জ্যানেট লেই: আধুনিকতা ও উন্মাদনা; অথবা ফিল্মস্টারের পতন

266
জ্যানেট লেই

মূল: রিচার্ড আর্মস্ট্রং
অনুবাদ: মুনতাসির রশিদ খান

জ্যানেট লেই
জ্যানেট লেই
ফিল্ম অ্যাকট্রেস
৬ জুলাই ১৯২৭–৩ অক্টোবর ২০০৪; ক্যালিফোর্নিয়া; যুক্তরাষ্ট্র

[স্কেয়ারমোচ-এর স্টিল]

সারা জীবনে কখনোই শূন্যতা বোধ করোনি তুমি; করেছ কী?
• নরম্যান বেটস। ফিকশনাল ক্যারেকটার। সাইকো [আলফ্রেড হিচকক; ১৯৬০]


১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরের, সেই রাতের কথা আমি কখনো ভুলব না– যেদিন প্রথমবারের মতো টাচ অব ইভিল [অরসন ওয়েলস; ১৯৫৮] দেখেছিলাম। পাব থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে টিভি চালু করতেই দেখলাম সেই বিখ্যাত ট্রেকিং-শট– যার সাথে ছিল ক্ষীণ হয়ে আসা [হেনরি] মানচিনির আবহসঙ্গীত। পিনাট বাটার স্যান্ডুইচ আর সস্তা কফি খেতে খেতে নিজের অন্ধকার বেডরুমে, আমি যেন মিশে গেলাম এক বিবাহিত মানুষের সেই অবস্থার সাথে– যেখানে সদ্য বিবাহিত বিপন্ন স্ত্রীকে নিয়ে কী করবে মেক্সিকোর এক সীমান্ত শহরে, সেই ভাবনায় বিভ্রান্ত সে। এরই মাঝে, সিরিঞ্জ হাতে এক সুদর্শন বদমাশের দুঃস্বপ্ন দেখছিলেন অর্ধনগ্ন জ্যানেট লেই [স্ত্রী সুসি চরিত্রে অভিনয়কারী]। টাচ অব ইভিল এরপরের অনেকদিন, আমার বেডরুমের দেয়ালে বীভৎস ছায়া ফেলেছে।

লুইস ব্রুক্স আর জেমস ডিনের মতো, জ্যানেট লেইও চলচ্চিত্রে আধুনিকতার এক শক্তিশালী প্রতিরূপ ছিলেন। অভিনেতা/অভিনেত্রী যারা এ ধারা অনুসরণ করেছেন, তারা মঞ্চ নাটকের দৃষ্টিকোণে ভিন্ন বলে প্রতিভাত হয়েছেন, সেজন্যেই ক্যাথরিন হেপবার্ন বা লরেন্স অলিভিয়ের সে অর্থে তারকা হতে পারেননি– যেভাবে ব্রুক্স, ডিন বা জ্যানেট লেই তারকা হয়েছেন।

ফ্রেঞ্চ তাত্ত্বিক নিকোলে ব্রেনেজ যেমনটা বলেছেন, তাদের ক্ষেত্রে ‘পর্দায় উপস্থিতি যা ক্লাসিক্যাল অভিনয়ের কাতারে পড়ে’– সেটা ছিল কম। কড়া তুলির টানের লেইয়ের ছবিতে প্রভাব ছিল পর্দায় বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে ভাব-বিনিময় আর চরিত্রের চলমান উপস্থিতিতে, এমনকি অনুপস্থিতিতেও– যা কেবল চলচ্চিত্রেই সম্ভব : তাদের চেহারা, ওয়াইমারের ফূর্তিবাজদের জনস্রোতে তাদের দুঃখী মুখ। সংক্ষেপে, তারা ছিলেন চলচ্চিত্রে নমনীয়তা আর আধুনিক জীবনের ব্যস্ততার ফল। এমন অভিনয়-শিল্পীদের সুনাম নির্ভর করে মাত্র কয়েকটি চলচ্চিত্রের ওপর; কারণ সংস্কৃতির পরিবর্তন অনেকটাই অস্থিতিশীল, আর হঠাৎ করেই তা নিভিয়ে দিতে পারে কোনো শিল্পসম্ভারকে।

জ্যানেট লেইয়ের জন্ম এমন এক সময়, ফলে তিনি হয়ে উঠতে পেরেছেন স্নায়ুযুদ্ধের প্রতীক– ১৯২৭ সালের ৬ জুলাই মার্সড, ক্যালিফোর্নিয়ায়। জ্যানেট হেলেন মরিসন ছিলেন ইনস্যুরেন্স আর রিয়েল এস্টেট এজেন্ট বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী, ১৫ বছর বয়সে হাইস্কুল শেষ করে সঙ্গীত আর মনোবিজ্ঞান পড়তে প্যাসিফিক কলেজে ভর্তি হন। নর্দান ক্যালিফোর্নিয়ার ট্রেকিতে তার বাবা ছিলেন একটা স্কি লজের কেরানি; সেখানে তার সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় তিনি চোখে পড়েন এমজিএম এর অবসরপ্রাপ্ত তারকা নরমা সিয়েরার– যিনি লেইয়ের বাবার কাছে তার কিছু ছবি চান।

