের বিধ্বংসী ঘটনাবলির একটি। সরকারবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে আজীবন সক্রিয় থাকা, শিয়াধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে, পাহলাভি-বিরোধী মনোভাব সমাজের সর্বস্তরে জমাট বাঁধতে থাকে।

১৯৭৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আয়াতোল্লাহ খোমেইনি নিজের ১৪ বছরের নির্বাসন জীবন থেকে ইরানে ফিরে আসেন বিজয়ীর বেশে। শাহ ইতোমধ্যেই দেশ ছেড়েছেন। তার প্রধানমন্ত্রী– শাপুর বখতিয়ারের কোনো অবস্থায়ই ছিল না পাহলাভি রাজশাসনের পরাজয় ঘটাতে আসা বৈপ্লবিক অগ্রগতিকে থামিয়ে দেওয়ার।

মার্চের ৩০ ও ৩১ তারিখে, খোমেইনি একটি জাতীয় গণভোটের নির্দেশ দেন– যেখানে অপ্রতিরোধ্যভাবে ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সরকারিভাবে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ শাসনব্যবস্থার পক্ষে রায় দেয়।

৪ নভেম্বর আন্দোলনরত ছাত্ররা আমেরিকান দূতাবাস দখল করে নেন, এবং আমেরিকান কূটনীতিক সৈন্যদের জিম্মি করে ফেলেন– এই সংকটটি ৪৪৪ দিন পর্যন্ত টিকে ছিল। ১৯৮১ সালের ১৯ জানুয়ারি যখন জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়, ধর্মীয় নেতৃত্ব সংস্থার প্রতিনিধিরা ততদিনে সংবিধানের খসড়া তৈরি করে তাতে অনুমোদনও দিয়ে ফেলেছেন।


হাজারও ইরানি বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী, এবং কোটি কোটি অন্যান্য ইরানির মতো, আব্বাস কিয়ারোস্তামিও ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অধীনে জীবনযাপন শুরু করেন

১৯৭৯ সালের ১৫ নভেম্বর, আরও হাজারও ইরানি বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী, এবং কোটি কোটি অন্যান্য ইরানির মতো, আব্বাস কিয়ারোস্তামিও ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অধীনে জীবনযাপন শুরু করেন।

ফার্স্ট কেস, সেকেন্ড কেস

ইরান যখন একটি প্রকাণ্ড বৈপ্লবিক উদ্দীপনায় আচ্ছাদিত, কিয়ারোস্তামি তখন একেবারেই ভিন্ন কিছু নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়েন। এ সময় নির্মিত ফার্স্ট কেস, সেকেন্ড কেস ফিল্মটিতে তার নিরীক্ষার বিষয় ছিল– গোপনীয়তা, দায়বদ্ধতা ও মর্যাদার বিষয়গুলোর সঙ্গে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা কীভাবে বোঝাপড়া করে। শ্রেণিকক্ষের শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে, সাতজন অল্পবয়সী বালককে বহিষ্কার করে দেয় তাদের শিক্ষক। নিজেদের বন্ধুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে অস্বীকার করেছিল ছয়টি নিষ্পাপ বালক; এবং পারস্পরিক আস্থার প্রতি মর্যাদা রেখে তারা সবাই মাথা পেতে নিয়েছিল শাস্তি।

একদল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে এই ঘটনার একটি ভিডিও দেখিয়ে, তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন কিয়ারোস্তামি। ক্লাস থেকে এক সপ্তাহ বহিষ্কৃত থাকার পর, এই বালকদের একজন তাদের বন্ধুটির কথা বলেছিল। প্রাপ্তবয়স্কদের সেই দলটিকে বলা হয়েছিল এ ঘটনার প্রতিফলন ঘটাতে।


নিষ্পাপ মহানুভবতাকে সমষ্টিগত বিচক্ষণতার মধ্যে নৈতিক রূপান্তর ঘটানোর ক্ষেত্রে, ‘পার্থক্য’ সবসময়ই একটি সাবটেক্সচুয়াল কিয়ারোস্তামিধর্মী নিরূপন হিসেবে ভূমিকা পালন করে

আদর্শমূলক ‘মহানুভব মিথ্যে’ স্বভাবের নানা তারতম্যের ওপর নির্মিত এই ফিল্মটি ন্যারেটিভ এনার্জি ধরে রেখে মর্যাদা সৃষ্টির তারুণ্যদীপ্ত ধারণাগুলোর মহানুভবতার ওপর নিরীক্ষা চালিয়েছে। সঙ্গতির একটি অব্যক্তবোধ যেখানে সাত বালককে একত্রে বেঁধে নিয়েছিল; সেখানে প্রাপ্তবয়স্করা নিঃশর্ত অত্যাবশ্যকতার ভিত্তিতে সেটি দেখাতে পারেনি, বরং একে অন্যকে দোষারোপ করেছে। নিষ্পাপ মহানুভবতাকে সমষ্টিগত বিচক্ষণতার মধ্যে নৈতিক রূপান্তর ঘটানোর ক্ষেত্রে, ‘পার্থক্য’ সবসময়ই একটি সাবটেক্সচুয়াল কিয়ারোস্তামিধর্মী নিরূপন হিসেবে ভূমিকা পালন করে।

