চিত্রনাট্য নিয়ে সাওয়াল জবাব

1326
সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী

লিখেছেন । সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী

অনেক প্রশ্ন এসেছে। স্ক্রিনপ্লে, চিত্রনাট্য নিয়ে বেশি। শঙ্কা, কৌতূহল। কৌতূহল ভালো, শঙ্কা নয়। দায়ী আমরা স্বঘোষিত তাত্ত্বিকরা। প্রায়শই যদিও বলি নিছক তত্ত্ব দিয়ে রুটি ভাজা হয় না, কিন্তু পৃথিবীর কোনো রুটিই তত্ত্ব ছাড়া ভাজা হয়নি!

আবার কনফিউজিং? ভুলে যান প্লিজ! গিরিশ কারনাড বলতেন, তত্ত্বে ডুবে মরে যেও না। তত্ত্ব জানো, তারপর ভুলে যাও। ‘প্রস্তুতির’ সময় অবচেতনভাবে তত্ত্ব এসে সাহায্য করবে, অভিধান খুলে কি কবিতা লেখা হয়? না গ্রামারের বই খুলে বাক্য বা সাহিত্য?

ঘটক বলতেন : প্রযুক্তির দাস হবে না, প্রযুক্তি তোমার দাস হবে! অবক্ষয়ের প্রযুক্তিকে লাথি মারব নবতর প্রগতির প্রযুক্তি কাছে পেলে!

Arrogance নয়, হক কথা! বিশেষ করে কলিকাতাকেন্দ্রিক কতিপয় চলচ্চিত্র বিষয়ের ‘লেখক’ দিস্তা দিস্তা, বস্তা বস্তা লিখে নবাগত উৎসুক নির্মাতাদের ঘূর্ণাবর্তে [whirlpool] ফেলে দিয়েছিলেন একসময়। সত্যজিৎ আসক্ত কতিপয় রায়ের প্রস্তুতির স্কেচবুককে ‘আদর্শ’ বলে প্রচার দিয়ে আসর জমাতে চাইতেন। রায়কে আমরা অন্তরঙ্গ আলোকে কাছে পেয়েছিলাম দুদিনের জন্য। মুখ গম্ভীর দেখালে কী হবে? সুকুমার রায়ের সন্তান, রসবোধ প্রবল। একজন ‘রায় পাগল’ একটি লাশ বহনের ‘নেগেটিভ ইমেজ’ করা শটের প্রশংসায় ফেনা উঠিয়ে গীত গাইছিল। শেষ না হতেই স্মিত হেসে থামিয়ে বললেন : শোনো, ওটা কেন করেছিলাম, জানো? লাশের অভিনয় কঠিন, নিশ্বাস নিয়ে ফেললে ধরা খাব। ‘দর্শক লাশে নিশ্বাস খোঁজে’!

আমাদের প্রবল হাসি। এ দেশেও একটি ‘বোদ্ধা’দের অনুষ্ঠানে একজন অতি বোদ্ধা সত্যজিতের একটি শটের বর্ণনা দিতে যেয়ে অতি উৎসাহে বলছিলেন : ঐ পাকুর গাছের ওই পাতাটির ফাঁক দিয়ে সকালের প্রথম সূর্য ‘টুকি’ দিয়ে এসে নিচে, এইখানে পতিত হবে। রায় নাকি সন্ধ্যা থেকে ক্যামেরা আর সুব্রত বাবুকে নিয়ে ঘাপ্টি মেরে বসে আছেন ‘আকাশ পানে চেয়ে’, কখন মামা টুকি দেবেন পাকুর পাতার কাঙ্ক্ষিত শটের জন্য!