দ্য রোমান্স অব রোজি রিজ
কাস্ট: ভ্যান জনসন, জ্যানেট লেই
ফিল্মমেকার । রে রোল্যান্ড

এরপর স্ক্রিন টেস্ট দিয়ে তিনি মানোনীত হন এমজিএম-এর দ্য রোমান্স অব রোজি রিজ [১৯৪৭] ছবির জন্য। ১৯৭০ সালে সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনে দেওয়া এক ইন্টারভিউতে পর্তুগিজ ফিল্মমেকার রুই নোগ্যেইরা, লেইকে তুলনা করেছেন ‘আকর্ষণীয় সরল কুমারী হিসেবে।’ তাকে অভিনয় করতে হয়েছে পরিপূর্ণ সামগ্রিকতার সাথে বিভিন্ন চরিত্রে– মিউজিক্যাল থেকে ওয়েস্টার্ন, কমেডি কিংবা থ্রিলারে।

অ্যাক্ট অব ভায়োলেন্স
কাস্ট: রবার্ট রায়ান; জ্যানেট লেই
ফিল্মমেকার: ফ্রেড জিনমান

শুরুর দিকের ছবিগুলো অবশ্য বেশি চলেছে জ্যানেট লেইয়ের পরিচয়ে নয়; বরং সেগুলোর কাহিনী ভালো ছিল বলে। তবু দর্শকের চোখে তার সরল হাসি, অন্তর্নিহিত ইতিবাচকতার প্রাচুর্যে সেগুলো হয়ে ওঠে জ্যানেট লেইয়ের ছবি : ওয়ার্ডস অ্যান্ড মিউজিক, অ্যাক্ট অব ভায়োলেন্স, লিটল ওম্যান, অ্যাঞ্জেলস ইন দ্য আউটফিল্ড

ওয়ার্ডস অ্যান্ড মিউজিক
কাস্ট: জ্যানেট লেই; টম ড্রেক
ফিল্মমেকার: নরম্যান টুরোগ

১৯৫১ সালে তিনি বিয়ে করেন জনপ্রিয় সিনে-অভিনেতা টনি কার্টিসকে আর এই সোনালী চুলের সুদর্শনা ক্যালিফোর্নিয়ান জিতে নেন ট্যাবলয়েডের পাতার আকর্ষণ আর চলচ্চিত্র জগতের ‘আদর্শ দম্পতি’র খেতাব। এই তারকাযুগল পরে আবির্ভূত হন বিভিন্ন চলচ্চিত্রে– হুডিনি, দ্য ব্ল্যাক শিল্ড অব ফলওয়ার্থ, দ্য ভাইকিংস। এ প্রসঙ্গে দ্য নিউ বায়োগ্রাফিক্যাল ডিকশনারি অব ফিল্ম গ্রন্থে ডেভিড থমসন লিখেছেন : “টনি তাকে [লেই] সাহায্য করেছিলেন স্যাক্সন রাজকন্যার আবরণ থেকে বেরিয়ে আসতে, যেন তিনি আরও ভালোভাবে এগোতে পারেন।” এরপর স্কেয়ারমোচ ফিল্মে, স্টুয়ার্ট গ্রেঞ্জারের বিপরীতে লেই আবির্ভূত হন ভালোবাসার প্রতিমা হিসেবে।

দ্য নেকেড স্পার
কাস্ট: জ্যানেট লেই; জেমস স্টুয়ার্ট
ফিল্মমেকার: অ্যান্থনি মান

অ্যান্থনি মানের সাইকোলজিক্যাল ওয়েস্টার্ন দ্য নেকেড স্পার-এ [১৯৫৩] তিনি ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হন, নিজের ঋজু দেহকে আড়াল করে, মোটাসোটা জবরজং পোশাকে, সোনালী চুলকে ছেলেদের মতো করে ছোট করে কোঁকড়ানো অবস্থায়। রকি পর্বতের পটভূমিতে, লেই অভিনীত চরিত্রটিকে নিয়ে, তার ‘পারিবারিক বন্ধু’ অর্থাৎ, রবার্ট রায়ান অভিনীত চরিত্রটির সঙ্গে পুরুষালী দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে জেমস স্টুয়ার্ট অভিনীত চরিত্রটি। ১৯৮৪ সালে লেই তার আত্মজীবনী দেয়ার রিয়েলি ওয়াজ অ্যা হলিউড-এ লিখেছেন, ‘এই বারুদটা ছিল একেবারেই আলাদা… অনেকটাই নায়িকাবিদ্বেষী।’

