লিখেছেন । মেঘদূত রুদ্র
দৃশ্য-১
অনেক জিনিস আছে যেগুলো মানুষের প্রথম প্রথম করতে খুবই ভালো লাগে। আনন্দ লাগে। কিন্তু সেটা দিনের পর দিন বা মাঝে মাঝেই করতে হলে একসময় ব্যাপারটা একঘেয়ে হয়ে যায়। মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে। আমার সাথেও এরকম হয়।
কিন্তু কিছু জিনিস আছে যেগুলো দিনের পর দিন করেও আজ পর্যন্ত আমার একঘেয়ে লাগেনি আর হাঁপিয়েও উঠিনি। তার মধ্যে একটা হলো গ্রেট মাস্টার স্যার আলফ্রেড হিচককের ছবি দেখা ও তাঁর প্রশংসা করা। দিনের পর দিন মুগ্ধতা বাড়ছে।
আজকে অনেকদিন পর আবার সাইকো ছবিটা দেখলাম। কাল্ট ক্লাসিক ছবি। অনেক চিত্র সমালোচক ও বিদগ্ধ জনেরা বলেন যে সাইকো, রেয়ার উইন্ডো, দি বার্ডস, রোপ— এরকম কিছু ছবি হিচকচ সাহেবের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছবি। কিন্তু আমি আজ পর্যন্ত এটা বুঝে উঠতে পারিনি যে, হিচককের কোন ছবিগুলো তাঁর কম গুরুত্বপূর্ণ ছবি! যেমন নর্থ বাই নর্থ ওয়েস্ট, ডায়াল এম ফর মার্ডার, দি ম্যান হু নিউ টু মাচ, দি রং ম্যান ইত্যাদি ছবিগুলিকে তাঁর কম গুরুত্বপূর্ণ ছবি বলার কারণগুলো আসলে কী, তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়।
কিন্তু আমার এই ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে সাইকো হিচককের সবথেকে সেলিব্রেটেড ছবি। আমার ধারণা কেউ যদি জীবনে হিচককের একটা ছবি দেখে থাকে বা একটা ছবিরই নাম শুনে থাকে, তাহলে সেটা সাইকো।
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে মৈনাকদা, মানে অধ্যাপক মৈনাক বিশ্বাস আমাদের সাইকো পড়িয়েছিল। অনেক ধরনের অ্যানালাইসিস করেছিল। ছবির একটা দৃশ্যের কথা বলেছিলেন। ওই জিনিসটা আমার এখনও মনে আছে। আজকে ছবিটা দেখার সময় ওই দৃশ্যটা কখন আসবে, তার জন্য ব্যকুলভাবে অপেক্ষা করছিলাম। না , সেই সাওয়ারের নিচে খুনের দৃশ্যটা নয়। ওটা ওনার স্ট্রেট ব্যাটে ছয়। অক্ষয় অমর দৃশ্য। কিন্তু এই ছবিতে ভদ্রলোক আরও অনেক দর্শণীয় কাট, হুক, গ্লান্স ইত্যাদি মেরেছিলেন। সেরকমই একটা শটের কথা বলব।
ছবিতে একটা জায়গা আছে যেখানে একজন মহিলা (ছবির ফিমেল প্রোটাগনিস্ট ম্যারিয়ন ক্রেন যিনি শাওয়ারের নিচে খুন খুন হয়েছেন, তাঁর বোন লীলা) আর তার দিদি ম্যারিয়নের প্রেমিক স্যাম সেই কুখ্যাত ‘বেট্স মোটেলে’ আসেন তাঁর দিদির অন্তর্ধানের রহস্য ভেদ করতে।
মোটেলের পাশেই মালিক নরম্যান বেটসের বসত বাড়ি। দর্শকরা জানে যে, ওই বাড়িতে একজন বয়স্ক মহিলা থাকেন। আগেই নরম্যানের মুখ থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, উনি নরম্যানের অসুস্থ মা এবং তারপর আমরা দেখেছি যে উনিই ম্যারিয়নসহ আরেকজনকে খুন করেছেন।