আমি থামিয়ে বললাম : প্লিজ, সত্যজিৎ আর যাই হোন, ‘বেয়াকুফ’ নন। তিনি অসাধারণ টেকনিক্যাল জ্ঞানসম্পন্ন পরিচালক, এবং স্রষ্টা! বাস্তবতার নিরিখে কি করে তার স্কেচবুকের চিত্রগুলোকে moving image-এ transform করতে হবে সৃষ্টির রসে, তিনি তা জানেন। বেচারাকে রাতভর মশার কামড় খাইয়ে ম্যালেরিয়া [এখন ডেঙ্গি বা চিকনগুনিয়া] আক্রান্ত না করাই মঙ্গলের।

সত্যজিতের স্কেচবুক
সত্যজিতের স্কেচবুক


চিত্রনাট্য
প্রথমত, প্রাথমিকভাবে
ব্যক্তিগত সম্পত্তি, একান্তভাবে

আসল শব্দটি নিছক চিত্রনাট্য নয়। পেছনের শব্দটি ‘প্রস্তুতি’– আর কিছু নয়! চিত্র আর নাট্য। চিত্রনাট্য প্রথমত, প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, একান্তভাবে। গল্প, নাটক, কবিতা, ঘটনা, খবরের পাতায় প্রেম, আত্মহত্যা বা কারও উক্তি, আরেকটি ছবি, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে একটি স্বগত উচ্চারণ, যেমন Rosebud! [Citzen Kane, Orson Welles, 1941] বা মহাকাশ বা মহাসমুদ্রের কিছু মনের ভিতর ‘টুং’ করে উঠলে, নাড়া দিলে, মনের ভিতর সৃষ্টির আবেগ জেগে উঠলে সেই Day One থেকে চিত্রনাট্যের জন্ম এবং ‘প্রস্তুতির’ সূত্রপাত!

অঙ্ক নয় : (১) আইডিয়া : পাঁচ থেকে দশ লাইনে লিখুন; (২) আইডিয়ার পরিবর্ধন Development of the idea করুন! নাট্যচিন্তায় সাজিয়ে ফেলুন আপনার পদ্ধতিতে। প্রথম কাজ নিছক ‘আবেগ’ বা obsession পরিহার করা মানসিক বাছাই পর্ব, ঝাড়ুদার হিসেবে। The more you cut, the more it sparkles! DIAMOND!


ঝাড়ু
দিয়ে অবান্তর
ফেলে দিয়ে বাছাইকৃত
চিত্র আর নাট্য-মুহূর্তের মুক্তগুলোই
আপনার
সম্পদ

যেকোনো শিল্পে অতিরিক্ত আবেগ উদবমন আর শ্বাসকষ্টের জন্ম দিতে পারে, ডুবিয়ে মারতে পারে। ঝাড়ু দিয়ে অবান্তর ফেলে দিয়ে বাছাইকৃত চিত্র আর নাট্য-মুহূর্তের মুক্তগুলোই আপনার সম্পদ। লিখে ফেলুন, মহাকাব্য, উপন্যাস নয়; আপনার ‘নিজস্ব’ বোধগম্য পদ্ধতিতে, মেদ-চর্বিহীন বাক্য, ফেনা না তুলে, স্কেচে, স্টিল এমনকি সেলফোনের গ্রন্থনায়। এটি ধর্মগ্রন্থ বা বেদবাক্য নয়। এটি পুরোনো দিনের ভাষায় ‘ব্লুপ্রিন্ট’– Blue Print– [careful! the last word is PRINT!]।

শটের আগের মুহূর্তেও পরবর্তনযোগ্য– কিন্তু স্রষ্টার গুরুদায়িত্ব ‘খেই’ ধরে রাখার প্রাথমিক কাঠামো অনুসারে। ‘আউলাইয়া ফেলিলে চলিবে না!’ শিল্পীকেও বুঝাতে হবে। আপনার ঐ মুক্তোগুলোর যথাযথ প্রয়োগ হলো মূল! সত্যজিতের আদর্শ চিত্রনাট্য দিয়ে অন্য কেউ বানালে কিয়ামত হয়ে যাবে। পুত্রও পারেনি।

গৌতম চিত্রনাট্য হাতে লেখে, পড়ে শোনায়, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ পড়ে শোনাচ্ছে রাতভর আমার বাসায়। বাণিজ্যিক ছবিতে হয়, গৌতমের আত্মবিশ্বাস অসাধারণ
গৌতমের চিত্রনাট্য/ পদ্মা নদীর মাঝি

সংলাপ নিজে লেখার চেষ্টা করবেন। অথবা এমন একজনকে সঙ্গে নেবেন, যিনি আপনার চরিত্রগুলোর সঙ্গে আপন হতে পারবেন। নিছক ‘ভাড়াইট্টা’ নয়। পুনেতে সহপাঠি কমল স্বরূপ আমার সংলাপ হিন্দিতে রূপান্তর করত, সে নিজেও বড় লেখক, শায়ের। আমাকে বলত : বাংলা সংলাপ আমার সামনে পড়… পড়… পড়…। আমি প্রথমে শুনব! তারপর সে লিখত, এমনকি শিল্পী রামেস্বরিকে বসিয়ে দুটোই শোনাত।

রামেস্বরী পরে আমার গান করেছিল : আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে– অনুবাদ করতে হয়নি! অনুবাদে সর্বনাশ হতে পারে! একজন অনুবাদক ঠাকুরের অরূপ রতনের ইংরেজি অনুবাদ করেছিল : Ugly Stone!

আমার ঘুড্ডির কথাই বলি : প্রথাগত স্ক্রিপ্ট ছিল না– সবাই জানেন; তবে ডে ওয়ান থেকে সেই গাড়িতে সুবর্ণার প্রশ্ন ছিল : কই বললে না তো আমার চরিত্র?

ফ্রন্ট সিট থেকে বলে ফেললাম : ধর, তুই আর্কিটেকচার ফ্যাকাল্টির মুক্তচিন্তার ছাত্রী…!

আসাদ তার গম্ভীর গলায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন : আমার?

উত্তর : এই তুই তুই-ই! মুক্ত হাওয়ার!

কক্সবাজারে শেষ দিনের শুটিং, পয়সা নেই, র’ফুটেজ মাত্র কিছু। মাথায় লম্বা শট। লাঞ্চ আওয়ারে লিখছি, ছিন্নপাতা সুবর্ণার হাতে দিচ্ছি, লাঞ্চ করছে না, পাঠ করছে, স্বগত উচ্চারণের মতো। আসাদ চুপ করে শুনছে। ৩০ মিনিট লিখলাম, ১৫ মিনিট পরে লাফ দিয়ে উঠে বলল : চলো। প্রম্পট করবে না। লম্বা শট, কিচ্ছু মিস করেনি। ‘গাঙচিল গাঙচিল তুমি উড়ে যাও…।’ ১৫ মিনিটের প্রস্তুতি! ‘প্রস্তুতি!’

শিল্পী বলেনি মুখ বাঁকা করে, নাক উঁচু করে : সংক্ষেপে content বলে দাও, ‘improvise’ করে বলে দেব! গাঙচিল বেঁচে গেছে! সবচেয়ে বড় কথা, শট শেষে শিল্পী কেঁদেছিল। শিল্পীর achievement-এর আনন্দ! আজ কোথায় সে আনন্দ! একটি প্রাসঙ্গিক কথা বলি : ‘improvisation’ শব্দটি অপব্যবহারে প্রস্তুতিহীনতার প্রতিশব্দ হয়ে নাট্যচিন্তাকে impoverish করে দীনতায় ঢেকে দিচ্ছে। ব্যস্ততার ‘অজুহাত’ গ্রহণযোগ্য নয়। মুক্তচিন্তা, মুক্ত অভিনয় যথেচ্ছাচার নয়। ক্ষমা করবেন আমাকে।

‘ঘুড্ডি’ ১৫ মিনিটের প্রস্তুতির সেই শট : গাঙচিল গাঙচিল তুমি উড়ে যাও

দেশ-বিদেশের বিখ্যাত ছবির পোস্টপ্রোডাকশন চিত্রনাট্য পাঠ করবেন। আপনার নিজস্ব পদ্ধতি আপনার হাতেই এসে যাবে। চিত্রনাট্য (a+b)2= a^2+b^2+2ab নয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ : চিত্রায়ন, rendition, transformation আর TIME and SPACE নিয়ে খেলা চলচ্চিত্রের ভাষায়। ভাষায়? না, বড় বড় কথা বলে বিভ্রান্তি তৈরি করতে চাই না। পরের কিস্তিতে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করব। চলচ্চিত্রিকের হাতে দুটো এলিমেন্ট কুমোরের মাটি, ভাঙা যায়, গড়া যায়। চলচ্চিত্র পর্দা, টেলিভিশন স্ক্রিন essentially 2D, দু-মাত্রার, ফ্ল্যাট। কিন্তু ঐ ফ্ল্যাট সারফেসে তিন মাত্রার DEPTH তো বটেই, অনুভূতির বহু মাত্রা তৈরি করা হয়, একটি বিশ্বাসের জগত তৈরি হয়।

আর সময়?


