এ শহর না আমায় ধারণ করতে পারবে, না পারবে উপেক্ষা করতে: ঋতুপর্ণ ঘোষ [৩]

1184
ঋতুপর্ণ ঘোষ

সাক্ষাৎকার । কৌস্তভ বকশী
অনুবাদ । নাফিস সাদিক

অনুবাদকের নোট:
বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নির্মাতাদের একজন ঋতুপর্ণ ঘোষ [৩১ আগস্ট ১৯৬৩–৩০ মে ২০১৩]। মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছরের জীবনে নির্মিত উনিশটি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি পেয়েছিলেন বারোটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তাঁর নির্মিত প্রতিটি চলচ্চিত্রে মৌলিকত্ব এবং স্বাতন্ত্র্য এত তীব্রভাবে উপস্থিত যে আলাদাভাবে দাগ কেটে যায় দর্শকের মনে। নারীর মনস্তত্ত্ব, অবচেতন- অবদমনের বিচিত্র দ্বন্দ্ব এবং সমাজের অলিখিত-অনালোকিত নানা সমস্যায় আলো ফেলেছেন তিনি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং চলচ্চিত্র সমালোচক কৌস্তভ বকশীকে দেওয়া একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্র ভাবনার নানাদিক উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল চলচ্চিত্র ও সমন্বিত শিল্পকলা বিষয়ক কলকাতাকেন্দ্রিক পত্রিকা ‘সিলুয়েট’-এ (Silhouette)। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করা হলো তিন কিস্তিতে। বাংলায় অনুবাদের জন্য ‘সিলুয়েট’ সম্পাদক অমিতাভ নাগের অনুমতি নেওয়া হয়েছে।
আজ প্রকাশিত হলো সাক্ষাৎকারটির শেষ কিস্তি।

আগের কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন: প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি


ঋতুপর্ণ ঘোষ
ফিল্মমেকার, অ্যাকটর; ভারত । ৩১ আগস্ট ১৯৬৩–৩০ মে ২০১৩

শেষ কিস্তি

কৌস্তভ বকশী
মনে পড়ে গেল… আমি কিন্তু চোখের বালির একটা বিষয়ে কিছুটা হতাশ হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, মহেন্দ্র-বিহারীর সম্পর্কের মাঝে সমলৈঙ্গিক আকর্ষণের দিকটিও আপনি আনবেন।

ঋতুপর্ণ ঘোষ
হুম, আনা উচিত ছিল। কিন্তু আমিও চাপের মধ্যে ছিলাম। আমি এখানে একজন বিধবার মাসিক হওয়া দেখিয়েছি… এছাড়া অনেকগুলো প্রথা ভেঙেছি। এতকিছু একবারে আনলে তা আমার দর্শকদের জন্য ওভারডোজ হয়ে যাবে! তাই কৌশলগতভাবেই সমলৈঙ্গিক আকর্ষণের দিকটা এড়িয়ে গেছি, যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসে কিন্তু এটার স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল।

মহেন্দ্র বিহারীকে বিভিন্ন সময়ে অপমানিত করে, কিন্তু বিহারী মহেন্দ্রকে ছেড়ে যায় না। এমনকি তার বাড়িতে আসাও সে বন্ধ করে না। এর একটি সরল ব্যাখ্যা হলো, অন্নপূর্ণা ও রাজলক্ষ্মীর স্নেহের আকর্ষণেই সে ফিরে আসে। সেটাও একটা কারণ হতে পারে! কিন্তু মহেন্দ্রের প্রতি যে তার গভীর ভালবাসা, সেটাই তাকে বারবার ফিরিয়ে আনে। একই জিনিস কিন্তু শ্রীবিলাস-শচীশ অথবা গোরা-বিনয়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সত্য।

চোখের বালি
চোখের বালি

কৌস্তভ বকশী
যদিও আপনি পুরুষ অভিনেতাদের মধ্যে সমলৈঙ্গিক আকর্ষণ স্পষ্টভাবে দেখাননি, তবে তাদের উন্মুক্ত দেহ দেখিয়েছেন…

ঋতুপর্ণ ঘোষ [মৃদু হেসে]
হুম, সর্বোচ্চ সেটাই আমার পক্ষে করা সম্ভব ছিল।

কৌস্তভ বকশী
চিত্রাঙ্গদা
আপনার প্রথম চলচ্চিত্র যেখানে আপনি সমলৈঙ্গিক আকর্ষণকে আর আকার-ইঙ্গিতে দেখাননি, বরং এটাকেই উপজীব্য করে কাজ করেছেন। এখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র নিজেই যৌনতার প্রচলিত ধারণার বাইরের একজন মানুষ এবং সে তার লিঙ্গ পরিবর্তন করতে আগ্রহী। আপনার সামনের কাজগুলোতে এমন চরিত্র কি আমরা আরও পেতে যাচ্ছি?

