আমিষ: অবদমিত দেহবাসনার কারুকাজ অথবা মাংসের ক্ষুধা

1396
আমিষ

লিখেছেন । বেলায়াত হোসেন মামুন

আমিষ

আমিষ
ফিল্মমেকার; স্ক্রিনরাইটার । ভাস্কর হাজারিকা
প্রডিউসার । পুনম দেওল; শ্যাম বোড়া
সিনেমাটোগ্রাফার । রিজু দাশ
মিউজিক । কুয়ান বে
এডিটর । শ্বেতা রায় চামলিং
কাস্ট [ক্যারেকটার] । লিমা দাশ [নির্মালী]; অর্ঘ্যদেব বড়ুয়া [সুমন]; নীতালি দাশ [জুমি]; সাগর সৌরভ [ইলিয়াস]
রানিংটাইম । ১০৮ মিনিট
ভাষা । অসমীয়া
দেশ । ভারত
রিলিজ । ২০১৯


সেলফোনের স্ক্রিনে প্রিয় নারীর মুখচ্ছবি। যদিও সে ছবিতে নারীর সন্তানও উপস্থিত। ছবি জুম করে সন্তানকে স্ত্রিন থেকে সরিয়ে নারীর মুখশ্রী কাছে আনা হয়। সেই মুখশ্রী কাছে আনতে আনতে কেবল তার চোখে স্ত্রিন স্থির হয়। সেই চোখ, যে চোখে আশ্রয় অথবা প্রশ্রয় খোঁজে প্রেমিক।

সেই চোখে তাকিয়ে থেকে মুহূর্তে সুররিয়্যাল হয় জাগতিক স্পেস। চোখ ঢুকে পড়ে নিউরনে আর নিউরনে তখন বাসনার বিস্তার। শ্বাস ধীর আর ঘন হয়ে আসে। নিউরনে তখন আর প্রিয় নারীর চোখ নয়; দেহ খেলা করে। দেহের খাঁজে অথবা ভাঁজে, দেহের ভেতরে অথবা বাহিরে, ছুঁয়ে দেখার অথবা ছুঁয়ে থাকার বাসনার উত্তুঙ্গ ক্ষণে ‘ভেতরে যাওয়ার’ অনুমোদন মেলে। ‘ভেতরে যাওয়ার’ এই অনুমোদন অথবা ‘ভেতরে আসার’ আহবান জাগতিক স্পেসে ঘটা কোনো ঘটনা নয়। এ হলো বাসনার ফাঁদ।

বাসনা মনের গহীন কোনে অবদমিত হতে হতে নিজে নিজেই অনুমোদন তৈরি করে। জাগিয়ে তোলে অবদমিত বাসনা চরিতার্থ করবার পথ। সে পথ প্রচল মতে ‘স্বাভাবিক’ হোক আর না হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। অবদমিত বাসনার আগ্নেয় পথ-বিস্তারে পথিকের নিজের কার্য-কারণ জ্ঞানের ধারনা লোপ পায়। তাই ঘটে নানা অনর্থ। যেমন ঘটেছে আসামের চলচ্চিত্র নির্মাতা ভাস্কর হাজারিকার চলচ্চিত্র আমিষ-এর গল্পে।

‘ভেতরে যাওয়ার’ বা penetrate করার বাসনা ভীষণ যৌন আকাঙ্ক্ষা। যখন এই আকাঙ্ক্ষায় বাধার দেয়াল এমন মজবুত হয় যে, তা ভাঙা আপাত দৃষ্টিতে সম্ভব নয়। তখন এই আকাঙ্ক্ষা মজবুত সেই দেয়ালকে বাইপাস করে নিজের ‘অন্য’ কোনো পথ তৈরি করে। চলচ্চিত্র আমিষ-এ এমন এক ‘অন্য’ পথের গল্প বলেছেন নির্মাতা ভাস্কর হাজারিকা।

প্রশ্ন হলো, এই ‘অন্য পথের’ গল্প কতটা গল্প আর কতটা আইডিয়ার বাস্তবায়ন? আর আইডিয়ার বাস্তবায়নে গল্প অথবা গল্পের ভেতরে আইডিয়ার বিকাশ ধারনাটি আসলে কেমন? কোন পথ বেশি কার্যকর?

এ প্রশ্নে একটু পরে আসছি। বরং চলুন প্রথমে আমিষ-এর গল্পটা বুঝে নিই।

১.

আমিষ ২০১৯ সালের ভারতীয় চলচ্চিত্র। ছবিটি অসমীয়া ভাষায় নির্মিত। ছবিটি নির্মাণ করেছেন ভাস্কর হাজারিকা। ভাস্কর হাজারিকার আগের কোনো চলচ্চিত্র দেখিনি। জানি যে, তিনি এর আগে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সে অর্থে আমিষ তার দ্বিতীয় নির্মাণ।

আসামে চলচ্চিত্র এখনও সে অর্থে ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হয়ে ওঠেনি। তবে ধীরে ধীরে আসামের চলচ্চিত্র নানাভাবে ভারতীয় চলচ্চিত্রের মধ্যে নিজের অবস্থান তৈরি করতে শুরু করেছে। সম্প্রতি আমিষ ছবিটি নিয়ে ভারতে বেশ আলোচনা হয়েছে এবং ছবিটি নানাভাবে বাংলাদেশের অন্যছবির দর্শকের কাছেও আলোচিত হয়েছে। ছবিটি যারাই দেখেছেন, তাদের প্রায় সকলেরই কোনো না কোনো তীব্র অনুভূতি হয়েছে বলে শুনেছি।

কারও কারও কাছে ছবিটি ভীষণ ‘ভয়ানক’, তবে ‘উপভোগ্য’; কারও কাছে ছবিটির গল্পে ‘ধাক্কা’ আছে; কারও কারও কাছে ছবিটি ‘বমি উদ্রেককারী’– বাজে।

কোনো চলচ্চিত্র নিয়ে দর্শকদের এই ধরনের মিশ্র কিন্তু প্রবল প্রতিক্রিয়া বেশ মজার। হয়তো এসব কারণে আমিও ছবিটি নিয়ে এই শোরগোলে কান দিয়েছি এবং ছবিটি দেখতে উৎসাহবোধ করেছি।

এই পর্যন্ত যারা পড়েছেন, তাদেরকে লেখাটি পাঠের বিষয়ে একটি সতর্কতা জানিয়ে রাখছি, আমার আলোচনার জন্য আমি ছবিটির পুরো গল্প বলব এবং গল্পের কাঠামোগত চরিত্রের ব্যবচ্ছেদও করব; আমার আলোচনার জন্য এটা জরুরি।তাই যারা ছবিটি এখনও দেখেননি, তারা লেখাটি আপাতত আর না পড়াই ভালো।

তো, চলুন আমিষের গল্প নিয়ে আলাপ হোক।

আমিষ-এর গল্পে প্রটাগনিস্ট দুজন। গল্পের স্থান আসামের গুয়াহাটি শহর। একজন পিএইচডি শিক্ষার্থী সুমন বড়ুয়া। যিনি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার মানুষের মাংস খাওয়ার ধরন বা খাদ্যাভাস নিয়ে তার থিসিস করছেন। থাকেন একটি হোস্টেলে। একা।