‘কাট’–
কেটে দেওয়া
নয়, জুড়ে দেওয়া

চলচ্চিত্র গঠনে ‘সময়’ আমাদের হাতে : কতক্ষণ শটটি রাখব, shot duration! প্রাথমিক সম্পাদনা পরিচালকের মাথায়, পরে সম্পাদনার টেবিলে, আপনি নিজেই সম্পাদক হতে পারেন, চিত্রনাট্যের ‘নাট্য’ তো আপনার মস্তিষ্কপ্রসূত, নয় কি? কুব্রিকের স্পেস ওডেসি ২০০১-এ আদিমানব একটি হাড্ডি ছুড়ে মারল আকাশে– যাচ্ছে… যাচ্ছে… যাচ্ছে– কাট– হাড্ডি মুহূর্তে হয়ে গেল মহাকাশ যান। শত বছরের ‘যোজন’ একটি কাটে! ‘কাট’– কেটে দেওয়া নয়, জুড়ে দেওয়া! একটি কাটেই মহাবিশ্বময়!

প্রশ্নমালায় টাইম স্পেস নিয়ে প্রশ্ন এসেছে, এসেছে ‘imaginary line’ নিয়ে প্রশ্ন। এখানেও ভয় বা বিভ্রান্তির অবকাশ নেই ফিল্মফ্রির বন্ধুদের। শুধু দুটি লাইন বলছি আজ :

একটি ফ্রেম আমি ম্যাপের ডিরেকশন ব্যবহার করছি : পুব ডানে, পশ্চিম বামে। উত্তর উপরে, দক্ষিণ নিচে! দুটি চরিত্র, একটি লাস্যময়ী নারী বামে; অর্থাৎ, পশ্চিমে বসে পুবমুখো হয়ে, অপর দিকে মুখোমুখি সুদর্শন পুরুষ, পুবে বসা পশ্চিমমুখো হয়ে। সন্দেহ নেই প্রেম নিয়ে। দুজনকে দুটি পয়েন্ট হিসাবে ধরে মনে মনে একটি লাইন টানুন। পিছনে depth-এ একটি বিড়াল ঝিমাচ্ছে! শটটি হলো, কিন্তু আপনি যদি পরের শটে ঐ লাইনটি অতিক্রম করে ঐ পাশে যেয়ে লাস্যময়ীর সিঙ্গেল শট নেন অতি উৎসাহে, তাহলে সর্বনাশ। লাস্যময়ী মুখ ঘুরিয়ে পশ্চিমমুখো হয়ে গেছে! আহারে! সুদর্শনের কি অবস্থা বুঝতেই পারছেন। বিড়ালটিও ম্যাও করে উঠেছে!

হ্যাঁ, ভাঙাভাঙি করা যায়, তবে আগে আমরা গড়া শিখি, তারপর ভাঙব!!

ক্যালগেরি টু হিটলার বইটি পাঠ করবেন; না, চিত্রনাট্যের জন্য নয়।

Print Friendly, PDF & Email
প্রখ্যাত ফিল্মমেকার; সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশ ।। জন্ম : ২৬ আগস্ট ১৯৪৬; টাঙ্গাইল। মৃত্যু: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩; ঢাকা।। ফিচার ফিল্ম : ঘুড্ডি ; লাল বেনারসী; আয়না বিবির পালা ।। শর্টফিল্ম : দেয়াল, তামাশা, গল্পদাদুর গল্পকথা, অংকুর ইত্যাদি ।। মহাপরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন [১৯৯৬-২০০১] ।। অপারেশন ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন [১৯৮১-১৯৯৪] ।। শিক্ষার্থী, ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া [(পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট); ১৯৭২-১৯৭৭]

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here