কিন্তু তার সঙ্গে এলাকার ডেপুটি শেরিফের মুখ থেকে দর্শক এটাও শুনেছে যে, নরম্যানের মা দশ বছর আগে মারা গেছেন। ফলে গোটাটাই রহস্য ঘেরা। তাই ওদের ধারণা, ওই বাড়ির ভেতরেই লুকিয়ে আছে আসল সত্য।
লীলাকে ভেতরে যেতেই হবে। ফলে প্ল্যানমাফিক স্যাম নরম্যানকে এদিক ওদিককার কথায় ব্যস্ত করে রাখে এবং সেই সুযোগে লীলা ওই বাড়িটার দিকে যেতে থাকে। বাড়িটা একটু উঁচুতে। ছোট টিলার ওপর। আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে বাড়িটার দিকে যেতে হয়।

দিনের বেলা। আলোছায়ার কোনো খেলা নেই। ভয় দেখানোর জন্য সবথেকে অনুপযুক্ত সময়। লীলা যেতে শুরু করে। এইবার আসে সেই বিখ্যাত দৃশ্য এবং সেই শট টেকিং মেথড। সেই সময় (যখন হিচকক ছবি বানাতেন) অনেক বিদ্বজ্জনের ধারণা ছিল যে, হরর আর থ্রিলার ছবির ঘরানাটা হলো এক ধরনের সস্তা জনপ্রিয় ও বাজারি ঘরানা। অনেকের মতে আবার ইনফেরিয়র আর্ট। এবং আজও অনেকেই বুক ফুলিয়ে এই ধারণা পোষণ করেন (আমার ধরণা, তারা হিচককের একটা ছবিও দেখেননি)।
শটটা ছিল এ রকম– লীলা নিচে দেয়ালের আড়াল থেকে বাড়িটাকে দেখল। আগেই বলেছি উঁচু টিলার ওপর। সে হাটতে আরম্ভ করল। এবার পর পর সাতটা শটে আমরা দেখতে পেলাম যে লীলা হাঁটছে এবং এগোতে এগোতে বাড়ির একদম সামনে চলে আসছে। লীলার পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে আমরা দেখতে থাকি যে বাড়িটা ক্রমশ লীলার কাছে চলে আসছে। এখানে কোনো নতুনত্ব নেই। কিন্তু ওই সাতটা শটের সাথে সাথে তার সাতটা কাউন্টার শটও হয় (‘শট কাউন্টার শট’ আমরা অনেকেই জানি। অর্থাৎ দুজন ব্যক্তি যখন একে অপরের সাথে কথা বলে বা নিজেদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে তখন দুজনেরই পয়েন্ট অব ভিউ থেকে শট নেওয়া হয়। A দেখছে যে B আসছে, আবার B-ও দেখছে যে A আসছে– এ রকম)।

তো, সাইকোর এই দৃশ্যে কাউন্টার শটে বাড়ির পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে আমরা দেখতে থাকি যে লীলা ক্রমশ বাড়িটার কাছে চলে আসছে। দেখতে পাই যে শুধু লীলা বাড়িটাকে নয়, বাড়িটাও লীলাকে দেখছে। এর আগে নরম্যান ছাড়া বাইরের কেউ কোনোদিনও এই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেনি। যেই বাড়ির মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো এক নিষ্ঠুর অজানা সত্য। কোনো এক আদিম পাপ। এই প্রথম লীলা তার ভেতর প্রবেশ করবে। বাড়ি নামক এই রহস্যময় বস্তুটা তাই লীলাকে দেখছে। যেন নীরবে লীলাকে ডাকছে– ‘আয় কাছে আয়।’ এরপর কী হবে, আমরা কেউ জানি না।