ঋতুপর্ণ ঘোষ
‘নিয়মতান্ত্রিকতার বাইরে যাওয়া’ বা ‘প্রথাবিরুদ্ধতা’র ব্যাপারটা আসলে কী? এই যে আমি যৌন সম্পর্কের ভিন্ন মাত্রাগুলো নিয়ে কাজ করি– এটা? না, এটা না। আবার আমাকেই-বা কেন এটা নিয়ে কাজ করতে হবে?

আপনারা অনেকেই জেনে থাকবেন, আমি ঠাকুরবাড়ি নিয়ে একটি চলচ্চিত্র বানানোর পরিকল্পনা করছি। ওই গল্পও কিন্তু প্রথাবিরোধিতার একটি পাঠ হতে যাচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের একেবারে পাশেই অবস্থান করে একটি ব্রাহ্ম পরিবারের উত্থান-পতন আমি এখানে দেখানোর চেষ্টা করব।

ঠাকুরবাড়িতে গোপনে যেসব নাটক মঞ্চায়িত হতো, সেগুলোতে কাদম্বরী দেবী যে পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করতেন– এই তথ্য আমাকে আকর্ষণ করে। ওই পরিবারে যেসব বিবাহ- বহির্ভূত সম্পর্কের গুঞ্জন শোনা যায়, সেগুলোরও পুনর্পাঠ প্রয়োজন। আবার যেমন ধরুন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নটী বিনোদিনীর মধ্যে তথাকথিত সম্পর্কও ওই চলচ্চিত্রের বিষয় হতে পারে।


সব সময় যে যৌন সম্পর্কের ভিন্নমাত্রা নিয়ে কাজ করতে হবে, ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়

যে সম্ভাবনাগুলোর কথা উল্লেখ করলাম, এগুলোর প্রতিটিই কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে ‘প্রথাবিরুদ্ধতা’কে ইঙ্গিত করে। সব সময় যে যৌন সম্পর্কের ভিন্নমাত্রা নিয়ে কাজ করতে হবে, ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়।

কৌস্তভ বকশী
ঠাকুরবাড়ির প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল… রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেসব উপন্যাস নিয়ে আপনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, যেমন চোখের বালি কিংবা নৌকাডুবি— প্রতিটায় সমালোচকরা নায়িকাদের অতি আধুনিকীকরণ কিংবা সেটের অতিরঞ্জন নিয়ে অভিযোগ করেছেন। দর্শকদের বাণিজ্যিক মনস্তত্ত্ব মাথায় রেখেই কি এমন করেছেন?

নৌকাডুবি
নৌকাডুবি

ঋতুপর্ণ ঘোষ
চলচ্চিত্রের জন্য দর্শক খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটা অস্বীকার করব না। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নায়িকাদের নিয়ে কাজ করার সময় তাদের অতি আধুনিকীকরণ করেছি বলে মনে করি না। ঠাকুরবাড়ির মহিলারা কিন্তু বিশেষ করে পোশাক-আশাক নিয়ে খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন। শরৎকুমারী দেবীর কথাই ভাবুন, কি সচেতনভাবে রূপচর্চার সূক্ষ্ম দিকগুলোর চর্চা করেছেন। ঠাকুরবাড়ির নিয়মে শাড়ি পরা তো ছিল রীতিমতো বিখ্যাত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেহেতু তার নায়িকাদের বিস্তৃত বর্ণনা দেননি, চলচ্চিত্রকার হিসেবে আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে তাদের সৃষ্টি করার স্বাধীনতা আছে।

কৌস্তভ বকশী
ভালো কথা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে আপনার প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? এটি নির্মাণের সময় গবেষণা করতে গিয়ে নতুন কিছু কি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন?