এটি হলো সময় ও স্থানকালের ভেতর দিয়ে ন্যায়বোধের একটি ঐতিহাসিক সামঞ্জস্যবিধানে তখন পর্যন্ত হওয়া সবচেয়ে বিধ্বংসী মধ্যস্থতাকারীগুলোর একটি। একটি আলাদা ধরনের ‘নৈতিকতা’, একটি ‘প্রতি- নৈতিকতা’র আবির্ভাব ঘটে এখানে– যা কোনো বিমূর্ত নৈতিক শর্তাবলির মধ্যে নয়, বরং ঘটনাটির নিজস্ব বাস্তবতার ভেতর সম্পূর্ণভাবে আপেক্ষিক। প্রি-থিওরিটিক্যাল বা প্রাক-তাত্ত্বিক মুহূর্তটির ওপর এই যে অধিষ্ঠান– এটি কিয়ারোস্তামির সিনেমায় ধ্রুবসত্য হিসেবে বজায় থেকেছে।

এই প্রাক-তাত্ত্বিক মুহূর্তটির মধ্যে, বাস্তবতা এটির নিজস্ব সঙ্গতির রূপ ও রীতিনীতিকে জ্ঞাপন করে। মেটাফিজিক্সের ভায়োলেন্সের এমনতর শান্তিপূর্ণ ও দমিত ক্ষয়সাধনের মধ্য দিয়ে, কিয়ারোস্তামি ধীরে ধীরে এমন একটি কাউন্টারকালচারের প্রতিষ্ঠা করেছেন– যেটির মধ্যে কোনোরকম অমার্জিত আন্দাজের প্রতি নির্দোষ বাস্তবতার অন্যতর অনিবার্য অঙ্গীকার ছাড়াই কোনো জিনিসের তাৎক্ষণিক তাৎপর্য ও গুরুত্ব পাওয়া যায়।

ফার্স্ট কেস, সেকেন্ড কেস

১৯৮০ দশক

ইসলামি বিপ্লবের জাগরণে এই ভূখণ্ডটির মেজাজ কেমন ছিল, তা ১৯৭৮ সালের শরৎকালে লেখা, প্রথিতযশা কবি আলী মুসাভি গারমারুদির দ্য টাইম ইজ শর্ট কবিতা থেকেই টের পাওয়া সম্ভব :

সময় বেশি নেই।
চলে যেতে হবে আমাদের।
বলতে হবে– হ্যালো–
বৃক্ষসকলকে–
এক এক করে।

থাকতে হবে জেগে আমাদের :
পৃথিবীর সকল
ঝর্ণাধারার গিয়ে পাশে,
আর, ওদের শুদ্ধতার আয়নায়
ফেলতে হবে ধুয়ে– নিজেদের মুখ।

উঠে দাঁড়াতে হবে আমাদের।
করতে হবে প্রার্থনা
সমুদ্রের ঢেউয়ের উচ্চতায় দাঁড়িয়ে।

আমাদের নিতে হবে নিরহঙ্কার হওয়ার পাঠ;
আর সারাটা রাত–
কাটাতে হবে শামুকের পরিমিত খোলসে।

ঝিনুকের অন্তস্তলে, গোপনে যেতে হবে নেমে
আমাদের; আর
সইতে হবে নিজস্ব নিঃসঙ্গতা–
মুক্তার ঝিকিমিকির ভেতর।

কাফেলার নেতাদের পায়ে পায়ে
যেতে হবে আমাদের;
আকণ্ঠ নিতে হবে গিলে–
মরুদ্যানের রাত।

চুমু খেতে হবে আমাদের–
লাখ লাখ জমাটবদ্ধ হাতে–
ইটের কারখানাগুলোয়
মাটির নম্রতা নিয়ে।
সময় খুবই কম।

আমাদের যেতে হবে চলে।
আমাদের ফেলতে হবে পিষে–
সিল্ক রোডের ওপরে থাকা
হাজারও জোঁক।
ধানের জমিনে ভরে থাকা সব জোঁক–
হবে ফেলতে বেছে আমাদের।

সবকিছু ফেলতে হবে করে আমাদের
একবারে, একেবারেই;
ফিরে এসে সাজাতে হবে–
বাগানের চারপাশের বেড়ার খুঁটি,
আর
কুড়োতে হবে পড়ে যাওয়া টাটকা আখরোট।

আমাদের রু’তে হবে গাছ।
সবজির বাগানটা বাড়িয়ে নিতে হবে আরও।
আর ফেলে দিতে হবে ছুড়ে– মার্বেলের জাদু।

আমাদের শিখতে হবে
কী করে ওড়া যেতে পারে–
পরিযায়ী পাখির কাছ থেকে,
রবিন পাখির কাছ থেকে
শিখতে হবে আমাদের।

জগতের সকল বিজয়ীর হেলমেট থেকে–
সারস পাখির শোভাবর্ধক পাখনা
নিতে হবে খুলে আমাদের;
আর সেটি দিয়ে হবে লিখতে নতুন করে–
ভালো একটা বই।

ঘৃণার বর্জ্য আর থুতুর শ্লেষ্মায় ভরা
অগুনতি মাথা ফেলতে হবে কেটে আমাদের;
দিতে হবে ফেলে লেট্রিনে।

খুব ভোরের আটকে আসা গলায়–
কাঁদতে কাঁদতে–
চালাতে হবে এক অপারেশন, আমাদের।

খুব ভোরটাকে আমাদের পাঠাতে হবে
আফ্রিকায়; আর সাদা চামড়ার লোকগুলোকে
করতে হবে বাধ্য–
যেতে নির্বাসনে।

সময় খুব কম।
যেতে হবে আমাদের।

হিংস্র সময়। এ এক প্রকট প্রতিশ্রুতির সময়। আত্মারা বিক্ষুব্ধ সব। পুরুষেরা অস্ত্রসজ্জিত। নারীরা আতঙ্কগ্রস্ত। নৃশংসতা উন্মত্তভাবে সর্বত্র বিরাজমান। পুরো জাতিই নিজ জখমে উন্মুক্ত। প্রতিশোধ তো দৈনন্দিন রুটিন। তত্ত্ববধায়কেরা এক হাতে তরবারি আর আরেক হাতে ধর্মগ্রন্থ ধরে আছেন চরম আতঙ্কে। পুরুষেরা কথা বলছেন স্রষ্টার প্রতিনিধি হয়ে যেন! এ রকম অবাধ উন্মত্ততার ভেতর, কিয়ারোস্তামির মতো মানুষ, কী করে দাঁতব্যথার কথা ভাবতে পারেন?