—
এই আনক্যানি ফিলিং পৃথিবীর কোনো ফিল্মমেকার এর আগে পর্যন্ত দিতে পারেনি
—
এই প্রথম কোন ছবিতে আমরা দেখতে পেলাম যে শুধু মানুষ বস্তুকে দেখে না, বস্তুও পাল্টা মানুষকে দেখতে পারে। এবং সেখান থেকেই তৈরি হলো আসল আনক্যানি। এবং এই আনক্যানি ফিলিং পৃথিবীর কোনো ফিল্মমেকার এর আগে পর্যন্ত দিতে পারেনি। এতদিন পর্যন্ত যাদের আমরা অবজেক্ট ভেবেছিলাম এবং দেখে গেছিলাম, আজ হঠাৎ করে তারাও পাল্টা আমাদের অবজেক্ট ভাবছে। আমাদের দেখছে। এই প্রথম আমরা এই অসহ্য অনুভূতির সম্মুখীন হলাম। এই প্রথম সিনেমার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম আমাদের চিরাচরিত দেখার যে চোখ আছে, তার বাইরেও একটা চোখ হয়। আমাদের জ্ঞানের যে পরিধি, তার বাইরেরও একটা জ্ঞানবিশ্ব আছে। এটা এতকাল আমাদের অজানা ছিল।
এই প্রথম জানলাম। আঁতকে উঠলাম। ঠিক আজ যেভাবে করোনার ভয়ে প্রতিমুহূর্তে আমরা আঁতকে উঠছি। এই দৃশ্য, এই শট টেকিং মেথড থ্রিলার সিনেমা নামক এই সো-কলড সস্তা জনপ্রিয়, ইনফেরিয়র ও বাজারি ঘরানার শিল্পের ব্যপ্তিকে বহু আলোকবর্ষ এগিয়ে দিয়েছিল। মহাকালের সাথে করমর্দনে লিপ্ত করিয়ে দিয়েছিল তাকে।
একজন পরিচালকের সব ছবি সমমানের হতে পারে না। বা বড় পরিচালকদের সব ছবি ভালোও হতে পারে না। এ রকম একটা ধারণা আজও প্রচলিত আছে। এবং এই ধারণাটা সঠিক। কিন্তু সব প্রচলিত ধারণারই কিছু ব্যতিক্রম থাকে। চিত্র পরিচালকদের সম্পর্কে এই ধারণার উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হলেন গ্রেট মাস্টার স্যার অ্যালফ্রেড হিচকক। ওনার কোনো একটা ছবি দেখছি, অথচ আঁতকে উঠছি না– এ রকম আজ পর্যন্ত হয়নি।
দৃশ্য-২
আবার ক’দিন পর অনেক রাতে স্যার অ্যালফ্রেড হিচককের দি বার্ডস ছবিটা আরেকবার দেখলাম। আমি অনেকদিন আগে থেকেই একটা তালিকা বানাচ্ছিলাম, যেখানে কোন কোন ছবি আমি আরেকবার বা আরও একাধিকবার দেখতে চাই, সেগুলি মনে করে করে লিখছিলাম। ঠিক করেছিলাম ঝটিকা বা পুরোপুরি বানপ্রস্থে গেলে পর পর এগুলো দেখতে থাকব। তালিকায় হিচককের ছবির সংখ্যা সবথেকে বেশি। ভাগ্যিস ভদ্রলোক তাঁর প্রায় ৬০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ৫৪টি ছবি বানিয়েছিলেন। উনি গ্রেট মাস্টার। ছবিগুলিও মাস্টারপিস। এ রকমটা আর কেউ পারেননি।