মাই সিস্টার এলিন
কাস্ট: বব ফশি; জ্যানেট লেই
ফিল্মমেকার: রিচার্ড কুইন

মাই সিস্টার এলিন-এ [রিচার্ড কুইন; ১৯৫৫], লেই সম্ভবত সেখানেই শেষবারের মতো, “মিস পিচেস এন ক্রিম” হিসেবে অভিনয় করেন। বোহো গ্রিনউইচের প্রেক্ষাপটে লেই এখানে এলিন চরিত্রটি থেকে পরের ছবি টাচ অব ইভিল, আর সাইকোর [আলফ্রেড হিচকক; ১৯৬০] যাত্রা শুরু করেন। এর আগে, জেট পাইলট [১৯৫৭] ফিল্মে পরিচালক জোসেফ ভন স্টার্নবার্গ আগ্রাহী ছিলেন লেইকে পরিচিত বুর্জোয়া কলেজ ছাত্রী চরিত্র থেকে বেরি করে, সোভিয়েত স্পাই চরিত্রে ব্যবহার করতে। এরপর ওয়েলস আর হিচকক এই তারকা-অভিনেত্রীর দেহ-সৌন্দর্য ব্যবহার করেছেন দ্বিতীয় যুদ্ধের পরের সময়ের চলতি সংস্কৃতির পরিচায়ক হিসেবে।

টাচ অব ইভিল আর সাইকোতে এই তারকা যেন স্বমূর্তিতে ফিরে আসেন। এই ছবিগুলিতে বিশেষ করে উঠে আসে আধুনিক জীবনের নানা অবক্ষয়ের কথা। টাচ অব ইভিল-এ আমরা দেখি, আমেরিকান মেয়েদের প্রতিনিধি লেইয়ের পতন আসলে ঘটে গেছে সহজ সরল বালিকা থেকে তারকায় রূপান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে। হার্ভে যেমনটা বলেছেন, সুসি ভার্গাস ‘কোনো সোয়েটার পড়া ক্যাম্পাস-রানী নয়; বরং সে সাহসী, স্বয়ংসম্পূর্ণ এক তরুণী।’ হানিমুনের সময় সুসির অভিগম্যতা ছিল তীব্র, প্রায় ভাবালু। কিন্তু শুরুর দিকের দৃশ্যে তাকে দেখা গেছে কফিরঙা চুলে নিজের উপচে পড়া আত্মবিশ্বাস নিয়ে উঠতি আমেরিকাকে দেখাতে। এখানে চকোলেট সোডা খুঁজতে বের হওয়া তরুণীকে শেষ পর্যন্ত শ্লীলতাহানির শিকার, মাদকাসক্ত, এবং অর্ধনগ্ন অবস্থায় দেখি আমরা। তার স্বামী যদিও, তারকা মাদক-তদন্তকারী মাইক ভার্গাস [চার্লটন হেসটন], ফিল্মটিতে অনেকটা সময় সে কাটিয়েছে সুসিকে নিয়ে কী করবে, কোথায় তার থাকা উচিৎ, কীভাবে তারা একসঙ্গে হতে পারে– এ সব ভেবে।

টাচ অব ইভিল
ফিল্মমেকার: অরসন ওয়েলস

টাচ অব ইভিলসাইকো খেলা করেছে প্রস্ফুটিত নবযুবতী সম্পর্কে পুরুষের উদ্বেগ নিয়ে। যেমন, হার্ভে বুঝতে পেরেছেন, শক্তিশালী চরিত্র আর সহিংসতারআমেরিকানদের প্রতি যেন একটি নির্দিষ্ট তারিফ আছে। অন্যদিকে, শুধুমাত্র একটি পার্শ্ব-ঘটনা হিসেবে সমাজের অবনতি দেখিয়েছেন ওয়েলস। অথচ, হিচকক কিন্তু এর অন্তর্নিহিত মানসিকতার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন; নিজের ছবিতে এই অক্ষমতাকে নাটকীয়ভাবে দেখিয়েছেন তিনি। ওয়েলস ও তার সিনেমাটোগ্রাফার রাসেল ম্যাটি উল্লম্ব স্পেসের অনেক ব্যবহার করেছেন অনেক থামের আর জ্বলজ্বলে জিনিসে মাধ্যমে; এবং তার উপাদানের মধ্যে সুসির অন্য উল্লম্ব আকৃতি দিয়ে, পায়ের দীর্ঘ পেন্সিল প্লেটস, হাই হিল দিয়ে সমাপ্ত একটি টাইট স্কার্টের মাধ্যমে নাটকীয়তা প্রকাশ পেয়েছে।

এই উল্লম্ব শটের শুধুমাত্র বিরতি টেনে, উন্মাদিনীর স্তন যখন দেখানো হয়, এক সময় সে চিৎকার করে বলে, ‘আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই : তুমি অনেক সহিংস ছবি দেখো!’ এ যেন ডরিসডের বখাটে ভাতিজার প্রতি উপদেশ। [এ সময়ে শুধুমাত্র গ্রান্ডি নিজেকে সঙ্কুচিত করেছে; যদিও লস রোবসের মতো সন্ত্রাসীরা এর মধ্য দিয়ে বিদেশের প্রতি আমেরিকানদের আতঙ্ককে প্রকাশ করে]। টাচ অব ইভিল-এর শেষের দিকে আমরা আধুনিক এক নারীকে দেখি, সে নগ্ন হতে বাধ্য হয়, নিচু হতে হয় তাকে, হেরোইন-আসক্ত হতে হয়… বা আরও বাজে কিছু।


