লিখেছেন । সমন্বয়

দ্য ইডিয়িটস
Idioterne
ফিল্মমেকার, স্ক্রিনরাইটার, সিনেমাটোগ্রাফার । লার্স ফন ত্রিয়া
প্রডিউসার । ফিবেকে ভিন্দেলফ
এডিটর । মলি মালেনে স্তেন্সগার্দ
কাস্ট [ক্যারেক্টার] । বডিল ইয়ের্জেন্সেন [কারেল]; ইয়েন্স অ্যালবিনুস [স্তফার]; অ্যানে লুইজে হাসিং [সুজানে]; লুইজে মিয়েরিৎস [জোশেফিন]; নিকোলাই লি কাস [জেপি]; হেনরিক প্রিপ [পেড]; নুড রোমার ইয়ের্জেন্সেন [এক্সেল]; অ্যানে-গ্রেথে বিয়ারুপ রিস [ক্যাত্রিন]
রানিংটাইম । ১১৪ মিনিট
ভাষা । ডেনিশ
দেশ । ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, সুইডেন
রিলিজ । ১৯৯৮

“হে কেশর, হে পরাগ, আমাদের চারিপাশে পরিকীর্ণ এই
বাস্তবের মতো হয়ে বাস্তব বিশ্বের মতো হয়ে আমাদের
মানসনেত্রের এক বিশ্ব আছে, মানস বিশ্বও বাস্তব।“
প্রথমে, স্তফারের হাত ধরে ক্যারেন বোকাদের দেশে আসে…
“Beyond the fiction of reality , there is the reality of fiction” –Slavoj Zizek
ছবিটির এক ঘণ্টা ছাব্বিশ মিনিটের মাথায়, দৃশ্যের মধ্যে জোশেফিনকে তার বাবা বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে, জেপি তাদের গাড়ির পেছনে দৌড়ায়। এরপর একই দৃশ্যে, জেপি গাড়ির ওপরে লাফিয়ে পড়ে– জেপি ও জোশেফিনের মধ্যে গাড়ির কালো জানালা । এই শব্দহীন নীরবতাহীন দৃশ্যে, ভেতরের সংঘর্ষ ও প্রবণতা কিছু ইশারায় প্রকাশ হয়, দৃশ্যে, যে সময় দুটো বাস্তব পাকাপাকিভাবে আলাদা হচ্ছে। এই যে ধ্রুব তর্ক, দুটো বাস্তবের মধ্যে– আমার নিজস্ব ভাবনায়, দুটো কল্পনার মধ্যে– তা একটানা গোটা ছবিটিজুড়ে ঘটতে থাকবে। ছবিটির ইংরেজি নাম দ্য ইডিয়টস।
• জোশেফিন : আমি কাউকেই দেখছিলাম না।
• জোশেফিন : আমি চেষ্টা করছিলাম শুধু নিজেকে অনুভব করতে।
জেপি, বোকা বা স্পাশার হিসেবে কেমন জিজ্ঞেস করলে, জোশেফিন উত্তরে এই বলে। অর্থাৎ আরেকটি দক্ষতার স্তর নির্মাণ হয়– যে দক্ষতা যেন সবাইকেই রপ্ত করতে হবে– যা একইসঙ্গে একটি প্রয়োজনীয় গুণ হিসেবে বিবেচ্য হবে। বোকা বা স্পাশার হওয়াটাও একটা ‘কাজ’। গোষ্ঠীটি একটি ল্যাবরেটরি, যার সরাসরি সম্প্রচার আমরা দেখি। পেড– সে সারাক্ষণ কীসব লেখে? এবং এক্সেল এবং ক্যাত্রিন ও হেনরিক– কেউ এখানে বাস্তবকে সুরক্ষিত করতে আসে না– গোষ্টীর অংশ হওয়ার জন্যে প্রত্যেকের কারণ থাকে, নিজেদের কারণ– সে কারণে বিপ্লবের কোনো জনপ্রিয় ঘ্রাণ এখানে মেলে না।
চরিত্রদের হীরকের বহুস্বরে কাটা। হ্যান্ড হেল্ড ক্যামেরা ও তার দৃষ্টিকোণ, বাড়তি আসবাবহীনতা কিংবা নির্দেশিত আলোশূন্যতার মধ্যে, চরিত্রেরা নিজেদের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্যে অংশ নেয়– তারা পারফর্ম করছিল। ফন ত্রিয়া যে কী খুঁজছেন, তা কখনোই ঢেকে রাখেননি। দর্শকের জন্যে এক প্রকারের রিয়েলিটির সন্ধান, যা খানিক জমির কাছাকাছি– খানিক বিশুদ্ধের ক্যারিকেচার, এমন দর্শকের জন্যে, যারা উপন্যাস পড়েছিল ।