ঋতুপর্ণ ঘোষ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার সব সময় মনে হয়েছে, তিনি অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। এই প্রামাণ্যচিত্রের জন্য গবেষণা করার সময় ধারণাটা আরও বেশি সত্যি মনে হলো। মাত্র একটা প্রামাণ্যচিত্রে তাঁকে ধারণ করা অসম্ভব তো বটেই… এমনকি দশটাতেও সম্ভব হবে না।

নৌকাডুবি
নৌকাডুবি

কৌস্তভ বকশী
ঠাকুরবাড়ি ঘিরে নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি ভবিষ্যতে আমরা আপনাকে আর কোন কোন বিষয় নিয়ে কাজ করতে দেখতে পাব?

ঋতুপর্ণ ঘোষ
আমি সব সময়ই নতুন কিছু সৃষ্টি করতে চাই। সত্যি বলতে, গভীরভাবে বানাতে চাইতাম– এমন কিছু চলচ্চিত্র ইতোমধ্যে নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছি– যেমন, উনিশে এপ্রিল, বাড়িওয়ালি, দোসর, আবহমান। সামনেও নতুন কিছুই নির্মাণের চেষ্টা করব।


যে চলচ্চিত্রের জন্য আরও বেশি গবেষণা এবং গভীর ভাবনার প্রয়োজন হয়, এমনসব চলচ্চিত্রই সামনের দিনগুলোতে বানাব

মহাভারতের প্রতি আমার সব সময় আলাদা কৌতূহল রয়েছে। আমি এখন এই মহাকাব্যটির লৈঙ্গিক গঠন নিয়ে একটা বই পড়ছি… বিশেষ করে একটা অধ্যায়, যেখানে অর্জুন/বৃহন্নলা এবং অম্বা/ শিখণ্ডীকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমার আরও কিছু পরিকল্পনা আছে যেগুলোর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। যে চলচ্চিত্রের জন্য আরও বেশি গবেষণা এবং গভীর ভাবনার প্রয়োজন হয়, এমনসব চলচ্চিত্রই সামনের দিনগুলোতে বানাব।

কৌস্তভ বকশী
আপনার দেওয়া অন্য সাক্ষাৎকারগুলোয় যা পড়েছি, তা থেকে মনে হয়েছে আবহমান চলচ্চিত্রটির প্রতি আপনার বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। এটা অবশ্য অন্য কারণে মানুষের মাঝে সাড়া জাগিয়েছে… অনেকেই মনে করছেন, সত্যজিৎ রায়-মাধবী মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে সম্পর্কের গুঞ্জন নিয়ে এটি নির্মিত…

আবহমান
আবহমান

ঋতুপর্ণ ঘোষ
সবাই সত্যজিৎ রায়ের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে এর মিল খুঁজে পেতে এত অধীর– এটা আমাকে খুবই পীড়া দেয়। এই উন্মত্ততার কারণেই চলচ্চিত্রটির কিছু সূক্ষ্ম জিনিস অনেক দর্শকের চোখ এড়িয়ে গেছে।

আবহমান-এ অনন্যার প্রথম উপস্থিতির কথা আপনার মনে আছে? দীপঙ্কর দে যখন প্রজেক্টরে সিনেমা দেখছিল, তখন সে এসে হাজির হয়। আমার অতি প্রিয় পরিচালকদের একজন– গুরু দত্তের প্রতি এটা ছিল আমার ট্রিবিউট! কাগজ কে ফুল-এ [১৯৫৯ সালে গুরু দত্ত নির্মিত হিন্দি চলচ্চিত্র] ওয়াহিদা রহমানের প্রথম উপস্থিতির কথা মনে পড়ে? আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম, এটা নিয়ে কেউ লেখেনি। রায়-মাধবী সম্পর্কের সঙ্গে সামঞ্জস্য খুঁজতে মেতে ছিল সবাই। এ কারণেই শিল্প হিসেবে এই চলচ্চিত্র তার যথাযথ মর্যাদা পেতে ব্যর্থ হয়েছে।

কৌস্তভ বকশী
আমি মনে করি আবহমান আপনার সেরা নির্মাণগুলোর একটি; কারণ আপনি এখানে দুজন নারীকে সামনে রেখে নারী স্বাধীনতার প্রসঙ্গটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস্তবজীবন অথবা চলচ্চিত্রের জগতে বিনোদিনী এবং শিখা– দুজনেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে… যদিও তারা তাদের কাজের স্বীকৃতি পায়, তবু গৌণ চরিত্র হিসেবেই তাদের জীবন কাটিয়েছে…