সাধারণ আধুনিক কর্মজীবী রমণী থেকে সে পরিণত হয় এক জটিল ধাঁধায়, আর আমরা তাকে দেখতে পাই তার চোখে

অনেক দিক থেকেই টাচ অব ইভিল আর সাইকোর মধ্যে বেশ মিল রয়েছে। দুটোই খুব কম বাজেটে বানানো– যাদের মূল প্রতিপাদ্য– আধুনিক যুগে যৌনতা আর সহিংসতা। দুটোরই পরিচালনা অনুপ্রাণিত হয়েছে মানসিকতার প্রভাবের মাধ্যমে। দুটোতেই আছে এমন নারী চরিত্র– যারা তাদের সামাজিক সংস্কারের বাইরে বেরোতে পেরেছে, পুরুষের অবচেতন মনে তারা প্রভাব ফেলতে পেরেছে। সাইকো ছবিটির প্রথম আধঘণ্টায় নারী-পুরুষ সব ধরনের দর্শক আকর্ষিত হয়েছে; কারণ, এতে অনুসন্ধানী চোখে দেখানো হয়েছে– কেন সাদা চোখে স্বাভাবিক এক তরুণী এক বিবাহিত লোকের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে আর তার বসের কাছ থেকে কিছু চুরি করে। এর মধ্য দিয়ে সাধারণ আধুনিক কর্মজীবী রমণী থেকে সে পরিণত হয় এক জটিল ধাঁধায়, আর আমরা তাকে দেখতে পাই তার চোখে। আমরা আগ্রহী হয়ে পড়ি জানতে যে, কতদূর সে যেতে পারে। আমরা তার চিন্তা বুঝতে পারি, অনেকে অনুভব করতে থাকে তার কষ্ট– যেটিকে থমসন বর্ণনা করেছেন : ‘এক হতাশ, আশাহত, স্তম্ভিত সেক্রেটারির ধাওয়া খাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত গোসলখানায় টুকরো টুকরো করে ফেলা হিচককের চিত্রকল্প, কেবিন ১-এ, পথ চলতি এক মোটেলে ।’

সাইকো
সাইকো
কাস্ট: জ্যানেট লেই; জন গ্যাভিন
ফিল্মমেকার: আলফ্রেড হিচকক

নোগিয়েরার সাথে এক সাক্ষাৎকারে, ম্যারিয়ন চরিত্র সর্ম্পকে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে লেই বলেন : ‘আমার তাকে মনে হয়েছে ছোটখাট এক মহিলা, যে কোনোদিক থেকেই আকর্ষণীয়া নয়। সে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাপড় পরে। আমারও পোশাক বানানোর কেউ ছিল না; সে কিনে নিয়ে আসত এমন কাপড়– যা তার বেতনে কেনা সম্ভব। আমার চুল ঠিক করে দেওয়ার কেউ ছিল না; তাই আমি নিজেই করতাম, যেমনটা সে করে থাকে। এই মেয়েটার অনেক কিছুই আমার পরিচিত। সে ছিল গরীব আর নিঃসঙ্গ। তাকে তার ছোট বোনের দেখাশোনা করতে হতো; আর এরই মধ্যে আফিসে তার বস তার সঙ্গে সম্পর্ক করতে চাইছে।’

আসলে সাইকো ছবিটির প্রথমার্ধ একটা একগুয়ে নারীর গল্প। এর বাকি অংশে, যখন ম্যারিয়নকে বারবার ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়, সেই সময় থেকে হিচকক এমন চিত্রকল্প তৈরি করেন– যা দর্শকের মনে এক অন্যরকম ছাপ ফেলে যায়। তথাকথিত আমেরিকান আচরণ থেকে পালানো নরম্যান বেটস চরিত্রটির ঘন ঘন পরিবর্তন হওয়া আচরণ নিয়ে লিখতে গিয়ে হার্ভে লিখেছেন: “তার সত্তা আর প্রকৃতি থেকে হিচকক যেন বিদায় চাইছিলেন। তবে তা ওয়েলসের মতো নয়; হিচকক এই বিদায়কে এমনভাবে দেখিয়েছেন, যেন তিনি বেদনা ভারাক্রান্ত। সাইকো ছবিটি অনেকটাই এই বিদায়ের ধ্যান– যার পেছনে আছে মানবিকতার অপর্যাপ্ততা।”


এ যেন সুন্দর আমেরিকার বুকে এক বিচিত্র বাঁক

‘মানবিকতার অপর্যাপ্ততা’ বলতে হার্ভে এখানে হিচকক/নরম্যানকে বুঝিয়েছেন, যে তার মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত; এ যেন সুন্দর আমেরিকার বুকে এক বিচিত্র বাঁক– “তারা হাইওয়ে থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল”– চলচ্চিত্রে যেমনটা ছিল লেই আর কাটিসের অবস্থা। এতে আরও দেখানো হয়েছে জগতের নাটকীয়তা আর কাল্পনিক আশা– “সবারই একটা শখ থাকা উচিত!”