ধার্মিক ছবি? নাকি অথরের কায়দা…
ডওমে ৯৫ [ইংরেজিতে, ডমা-৯৫] এক ভাবভঙ্গি, যার স্বকীয় মেনিফেস্টো রয়েছে, মেনিফেস্টোর ভেতর দশটি নিয়ম আছে। এই গোটা দশ নিয়মকে ব্রেথরেনরা বলতেন, ‘শুদ্ধতার ব্রত’। নিয়মগুলি উইকি খুঁজলেও পাওয়া যাবে, এখানে ঊল্লেখ করলাম না। আবার নিয়মগুলি অনুশীলনকালে লঙ্ঘিত হলে, আরেকটি প্রক্রিয়া ব্রেথরেনদের মানতে হতো। একে ‘স্বীকারোক্তি’ বা ‘কনফেসন’ বলা হচ্ছে।
দ্য ইডিয়ট ডওমের দ্বিতীয় ছবি। এই ছবি করার সময়ে ব্রতের তিনটি নিয়ম লঙ্ঘন হয়, স্বীকার করেছিলেন ফন ত্রিয়া। অতএব বোঝা যাচ্ছে মেনিফেস্টো থেকে প্রক্রিয়া হয়ে ভাবনায়, ধার্মিক বুনটের আঁচ রয়েছে। ফন ত্রিয়া সে সময় ক্যাথলিক ধর্মের দিকে ঝুঁকেছিলেন। এর কারণ হয়তো তার মা-বাবার নাস্তিকতা।
ফন ত্রিয়া নিজেও মেনে নিচ্ছেন, সংঘটিত ধর্মের প্রতি তার দীর্ঘ অপেক্ষা ছিল : “I had a longing to submit to external authority.”
কিন্তু ছবি তৈরিতে ধর্ম কি কেবলই থিম হয়ে থেকে গেল? নাকি এখানে ধার্মিক ছবি তৈরিই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল? শুদ্ধতা, যে ধরনের নান্দনিক মর্ষকামের অভিজ্ঞতায়, ছবি ও ছবিকার, নিজেদের শুদ্ধিকরণ চাইছে, তা মনের দিক থেকে ধার্মিক। সমস্ত বাণিজ্যিক আবরণ ছেড়ে, রোগ থেকে আলগা হতে চাইছে, ধীরে ধীরে শুদ্ধতার দিকে। ভাবালুতা নয়, এটাই মেনিফেস্টোর নৈতিক কামনা।

সাক্ষাৎকারের সময়, যিনি ইন্টারভিউয়ার তার কণ্ঠস্বর ফন ত্রিয়ার নিজের। তিনি চাইলে অন্য কণ্ঠস্বর ব্যবহার করতেই পারতেন, তবে কেন? আর এমন একটি সাক্ষাৎকারের কথা হচ্ছে, যেখানে চরিত্রেরা নিজেদের বিগত আচরণের ওপরই মন্তব্য করছেন। আর এমন সময়ের কথা ইন্টারভিউয়ার জানতে চাইছেন, যা চরিত্রদের কাছে তাদের সাক্ষাৎকারকালের পরিবেশ ও অবস্থার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত।
…
নিজেদের
ভেতর ঝুঁকে দেখতে
পারছেন, তারা অনুতপ্ত ও পাপী
…
সাক্ষাৎকারকালে তারা একেবারে বিপরীত চরিত্র। বোকাদের বিশ্বের থেকে তাদের দূরত্ব রচিত হয়েছে। তারা নিজেদের ভেতর ঝুঁকে দেখতে পারছেন, তারা অনুতপ্ত ও পাপী। তারা, ভেবে দেখলে, যেন ইন্টারভিউয়ারের কাছে নিজস্ব পাপ কনফেস করছে। এখন, ভাবি, ইন্টারভিউয়ারটি কে? সে কি ঈশ্বরের চরিত্রে অভিনয় করছে না? সে, তার কণ্ঠস্বর যেহেতু নির্মাতার কণ্ঠস্বর, তবে নির্মাতা বাইরে থেকে, ছবির শরীরে সরাসরি ঢুকছে। সে অথর, যে ইন্টারভিউয়ারের চরিত্রে অভিনয় করছে। আর যেহেতু সে আরেকটি চরিত্র, ছবিটির ভাবুক ও শ্রমিক নির্মাতা, সেহেতু সে ঈশ্বর নয়– ঈশ্বরের ক্যারিকেচার। ছবিটিও ধার্মিক নয়, ধর্মের ক্যারিকেচার– faux-religious.