অন্য প্রটাগনিস্ট হলেন নির্মালী সাইকিয়া। তিনি একজন চিকিৎসক। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি বিবাহিতা। পাঁচ-ছয় বছরের পুত্র পিকু আর গৃহকর্মী মিনাকে নিয়ে থাকেন। কর্মসূত্রে তার স্বামী থাকেন প্রবাসে। নির্মালী তার নিজের একটি ক্লিনিকে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের পাশাপাশি শহরের কোনো এক হাসপাতালেও চাকরি করেন।

আমিষ

ছবির শুরুতে আমরা দেখি, সুমন তার আরও কিছু বন্ধুদের নিয়ে বনভোজনের আয়োজন করে। সেখানে তারা একটি খাসি বা ছাগল বা বকরী কেটে সেই মাংস রান্না করে ভুড়িভোজ করে। পরদিন সকালে সুমনের এক বন্ধু পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন।

বন্ধুর চিকিৎসার প্রয়োজনে সুমন ছুটে আসেন নির্মালীর ক্লিনিকে। নির্মালীর ক্লিনিক তার বাড়ির নিচতলায়। সেদিন ক্লিনিক বন্ধ। কিন্তু সুমন অনেক অনুরোধ করেন যেন নির্মালী তার অসুস্থ বন্ধুকে চিকিৎসা দেন। সুমনের পীড়াপিড়িতে নির্মালী রাজি হন। দেখতে যান সুমনের বন্ধুকে। সেখানে গিয়ে তিনি সুমনের বন্ধুকে দেখেন এবং সুমনের বন্ধুকে আশ্বস্থ করেন যে, সমস্যা তেমন গুরুতর কিছু নয়। সহজেই সেরে যাবে। তিনি দু-একটি ঔষধের নাম লিখে দেন।

কৃতজ্ঞ সুমন নির্মালীকে তার বাড়ি অবধি এগিয়ে দিতে আসেন। আসতে আসতে পথে তাদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা হয়। সুমন জানান, তাদের বন্ধুদের একটি ‘মাংস সংঘ’ বা মাংসাশীদের সংঘ আছে। তারা বন্ধুরা এই মাংস সংঘে নিজেরাই মাংস কুটে, নিজেরা রান্না করে খান। এ কথা শুনে নির্মালী আগ্রহী হন এবং সুমন যখন নির্মালীর ফিস দিতে উদ্যত হন, তখন নির্মালী বলেন, সুমনরা এরপর যখন আবার কোনো রান্না করবেন, তখন যেন সে রান্না থেকে তাকেও একটু দেন। ওটাই তার ফিস হবে। এতে সুমন খুব খুশি হন এবং এভাবে একদিনের একটি ছোট্ট সমস্যায় তাদের তৈরি হওয়া পরিচয়পর্ব সামনে এগুনোর পথ পায়।

এরপর সুমন নির্মালীর জন্য একদিন বন্য খরগোশের মাংস রান্না করে নিয়ে আসেন। নির্মালী সে মাংস খেয়ে খুব মজা পান। মাংস খেয়ে নির্মালীর আনন্দ বা মজা পাওয়া দেখে সুমন তাকে বিভিন্ন জায়গায় খাবারের দোকানে ‘আসল’ মাংস খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। আর এভাবেই সুমন ও নির্মালীর ‘মাংস’ খাওয়াকে কেন্দ্র করে একটি সম্পর্কের সূত্রপাত হয়।

সুমন নির্মালীকে একে একে বিভিন্ন স্থানে, রেস্তোরায় ‘মাংস’ খাওয়াতে নিয়ে যান। কখনো নিজেও রান্না করে খাওয়ান। মাংস খাওয়াকে কেন্দ্র করে তাদের এই ঘোরাঘুরি, ফোনাফুনিতে সুমন নির্মালীর প্রতি আকৃষ্ট হন। সুমন অনুভব করতে শুরু করেন, তিনি নির্মালীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছেন। এটা নির্মালীও বুঝতে পারেন। নির্মালী এতে অস্বস্তিবোধ করলেও নিজের ব্যক্তিগত একাকিত্বের কারণে নিজেকে সুমনের সঙ্গ গ্রহণ থেকে বিরত করতে পারেন না। এভাবে সম্পর্কের একটি পর্যায়ে সুমন বুঝতে পারেন, নির্মালী তার সঙ্গে বন্ধুত্বের পর্যায়ের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতায় যেতে অপারগ। কোনো এক মঞ্চনাটক দেখার এক সময়ে থিয়েটার হলের বাইরে তাদের এই পরিণতিহীন সম্পর্কের বিষয়টি দুজনেই অনুভব করেন। তবুও কি তাদের পথচলা থেমে থাকে?


নির্মালী
ক্রমাগত মাংস
গ্রহণের ভেতর দিয়ে
নিজের দেহগত অবদমিত
উত্তাপ মোচন করে
চলেন

থাকে না। সুমন প্রবলভাবে নির্মালীকে ছুঁয়ে অনুভব করতে চান। আর নির্মালী সুমনের সঙ্গ এবং সুমনের সঙ্গের ভেতর দিয়ে তাদের মাংসময় আলাপ এড়াতে পারেন না। এতে তিনি তার অবদমিত বাসনার ‘সুখ’ অনুভব করেন। তাদের দুজনের শারীরিক ঘনিষ্ঠতা না হলেও মাংস খাওয়াকে কেন্দ্র করে সুমন নির্মালীর ‘ভেতরে ঢুকতে’ বা penetrate করতে চান; আর নির্মালী ক্রমাগত মাংস গ্রহণের ভেতর দিয়ে নিজের দেহগত অবদমিত উত্তাপ মোচন করে চলেন।

মাংসে আসক্ত নির্মালীকে সুমন নিজের শরীরের এক টুকরো মাংস রান্না করে খাওয়ান। সুমনের দেহের এক টুকরো মাংস খেয়ে নির্মালী অনুভব করেন, তিনি যেন শারীরিক মিলনের তৃপ্তির সুখ অনুভব করছেন। যদিও তখনও তিনি জানতেন না তিনি সুমনের নিজের শরীরের মাংস খাচ্ছেন। অজ্ঞান বা unconscious থেকেও নির্মালীর এই ‘সুখের’ বাসনা বাড়তে থাকে, আর সুমনও নির্মালীর ভেতরে penetrate করবার সুখে সজ্ঞানে নিজের দেহের ছোট ছোট অংশ কেটে নির্মালীকে খাওয়াতে থাকেন। কিন্তু কতটা আর নিজের শরীর কাটা যায়?

একসময় নির্মালীকে সুমন বলেন যে, তিনি নিজের শরীরের মাংস কেটে নির্মালীকে খাইয়েছেন। এতে নির্মালী হতবাক হন, তার রাগ হয়, তিনি ছুটে বেরিয়ে যান রেস্তোরাঁ হতে। পথে তিনি বমি করার চেষ্টা করেন; কিন্তু তিনি বমি করতে পারেন না। তার বমি হয় না। কেন? বমি হওয়াটাই কি স্বাভাবিক হতো না? তার বমি হয় না; কারণ তিনি সজ্ঞানে বমি করতে চাইলেও অজ্ঞানে বা unconsciously সুমনের মাংসের রূপকে ‘সুখ’কে গ্রহণ করেছেন। সেটা তিনি deny করতে পারেন না।

এরপর একদিন নির্মালীও নিজের শরীর থেকে এক টুকরো মাংস কেটে রান্না করেন সুমনের জন্য, সুমন সে মাংস খেয়ে মজা পান কিন্তু যখন জানতে পারেন তখন বমি করে দেন। কেন? নির্মালীর বমি করতে না পারা আর সুমনের বমি হয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই অর্থপূর্ণ। কী সেই অর্থ? ভাবুন।

নির্মালীর এই কাণ্ডে সুমন আতঙ্কবোধ করেন এবং নির্মালীকে থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। নির্মালী মানুষের ‘মাংসে’ আসক্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি আরও খেতে চান। তার ক্ষুধা বাড়তে থাকে। নির্মালীর ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য সুমন নিজের শরীর আরও কাটতে চান; কিন্তু তার শরীরে যে অস্ত্রপচার করে সেই ‘ইলিয়াস দা’ বুঝতে পারেন যে সুমন কী করছেন। তাই তিনি সুমনের শরীর থেকে আর মাংস কাটতে বা সার্জারি করতে অস্বীকৃতি জানান। সুমনের অনুরোধ আর ইলিয়াসের না-এর মধ্যে একসময় তাদের মাঝে ধস্তাধস্তি হয়। ইলিয়াস সুমনকে থাপ্পড় মারেন আর সুমন অভিমানে-অপমানে সেখান থেকে বের হয়ে যায়।


তিনি
তখন
প্রবলভাবে
‘আসক্ত’ মাংসাশী

ইলিয়াসের অস্বীকারের কারণে নিজের শরীরের মাংস কাটা নিয়ে সুমনের সংকট তৈরি হয়। তিনি নির্মালীকে জানান, সেদিনের মতো মাংস রান্না হবে না। নির্মালী তখন হাসপাতালে ডিউটিরত। সে অবস্থায় তিনি মাংসের ক্ষুধায় ক্ষিপ্ত হয়। নির্মালী তখনই সুমনকে ডেকে পাঠান এবং বলেন, যেকোনোভাবে হোক তাকে আজ মাংস খেতেই হবে। কিন্তু সুমন জানান, মাংস আজ পাওয়া যাবে না। তখন নির্মালী সুমনকে হাপাতালের মর্গে নিয়ে যান। মর্গে তখন একটি লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। নির্মালী বলেন, এ লাশ সড়ক দুর্ঘটনার। বেওয়ারিশ। এই লাশ থেকে মাংস কেটে নিলে কেউ বুঝতে পারবে না। নির্মালীর এমন ভয়ানক ‘অবস্থা’ দেখে সুমন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু নির্মালী অবুঝ। তিনি তখন প্রবলভাবে ‘আসক্ত’ মাংসাশী। তিনি সার্জারির ছুরি হাতে নেন। তিনি মাংস কাটতে উদ্যত। এ সময় মর্গে হাসপাতালের কোনো এক কর্মচারী এসে উপস্থিত হয়। তাতে সুমন ভীত হন এবং নির্মালীকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে যান।

আমিষ

নির্মালী বের হয়ে আসেন; কিন্তু তিনি কাতরভাবে সুমনকে বলেন, আজ তার মাংস চাই-ই চাই। এরপর নির্মালীকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি পৌছে দিতে সুমন ও নির্মালী হাঁটতে শুরু করেন। হাঁটতে হাঁটতে নির্মালী সুমনকে বলেন, মানুষের মাংস খাওয়ার জন্য তার একটা তীব্র ক্ষুধা তৈরি হয়েছে। যদি তিনি একবার পেটপুরে মানুষের মাংস খেতে পারতেন, তবে হয়তো তার এই ক্ষুধা মিটে যেত। কিন্তু সুমন ভয় পান। তিনি বলেন, যদি ক্ষুধা না মেটে। যদি এরপর ক্ষুধা আরও বেড়ে যায়?

এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া হয় না।

কিছুক্ষণ নীরবতার পর আলাপ চলে, কীভাবে মানুষ মারা যেতে পারে। বিষ দিয়ে নাকি গলা কেটে। বিষ দিয়ে মারলে সে মাংস তো খাওয়া যাবে না। তাই অন্য উপায়ে মারার পন্থা ঠিক হয়। নির্মালীর পরিস্থিতিতে সুমন কাতরতা বোধ করেন। তিনি বলেন, আজ রাতেই মাংসের ব্যবস্থা করবেন। নির্মালী এতে খুশি হন। তিনি বলেন, মাংস নিয়ে যেন সুমন নির্মালীর ক্লিনিকে চলে আসেন। আর সুমনকে এও বলেন, যেন সুমন কেবল হাত ও পায়ের মাংসই নিয়ে আসেন।

এরপর সুমন গুয়াহাটি শহরে র‌্যানডম ঘুরে বেড়ান। খুঁজে বেড়ান তার শিকার। মাংস কাটার জন্য কেনে্ন একটি বড় ছুরি। নানা পথে-ঘাটে ঘুরেও তিনি তার সম্ভাব্য শিকার শনাক্ত করতে পারেন না। পরে তিনি এক রিকশাচালককে ভাড়া করেন। যাত্রী বেশে। এ সেই রিকশাচালক, যাকে ছবির শুরুতেই দেখানো হয়েছে। এই চালক তার রিকশার লোহার পাইপে রেডিও বেঁধে গান শোনেন। সুমন তাকে নিয়ে আসেন এক নির্জন ওভারব্রিজের নিচে। সেখানে আচমকা গলা টিপে হত্যা করে রিকশাচালককে। হত্যার পর মৃতদেহ ওভারব্রিজের নিচে নিয়ে যান।

সেখানে মাংস কাটার সময়ে এক পেট্রোল পুলিশ জিপ আসে। পুলিশ কর্মকর্তা মূত্রত্যাগের পর কাটাকাটির শব্দ শুনতে পান। শব্দের উৎসে গিয়ে দেখেন, সুমন মৃতদেহ থেকে মাংস কাটছেন। তিনি সুমনকে ধাওয়া দেন এবং কয়েকজন পুলিশ মিলে সুমনকে ধরেও ফেলেন।

রাতভর সুমনকে পিটিয়ে পুলিশ পুরো ঘটনা জানতে পারে। এ দিকে সুমনের অপেক্ষায় বারবার এসএমএস করতে করতে নির্মালী তার বাড়ির ব্যালকনিতেই ঘুমিয়ে পড়েন। ভোর হয়। নির্মালীর গৃহকর্মী নির্মালীকে এসে জাগায়। পিকু, মানে নির্মালীর সন্তানকে স্কুলে দিতে হবে। নির্মালী পিকুকে স্কুলের বাসে তুলে দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।


মানুষের মাংস
মানুষে খাওয়ার গল্প

চাঞ্চল্যকর এ খবর দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের মাংস মানুষে খাওয়ার গল্প। গণমাধ্যমে শোরগোল ওঠে। পুলিশ কাস্টডিতে সুমন ও নির্মালীকে পৃথক ঘরে রাখা হয়। এরপর তাদেরকে কারাগারে অথবা আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময়ে তাদের মুখ ঢেকে দেওয়া হয়। মুখঢাকা নির্মালী ও সুমন পাশাপাশি দাঁড়ান পুলিশের থানার সামনে। গাড়িতে তোলার আগে সাংবাদিকদের সামনে তাদের ফটোসেশন হয়। সেখানে নির্মালী প্রথমবারের মতো ছুঁয়ে দেন সুমনের হাত। মুখঢাকা সুমন ও নির্মালী তখন পরস্পরের হাত ধরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে। অবশেষে তাদের হাত ‘ধরা’ যখন ঘটছে, তখন তাদের সামনে গোটা বিশ্বের গণমাধ্যম, সমাজ এবং রাষ্ট্র হাজির।

এভাবেই ছবিটি শেষ হয়।

২.

তো, আমরা যদি শেষ থেকেই শুরু করি। কী হতো যদি সুমনের সঙ্গে নির্মালীর সহজ সম্পর্ক হতো। তাদের শারীরিক, মানসিক ঘনিষ্ঠতা যদি সহজে হয়ে যেত, তবে কি তাদের এই পরিণাম হতো?
যদি তাদের দুজনের চাওয়ার সহজ মীমাংসা হতো, তবে কি সুমনের প্রয়োজন হতো নিজের শরীর কেটে নির্মালীকে খাইয়ে নির্মালীর শরীরের ‘ভেতরে’ প্রবেশ করার?

মনে হতে পারে এটা একটা প্রবল অ্যাবসার্ড পরিস্থিতি। কিন্তু এ তো নতুন কিছু নয়। মানে এই শারীরিক ‘ভেতর’ বা ‘বাহির’। এই ছুঁয়ে দেখা বা ছুঁয়ে থাকা, পাওয়া বা পেতে চাওয়ার আকুতি এবং পেতে পেতে পাওয়ার আসক্তি, সবই ভীষণভাবে জাগতিক। চারপাশে এ হরদম ঘটছে। প্রাত্যহিক। হয়তো এভাবে ঘটছে না, মানে মানুষের মাংসা খাওয়ার মতো ‘ক্যানিবাল’ ভয়াবহতা হয়তো নেই। কিন্তু এ আকুতি জীবনেরই অংশ। হয়তো এভাবে নয়। অন্যভাবে আছে, ঘটছে। কিন্তু আছে।

বাংলায় বহু কবিতা-গানে এ ধরনের আকুতি হাজির আছে। বহু আগে থেকেই আছে। হয়তো তার প্রকাশ কোনো কোনো ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাগতিক। হয়তো তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভীষণভাবে শারীরিক। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো তা কেবল মানসিক। এ অনুভূতি এমন যেন, সে কাছেই আছে কিন্তু পাচ্ছি না– তাকে পেতে চাই। নিজের করে পাওয়ার এই ‘আকুতি’ নতুন নয়।
আমরা যদি কেবল কাজী নজরুল ইসলামের দিকে দেখি। তবে দেখব তাঁর মাঝে এমন আকুতি বিভিন্ন রূপে হাজির হয়েছে।

আমিষ

চট করে এখনই আমি নজরুল থেকে ভিন্ন ভিন্ন ভাব ও ভঙ্গির তিনটি উদাহরণ দিতে পারি। যেমন ধরুন তাঁর একটি গান এমন:

“আমি যদি আরব হতাম– মদিনারই পথ
এই পথে মোর চ’লে যেতেন নূর নবী হযরত।
পয়জার তাঁর লাগত এসে আমার কঠিন বুকে;
আমি ঝর্ণা হয়ে গ’লে যেতাম অমনি পরম সুখে।”

এখন ভাবুন। এই গানে নজরুল যে আকুতি জানাচ্ছেন, তা কেমন আকুতি। তিনি আরবের পথ হতে চেয়েছেন যেন তাঁর বুকে নবীর ‘পয়জার বা পাদুকার’ চিহ্ন তিনি ধারণ করতে পারেন। এই আকুতিতে শ্রদ্ধা আছে, আছে ভক্তি এবং আছে প্রবল সমর্পণ। এও কি প্রেম নয়? অবশ্যই প্রেম। নয় কেন?

আরেক গানে নজরুল বলছেন:

“শ্যামা নামের লাগলো আগুন আমার দেহ ধূপ-কাঠিতে
যত জ্বলি সুবাস তত ছড়িয়ে পড়ে চারিভিতে।
ভক্তি আমার ধূপের মত, উর্ধ্বে ওঠে অবিরত
শিব-লোকের দেব-দেউলে মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।”

এই গানে শ্যামা মায়ের শ্রীচরণ পরশিতে বা স্পর্শ করার আশায় নিজেকে ধূপের মত জ্বালাতে চাইছেন নজরুল। যাতে ধূপের ধোঁয়ার মতো উর্ধ্বে উঠে দেব-দেউলে পৌঁছাতে পারেন।

আগের গানের যে নজরুল, সেই একই নজরুল এই গানেও উপস্থিত। পার্থক্য কোথায়? এই গান দুটিতে একই বিষয়ের স্পর্শ তীব্র। আর তা হলো ভক্তি এবং সমর্পণ। ভালোবাসার কাছে সমর্পণ। এ ভক্তি প্রেমেই জন্ম নেয়। এ প্রেম বেহেস্ত বা স্বর্গ পাওয়ার আশায় তো নয়।

ঠিক এই আধ্যাত্মিক নজরুলই আবার গাইছেন:

“তেপান্তরের মাঠে বঁধু হে একা বসে থাকি
তুমি যে পথ দিয়ে গেছ চ’লে সে পথের ধূলা মাখি হে,
একা বসে থাকি।
যেমন পা ফেলেছো গিরিপথে রাঙ্গা পথের ধূলাতে
তেমনি করে আমার বুকে চরণ যদি বুলাতে,
আমি খানিক জ্বালা ভুলতাম ঐ মানিক বুকে রাখি হে
একা বসে থাকি।”

কী বলবেন এই গানকে? কৃষ্ণের জন্য বিরহী রাধার আকুতি। নাকি কোনো প্রেয়সীর জন্য নজরুলের নিজের আকুতি? যারই হোক, তাঁর আকুতি এমনই তীব্র যে, নিজের অস্তিত্বকে ভুলে প্রেমার্থের পায়ের স্পর্শ পাওয়া ধূলা মেখে পথে বসে থাকেন। তিনি পথে নিজের বুক পেতে দিতে চান, যেন বুকের ওপরে প্রেমার্থের চরণের স্পর্শ নিতে পারেন।


আমিষ-এর
এ দৃশ্যাবলি ভয়ানক
ও বিপদজনক হলেও এর
ভেতরের যে সুর, তা
অ্যাবসার্ড
নয়

এসব যদি অ্যাবসার্ড না হয়, তবে আমিষ-এর এই গল্প কীভাবে অ্যাবসার্ড? সে কি কেবল মানুষের মাংস খাওয়ার ভয়ানক নির্বিকার দৃশ্যাবলির জন্য? হয়তো, তাই। হয়তো বলছি; কারণ, আমিষ-এর এ দৃশ্যাবলি ভয়ানক ও বিপদজনক হলেও এর ভেতরের যে সুর, তা অ্যাবসার্ড নয়। এ খুব প্রচলিত বাসনা। এখানে মাংস কেবল রূপক। এ রূপক যৌনতার। এ রূপকunconscious desire-এর। যা এক শরীর থেকে অন্য শরীরে প্রবেশ করে। এ রূপক এত সহজ তবুও কেন এই ছবি অনেকের কাছে এতটা অদ্ভূত?

এই গল্পের প্রধান সুর আমার ধরতে অসুবিধা হয়নি। হয়নি, কারণ আমার শৈশবের উত্তরকালে, মানে তারুণ্যের প্রথম দিনগুলোর একটি স্মৃতি এখনো মনে বেশ সজীব আছে। এ গল্প ব্যক্তিগত।

আমার এক বাল্যবন্ধু। কবি। মানে তখন সে কবিতা লেখে। আর এখন তো সে বাংলাভাষার কবিদের মধ্যে বেশ পরিচিত এবং আলোচিত। তাই এখানে তার নাম উহ্য থাকুক।

আমার সে বন্ধু তখন প্রেমে আচ্ছন্ন। রাতদিন সে সেই প্রেমে নিজে যেমন আচ্ছন্ন, তেমনি তার প্রেমের তীব্র পরিস্থিতি দেখে আমরাও আচ্ছন্ন। একদিন আমার সে বন্ধু আমায় বলে, জানিস, আমার ইচ্ছে করে তাঁতি হই।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন? হঠাৎ তাঁতি হওয়ার শখ কেন?

সে বলল, আমার ইচ্ছে করে ‘ওর’ কাপড়গুলো আমি বুঁনে দিই। তাতে আমার হাতের স্পর্শে জড়িয়ে থাকবে সে সারাটাদিন।

আমার বন্ধুর কথা শুনে আমি হতবাক। সে বয়সে এ ধরনের কথা আমি আগে শুনিনি। আমার বন্ধু যে তার বক্তব্যে সিরিয়াস, তা তার মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম। ও যে শুধু ওর প্রেমার্থের জন্য কাপড় বুঁনতে চাইছিল– তা নয়; ওর দুঃখ ছিল যে, অন্যের বোঁনা কাপড় ওর প্রেমার্থ পরে। অর্থাৎ, অন্যের হাতের স্পর্শ তাকে ছুঁয়ে দেয়।

ওর সেই ভাবনা তখন এবং এখনও আমার কাছে অভিনব লাগে। নতুন এবং ভয়ানক মনে হয়। ভয়ানক; কারণ কারও প্রতি এই obsessed মনোভাব স্বাস্থ্যকর নয়। এই obsessed মনোভাব থেকে বহু অঘটন ঘটে। যা পারস্পরিক সর্ম্পককে চুরমার করে দেয়। যাহোক, আমার বন্ধুর ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটেনি। হয়তো এখন সে এ ঘটনা মনেও রাখেনি। কিন্তু আমার মনে আছে।

আর মনে আছে বলেই আমি আমিষ-এর সুমনকে বুঝতে পারি। আর বুঝি যে ভাস্কর হাজারিকা আদতে কোনো নতুন আইডিয়ার বুনিয়াদ গড়েননি। নিজের বাসনা যাকে তাকে ‘কাছে পাওয়ার’, ‘জড়িয়ে থাকার’ এই আকুতি চিরকালের। আর তাই এই আইডিয়া আমাদের সমাজে, শিল্পে, সংস্কৃতিতে বিভিন্ন রূপকে, বিভিন্নভাবে হাজির আছে।

ভাস্কর হাজারিকা এই নিত্য হাজির থাকা ‘আকুতি’কে বাস্তবিক অর্থে একটু push করেছেন। কল্পনায় আরও একটু সামনে নিয়ে গেছেন। কাজটা তিনি বিপদজনকভাবে করেছেন। এবং কিছুটা বিপদও ডেকে এনেছেন। যে কারণে তার এই ছবি দেখে কারও কারও বমির উদ্রেক হয়েছে। তাদের কাছে এই ছবি দেখার মানসিক আঘাত ভয়ঙ্কর মনে হয়েছে। কেউ কেউ এই চলচ্চিত্র দেখার মানসিক আঘাত কয়েকদিন মাথায় বয়ে বেড়িয়েছেন।

যেভাবেই তা ঘটুক, মানসিক এই আঘাত পাওয়াটা ভালো কথা নয়। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে, ভাস্কর এটাই চেয়েছেন। মানে তিনি দর্শককে এই আঘাতটা দিতে চেয়েছেন। সে তর্কেও বলব, এটা ভালো ব্যাপার নয়।

আমিষ

৩.

আমিষ-এ ভাস্কর হাজারিকার নারী-পুরুষ সম্পর্কের এই আইডিয়াটি কেবল পুরোনো তা নয়। ওর গল্পবলার ধরনটিও পুরোনো। কেমন করে? বলছি।

একটি ছেলে একটি বিবাহিত মেয়ের প্রেমে পড়েছে। সে প্রেম অনেক বেশি দেহগত বাসনার অন্তর্গত। কিন্তু মেয়েটিকে তার পাওয়া হচ্ছে না। কারণ মেয়েটির পরিবার-সমাজ-সন্তানের দায়, টানাপড়েন। উপরন্তু ছেলেটি মেয়েটির চেয়ে বয়সে ছোট। তাই মেয়েটি চাইলেও ছেলেটির আকাঙ্ক্ষায় সাড়া দিতে পারে না।

এরপর নানা অঘটন পেরিয়ে মেয়েটি বুঝতে পারে, একমাত্র এই ছেলেটিই তাকে বুঝতে পারে। তখন নানা অঘটনে সব কিছু হারিয়ে, জীবনের চরম মূল্য চুকিয়ে ছেলেটি এবং মেয়েটি পরস্পরকে পায়। এই হলো আমিষ-এর গল্প।

গল্পটি একটু ভিন্নভাবে হলেও গল্পটির সমাপ্তির ধরণ অতি পরিচিত। পরিচিত কারণ, এ এমন এক চলচ্চিত্রের সমাপ্তির ধরণ– যা ভুলে যাওয়া অসম্ভব। ছবিটি হলো ফরাসি চলচ্চিত্রকার রোবের ব্রেসোঁ নির্মিত পিকপকেট। ১৯৫৯ সালে ফ্রান্সে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি বিশ্বচলচ্চিত্রের অন্যতম ক্লাসিক বা চিরায়ত চলচ্চিত্রের উদাহরণ।

সে ছবির চরিত্র মিশেল। যে জান নামের একটি মেয়েকে ভালোবাসে। কিন্তু তার কাছে পৌঁছাতে পারে না। মিশেল এমন এক চরিত্র যে নিজেই নিজের কারাগারে বন্দি। জান তার কাছেই আছে, থাকে তবুও সে জানের কাছে পৌঁছাতে পারে না। শেষে নানা অঘটন পেরিয়ে যখন মিশেল রাষ্ট্রের কারাগারে বন্দি, তখন সে নিজের কারাগার ভেঙে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। আর তখন কারাগারের গরাদের দু’পাশে দুজন দাঁড়িয়ে একজন অপরকে ভালোবাসে, জড়িয়ে ধরে বা ধরতে চায়।

এবং জানকে একটু ছোঁয়ার আকুতিতে মিশেল বলে,
Oh, Jeanne, to reach you at last, what a path I had to take.

পিকপকেট-এর শেষ সিকোয়েন্সে মিশেল জানকে এ কথাটি বলে। সেটিই আদতে চলচ্চিত্র আমিষ-এর পুরো থিসিস। আমিষ-এর পুরো গল্পটি সাজানো হয়েছে এই অন্তিমক্ষণটি বা শেষ সিকোয়েন্সটিকে সামনে রেখে। পিকপকেট আর আমিষ-এর শেষ দৃশ্যের দার্শনিক ভাবনার কোনো পার্থক্য নেই। যেটুকু পার্থক্য, তা হলো– আমিষ-এ ভাস্কর সুমন বা নির্মালীর কণ্ঠে এমন কোনো সংলাপ রাখেননি। কোনো সংলাপ না রাখলেও তিনি কি আসলে ব্রেসোঁর চিন্তার ছক এড়াতে পেরেছেন?
পারেননি।

সমাপ্তিতে এসে নির্মাতা ভাস্কর হাজারিকা পুরো দুনিয়ার সামনে নির্মালী ও সুমনকে যেভাবে একে অপরের হাতে হাত রেখে দাঁড় করিয়েছেন, যে লোকলজ্জা-সমাজ-পরিবারের ভীতিতে নির্মালী সুমনকে একটু ছোঁয়ার সুযোগ দেননি, সে নির্মালী সুমনের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছেন। তাতে সুমন বা নির্মালী কেউ কাউকে পিকপকেট-এর মিশেলের ওই কথাটি না বললেও কথাটি তো অব্যক্ত থাকে না।
থাকে কি?

৪.

ছবি দেখে মনে হয়েছে, ভাস্কর হাজারিকার আমিষ-এর গল্প প্রথমে কনসিভ করেননি। করেছেন পিকপকেট থেকে উৎসাহিত এই আইডিয়াটি। এরপর তিনি এই আইডিয়াকে আসামের প্রেক্ষিতে বসিয়ে গল্পটি বা গল্পের প্লট সাজাতে শুরু করেছেন। প্লট ধরে চরিত্র নির্মাণ করেছেন। আর এ কারণে গল্পের গাঁথুনি হয়েছে বড্ড আনাড়ি। চরিত্রগুলো হয়েছে গল্পের প্রয়োজনে। মেকি। আর এই গল্প আর চরিত্র ধরে এর নির্মিতি হয়েছে চলনসই। আহামরি কিছু নয়।


মনে
হয়েছে
চিত্রনাট্যকার
হিসেবে ভাস্কর একেবারে নবীন এবং কাঁচা

কারণ ছবির গল্পটির গল্প বড্ড বেশি সাজানো গোছানো। বানানো। এটা যে বানানো, তা বুঝতে তেমন কোনো চলচ্চিত্রবিদ্যারও প্রয়োজন নেই। মনে হয়েছে চিত্রনাট্যকার হিসেবে ভাস্কর একেবারে নবীন এবং কাঁচা। কেন বলছি এমন?

চলুন আমিষ-এর গল্পটি একটু ব্যবচ্ছেদ করা যাক।

পূর্বেই বলেছি, আমিষ-এর প্রটাগনিস্ট দুজন। এই দুজনকে একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট করতে এবং অন্তিম পরিণতিতে নিতে যা যা করণীয়, তার সবকিছুই ‘কার্য-কারণ’ মেপে তৈরি করা। আর এই ‘কার্য-কারণ’ পদ্ধতির বাঁশের বেড়ার বাঁশের চেলাগুলো চলচ্চিত্রে খুবই বাজেভাবে দৃশ্যমান ছিল। মোটামুটি ভালোমানের নির্মাতারা তাদের গল্পের বুঁননে এই বেড়ার চেলাগুলোকে সযত্নে আড়াল করতে সক্ষম হন। তাই তাদের গল্প এবং গল্পবলাটা বানানো হলেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।

চলচ্চিত্রে নির্মালী অসুখি দাম্পত্যের নারী। স্বামী প্রবাসী। গুয়াহাটি শহরে সন্তান নিয়ে মোটামুটি একা একজন নারী তিনি। তার সময় রুটিন ধরে চলে। অনেকটা একঘেঁয়ে। ঘরে তার কিছু করতে হয় না, গৃহকর্মী মিনা সব সামলে রাখেন। ক্লিনিকেও রোগী দেখা ছাড়া তার আর কিছু করার নেই। সন্তান পিকু এত ছোট নয় যে তাকে নিয়ে তার দুঃশ্চিন্তা হবে। নির্মালীর জীবনে যতটুকু অভাব, তা হলো একজন সঙ্গীর। তার অভাব যাপনের রোমাঞ্চের। তার অভাব জীবনের উদযাপনের। আর তার এ অভাববোধ আরও তীব্র করে তোলে তার বন্ধু জুমি।

জুমিও বিবাহিত। কিন্তু তার ‘অন্য’ সম্পর্ক আছে। জীবনে রোমাঞ্চ আছে। জুমি ক্রমাগত নির্মালীকে প্রভোকড করে। জুমির এই প্রভোকেশনও নির্মালীকে সুমনের প্রতি উৎসাহিত হতে রসদ জোগায়।

আসি সুমনের চরিত্রের বাস্তবতায়। সুমন পিএইচডি শিক্ষার্থী। কেন পিএইচডি শিক্ষার্থী? কেন মাস্টার্স পর্বের ছাত্র নন? কারণ পিএইচডি শিক্ষার্থীর অবসর থাকে। পরীক্ষার আপাত চাপ নেই। চলচ্চিত্রের গল্পে সুমন যে ধরনের সম্পর্কে পড়বে বলে নির্ধারিত, সে ধরনের সম্পর্কে প্রচুর সময় তাকে দিতে হবে। নির্মালীর ক্লিনিক আছে, এরপর হাসপাতাল আছে, সংসারও আছে। তাই নির্মালী তো অত সময় দিতে পারবেন না। সুমন খুঁজে বার করবেন, কোথায় কোন রেস্তোরাঁয় কী ধরনের মাংস পাওয়া যায়। চিত্রনাট্য অনুযায়ী নির্মালী শুধু সেখানে যাবেন। খাবেন এবং আসক্ত হবেন।

নির্মালীকে এবং নির্মালীর জন্য সুমনকে প্রচুর সময় দিতে হবে, তাই সুমনের মাস্টার্স পর্বের ছাত্র হলে চলবে না, তাকে হতে হবে পিএইচডি পর্বের ছাত্র। সুমন নিজের শরীরের মাংস কেটে রান্না করবেন, তাই তাকে গুয়াহাটি শহরে একা রাখতে হবে। সুমন যদি নিজের পরিবারের সঙ্গে, মানে বাবা-মা-ভাই-বোনসহ থাকেন, তবে তো তিনি এই ধরনের ‘এক্সপেরিমেন্ট’ সে করতে পারবেন না। অতএব, সুমন থাকবেন একা এক হোস্টেলে। ছবিতে সুমনের ঘনিষ্ঠ কেবল একজন। তিনি ‘ইলিয়াস দা’। তিনি একজন পশু চিকিৎসক।

কেন পশু চিকিৎসক? কারণ তিনি সুমনের শরীরের মাংস কেটে দিয়ে তার এক্সপেরিমেন্টে সহযোগিতা করবেন। এবং চলচ্চিত্রের গল্পের প্রয়োজনে এই পশু চিকিৎসকই ‘মানবিক কারণে’ সুমনের শরীর থেকে শেষবারের মতো মাংস কেটে দিতে অস্বীকৃতি জানাবেন। ফলে চলচ্চিত্রের গল্পটি সহজেই ক্লাইমেক্সে প্রবেশ করবে।

আমিষ

নির্মালীর স্বামী একবার প্রবাস থেকে এসে চটজলদি ফিরে যাবেন। যদি এমন দ্রুত ফিরেই যাবেন, তবে তিনি গল্পে এলেন কেন? কারণ তিনি না এলে নির্মালীর চরিত্রের টানাপোড়েন, একাকীত্ব, দাম্পত্যের অসুখিভাব– এসব তো স্পষ্ট হবে না। অতএব গল্পে তার দ্রুত আসা এবং দ্রত প্রস্থান।

নির্মালী ক্লিনিকের পাশাপাশি হাসপাতালেও চাকরি করেন। করতেই হবে। না হলে চিত্রনাট্যে থাকা মর্গের দৃশ্যটি কীভাবে চিত্রায়িত হবে? দুজন মাংসখেকো চাইলেই তো যে কোনো মর্গে ঢুকে নরমাংস সংগ্রহ করতে পারবেন না। পারবেন কি?

আর এই চলচ্চিত্রের শেষ অংকের মিডিয়া ট্রায়াল। সেও পরিকল্পিত। এমন এক গল্পের ছবি কি সহজে ভারতীয় সেন্সর সনদ পাবে? পাবে না।

তাই ছবির শেষ অঙ্কে ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’ বলাতে নির্মাতা পুলিশ, গণমাধ্যম হাজির করে ‘মানুষের মাংস’ খাওয়ার মতো ‘বিকার’কে আইন ও নীতির প্রশ্নে বাতিল করে দেন। শেষ অংকের এই পুলিশ, অর্থাৎ রাষ্ট্রের, গণমাধ্যম মানে সমাজের সার্কাসটুকু দিয়ে নির্মাতা আমিষ-এর সেন্সর সার্টিফিকেট নিশ্চিত করেছেন। পাশাপাশি এ দিয়ে তিনি নিজেকেও সামাজিক পুলিশিংয়ের হাত হতে ‘রক্ষা’ করেছেন। কিন্তু তাতেও কি তিনি পুরোপুরি দায়মুক্ত হতে পারছেন?

আমিষ দেখলে যে কারও মনে হবে, ভাস্কর, মানে ছবিটির নির্মাতা তার প্রধান দুটি চরিত্রকে একে অপরের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে এবং ছবির শেষে তাদেরকে একটি চমকপ্রদ পরিণতিতে নিয়ে যেতে গণিতের ছক কষে নামতা পড়াচ্ছেন। এ নামতা পাঠে তিনি কোথাও কোনো ফাঁক রাখেননি। গল্পের এই নামতা পাঠের বুনন এত নিশ্চিত, মানে অবভিয়াস যে, তা প্রকটভাবে বিশ্বাসহীনতাকে জাহির করে। গল্পটিকে আলগা মনে হয়।

৫.

আমিষ-এ রিকশাচালকের পরিণতি অবাক করেছে। রিকশাচালককে দিয়েই দৃশ্যময় গল্পটির শুরু হয়। শুরুর আবহসঙ্গীতটি রিকশাচালকের রেডিও বা ক্যাসেটপ্লেয়ার থেকেই বাজে। সেই একই রিকশাচলককে শেষে ‘খাদ্য’ হয়ে উঠতে হয়। কেন?

এ কি শ্রেণি সচেতনতা?

রাতে পুরো শহরময় ঘুরে সুমন তার সম্ভাব্য শিকার ধরতে পারেন না। শেষে তিনি পথে ঘুমানো বা পথবাসী একজন রিকশাচালকে কেন টার্গেট করেন। নিরাপদ বলে? নাকি ধনী বা মিডলক্লাসের আহার্য এই পথবাসী, দরিদ্র মানুষরা বলে?

যাই হোক। আমিষ-এ কেবল এই রিকশাচালকের উপাখ্যানটাই একটু ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। গল্পে এ একটু খাপছাড়া। হয়তো সে কারণেই এটাই একটু ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে।

আমিষ

৬.

প্রথমত আমিষ নিয়ে লেখার উৎসাহ ছিল না। কারণ এই ছবির কাঠামোর ভেতরে ভারতীয় বাণিজ্যিক ছবির ফর্মুলা বা প্রকরণ খুঁজে পাই। দর্শককে চমক বা ভড়কে দেওয়ার বলিউডি বানানো কারসাজি। আমিষ-এর গল্পে আসামের কিছুই খুঁজে পেলাম না। চলচ্চিত্রটির ভাষা ‘অসমীয়া’ বদলে যদি একে ভারতের অন্য যে কোনো অঞ্চলের প্রেক্ষিতে বা সেটিংয়ে ফেলে দেওয়া যায়, তবে এর গল্পটিতে এতটুকু সমস্যা হবে না। কারণ নির্মালীর যে টানাপড়েন আর সুমনের যে ‘বাসনা’, তা অধিকাংশ ভারতীয় নারী বা পুরুষের টানাপড়েন বা বাসনারই উদাহরণ। এ তো নতুন কিছু নয়।


ছবির শেষ
সিকোয়েন্সগুলোতে
মাংস খাওয়ার জন্য তার যে
ক্ষুধার্ত মরিয়া ভঙ্গি, তা ভয়ানক

নতুন যা এবং যতটুকু, তা হলো, ওই প্রেমের জন্য নিজের শরীরের মাংস কেটে প্রিয়মানুষকে খাওয়ানোর চমক। এই চমকের সঙ্গে প্রশংসা করতে হয় ছবির প্রধান চরিত্র, মানে নির্মালীর ভূমিকায় অভিনয় করা লিমা দাসের। মূলত তার অভিনয় ছবিটি দেখবার জন্য বসিয়ে রেখেছে। সহজ এবং সাবলীল অভিনয়। ছবির শেষ সিকোয়েন্সগুলোতে মাংস খাওয়ার জন্য তার যে ক্ষুধার্ত মরিয়া ভঙ্গি, তা ভয়ানক। এ মনে থাকবার মতো অভিনয় দক্ষতা। সুমন চরিত্রের অগ্রদ্বীপ বড়ুয়াও ভালোই করেছেন। মন্দ নয়।

এসব ছাড়া আমিষ-এ আসাম কোথায়? সুন্দর বা মিষ্টি অসমীয়া ভাষার সংলাপ, দুই একটি গান বা গানের সুর ছাড়া এ ছবিতে আসামকে আর কোথাও খুঁজে পেলাম না!

নির্মাতা ভাস্কর হাজারিকা ছবিটির যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করেননি, তা নয়। তবে তিনি এখনো গল্প বলায় এবং নির্মাণে অনেকখানি আনাড়ি। সে কারণে তার গল্পের গাঁথুনি এত আলগা। তবে তিনি আমিষ-এ যে থেমে যাবেন, এমনটা মনে করি না। আশা করি তিনি আরও চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন এবং সেসব চলচ্চিত্র সত্যিকারের পরিণত কাজ হবে। বাস্তবিক অর্থে আমিষ-এ তাকে চলচ্চিত্রের ক্লাসের কেবল ভালো ছাত্র মনে হয়েছে, ছাত্রই বটে। পরিণত নয়।

হয়তো সে কারণেই তার আগামীর কাজের বিষয়ে আগ্রহী থাকব। কিন্তু আশা করব, তিনি তখন আর ছাত্র থাকবেন না। তিনি তখন ফেব্রিকেটেড ছবি না বানিয়ে হয়তো অর্গানিক ছবি বানাবেন। অনেকটা তার নিজের অঞ্চলের নির্মাতা রিমা দাসের মতো, যিনি ভিলেজ রকস্টার বানিয়ে আমাদের মনে মুগ্ধতা তৈরি করেছেন।

আমিষ

৭.

অতি সম্প্রতি আমি স্প্যানিশ একটি চলচ্চিত্র দেখেছি। ছবিটির নাম দ্য প্ল্যাটফর্ম। ছবিটি এ বছরই [২০২০] মুক্তি পেয়েছে। এ ছবিটির গল্প ও দৃশ্যায়ন অভিনব এবং চমকপ্রদ। ছবিটি দেখে এ ছবির ভাবনার গভীরতা ও চিন্তার বহুমুখি সম্ভাবনায় মুগ্ধ হয়েছি। পাশাপাশি দ্য প্ল্যাটফর্ম-এর অতি ভায়োলেন্স এবং ছবিতে ক্যানিব্যালিজমের ভয়াবহতায় প্রবলভাবে বিরক্ত হয়েছি। মানুষ মানুষকে খাচ্ছে– এ চিত্র দেখাটা ভয়ানক। তা যে ফর্মে, যে কোনো চিন্তা থেকে উৎসারিত হোক না কেন। এ ভয়ঙ্কর ইমেজ ভীষণ বিপদজনক। বর্বরতা দেখানো ছাড়া যদি চিন্তা প্রকাশ অসম্ভব হয়, তবে তা শৈল্পিক চিন্তাশূন্যতাই। বন্ধ্যাত্ব। যে কোনো ফর্মে এ বর্বরতা মানুষের মনকে বিষময় করে তোলে।

দ্যা প্ল্যাটফর্ম এবং আমিষ— এ দুটো চলচ্চিত্রেই এই ক্যানিবালিজমের উদযাপন দেখানো হয়েছে। কাছাকাছি সময়ে দেখা দুটি চলচ্চিত্রে এই ক্যানিবাল প্রবণতা আমাকে ভাবিত করেছে। একটি ছবি স্পেনে নির্মিত। আর অন্যটি ভারতের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া একটি প্রদেশে। বিষয়বস্তুর এই মিলটুকু অদ্ভুত। কাকতালীয় হলেও তা চিন্তা উদ্রেককারী। সব কিছু বাদ দিয়ে আমার মনে প্রথম যে প্রশ্নটি জেগেছে, তা হলো, কেন ক্যানিবালিজম?

এ কি পৃথিবীর মানুষের সামগ্রিক কোনো অসুখের পূর্বাভাস?

পৃথিবীর মানুষের আজ এমনই দুর্ভোগ যে, এই একবিংশ শতকের এত উন্নতি আর প্রাচুর্যের বিজ্ঞাপনের মধ্যেও মানুষকে মানুষ খাচ্ছে– এ রকম ভয়ানক দৃশ্য অভিনীত হচ্ছে। এতটা নৈরাশ্য, এতটা বিকার কি নেওয়া যায়? আমি তো পারি না!



ধরনের
দৃশ্যময়তা
মানুষের মানসিক ও
শারীরিক নিরাপত্তার জন্য বিপদজনক

এই ছবিগুলো বা এ ধরনের চলচ্চিত্র দুনিয়ার বিভিন্ন বয়সের, শ্রেণির মানুষের মনে-ভাবনায় মানুষের ‘মাংস’কে ‘লোভনীয়’ করে তুলছে কি-না, তা ভাবতে হবে। ভাবতে হবে, এই দৃশ্যময়তা সামাজিক পরিসরে মানুষের মাংস ‘সুস্বাদু’– এই বিজ্ঞাপনের ‘সম্মতি’ প্রদান করছে কি-না। যদি তা হয়, তবে এ ধরনের দৃশ্যময়তা মানুষের মানসিক ও শারীরিক নিরাপত্তার জন্য বিপদজনক।

আর সব কিছু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র এ কারণেই আমি নির্মাতা ভাস্কর হাজারিকাকে আমিষ নির্মাণের জন্য ধন্যবাদ দিতে পারি না। তার চলচ্চিত্রের এই বিপদজনক দৃশ্যময়তা আমাকে দূরবর্তী আশঙ্কায় শঙ্কিত করে। আমি মানুষের মানুষকে ‘খাওয়ার’ এই উদযাপন বা ‘শিল্প’ কারুকার্যের অন্তসারশূন্যতা এবং এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের দিকটিকে উপেক্ষা করতে পারি না। তাই শিল্পচর্চায় সমস্ত নিরীক্ষাপ্রবণতার কথা রেখেই এই অবদমিত দেহবাসনার কারুকাজকে ‘চমকে’ দেওয়ার বিপদজনক বাসনা হিসেবেই দেখছি। মাংসের ক্ষুধার মতোই এক তীব্র অজ্ঞান অন্ধকার ঘিরে থাকে চমকে দেওয়ার বাসনায়।

এ বাসনারই এক উগরানো চলচ্চিত্র নির্দশন আমিষ

৩০ মে ২০২০
Print Friendly, PDF & Email
লেখক; চলচ্চিত্র নির্মাতা; চলচ্চিত্র সংগঠক। ঢাকা, বাংলাদেশ। সাধারণ সম্পাদক, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ। সভাপতি, ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি। নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র : অনিবার্য [ পোশাক শ্রমিক আন্দোলন; ২০১১]; পথিকৃৎ [চলচ্চিত্রকার বাদল রহমানের জীবন ও কর্মভিত্তিক; ২০১২ (যৌথ নির্মাণ)]; সময়ের মুখ [জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জীবন অবলম্বনে; ২০১৮]। সম্পাদিত ফিল্ম-ম্যাগাজিন : ম্যুভিয়ানা; চিত্ররূপ। সিনে-গ্রান্থ : চলচ্চিত্রপাঠ [সম্পাদনা]; চলচ্চিত্রের সাথে বোঝাপড়া; স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের ইশতেহার : বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ; চলচ্চিত্রকথা [তারেক মাসুদের বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার; সম্পাদনা]। পরিকল্পক ও উৎসব পরিচালক : নতুন চলচ্চিত্র নতুন নির্মাতা চলচ্চিত্র উৎসব

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here