দি বার্ডস-এ একটা দৃশ্য ছিল, যেখানে একটা পেট্রল পাম্পে কয়েকটি পাখি একজনকে আক্রমণ করে। পরে গিয়ে সেন্সলেস হয়ে যায় সেই ব্যক্তি। তিনি সেই মুহূর্তে পেট্রল ভরছিলেন। তার হাত থেকে পেট্রলের নলটা পরে গিয়ে পেট্রল গড়িয়ে পড়তে থাকে। কিছু মানুষ ছুটে যায় ওনাকে সাহায্য করতে। এদিকে পেট্রল গড়িয়ে গড়িয়ে পাম্পের বাইরে পর্যন্ত চলে আসে। কেউ সেটা খেয়াল করে না। পাখিরা ডানা ঝাপটাতে থাকে। সবাই হতবাক। সবকিছু খুবই চকিতে ঘটে যাচ্ছিল।

একজন হ্যাট পরা হোমরাচোমরা গোছের লোক পাম্পের পাশে নিজের গাড়িটা দাঁড় করিয়ে সেখান থেকে নামে। পায়ের তলাটা পুরো পেট্রলে ছেয়ে গেছে। তাঁর মুখে চুরুট। এখনও চুরুটটা তিনি জ্বালাননি। হাতে দেশলাই। একটু দূরে একটা রেস্টুরেন্টে কিছু মানুষ ঘটনাটা দেখতে পায়। তারা চিৎকার করে ভদ্রলোককে আগুন জ্বালাতে বারণ করে। কিন্তু পাখির ভয়ে জানালার কাঁচ বন্ধ। আওয়াজ তাঁর কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না।
ভদ্রলোকের দৃষ্টি সামনে পাম্পের দিকে। অন্যমনস্কভাবে তিনি জ্বালিয়ে ফেলেছেন দেশলাই। কিন্তু চুরুট ধরাচ্ছেন না। ততক্ষণে জানালা খুলে আবার তাঁকে চিৎকার করে বারণ করা হচ্ছে। তিনি জানলার দিকে তাকান। হাতের দেশলাই জ্বলতে জ্বলতে তাঁর আঙুল পুড়ে গেল।

তিনি হয়তো ওদের বারণ শুনতেন। হয়ত আগুন নিভিয়ে দিতেন। কিন্তু ছ্যাঁকার জ্বালায় চমকে উঠে ফেলে দিলেন দেশলাই। মুহূর্তে সব শেষ। বিরাট বিস্ফোরণ। দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে পেট্রল পাম্প। ক্যামেরা কাট টু ‘বার্ডস আই ভিউ’। অনেক ওপর থেকে পাখিরা দেখছে এই ধ্বংসলীলা। দেখা একটা দুটো করে পাখি নিচের দিকে নেমে আসছে।
মানুষের এই অসহায়ত্ব দেখে হয়তো পাখিগুলো হাসছে। এরপর ঝাঁকে ঝাঁকে তারা নেমে আসবে। আছড়ে পড়বে। বদলা নেবে। মানুষের পাপ যখন চরমে পৌছে যায়, প্রকৃতি এভাবেই বিভিন্ন সময় তার বদলা নেয়।
—
রূপকার্থে হলেও এই প্রত্যাঘাত তো মানুষের অদৃষ্টেই ছিল
—
গল্পে ‘বোডেগা বে’ বলে যে উপকূলবর্তী জায়গাটা আমরা দেখতে পাই, এককালে সেখানে হয়তো শুধু পাখিরাই থাকত। মানুষ এসে তাদের জায়গা দখল করে নিয়েছিল। সঠিক জানা নেই; তবে রূপকার্থে হলেও এই প্রত্যাঘাত তো মানুষের অদৃষ্টেই ছিল। বহু বছর আগে স্যার আলফ্রেড হিচকক আমাদের সেটা বলে গেছেন। আজ করোনা সংকট আবার সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। পাপ কমাও মানুষ, বাঁচতে চাইলে পাপ কমাও।
পুরোটা দেখে মনে হলো, এটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ‘বার্ডস আই ভিউ’ শট। মনে হলো, এর আগে-পরে যা হয়েছে– সব বেকার, সব ভুয়ো, সব মিথ্যে।
এত সুন্দর লেখা আজকাল কম পড়া যায়, দেখার চোখ বা লেখার হাত সকলের থাকে না। আপনাকে অভিনন্দন এত সুন্দর একটি বৌদ্ধিক লেখার জন্য।