সামান্য বাস্তব
সাক্ষাৎকার :
দৃশ্যের খাঁজে খাঁজে অভিনেতাদেরই সাক্ষাৎকার, যখন তারা ঘটনা ও চরিত্রদের সম্বন্ধে বলছে, জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যখন তারা সাক্ষাৎকার দিচ্ছে, তখন তারা চরিত্রে থাকছে না, থাকছে তো বটেই– শ্রেষ্ঠ দর্শকের চরিত্রে, যারা বোকাদের আচরণ বিশ্বস্ত দূরত্ব থেকে দেখেছিল– নিজেদের। গল্প ও ঘটনার বাঁক সংক্রান্ত অনুমান করতে পারে তারা। তবে মনে রাখতে হবে, সেই অনুমানের নেপথ্যে তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতাখচিত তথ্য রয়েছে। কিন্তু তাদের মন্তব্যও আমাদের প্রতারণা মনে হয়। এটার কারণ হতে পারে, ছবি সম্বন্ধীয় আমাদের বিশ্বাস : একটি মাধ্যম যা কেবল বিশেষ ভ্রান্তিই সৃষ্টি করে।
বোকাদের ছবি, ছবির বোকারা :
উনচল্লিশ থেকে চল্লিশ মিনিটের মধ্যে, বিশুদ্ধ পঙ্গুর দল, রঙ্গবোকাদের বাড়িতে আসে। এখনো অবধি যা কিছু হচ্ছিল, সব ঘটনাই গল্পকে এগিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই পরিবেশন করা হয়েছে। কিন্তু এই নির্দিষ্ট দৃশ্যটিকে কোন মনভঙ্গি নিয়ে কোম্পোজ করা হলো, আমরা বুঝতে পারি না। ব্যাপারটা, অন্তত আপাতস্তরে এত উদ্দেশ্যহীন, এত অযৌক্তিক ঠেকে যে, এদের আগমন বিষয়ক কোনো অথেনটিক কারণ আমরা খুঁজে পাই না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি শুধু। বুঝতে পারি না।
…
ফন
ত্রিয়া, অংক
কষে তৈরি গল্পের
মাঝে, সন্ত্রাস প্রেরণ করেন
…
দৃশ্যটি এতটাই বোবা মূর্খ করে দেয় যে, দৃশ্যটির স্বাভাবিক অস্তিত্ব আমাদের বুদ্ধির বাইরে, নাগালের বাইরে চলে যায়। এই অযৌক্তিকতার কোনো কৈফিয়ত হয় না; কারণ পঙ্গুরা অকেজো, আর অকেজোদের আবার কী কৈফিয়ত! ওরা তো পঙ্গু , ওরা তো অকেজো– আমার মান্যতা পেয়েছে। এই সাদা সত্য, ছবির দেহ ফুড়ে যখন আসে, তখন চোখ জ্বালা করে আমাদের। উদাসীন সুড়ঙ্গে ডুবি। কিছুক্ষণ। ফন ত্রিয়া, অংক কষে তৈরি গল্পের মাঝে, সন্ত্রাস প্রেরণ করেন। যখন আমরা সব কিছুর কারণ খুজতে ব্যস্ত– দরজা খোলা ছিল সত্যের– কিন্তু মিস করে গেছি, উদ্দেশ্য সন্ধান লালসায়। এই দৃশ্য বুকে করে দর্শক চোখের ভগ্নস্বাস্থ্যগাথা ধরে রাখে।

