আদুরের দরোজায়

523
আদুর গোপালকৃষ্ণন
আদুর গোপালকৃষ্ণনের প্রতিকৃতি: শুভজিৎ দে [সূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস]

লিখেছেন । শিবলুল হক শোভন

আদুর গোপালকৃষ্ণন
আদুর গোপালকৃষ্ণন
ফিল্মমেকার; ভারত । জন্ম: ৩ জুলাই ১৯৪১

আদুর গোপালকৃষ্ণন মালায়লাম চলচ্চিত্রের এক বিস্তৃর্ণ দরোজার নাম। যেখানটায় প্রবেশ করলে আমারা যাব চলচ্চিত্রের অন্য রকম এক জগতে। যেখানে গল্পগুলো রূপক, চরিত্রগুলো সামাজিক স্তরের বিভিন্ন শ্রেণিকে সাধারণভাবে উপস্থাপন করে।

আদুর গোপালকৃষ্ণন মালায়লাম চলচ্চিত্রে পদার্পণ করেন তার স্বয়াম্ভরাম [১৯৭২] চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। যেখানে একজন নারীর নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করার, অর্থ্যাৎ বাসা থেকে পালিয়ে বিয়ে করার পর যে প্রেক্ষাপটগুলোর সম্মুখীন হয়, সেগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। চলচ্চিত্রটি ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা দিয়ে স্পষ্টত প্রভাবিত হলেও এর প্রেক্ষাপটকে মোকাবিলা করার ধরন ছিল আলাদা।

স্বয়াম্ভরাম [ওয়ান’স ওন চয়েস]

প্রথম চলচ্চিত্রে তার ভাষার মৌলিকতা প্রকাশ না পেলেও অনেকগুলো বিষয়ের উপস্থাপন দেখি– যা ভারতীয় চলচ্চিত্রে বিরল। শব্দের ব্যবহারে আবহ শব্দকে তিনি সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কোনো নির্দিষ্ট অবস্থায় চরিত্রের মানসিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশে আবহ শব্দকে রূপক হিসেবে ব্যবহারে করেছেন।


আদুরের
মাঝে কাব্যিক ভঙ্গি,
দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন
থাকলেও শেষ পর্যন্ত চরিত্রের
মানসিক চিন্তাটাই মূল হয়ে ধরা দেয়

তার সবচেয়ে মৌলিক উপস্থাপন চরিত্রগুলোর মানসিক উত্তেজনা ও চিন্তার মোড়। উপস্থাপনশৈলীর কারণে অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতাকে বলা হয় কবি, অনেককে বলা হয় দার্শনিক। আদুর গোপালকৃষ্ণনের ক্ষেত্রে ‘মনস্তত্ববিদ’ বলতে হবে। আদুরের মাঝে কাব্যিক ভঙ্গি, দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন থাকলেও শেষ পর্যন্ত চরিত্রের মানসিক চিন্তাটাই মূল হয়ে ধরা দেয়।

নিজহালকথু
নিজহালকথু [স্যাডো কিল]

তার এলিপায়াত্থাম, ভিদেহান, নিজহালকথু চলচ্চিত্রগুলোতে মানসিক পরিস্থিতির রূপক অবস্থান থাকলে, আনান্তারাম চলচ্চিত্রটিতে একদমই মনস্তত্বের গভীর জায়গাগুলোতে কাজ করেছেন। পুরো চলচ্চিত্রটি একজন পুরুষের মানসিক বিভ্রম ও তার অতীত ইতিহাস।

এলিপায়াত্থাম [দ্য র‍্যাট ট্র্যাপ]

যেকোনো চলচ্চিত্রেই আদুরের কাছে মানুষের মনের ভেতর খেলা করা রহস্যটা মূল। তবে এই মন রাজনৈতিক ও শ্রেণিচেতনাহীন নয়। তার এলিপায়াত্থাম, ভিদেহান চলচ্চিত্রে মানসিক দ্বন্দ্ব উঠে এসেছে শ্রেণিদ্বন্দ্বের প্রতিফলন হিসেবে। এলিপায়াত্থাম চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র ঘরকুনো একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ। যিনি অতিমাত্রায় তার বাড়ন্ত ও বিবাহের বয়স অতিক্রান্ত বোনের ওপর নির্ভরশীল। তিনি তার বোনের বিয়ের প্রস্তাব নানা অজুহাতে ফিরিয়ে দিচ্ছেন বারবার সম্বন্ধ আসার পরেও। এখানে পুরুষ চরিত্রটির এই মানসিক টানাপড়েন যেমন আছে, চলচ্চিত্রটিতে তেমনি আছে সমাজের উপস্থাপন। তৎকালীন ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত সমাজের সাধারণ উপস্থাপন সেই পুরুষ চরিত্র, যারা তার চতুর্দিকে তৎকালীন ক্রমশ বর্ধনশীল পুঁজিপতি সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারছেন না, আবার ছাড়তে পারছে না তার আভিজাত্যকে।

ভিদেহান [দ্য সার্ভাইল]

মানব মনের সারাজীবনের আরেক আকাঙ্ক্ষা– ‘মুক্তি’। কখনো সামাজিক ও রাজনৈতিক শোষনণ বা কখনো-বা যৌনক্ষুধা থেকে মুক্তি। এই মুক্তির এমনই এক আকাঙ্ক্ষা, যেখানে রাজনৈতিক কর্মীরা উন্নততর জীবনের আশা ছুড়ে ফেলে দিয়ে সারাজীবন খেটে খাওয়া মানুষের তরে বিলিয়ে দেন নিজের জীবন, নির্বাণপ্রাপ্তির আশায় সাধকেরা সারাজীবন করে যান তপস্যা। কঠিন থেকে কঠিনতর তপস্যা। এই সমস্ত বিষয়গুলোকে আদুর এক সুতায় বেঁধেছেন তার মাথিলুকাল চলচ্চিত্রে।