ঋতুপর্ণ ঘোষ
হুম। মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার পেছনে পুরুষের আসল উদ্দেশ্য হলো তাদের আরও ভালোভাবে সেবাদান করানোর জন্য প্রস্তুত করা। নির্মম সত্য হলো, যেসব মেয়ে স্বাধীন হতে চেয়েছে, তারা আরও বেশি পুরুষতন্ত্রের অধীনস্থ হয়ে পড়েছে। উনিশ শতক এবং বর্তমান– দুই সময়ের দুজন নারী অভিনেত্রীকে একই ফ্রেমে এনে আমি এটাই দেখানোর চেষ্টা করেছি। [এত বছরে] প্রকৃতার্থে কোনো কিছুই বদলায়নি।

কৌস্তভ বকশী
একই ব্যাপার বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রেও সত্য। বিধবারা এক দিক থেকে ‘প্রভুহীন’, কাজেই পুরুষতন্ত্রের জালে তাদের আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়। আমার মনে হয় চোখের বালির শেষে ব্যাপারটি খুব ভালোভাবে এসেছে– যখন বিহারীকে বিনোদিনী প্রত্যাখ্যান করে…

চোখের বালি
চোখের বালি

ঋতুপর্ণ ঘোষ
একদম ঠিক! এবং চলচ্চিত্রের শেষে বিনোদিনী আশালতাকে যে লম্বা চিঠি লেখে, তাতে তার অনুভবগুলো পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

কৌস্তভ বকশী
এখন আমি এমন একটি বিষয়ে কথা বলব, যেটা আপনার চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তবে অনেকেই আপনার কাছে এ বিষয়ে জানতে চায়। গত দুই দশকে কলকাতা শহরে LGBT আন্দোলন [Lesbian, Gay, Bisexual, and Transgender– যৌন চেতনার ভিন্নরূপ ধারণকারীদের পরিচয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন] বেশ জোরদার হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি প্রতি বছর একটি কুচকাওয়াজ এবং একটি চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। আপনি আগে কখনো এসব আয়োজনে অংশ নেননি; কিন্তু এ বছর আপনার নির্মিত চিত্রাঙ্গদা ওই উৎসবের শেষ ছবি ছিল…


নারী নির্মাতাদের জন্য আলাদা চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা… যেন তারা দুর্বল বলে তাদেরকে আলাদাভাবে সুযোগ দিতে হবে

ঋতুপর্ণ ঘোষ
LGBT শ্রেণির জন্য একটি আলাদা চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজনকে আমি আগে অপ্রয়োজনীয় মনে করতাম। এমনসব আয়োজনে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য আরও নগ্নভাবে প্রকাশ পায় বলেই আমার ধারণা ছিল। যেমন ধরুন, নারী নির্মাতাদের জন্য আলাদা চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা… যেন তারা দুর্বল বলে তাদেরকে আলাদাভাবে সুযোগ দিতে হবে!

কিন্তু পরবর্তীকালে যৌনতার ভিন্ন মাত্রাগুলো নিয়ে আয়োজিত চলচ্চিত্র উৎসব সম্পর্কে আমার ধারণা বদলেছে। আমার মনে হয়েছে, এসব চলচ্চিত্র উৎসব অনেকটা রাজনৈতিক আন্দোলনের মতো, যেটা প্রথার বাইরে আলাদা যৌনসত্তাকে তুলে ধরে এবং উদযাপন করে। এটা কোনো অসহায়ত্বের প্রদর্শন নয়; বরং বিপরীত-লিঙ্গতাত্ত্বিক নিয়মতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ। আমি এটাকে জরুরি মনে করছি।

কৌস্তভ বকশী
তার মানে, আপনি কি LGBT আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হচ্ছেন?

ঋতুপর্ণ ঘোষ
না, একজন শিল্পীর জন্য আন্দোলনে অংশ নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। আবার, শিল্পও যে সব সময় রাজনৈতিক হবে, এমন কিন্তু নয়! একজন শিল্পী হিসেবে আমি নিজের মতো করে এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছি।

যৌনতার ভিন্ন মাত্রাগুলোকে আমি যে পর্দায় দেখানোর চেষ্টা করেছি, এটাকেই আপনি আমার আন্দোলন বলতে পারেন। এ কাজের জন্য আমি যে আমার দর্শকদের একাংশকে হারাব, সে আমি জানতাম। কিন্তু তাই বলে তো আমার যৌন পরিচয় নিয়ে মিথ্যাচারণ করতে পারি না? তাহলে সেটা আরও বেশি অসততার পরিচায়ক হবে।

কৌস্তভ বকশী
আপনি মনে করেন এজন্য আপনার দর্শকদের একাংশকে হারিয়েছেন?

চিত্রাঙ্গদা
চিত্রাঙ্গদা

ঋতুপর্ণ ঘোষ
হুম… তবে আমি জানি এ শহর না আমায় ধারণ করতে পারবে, না পারবে উপেক্ষা করতে… [মৃদু হেসে] এক শ্রেণির দর্শককে আমাকে ছেড়ে গেছে। তাদের অনেকেরই আমার পোশাক-আশাক নিয়ে আপত্তি ছিল। সত্যি বলতে, আমি আগে যে সম্মান পেতাম, আমার যৌন পরিচয় প্রকাশ করার পর সেটাও যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছে।

কৌস্তভ বকশী
যৌনসত্তা প্রকাশ ও প্রচারের আন্দোলন গত দুই দশকে আরও বেশি বেগবান হয়েছে। যৌন পরিচয়ের ভিন্ন মাত্রা নির্দেশ করে এমন সব শব্দ যেমন, ‘gay’, ‘lesbian’, ‘bisexual’, ‘transgender’, ‘transvestite’, ‘transsexual’, ‘intersex’ ইত্যাদি এখন নিয়মিত ব্যবহৃতও হচ্ছে।

যদিও এই মাত্রাগুলোর প্রতিটিই তরল প্রকৃতির; তবু একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিতে সংজ্ঞায়িত করার চাহিদা খুব বেশি। যৌনসত্তার পরিচয় নির্ধারণী যেসব শব্দগুচ্ছ এখন পর্যন্ত সৃষ্টি হয়েছে, আমি যদি সেগুলোর মধ্যে কোনো একটি দিয়ে আপনাকে চিহ্নিত করতে চাই, আপনি কোনটা বেছে নিবেন?

ঋতুপর্ণ ঘোষ
দুঃখজনক হলেও সত্য, দুজন মানুষের বিপরীতলৈঙ্গিক বা সমলৈঙ্গিক আকর্ষণ পর্যন্তই আমাদের প্রচলিত যৌনতার ধারণা সীমাবদ্ধ। যৌনসত্তার এমন অনেকগুলো মাত্রা রয়েছে, যেগুলোকে কোনো শব্দ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব না। এমনকি আপনি যে শব্দগুলো উচ্চারণ করলেন, সেগুলো দিয়েও নয়।

আমাদের সত্তা বা পরিচয় নির্ধারিত হয় দেহের বৈশিষ্ট্য থেকে… সেটাও কিন্তু একটা সীমানা। আমি সেই সীমানাকে অতিক্রম করায় বিশ্বাস করি। আমাদের দেহ দীর্ঘ সময় ধরে একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে থাকে… একইভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে সত্তা। কাজেই, একটি নির্দিষ্ট ভাগে এটাকে সংজ্ঞায়িত করা সহজ নয়। এটা আমার কাছে অসম্ভব মনে হয়।

কোনো কিছুই সম্পূর্ণ নয়… বরং সবকিছুই একটি চলমান প্রক্রিয়ায় তৈরি হতে থাকে। মানুষের দেহের জন্য এটা যেমন সত্য, একইভাবে সত্য সত্তা বা পরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে। এটা জীবনভর চলতে থাকে।


সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর নোট:
যদিও ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে ওপরের এই কথোপকথন অনেকটা আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকারের মতো লাগছে, তবে কথোপকথনটি এখানে যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, সেভাবে আমাদের আলাপ হয়নি। ঋতুপর্ণ ঘোষকে আমি ‘ঋতুদা, তুমি’ বলতাম আর ঋতুদা আমাকে ‘তুই’ বলতেন। প্রকাশের সময় সম্বোধনেও পরিবর্তন আনতে হলো। বিভিন্ন সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার যে কথা হয়েছে, তারই চুম্বক অংশ এখানে একসঙ্গে উপস্থাপন করেছি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা প্রায়শ বাংলাতেই আলাপ করেছি, কাজেই বিভিন্ন বিষয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের এই প্রতিক্রিয়া মূলত আমার পুনর্লেখন।

Print Friendly, PDF & Email

2 মন্তব্যগুলো

Leave a Reply to Bidrohi Dipon

Please enter your comment!
Please enter your name here