টুথেক
টুথেক

টুথেক-এ কিয়ারোস্তামি বেদনার একটি আয়রনিক পাঠের এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছেন। বালক মোহাম্মদ রেজার দাদা ও বাবা দীর্ঘকাল দাঁতব্যথায় ভোগার পর সদ্যই দাঁতের পাটি বাঁধানোর সুবিধা উপভোগ করতে শুরু করেছে; অথচ বালকটির শুরু হয়ে গেছে তীব্র দাঁতব্যথার রোগ! এই অজুহাতে স্কুল থেকে ছুটি পায় সে; তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। সেখানে তাকে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেয় জনৈক দন্ত-বিজ্ঞানী।

বাবা ও দাদার দাঁতের পাটি বাঁধানোর সুবিধাটি এই বালকের দাঁতব্যথাকে যথেষ্ট প্যারাডক্সিক্যাল করে তুলেছে। একজোড়া ছোট, বাঁধানো দাঁতের পাটি পেলে কি সে আরেকটু বেশি স্বস্তিবোধ করবে না?

ফিল্মটির ন্যারেটিভও বানানো-বাস্তবতার [বাঁধানো দাঁতের পাটি] সঙ্গে বাস্তবতার [দাঁত] সম্পর্কটিকে একটি টিপিক্যাল কিয়ারোস্তামিধর্মী প্রবণতায় চালিত করেছে। এখানে শৈল্পিকভাবে পুনঃসৃষ্টিকৃত বানোয়াট-বিশ্বাসটি [বাঁধানো দাঁতের পাটি] প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টিকৃত বাস্তবতার [দাঁত] ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে।

টুথেক নির্মাণ করা হয়েছিল কানুন-এর জন্য; এবং মুখের স্বাস্থ্যবিধির সুবিধাগুলো সম্পর্কে শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশে এই ডকুমেন্টারিটি দেশের সব প্রান্তেই প্রচার করা হয়। দাঁতের মধ্যে নোংরা খেলায় মেতে আছে পুচকে শয়তানগুলো– এ রকম চার্ট ও কার্টুনও রয়েছে ফিল্মটিতে; এবং বেচারা বালকটি যখন হাত নেড়ে ব্যথার প্রতিক্রিয়া জানায়, মুখের অভ্যন্তরের স্বাস্থ্যবিধির সুবিধাগুলো তখন উন্নাসিক সিরিয়াসনেস নিয়ে ব্যাখ্যা করতে থাকে হাসপাতালটির চিফ ডেন্টিস্ট।

টুথেক

দেশের বাদবাকি অংশ হয়তো বিপ্লব নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল; কিন্তু কিয়ারোস্তামির জগত, প্রাকৃতিক দাঁতের বেদনাগুলোকে পর্যবেক্ষণ ও বিপরীতধর্মী করে তুলে, এক সেট বাঁধানো দাঁতের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পাটিকে তখন খেয়ালিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলতে মগ্ন। এর কারণ কী?

জনৈক মধ্যযুগীয় ক্যালিগ্রাফারকে নিয়ে একটি গল্প রয়েছে– যার বাস ছিল শিরাজ শহরে। একদিন ভয়ানক এক ভূমিকম্প পুরো শহরটিকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। ভূকম্পন থেমে যাওয়ার পর, সুবিস্তৃত ধ্বংসলীলা স্পষ্ট হয়ে ওঠে; আর ক্যালিগ্রাফারের খোঁজ নিতে হাজির হন তার প্রতিবেশীরা। তারা তার বাড়িতে গিয়ে দেখেন, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সেটি।

বহুকষ্টে সব ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে, তাকে খুঁজতে থাকেন তারা। পুরো বাড়িটির প্রতিটি ইট-পাথর সরিয়ে দেখার পরে, জীবনের কোনো চিহ্নের প্রত্যাশায় বেসমেন্টের দিকে ছুটে যান প্রতিবেশীরা। বেসমেন্টের গভীরে, একটি কোণায়, ধ্বংসাবশেষের ভেতর তারা দেখতে পান– লোকটি হাতে রিড-পেন ও কালি নিয়ে, এক টুকরো কাগজের ওপর নিজ কাজে মগ্ন।

তারা জানতে চাইলেন, ‘আপনি ঠিক আছেন তো?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘এন অক্ষরটি দেখুন একেবারেই নিখুঁতভাবে লিখতে পেরেছি আমি। এর চেয়ে নিখুঁতভাবে আর কেউ কখনোই এন লিখতে পারেনি!’

বাস্তবতার এমনতর পুনঃখড়সাকরণেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন কিয়ারোস্তামি; বিপ্লবের সকল বেদনা ও প্রতিশ্রুতির ভেতর কীভাবে বেঁচে থাকার একটি পথের নকশা ভিন্নভাবে করে তোলা যায়– সেদিকেই ছিল তার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। বিপ্লবটির প্রতিশ্রুতি কী ছিল? কতটুকুই অর্জন করতে পেরেছে সেটি? আধুনিকতা ও নব্য-ঔপনিবেশিকতার বিপজ্জনক অবস্থানসমূহ, এবং সেগুলোর প্রতি ‘ইসলামের’ তীক্ষ্ণ জবাব ইরানের কোন জায়গাটিতে জায়গা করে নিতে পেরেছে?