সাইকো একটি আধুনিক ছবি, যেখান শহুরে সমাজের আরও দুটি নাটকীয় চরিত্র সামনে নিয়ে এসেছে– সেলসগার্ল এবং এক অদ্ভুত বদমাশ– যে কি না কাজ করে মেয়েটির লাগোয়া অফিসে, তাকে মেয়েটি দেখে তাকিয়ে থাকতে। সাইকো বিশেষ করে দেখিয়েছে আধুনিক নির্লিপ্ততা আর নিসঙ্গতা। এটি আলোতে এনেছে সমাজকে তার অন্ধকার ছায়া থেকে।

১৯৬০ সালের এ ছবিতে ইচ্ছে করে সংলাপে অতীতকাল আর বর্তমানের ঘটানো হয়েছে সংমিশ্রণ। অতীত ব্যবহার করা হয়েছে– যা গোপন, ক্ষতিকর আর যা ভুতুরে, তার ক্ষেত্রে। অনেকটা পাহাড়ের ওপর যে অন্ধকার জিনজার ব্রেডের মতো, নরম্যানের ঘরটার মতো– বর্তমানে যে সব উজ্জ্বল, আবেদনময়, নতুন তার ক্ষেত্রে। এ যেন বিদ্রূপাত্মক আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে অভ্যস্ত, বিজ্ঞাপনের আমেরিকার প্রতি হিচককের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। এমনকি তার নায়িকাও গাড়ি বিক্রি করেছে অবলীলায়, মামুলি কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই।

২০০২ সালে প্রকাশিত অ্যা লং হার্ড লুক অ্যাট সাইকোতে রেমন্ড ডার্গনাট লিখেছেন– ‘ফিল্মটির শিরোনামও যেন ভিন্ন ধারার প্রতি আগ্রহীদের জন্য উপহার মনে হয়’; তিনি এ ছবির অনুরণন খুঁজতে গিয়ে পেয়েছেন– ‘মূলধারার চলচ্চিত্র ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এটি একটি সন্ধিক্ষণ [যা কিনা রক্ষণশীল-উদারপন্থী ঐক্যমত থেকে ‘পালানো’র নির্দেশ করে– মানবতাবাদ থেকে উত্তরকালীন-মানবতার প্রতি]।’

সাইকো
সাইকো
কাস্ট: অ্যান্থনি পার্কিনস; জ্যানেট লেই

নরম্যান [অ্যান্থনি পার্কিনস অভিনীত] কাপড় ছাড়ার সময় ম্যারিয়নকে দেখার পরে, তার শাওয়ারের দৃশ্য দেখানোর মধ্য দিয়ে হিচকক সমতালে চলা নরম্যানের দুই পৃথিবী ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। শাওয়ারের নিচে সেই তরুণী, যাকে আমরা দেখে আসছি সেই ফিনিক্সের অফিসের দৃশ্য থেকে, তার সাথে অনেকটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম আমরা।

হয়তো সে অদ্ভুত নরম্যানের ওপর নজরদারি করেছে; তাই তার দরজা লাগানো থাকবে– এটাই আশা করা যায়। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত অব দ্য ফিগার ইন জেনারেল অ্যান্ড দ্য বডি ইন পার্টিকুলার গ্রন্থে ব্রেনেজ লিখেছেন, প্রতীকী অর্থে এ দৃশ্যে বিমূর্ত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পাই পানি, পানির কল, ম্যারিয়ন মুখের শট সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গতা। আর তা থেকে আমরা একটা ধারনা পাই : শুভ্রতা, আর্দ্রতা, পরিচ্ছন্নতার।

ডুর্গান্ট ১৯৬০ সালের সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনের পর্যালোচনায়, ছবির এই নিশ্চিন্তকে অভিহিত করেছেন ‘গুরুত্বহীন সংবেদন’ হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে, ম্যারিয়নের হত্যা দৃশ্যে ঝরনা থেকে চলমান পানি বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আপাতদৃষ্টিতে ভিত্তিহীন উচ্চকোণ শট হিসেবে, জ্যঁ-লুক গোদারের টু অর থ্রি থিংস আই নো অ্যাবাউট হার [১৯৬৬] ফিল্মটির সঙ্গে অস্বাভাবিক সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এই শাওয়ারের প্রথমদিকের দৃশ্য যেন ম্যারিয়নের পলায়নের নিষ্করুণ আখ্যানেরই সংক্ষিপ্তরূপ। ম্যারিয়নের ঢালা পানি আমাদের এক মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দেয়, কীভাবে উইন্ডশিল্ডের ওপর বৃষ্টির মধ্যে বেটস মোটেলে এসেছে। কেবলমাত্র এরপরই তার মাথার আসে নিজের মনিব, সহকর্মী, এবং শিকারী টেক্সান ধনকুবেরের কথা– যার টাকা সে চুরি করে পাপের সীমা লঙ্ঘন করেছে। । নরম্যান বেটসই এখানে একমাত্র মানুষ নয়, যার মাথার ভেতরে কণ্ঠস্বর পাগল করে তুলছে; এর মধ্য দিয়ে নরম্যান আর ম্যারিয়ন একটি অদ্ভুত জুটিতে পরিণত হয়।

সাইকো

কিন্তু ভয়াবহ সত্য হলো, এই আধুনিক মেয়েটি এক অন্ধকার, ফাঁকা জায়গায় আটকে গেছে। তাহলে ‘মিস আমেরিকা’ কিংবা ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’ নয়, সে কিছু চুরি করেছে–একটা অনাচারে তার প্রবেশ ঘটেছে গতিময়তার সঙ্গে। হার্ভি লিখেছেন, ‘মূলধারার দৈনিক আমেরিকান আখ্যান থেকে এই পলায়নের প্রতীক হিসেবে এসেছে শাওয়ারের দৃশ্যটি।’

অস্ট্রেলিয়ান একাডেমিক ওয়ার উইক মুলস দৃশ্যকল্পটি নিয়ে বলেছেন, ‘এই শক্তিশালী আন্দোলনে প্রমাণ হয়, পর্দায় দৃশ্যকল্প যেন ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে চরিত্র বা বর্ণনাকে; আর দৃশ্যকল্প চলচ্চিত্রকে নিয়ে যায় অন্য মাত্রায়।’ এর সঙ্গে মিলে যায় ম্যারিয়নের শুরুর দিকের মুখের অভিব্যক্তি– ‘তার চেহারা তার সৌন্দর্য আর অর অন্তর্দ্বন্দ্ব ছাপিয়ে গল্পের চরিত্রের এক প্রতীক হয়ে উঠেছে।’ পরে শাওয়ারের দৃশ্যে– ম্যারিয়নের আতঙ্ক, প্রভাবিত দৃশ্যপটে আর শব্দের মধ্য দিয়ে।


শাওয়ারে নগ্ন স্বর্ণকেশীকে সিক্ত আর চিৎকাররত অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের সময়ে আধুনিক সময় আর সাংস্কৃতিক চেতনার এক ফ্ল্যাশব্যাক করে তোলা হয়েছে

এমন নয় যে, জ্যানেট লেইয়ের মুখ [দেহ] তার সহিংস মৃত্যুর বাহ্যিক প্রকাশ; কিন্তু তাকে ক্ষত-বিক্ষত করার মধ্য দিয়ে ছবির প্লট পূর্ণতা পায়। গল্পের প্রয়োজনেই তার মৃত্যুদৃশ্য এভাবে দেখানো হয়েছে। এই ক্ষত-বিক্ষত করার মধ্য দিয়ে সাইকো সিনেমাটি জানান দেয়, ৬০-এর দশকের আধুনিকতার মধ্য দিয়ে ম্যারিয়নকে বিছিন্ন করা হয় ‘জ্যানেট লেই’ সত্তা থেকে। এর মধ্য দিয়ে ছবিটি আলাদা করে দেয় সেই লেইকে– যিনি আধুনিকতার প্রতিচ্ছবি। শাওয়ারে নগ্ন স্বর্ণকেশীকে সিক্ত আর চিৎকাররত অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের সময়ে আধুনিক সময় আর সাংস্কৃতিক চেতনার এক ফ্ল্যাশব্যাক করে তোলা হয়েছে।

প্রতীকী অর্থটাই ব্রেনেজের কাছে সত্য। আবেল ফেরেরাকে নিয়ে এক লেখায় তিনি বলেছেন, শুধুমাত্র সিরিয়াল কিলার, ভ্যাম্পায়ার আর লেফটেন্যান্ট হিসেবে তিনটি ভিন্ন মাত্রায় অভিনয় করিয়েছেন। ব্রেনেজের মতো আমরা করে বলতেই পারি, ম্যারিয়ন ক্রেনের ক্ষেত্রে জীবনের হিসেব থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার চরিত্র, রক্ত; সে হয়েছে সিরিয়াল কিলারের শিকার– আধুনিক বিশ্বের এ যেন এক ভয়াবহ প্রতীক।

সাইকো
সাইকো

আরেকটি ধারণা ব্রেনেজের পর্যালোচনা করে পাওয়া যেতে পারে: এ দৃশ্য যেন ভাস্কর্যের কাছ থেকে তার সত্তা শুষে নেওয়া। ১৯৯৮ সালের দ্য অ্যাকটর ইন (দ্য) প্লেস অব এডিট প্রবন্ধের আলোকে বলা যায়, আমরা ম্যারিয়নের যে চূড়ান্ত ইমেজ দেখি, তার সঙ্গে নরম্যানের মায়ের খুলি মিলে সম্ভবত এক আতঙ্কজনক চিত্রকল্প গড়ে উঠেছে।

ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অস্ট্রেলীয় সমালোচক আদ্রিয়ান মার্টিন আমাকে বলেছেন, ব্রেনেজের ধারণা, এখানে কখনো কখনো চলচ্চিত্র শৈলীগত কাজটা ছাড়িয়ে গেছে। নিসঙ্গতা ও একদম নিখুঁতভাবে তৈরি এক অসাধারণ অর্কেস্ট্রা রচনা হয়েছে সাইকোর ওই মুহূর্তে।

সাইকোতে জ্যানেট লেই অভিনয়ের ক্ষেত্রে তার শরীর নিয়ে যা করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করেছেন মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে। গভীরভাবে ভাবলে দেখা যাবে, সিনেমাটিতে জ্যানেটের শরীর হিচকক আঘাতে আঘাতে বিকৃত করলেও তার সুন্দর মুখটাকে ঠিকই দেখিয়েছেন বাথরুমের মেঝেতে পড়ে থাকতে। যখন ম্যারিয়ন আর নরম্যান কথা বলছিল, নরমান তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ম্য্যারিয়ন ওরফে জ্যানেট লেইয়ের ঘুরে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা ছিল অনেকটা নাচের মতো। যখন নরম্যান তাকে পাশ কটিয়ে যাচ্ছিল, তখন সে হেসেছিল আপনমনে– সে এমনকি তার সামনে ‘বাথরুম’ কথাটাও বলতে পারেনি; সে সময় মেরিয়ন তার দিকে যে হাসি হেসেছিল, সেটা কোনো দিকে তাকিয়ে নয়, যেন অনেকটা সম্মতির ভঙ্গিতে। যেন নরম্যানের অদ্ভুত আচরণের জন্য সে তাকে পছন্দ করতে শুরু করেছিল। তার ক্লান্ত চেহারায় হঠাৎ করেই যেন নতুন সম্ভাবনা দেখা দেয়।

এই সময়টাতে, যেন নতুন করে ফিরে পায় তা স্বভাবজাত ইতিবাচক অভিজ্ঞতা। নরম্যান যখন ম্যারিয়নকে তার সঙ্গে খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়, আমরা যেন শিহরণের সঙ্গে মোহনীয়তা খুজে পাই। সে সময়ে ম্যারিয়নের চেহারার জন্য আমরা লক্ষ্য করতে ভুলে যাই নরম্যানের চেহারার ক্রুর ভীতিকর নীরব নিঃসঙ্গতা আর অশুভ ছায়া। এই সময়ে সেটা ছাড়িয়ে যায় পারকিন্সের বালকসুলভ ঔজ্জ্বল্যে, যার জন্য সে নরম্যানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে।

তাকে বেশ আধুনিক বলে মনে হয়, যেটা ছবিটির প্রথমার্ধজুড়ে ছিল, যেন সে নিজে উদ্যোগ নিচ্ছে; একটা গল্প তৈরি হচ্ছে– যা তার নিজেকেও রোমাঞ্চিত করছে। যেমনটা হার্ভে লিখেছেন, ‘সে যেন সব আমেরিকান মেয়ের প্রতিচ্ছবি, যেমনটা আমরা ম্যাগাজিনের কাভারে দেখি অথবা সিগারেটের বিজ্ঞাপনে, এমনকি সিনেমাও– যেমন জ্যানেট লেই, সোজা কথায় বলতে গেলে– আদর্শ কন্যা, আদর্শ স্ত্রী।’ এ বেলা সে নরমানের কাছেও তাই।

কিন্তু আমরা যদি তাদের মধ্যকার আবেগ দেখে রোমাঞ্চিত হই, যাকে লেই বলেছেন ‘অদ্ভুত ধরনের ভালোবাসার দৃশ্য’, ভাবি– তারা একটা যুগল হতেও পারে; আর সেই সম্ভবনা কুটি কুটি হয়ে যায় গোসলখানায় ম্যারিয়ন ছুরির আঘাতে হিংস্রভাবে খুন হলে। আমরা যদি সাময়িকভাবে, শুভবুদ্ধির সঙ্গে শাওয়ারের নিচে ম্যারিয়নের চিন্তার সঙ্গে সামিল হই, তবে পরের মূহুর্তেই দেখতে পাই আকর্ষণীয় দেহ– যা আমেরিকান সংস্কৃতিতে যৌনতার বহিঃপ্রকাশ।


যখন তার আক্রমণকারী শাওয়ারের পর্দার এক প্রান্ত ছিড়ে ফেলে, তখন যেন আমরা একাত্ম হই– খুনীর বিকৃত মানসিকতার সঙ্গে

ছবিতে ঘটনার মেজাজে যে এই পরিবর্তন আমাদের আরও আগ্রহী করে তোলে আর এতে আকৃষ্ট হতে বাধ্য যেকোনো সংস্কৃতি। সবাই বুঝতে পারছে, এটা ঘটতে চলেছে। কিন্তু তার পরেও এটা একটা চমক হিসেবে আসে। যখন তার আক্রমণকারী শাওয়ারের পর্দার এক প্রান্ত ছিড়ে ফেলে, তখন যেন আমরা একাত্ম হই– খুনীর বিকৃত মানসিকতার সঙ্গে [সেটা আমরা স্বীকার করি আর না-ই করি] মিশে যায় নারীদেহের নানা খাঁজে লুকিয়ে থাকা রহস্য দেখার অদম্য কৌতূহল।

হিচকুকের ধারাবিবরণকারী  ডোনাল্ড স্পোটো দ্য আর্ট অব আলফ্রেড হিচকক [১৯৯২] বইয়ে লিখেছেন, ‘সাইকো ছবিটি আসলে ঘটেছে দর্শকের মনে।’ যখন ম্যারিয়ন মারা যাওয়ার আগে শাওয়ারের পর্দা হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করে, সেটা অনেক দিক থেকেই বাহুল্যের প্রকাশ; কিন্তু সেটা আমাদের মনে করিয়ে দেয়– কনুইয়ে হাত দিয়ে নরম্যান তার মাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর সময়ের কথা, যেটা ছিল বাড়াবাড়ি।

পর্দায় তার কম সময়ের উপস্থিতিতে, লেইয়ের চেহারায় আবেগের বিস্তৃতি ছিল কখনো পরিতৃপ্ত থেকে হতবুদ্ধি, দুঃখী থেকে সহানুভূতিশীল, চিন্তাক্লিষ্ট থেকে যন্ত্রণাদগ্ধ। তিনি যেন প্রকাশ করতে পেরেছিলেন একটা অভিধানের মতো– সমসাময়িক লক্ষ লক্ষ কর্মজীবী নারীকে– যাদের আপস করতে হতো সমসাময়িক লৈঙ্গিকবৈষম্য আর প্রথার সঙ্গে– এ এমনই আমেরিকান সাধারণ এক মেয়ের জীবনের [অথবা মৃত্যুর] গল্প।

ওয়েলস যদি হ্যাঙ্গক কুয়েলিনের মতো নৈতিক শৃঙ্খলায় আগ্রহী থাকতেন, তাহলে সুজির সঙ্গে মোটেল কেবিনে যা হচ্ছিল– তা হতো না; কিন্তু হিচকক যেন লক্ষ মানুষের অক্ষমতা তুলে ধরেছেন দর্শকের সামনে।

সাইকো আমেরিকান আধিভৌতিক সিনেমাকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যা ভয়াবহ; তার শিকারের রক্ত মাংসের মতো আক্ষরিকভাবে তৈরি। যা এখন পরিচিত ‘স্ল্যাশার’ সিনেমা বলে– তার একটা সাধারণ অনুষঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে নরম্যানের ছুরি। এছাড়াও ম্যারিয়নের হত্যার সময় নৃশংসতার আধিক্য। যদিও প্রজন্মের সবাই যেমন দেখে এসেছেন নায়িকার হাতে নায়কের হাত, সেখানে সবসময় অনেকে চেয়েছে ভিন্নতা– যা প্রচলিত রীতি অনুমোদন করে না।

টাচ অব ইভিলসাইকো দিয়েছে ভিড়ের মধ্যে কমসংখ্যক কিছু মানুষকে বিনোদন– যা তারা অনেক দিন ধরেই খুঁজছিলেন।

দ্য মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট
কাস্ট: ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা; জ্যানেট লেই
ফিল্মমেকার: জন ফ্রাঙ্কেনহাইমার

খুব কম তারকাই সাইকোতে জ্যানেট লেইয়ের মতো স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করতে পেরেছেন। সারা ছবিতেই যেন তাকে হারানোর ব্যথা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ছবিটির ব্রিটিশ ভিডিওতে আমরা দেখি, ম্যারিয়ন তখনো শাওয়ারে চিৎকার করছে, তার মুক্তার মতো শুভ্র দাঁত তার ভুরুর কাছের কালো চুলে আমরা ধরতে পারি– এই তো ভ্যান জনসনের দ্য রোমান্স অব রোজি সিনেমার জ্যানেট লেই। এর প্রতিচ্ছবি আরও দেখা যায় অর্ধেক জীবনের ক্যারিয়ারে করা লেইয়ের পরের ছবিগুলোতে– দ্য মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট [১৯৬২], টেলিথিওন [১৯৭৭], ফগ [১৯৮০]– যেগুলো অ্যান্টি ক্লাইমেটিক।


রিচার্ড আর্মস্ট্রং
অ্যাসোসিয়েট টিউটর, ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিউট
গ্রন্থ: বিলি ওয়াইল্ডার, আমেরিকান ফিল্ম রিয়েলিস্ট; আন্ডারস্ট্যান্ডিং রিয়েলিজম
লেখাটির সূত্র: অ্যা জার্নাল অব ফিল্ম অ্যান্ড পপুলার কালচার

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here