ভৈকম মুহাম্মদ বশিরের আত্মজৈবনিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে আমরা দেখতে পাই একজন লেখকের গল্প, যিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হন তার বিদ্রোহী লেখালেখির কারণে। যিনি পুরোটা সময় অত্যন্ত ধৈর্য্য নিয়ে কাটান; বাকিদের সঙ্গে আনন্দ-ফূর্তিও করেন। জেলাররা তার কাছে আসেন খোঁজ-খবর নিতে। তিনি তাদের জেল থেকে মুক্ত হবার পর বিভিন্ন কাজকর্ম করার প্রয়াস ব্যক্ত করেন।

অসম্পূর্ণ যে উপন্যাসটা আছে, সেটা শেষ করবেন, নতুন আরেকটা বিষয় নিয়ে গল্প লিখবেন, একজন ভালো মেয়ে খুঁজে বিয়ে করবেন– এ রকম নানা কথা। হঠাৎ তার সেলের সবার রিলিজের নোটিশ আসে। সবাই আনন্দিত; লেখকও আনন্দিত বটে। কিন্তু মুহুর্তেই খবর আসে, নোটিশে সবার নাম থাকলেও তার নাম নেই। লেখক এই প্রথম মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। জেলার আশ্বাস দেন, নিশ্চয়ই কোনো ভুল হয়েছে, তিনি খোঁজ নিয়ে জানাবেন। কিন্তু পুরো খালি সেলে তার মন আর মানতে চায় না।

মাথিলুকাল [ওয়ালস]

এর মধ্যে হঠাৎই একদিন গরাদের লম্বা দেওয়ালের উল্টোপাশে মেয়েদের সেলের এক তরুণীর সঙ্গে তার কথা শুরু হয়। দিন যায়, এপাশ থেকে ওপাশে দেওয়া নেওয়া হয়। কখনো ফুল, কখনো-বা আচার। কথাবার্তাও হয়, সেই কথা আবার শুধু সাধারণ কথা নয়। সেখানে থাকে রস; কখনো হাস্যরস, কখনো করুনরস, আবার কখনো শৃঙ্গাররস।

কিন্তু এভাবে দেওয়ালের উল্টোপাশ থেকে আর কতদিন? কোনো দেখা নেই, স্পর্শ নেই! তারা ঠিক করেন, দেখা করবেন। অসুস্থতার অজুহাতে হাসপাতালে। সময় ঠিক হয়। দুজনেই উত্তেজিত দেখা করা নিয়ে। তারপর…


এই যে
মানুষের
মুক্ত হওয়ার
তীব্র আকাঙ্ক্ষা,
এটা আদিম; তবে
আরও আদিম– মানুষের
অভিযোজিত হওয়ার ক্ষমতা

তারপর তাদের দেখা হয়েছিল কি না, সেটা বলব না! এই যে মানুষের মুক্ত হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, এটা আদিম; তবে আরও আদিম– মানুষের অভিযোজিত হওয়ার ক্ষমতা। শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে থাকতে সেখানে নতুন জগৎ, নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে ফেলে মানুষ। সেই আকাঙ্ক্ষার আস্বাদে সে ভুলেই যায় তার শৃঙ্খলের কথা, তার গরাদের কথা।

মানুষের এই জটিল মন ও সেই মনের নানা বাঁকই আদুর গোপালকৃষ্ণনের নিরীক্ষার বিষয়। সিনেমাটোগ্রাফির নিরীক্ষা, ক্যামেরার নানাবিধ আঙ্গিক, দৃশ্যের কম্পোজিশনে চমৎকারিত্ব থাকলেও চরিত্রের মানসিক উত্তেজনার নানারকম বহিঃপ্রকাশই তার শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা। চরিত্রের নীরবতা, হিসাবি শব্দচয়ন, মুখভঙ্গিই তার মৌলিকত্বের জায়গা।

আনান্তারাম [মনোলগ]

সব শিল্পই চায় নীরবতা তৈরি করতে এবং সেটা আলতোভাবে ভাঙতে। আদুর গোপালকৃষ্ণনের সেই নীরবতা খুবই মোলায়েম এবং তা তিনি ভাঙেন উত্তেজনা দিয়ে। নীরবতার মধ্য দিয়ে, সঙ্গীতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে শুধুই দৃশ্য ও শব্দ দিয়ে তৈরি এই উত্তেজনাকর নীরবতা এমন এক জগতে প্রবেশ করায়, যাকে বাস্তব বলা যায় না; আবার কবির কল্পনাও না। অনেকটা, বাস্তবের ভেতর অধ্যাত্মের মিশ্রণ। যতটা দৃশ্যের ভেতরে বলা হচ্ছে, তার চাইতে আরও অনেক বেশি না বলা কথা থেকে যাচ্ছে দৃশ্যের বাইরে।

এই দৃশ্য, নীরবতা, উত্তেজনা এবং তার রূপক উপস্থাপনই আদুর গোপালকৃষ্ণনের চলচ্চিত্রের দরোজা। এই দরোজার ভেতরে উন্মুক্ত প্রকৃতি, যেখানে প্রাকৃতিক শব্দগুলোই সঙ্গীত, সেই শব্দগুলোই তার রহস্য তৈরির উপাদান।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here