তার সিনেমা হলো পৃথিবীর বুকে জীবনের একটি অন্তর্দর্শন– তা একেবারেই নিশ্চিতভাবে বাস্তবতার ভেতরে নশ্বরতার একটি উদযাপন, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াকে আলিঙ্গনের একটি উৎসব

কিয়ারোস্তামির এজেন্ডা একেবারেই আলাদা ধরনের ছিল; এ ছিল মৃত্যু ও অস্বীকৃতির, মেটাফিজিক্স ও মিস্টিসিজম, আড়ালপনা ও সন্দেহের সংস্কৃতির ধারণকৃত ম্যান্ডেটগুলোর থেকে মুক্তির এজেন্ডা। তার সিনেমা হলো পৃথিবীর বুকে জীবনের একটি অন্তর্দর্শন– তা একেবারেই নিশ্চিতভাবে বাস্তবতার ভেতরে নশ্বরতার একটি উদযাপন, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াকে আলিঙ্গনের একটি উৎসব।

চলুন, এবার তার বাকি গল্পের কাছে ফেরা যাক।

কিয়ারোস্তামির সবচেয়ে বিধ্বংসী শর্টফিল্মগুলোর একটি– অর্ডারলি অর ডিসঅর্ডারলি। এই ফিল্মে একটি সাদামাটা অনুশীলনের সুস্থির চেহারার মধ্য দিয়ে, আনুগত্যের কর্তৃত্বপরায়ণ উপাদানগুলোর গভীরতা ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে। কয়েক জোড়া অভিনেতার একগুচ্ছ শর্ট-স্কেচ পারফর্মের ভেতর দিয়ে, কিয়ারোস্তামি ‘অর্ডার’ বা শৃঙ্খলার উদ্ভটত্বগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে ফিল্মের কলা-কুশলীরা শৃঙ্খলার বিন্যাস ঘটানোর চেষ্টা করতে গিয়ে যথেষ্ট ভুগেছেন। ‘ডিসঅর্ডার’ বা বিশৃঙ্খলা অবশ্য কোনো ‘অর্ডিনারি’ মানুষের গোছানো হওয়ার দক্ষতা ও কল্পনাশক্তিকে উপেক্ষা করেছে। শৃঙ্খলাবদ্ধতা, সুবিন্যস্ততা, সমন্বয়, উপস্থাপনাকে উপেক্ষা করতে প্রভাব ফেলেছে ডিসঅর্ডার।

অর্ডারলি অর ডিসঅর্ডারলি

আনুগত্যের কোনো গ্রহণকৃত নমুনা যদি আদৌ থেকে থাকে, তাহলে সেগুলোর কীভাবে বিনাশ ঘটানো সম্ভব; কিংবা, আরও গুরুতরভাবে বললে, শিল্প কীভাবে বিধ্বংসী হয়ে ওঠতে পারে– সেই প্রশ্ন এই চমৎকার ফিল্মটি গভীরভাবে জাহির করেছে। বিধ্বংসী হয়ে ওঠতে হলে, অদৃশ্যমানতার মধ্যে শিল্পের ভেঙে পড়া ঠিক নয়; তাই আমরা সবসময়ই এমন একটি সন্দেহের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকি যে, কিয়ারোস্তামির প্যারাডক্স ও পরিহাসবোধ আবার তাকে নৈরাশ্যবাদ ও আশাহীনতার দিকে ধাবিত না করে!

তার পরবর্তীকালের ফিল্মগুলোতে এ বিষয়টি যথেষ্ট স্পষ্ট যে, নৈরাশ্যের প্রতি জীবনের সত্যায়ন ও উচ্ছ্বাসমুখরতার যথেষ্ট বোধ তিনি ছুড়ে দিয়েছেন। তবে তার কাজের মধ্যে এমন সব মুহূর্তও রয়েছে, যার মাধ্যমে একেবারেই নৈরাশ্যের একটি বোধের চারপাশে পরিহাসের সীমারেখা টেনে দিয়েছেন তিনি।

দ্য কোরাস-এ তিনি এমন এক বুড়োকে ফুটিয়ে তুলেছেন, যে শুনতে পায় না। বাড়ি ফেরার পথে, রাস্তাঘাটের সোরগোল তার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে; ফলে নিজের হেয়ারিং-এইড যন্ত্রটি খুলে রাখে সে। এভাবে সে স্বর্গীয় নৈঃশব্দের ভেতর বাড়ি ফেরে। এরপর স্কুল থেকে তার নাতনি বাড়ি ফিরে, ডোরবেল বাজাতে থাকে এ আশায়– নিশ্চয়ই দাদা দরজা খুলে দেবে। শেষ পর্যন্ত মেয়েটির স্কুলের সহপাঠিনীরা কোরাস গাইতে শুরু করে– বুড়ো লোকটিকে সজাগ করার জন্য।

দ্য কোরাস

এখানে হেয়ারিং-এইডটি একটি প্রতীক হিসেবে টুথেক-এর বাঁধানো দাঁতের পাটির কথা মনে করিয়ে দেয় আমাদের : অর্থাৎ, বাস্তব জিনিসের প্রতিস্থাপন হিসেবে কোনো সাজানো বাস্তবতার হাজিরা। কিন্তু এই একই যন্ত্রটি এই বুড়ো লোকটিকে নিজের নাতনির বাড়ি ফেরার শব্দ কিংবা ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে রাগ ও উৎকণ্ঠায় গাওয়া মেয়েটি ও তার বান্ধবীদের গান শুনতে সাহায্য করতে পারত।

শিল্প যেহেতু এক ধরনের নির্মাণ; ফলে সাজানো বাস্তবতা হলো বাস্তবতার ধরনকে উপলব্ধি করতে পারার নিরীক্ষামূলক তাৎপর্য। আমরা সাধারণভাবে যেটিকে বাস্তবতার ‘নেচার’ বা ‘ধরন’ বলে ডাকি, সেটি আমাদের পর্যবেক্ষণের থিমেটাইজড অবজেক্ট– যে অবজেক্টগুলো বোধগম্য হওয়ার মতো করে পরিমার্জিত।

শিল্প যেহেতু বাস্তবতার গুণপরিবর্তন ও থিম-বদল করে; ফলে এই মার্জিতরূপ ও থিমেটাইজেশন গভীরভাবে স্বতঃসিদ্ধ হয়ে ওঠে। আর তাই এই ডিথিমেটাইজড ও ডিনেচারডের কারণে, বাস্তবতা নিজের মেটাফিজিক্যাল ফাউন্ডেশনের হাজিরা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রকাশ করতে পারে; আর সেই একই থিমেটাইজড বাস্তবতার অংশ হিসেবে আমাদের গুণের মাধ্যমে নিজেদের চোখের দেখা থেকে গোপন থাকা বাস্তবতার সাধারণত একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে এটি।

‘বাস্তবতা’র গুণপরিবর্তনের এই কৌশলের মধ্য দিয়ে, কিয়ারোস্তামি থিমেটাইজড বাস্তবতাকে কমিকের মতোই উদ্বেগ-জাগানিয়া হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তেহরান ট্রাফিকের একটি বিদ্রূপাত্মক পাঠ হিসেবে, ফেলো সিটিজেন ফিল্মটি, মুভিং বক্সগুলোর ভেতর নিজেদের লুকিয়ে রাখার কথা কল্পনা করা মানুষগুলোর মধ্য দিয়ে, মানব-সম্পর্কগুলোর ধরনের ওপর একটি অভিযাত্রিক প্রতিফলন ফেলেছে।

ফেলো সিটিজেন

বরাবরের মতোই, এই চমৎকার কাজটি সামাজিক মিথষ্ক্রিয়াগুলোর সেই ধরন, ফাংশন, ও চিরপরিবর্তনশীল উত্তেজনার ওপর প্যারাডকুমেন্টারি পরীক্ষণ চালিয়েছে– যেখানে নৈরাজ্যের মতো আপাদমস্তক ভেঙ্গে পড়ার সামাজিক কর্মপ্রক্রিয়ায় মানুষ কীভাবে একটি বিধ্বংসী পরীক্ষার বিষয় হয়ে ওঠতে পারে– সেটি সহজেই টের পাওয়া সম্ভব। একটি মুভিং বক্সের উপস্থিতিটি জনতার একের অন্যকে দেখার পরিপূর্ণ ভিউ বাধাগ্রস্ত করে; ফলে এটি সহজেই সেই নৈরাজ্য ও সন্দেহের দিকে তাদের ঠেলে নিয়ে যায়– যেন সামাজিক যোগাযোগ সৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা কখনোই নেই।

দার্শনিক এমিল চ্যোরান যদিও সামাজিক ঐকমত্যের সম্ভাবনাহীনতার একটি হতবুদ্ধিকর আতঙ্কে চিরন্তর ভুগতেন; কিন্তু কিয়ারোস্তামি তার মতো ছিলেন না, বরং এটির পুরোদস্তুর উপস্থিতির দিকে হাসি ছুড়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন তিনি। বিশেষ করে, এটি যখন ‘সোশ্যাল রিয়েলিটি’ বা ‘সমাজ-বাস্তবতা’র মধ্যে চলে আসে, তখন আমরা দেখতে পাই ‘প্রকৃতি’ ও ‘শিল্পের’ মধ্যকার পার্থক্যটির সম্পূর্ণ বিনাশ হয়ে যাওয়া; যা অন্তত এরিস্টটলের সূত্রমতে, আমরা নিরপেক্ষভাবেই গ্রহণ করে নিই।

এরিস্টটল তার মেটাফিজিক্স গ্রন্থে লিখেছেন, ‘কোনোকিছুর রূপান্তর ঘটে হয় শিল্পের মাধ্যমে, নয়তো প্রকৃতির মাধ্যমে, নয়তো ভাগ্যক্রমে, নয়তো স্বতঃস্ফূর্তভাবে।’ ‘ভাগ্য’ ও ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’ শেষ পর্যন্ত প্রকৃতি ও শিল্পের মধ্যে ভেঙ্গে পড়ে; কেননা, এরিস্টটল এ কথাও বলেছেন, ‘কোনোকিছুর প্রকৃতির কাছে মুভ করার ক্ষেত্রে সে জিনিসটির নিজের একটি মূলতত্ত্ব হয়ে ওঠার চেয়ে,… এবং এ দুটির [বস্তু ও শিল্প] অন্য কোনো ক্লেশের চেয়ে, বরং অন্য কোনোকিছুর মধ্যে মুভমেন্ট করার একটি মূলতত্ত্ব হলো শিল্প।’


‘বাস্তবতা’র একটি নন্দনতাত্ত্বিক ডিথিমেটাইজেশনের মাধ্যমে, কিয়ারোস্তামি নিরবচ্ছিন্নভাবে ‘প্রকৃতির’ শেকড়ে গভীরতর মেটাফিজিক্যাল পূর্বানুমানকে ফুটিয়ে তুলে গেছেন

‘বাস্তবতা’র একটি নন্দনতাত্ত্বিক ডিথিমেটাইজেশনের মাধ্যমে, কিয়ারোস্তামি নিরবচ্ছিন্নভাবে ‘প্রকৃতির’ শেকড়ে গভীরতর মেটাফিজিক্যাল পূর্বানুমানকে ফুটিয়ে তুলে গেছেন। ফলে ‘প্রকৃতির’ আবির্ভাব ঘটেছে যে কোনো অনুসন্ধিৎসু উপদ্রবকে ছাড়িয়ে যাওয়া সবচেয়ে সফল রকমের থিমেটাইজড বাস্তবতার ধারণা হিসেবে।

ইসলামি বিপ্লবের চার বছর পর নির্মিত ফেলো সিটিজেন-এর পক্ষে একটি রাজনৈতিক রূপকধর্মিতা হয়ে ওঠার খুব সহজ সম্ভাবনা ছিল। অন্য যে কোনো ফিল্মমেকারের পক্ষে এ রকম প্রলোভনের মধ্যে ডুবে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। কিন্তু কিয়ারোস্তামির সিনেমার ধরনটি সহজ-সরল রূপকধর্মিতাকে উপেক্ষা করে। একটি ট্রাফিক জ্যামে এই সামাজিক ক্রিয়াকলাপ ও গুপ্ত আবেগপ্রবণতার উদ্ভট জনসমাগমটি খোমেইনির ব্যানারের নিচে জড়ো হতে থাকা বৈপ্লবিক আমজনতার সমাজ-মনস্তাত্ত্বিকতার সঙ্গে অতিশয় সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে ধরা দেয়। কিন্তু কিয়ারোস্তামির বিনম্র ও কমিক ক্যামেরা, এ ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লেষগুলোকে আয়ত্বের বাইরে চলে যাওয়ার ও বাস্তবতাগুলোকে বিশিষ্ট হয়ে ওঠার কোনো সুযোগ দেয়নি।

বৈপ্লবিক জনসমাগমের সমাজ- মনস্তাত্ত্বিকতার সঙ্গে এই ট্রাফিক জ্যামের যদি কোনো মিল থাকে, তা শেষ পর্যন্ত সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের একান্ত স্বভাবের প্রতিই অধিকতর বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য জাহির করেছে। কিয়ারোস্তামিকে রাজনৈতিকভাবে পাঠ করতে চাওয়ার প্রলোভনটি তার ফার্স্ট গ্রেডারস ফিল্মে সমান শক্তিধর হয়ে আছে। যারা বিপ্লবকে নিজেদের সম্পত্তি ভেবেছিলেন, অথচ এ সময়ে এসে তাদের বিপজ্জনক রাজনৈতিক অবস্থার জন্য সিআইএ, জেজিবি [সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান সিকিউরিটি এজেন্সি], মোসাদ [ইসরাইলের ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি] ও ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স সার্ভিসের সকল পদক্ষেপ ও কর্মকর্তাকে দায়ী করেন এই উল্টো অথচ সুতীব্র ক্রোধ নিয়ে– এমনতর ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের সাহস-হারানোর আত্মা-অনুসন্ধানের সময়কালটিতে ফিল্মটি মুক্তি পায়।

ফার্স্ট গ্রেডারস

ফার্স্ট গ্রেডারস-এ আমরা একদল কচি শিক্ষার্থীর দেখা পাই, যাদের কোনো এক কারণে, ক্লাস পণ্ড করার দায়ে স্কুলের প্রিন্সিপালের কাছে পাঠানো হয়। প্রথমে তারা অপকর্মের কোনো দায় নিতে রাজি হয় না; কিন্তু প্রিন্সিপালের বিরামহীন প্রশ্নবান শেষ পর্যন্ত অপরাধ স্বীকার করতে বাধ্য করে তাদের। বিশৃঙ্খলা, ভাঙচুর, অস্বীকার, প্রশ্নবান, ও দোষ-স্বীকারের এই দৃশ্যগুলো স্কুলটির মর্নিং এক্সারসাইজের দৃশ্যগুলোর মধ্যে সুশৃঙ্খলভাবে ধারাবাহিকভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

ভাঙচুরের বিশৃঙ্খলা, কিংবা শৃঙ্খলা ফেরানো– কোনোটির প্রতিই সমবেদনা দেখায়নি ক্যামেরা। বরং মনে হয়েছে, অস্বীকারের ধরন ও স্বীকারোক্তির প্রক্রিয়ার প্রতিই কিয়ারোস্তামি বিশেষ মনোযোগী।

১৯৮০ দশকের মধ্যভাগে, ইরানি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনেক বেশি রূঢ় বাস্তবতায় ছেয়ে যায়। ইরান-ইরাক যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠলে, উভয় জাতির সর্বনাশা সময় ঘনিয়ে আসে। ইরানে ধর্মশাসনের রাজত্ব পুরোপুরি দোলে ওঠে এ সময়। আমেরিকান জিম্মি সংকট ও ইরান-ইরাক যুদ্ধের ছায়াতলে, ইসলামি বিপ্লবের আদর্শগুলো এমন একটি সংবিধানের অনুমোদন দেয়– যার মাধ্যমে নাগরিক সমাজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পুরোদস্তুর অন্তর্ভুক্তি ঘটে যায় রাষ্ট্রটির রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে। নাগরিক স্বাধীনতাগুলো ধারাক্রমে ও সাংবিধানিকভাবে নির্মূল করা হয়।

নিরীহ মানুষের ওপর আক্রমণের ও একটি মধ্যযুগীয় বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়ার কাজে সরকারিভাবে গুণ্ডা ও দুর্বৃত্ত নিয়োগ দেয় ইসলামি প্রজাতন্ত্র সরকার। মোজাহেদিন-ই খালক [ইরানি মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক-সংগ্রামী সংগঠন] সংস্থাটির বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকা-ের একটি পারম্পর্য এই ইসলামি প্রজাতন্ত্রের খুঁটি নাড়িয়ে দেয়। এর বদলা নিতে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র শুধু মোজাহেদিনকেই নয়, অন্য সকল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিজেদের সন্ত্রাসনীতির জোরে নৃশংসভাবে গুড়িয়ে দেয়। ইরানি মধ্যবিত্ত শ্রেণির লাখ লাখ লোক বিদেশে পাড়ি জমান।

যারা থেকে গিয়েছিলেন দেশে, তারা একটি বৈপ্লবিক, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত, নৃশংস যুদ্ধবাজ শাসনব্যবস্থার দৈনন্দিন সহিংসতার শিকার হতে থাকেন। বিপ্লবের নেতারা, প্রেসিডেন্ট বানিসাদ্রের মতো হয় নিজেদের জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন; নয়তো প্রেসিডেন্ট রাজাই, প্রধানমন্ত্রী বাহোনার ও প্রধান বিচারপতি বেহেশতির মতো মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। এই বর্বর বছরগুলোতে, ইরানে দিনপ্রতি গড়ে শতাধিক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।


তার সিনেমা ইরানি বিষয়বস্তুর নিয়মতন্ত্রের ভেতর গোপনকৃত ভান-সর্বস্বতাকে সক্রিয়ভাবেই উত্ত্যক্ত করেছে

‘নৈরাশ্যের দিনগুলোতে কবিতার কাজ কী?’ –এমন প্রশ্ন তুলেছিলেন হোল্ডারলিন; কিয়ারোস্তামির সিনেমা সবসময়ই রাজনীতি থেকে সর্বাধিক দূরত্ব বজায় রেখেছে; তবু সবচেয়ে বিধ্বংসী বোধের বিচারে এর মধ্যে ‘রাজনীতি’ রয়েই গেছে। সচেতনভাবে হোক বা না-ই হোক, তার সিনেমা ইরানি বিষয়বস্তুর নিয়মতন্ত্রের ভেতর গোপনকৃত ভান-সর্বস্বতাকে সক্রিয়ভাবেই উত্ত্যক্ত করেছে। ‘বাস্তবতা’র একান্ত ধারণার অন্তস্তলকে উদ্দেশ্য করে, বিষয়বস্তুটিকে সাফল্যের সঙ্গে দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলেছেন কিয়ারোস্তামি– যেন কেউ সেটি বুঝে ফেলার দাবি করতে না পারে। রিসাবজেকশনের একটি কার্যকর কৌশল হিসেবে, জ্ঞানের অবজেক্টের সঙ্গে বাস্তবতার দ্বিধা মিলে সাবজেক্ট ও অবজেক্ট– উভয়ের জন্যই ঝামেলা তৈরি করেছে; এবং এগুলোর নিয়মতন্ত্রের সঙ্গে নতুন করে বোঝাপড়া করার জায়গাটি উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

কিয়ারোস্তামির বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দর্শনের সবচেয়ে বৈপ্লবিক তাৎপর্য এটিই। তার অন্তর্দৃষ্টি সহজ-সরল, এবং স্রেফ প্রতি-সাংস্কৃতিক। তবে কোনো বিকল্প সংস্কৃতির প্রস্তাবনার বোধ থেকে এটি প্রতি-সাংস্কৃতিক নয়: যে কোনো সংস্কৃতির সংক্ষেপায়নকে কিয়ারোস্তামি বরাবরই থামিয়ে দিয়ে, বরং এভাবেই বাস্তবতার প্রাক-সাংস্কৃতিক বিকল্পকে উদযাপন করেছেন।

দ্য সোভারিনটি অব আর্ট [১৯৯৮] গ্রন্থে ক্রিস্তফ মেঙ্খা লিখেছেন, ‘শিল্পের কাজগুলোকে সবকিছুর সঙ্গেই সেগুলোর শুধুমাত্র নেতিবাচক সম্পর্কের ভিত্তিতে ধারণ করার মাধ্যমে, শিল্পের পক্ষে সে ধরনের কাজের ওপর স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়; সেগুলোর উপস্থাপনার এবং সেগুলো যেভাবে অভিজ্ঞতালব্ধ হয়েছে– সেটির অন্তঃস্থ যুক্তির মাধ্যমে, শিল্পকে সমুচিতভাবে বোঝা সম্ভব।’

কিয়ারোস্তামির ক্ষেত্রে, বাস্তবের কল্পিত স্বচ্ছতার একটি জাগ্রত সচেতনতাবোধই হলো– তাৎপর্যপূর্ণতার বৈকল্পিক কার্যপদ্ধতিগুলোর প্রতি সমর্পিত হওয়া পৃথিবীকে তার তৈরি করে নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব নিয়মতান্ত্রিকতা।

হ্যোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ড’স হোম?
হ্যোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ড’স হোম?

১৯৮০ দশকের শেষভাগে, কিয়ারোস্তামি তার মাস্টারপিস ফিল্মগুলোর একটি, পরবর্তীকালে কোকের ট্রিলজি নামে পরিচিত হয়ে ওঠা ট্রিলজিটির প্রথম ফিল্ম, হ্যোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ড’স হোম? নির্মাণের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন। এর চেয়ে সারল্যমাখা কাহিনি আর হতে পারে না। নেমাতজাদেহ নামের এক অল্পবয়সী স্কুলছাত্রকে তার শিক্ষক কড়া-সতর্ক করে দিয়েছিল সঠিক নোটবুকে নিজের হোমওয়ার্ক না লেখার দায়ে। শিক্ষক তাকে ধমক দিয়েছে, এ রকম অপরাধ আরেকবার করলে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে।

ভাগ্য এমনই খারাপ, নেমাতজাদেহ একদিন নিজের নোটবুক নিয়ে আসতে ভুলে গেল; তার বন্ধু ও সহপাঠী আহমেদ ভুলক্রমে সেটি নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। যখন সে বাড়ি ফিরে হোমওয়ার্ক করতে বসল, মায়ের নানা ধরনের টুকিটাকি কাজ তাতে অবিরাম বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল; এরই মধ্যে আহমেদ টের পেল, নেমাতজাদেহের নোটবুকটি তার ব্যাগে রয়ে গেছে।

এরপর বন্ধুর নোটবুকটি ফিরিয়ে দিয়ে আসতে, তার বাড়ি খুঁজতে আহমেদের নিরন্তর অনুসন্ধানের দেখা পাই আমরা। চলতি পথে অল্পবয়সী আহমেদ যে সব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, এবং কাহিনিটির যে চমৎকার-রকমের বিস্ময়কর সমাপ্তি– এ সবের মধ্যে কিয়ারোস্তামির নৈপুণ্যের পরিপক্কতা চিহ্নিত হয়ে আছে।

কেন্দ্রীয় চরিত্র আহমেদের চরিত্রটির সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ হলো– তার একাকিত্ব ও জেদ। কিয়ারোস্তামির অল্টার-ইগো বা বিকল্প-সত্তা হিসেবে সৃষ্ট আহমেদ আসলে এই টার্মটির [অল্টার-ইগো] চেয়েও এক চরম শক্তিধর বোধ থেকে আলাদা। আহমেদ অন্য যে কোনো কিছু থেকে স্রেফ দূরে চলে আসে : তার শিক্ষক ও শিক্ষকের আধা-স্বৈরতান্ত্রিক অনুশাসন ও বিধি-বিধান থেকে দূরে, নিজের মা এবং কাজ করার জন্য মায়ের অবিরাম জবরদস্তি থেকে দূরে, নিজের দাদা এবং শিষ্টাচার ও ভদ্রতা সম্পর্কে দাদার আহাম্মকি ধ্যান-ধারণা থেকে দূরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, আহমেদ সেই বাড়িটি থেকেও দূরত্বেই থেকে যায়– যে বাড়িতে তার বন্ধুটির বাস, এবং যেটি পৃথিবীর বুকে চেহারা দেখাতে যেন রাজি নয়।

হ্যোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ড’স হোম?
হ্যোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ড’স হোম?

আহমেদ একটি ভিন্ন ভবিষ্যতের, একটি বিকল্প ভবিতব্যের, বাস্তবতার একটি সংশোধিত সংস্করণের, বেঁচে থাকার একটি নতুন সংজ্ঞায়নের শিশু। আহমেদ যেন সৃষ্টির অপেক্ষারত কোনো এক স্বর্গরাজ্যের আদম [আদিমানব]; এবং সেই রাজ্যটি যদি কখনোই সৃষ্টি না-ও হয়, তবু আহমেদ সেখানকারই অধিবাসী। কিয়ারোস্তামির রিসাবজেকশনের রীতি কখনোই অন্যতর কোনো মেটাফিজিক্সে পর্যবসিত হয়নি। শিক্ষক, মা, দাদা, প্রতিবেশী– সবগুলো চরিত্রই এড়িয়ে যাওয়ার মতো অতটা স্পর্ধা দেখায়নি। ফলে অন্যদের চেয়ে আহমেদের চিন্তাশৈলী এই ভিন্নতাকে কখনোই মূলরীতিগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া, কিংবা সহিংস করে তোলা, কিংবা এগুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।

কিয়ারোস্তামির স্বর্গরাজ্যে, বাস্তবতার মতো এমন ‘সত্য’, চিন্তাশৈলীর মতো এমন ‘নৈতিকতাবোধ’ আর কিছুতে নেই। আহমেদের চরিত্রটি মজ্জাগতভাবে অতিরিক্ত উন্নতচরিত্র নয়; কেননা, বন্ধুর কাছে তার বইটি ফেরত দিতে গিয়ে সে আসলে ‘সঠিক কাজ’টিই করেছে– এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে বই ফেরত দিতে পারার বিষয়টি সবসময়ই সান্নিধ্যের মধ্যে রয়ে গেছে।

‘উদারতার’ পদক্ষেপ হিসেবে মেটাফিজিক্যাল অহংবোধের কোনো উত্থানের দাবি এটি কখনোই করে না। নৈতিকতার মেটাফিজিক্সকে যতটা না ধ্বংস করে, তার চেয়ে বরং এটিকে অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে গণ্য করে এড়িয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই এখানে মাস্টার ফিল্মমেকারের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন কিয়ারোস্তামি।…


হামিদ দাবাশি
১৯৫১–। ইরানি-আমেরিকান সিনে-গবেষক ও বহু সিনে-গ্রন্থের রচয়িতা; প্রফেসর, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
[এই গদ্য তার ‘ক্লোজ-আপ : ইরানিয়ান সিনেমা পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার’ বই থেকে নেওয়া]

গ্রন্থসূত্র

কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা
[ইরানি ফিল্মমেকার আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে নিয়ে গদ্য, তার সাক্ষাৎকার ও সব ফিল্মের রিভিউ]
গ্রন্থনা ও অনুবাদ । রুদ্র আরিফ
পৃষ্ঠাসংখ্যা । ৪৩২
বাংলাদেশি সংস্করণের প্রকাশক । ভাষাচিত্র
প্রথম প্রকাশ । ফেব্রুয়ারি ২০১৭
মূল্য । ৬৭৫ টাকা
ভারতীয় সংস্করণের প্রকাশক । প্রতিভাস
প্রথম প্রকাশ । জুলাই ২০১৭
মূল্য । ৫০০ রুপি


পঞ্চম কিস্তি, আসছে…

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here