দুটো বিশ্ব, মাঝে বাণিজ্য
ছবিটির দুটি বিশ্ব রয়েছে। একটি যা কনসেপ্ট, আরেকটি যা সেই কনসেপ্টের মতে– বাইরের বিশ্ব। বিনিময়, এক ধরনের বাণিজ্য চলে দুই বিশ্বের মধ্যে। প্রথমে, স্তফারের হাত ধরে ক্যারেন বোকাদের দেশে আসে এবং শেষ প্লট পয়েন্টে জোশেফিন বাবার হাত ধরে বোকাদের দেশ ছেড়ে চলে যায়। এই ট্রেডিং যেন গা সওয়া। আগে দেখেছি, ক্যাত্রিনের দলে পুনরাগমন ও খেলার সিদ্ধান্ত শুনে এক্সেলের দলত্যাগ– তো আমরা জেনে ফেলেছি, দুটো ফিকশনের মধ্যে যাতায়াত সম্ভব, অবস্থান ও ভূমিকার বদল হয়– এটা খেলা; কিন্তু চরিত্রেরা বাধ্য দুটো ব্যবস্থার ভেতরেই পারফর্ম করতে।
একটি ব্যবস্থা জ্ঞানচর্চার জন্যে অথবা কেবল ‘ফান’ এবং আরেকটির বিন্যাস উচ্চাশা লক্ষ্য– এসব সুবিধা ও সন্তুষ্টি নিয়ে, যেখানে অফিস যাওয়া আছে। দুটো ব্যবস্থার মধ্যে রেষারেষি আছে। একটি ফিকশন আরেকটি ফিকশনকে অধিকার করতে চায়; বারেবার একটি আরেকটিকে টপকে মুখ বাড়িয়ে দর্শককে বলতে চায় , “দেখো দেখো , আমি ফিকশন নই, আমি বাস্তব।”

একটি স্বীকারোক্তি
বোকাদের গ্যাংব্যাংয়ের দৃশ্যে, জোশেফিন জেপির কাছে স্বীকার করে তার ভালোবাসা, যখন তারা জড়িয়েছে। ক্লিশে, তাই প্রয়োজনীয়। এবং আদম ও ইভের জনপ্রিয় আখ্যানের আবার সৃষ্টি, স্মৃতিতে আঘাত আসে। মনে থাকে না, কিন্তু ভুলেও যাই না। এই সেই আদিম ভুল, যে ফাটল তৈরির মুহূর্তে বাস্তব নাকি ফিকশন, ভাবনা নাকি না-ভাবনা, বুদ্ধি নাকি বোধ, দেহ নাকি আত্মা সমস্ত তর্কের বাইরে, ছবিটি এই প্রথম শ্বাস নেয়। সন্ধান ও বিশ্লেষণের একঘেয়েমি, তার মধ্যে দৃশ্যটি প্রয়োজনীয়ভাবে ধীর। দৃশ্যটির মধ্যে নির্মাতা কোনো প্রকারের বলিষ্ঠতা রাখেননি। এই মুহূর্তেই ছবিটি তাৎক্ষণিক মুক্ত হয়, যখন সে ভাবে না, কেবল কম্পন টের পায় উদ্দেশ্যহীন।

কথার ক্লান্তি কোথায়…
যেহেতু বাড়তি কোনো পোস্ট প্রোডাকশন টুলস ব্যবহার হয় না, কোনো বাড়তি আলো, বাড়তি আসবাব অথবা সুসজ্জিত মিসে-এন-সিন রাখা হয়নি, তাই গল্প ধরে ধরে দর্শককে প্রায় প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো কল্পনা করে নিতে হয়। যেন জল খাওয়ানোর পর, তাদের বলা হচ্ছে, ‘চেবাও’।
ফন ত্রিয়া গল্পের জটিল ম্যাপটি ফেঁদেছেন ও আমাদের কাছে তুলে দিয়েছেন। যদি কোনো মুখবন্ধ সত্যিই থেকে যায়, তার অর্থ : ছবিটি এত এত বেশি রিয়েল দেখাবে যে, তার মধ্যের বাড়তি এলিমেন্ট খোঁজার জন্যেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে।