সিনেমা বানাবই, কারণ সিনেমাকে ভালোবাসি : ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা

351
ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা

অনুবাদ । তানভীর পিয়াল

অনুবাদকের নোট
মারিও পুজোর দ্য গডফাদার সিনেমা হিসেবে মুক্তি পাবার পর, দুনিয়া জোড়া খ্যাতি পেলেন অনেকে। তাদের একজন সিনেমাটির পরিচালক স্বয়ং। সিনেমাটি মুক্তির আগে তাকে তার অসফল সিনেমাগুলোর জন্য খুব অল্প কিছু মানুষই চিনতেন। মুক্তির পর এই সিনেমা যেমন বিশ্ব চলচ্চিত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ সিনেমাটির পরিচালকও। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে না হলেও নিজের অতীতকে কখনো ভোলেননি তিনি। দ্য টকস-এর জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে নিজের অতীত, বর্তমান এমনকি ভবিষ্যৎ নিয়েও তিনি কথা বলেছেন, বলেছেন নিজের দেখা হলিউড ইন্ডাস্ট্রি নিয়েও। ইনি ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা। নিউ হলিউড ওয়েভ বা আমেরিকান নিউ ওয়েভ ধারার গডফাদার এই মার্কিন পরিচালক ১৯৩৯ সালের ৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। আর, এই সাক্ষাৎকারটি ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারকের নাম ছাপা হয়নি।

ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা
ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা

  • এক সময় আপনি বলেছিলেন, যারা পয়সাওয়ালা তাদের পক্ষে ভালো শিল্পী হওয়া মুশকিল। এখনো কি সেটা বিশ্বাস করেন?

ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা : : আজকাল আমার মনে হয় বড়লোক হওয়াই ভালো; কারণ আপনি তাহলে পয়সা কামানোর জন্য সিনেমা বানাবেন না! সেসব কেউ দেখতেও যাবে না। আর যদি টাকাই কামাতে চান, আপনি সেইসব সিনেমা বানাতে চাইবেন, সেসব সিনেমা অনেক বেশি মানুষ দেখতে চায়– সেইসব সিনেমার মতো, যা তারা আগেও অনেকবার দেখেছে। এজন্যই ওরা প্রচুর সিক্যুয়াল বানায়। একটা সিনেমা বানানো তাদের জন্য রিস্কের। তারা রিস্ক পছন্দ করে না। সেটা যেকোনো ব্যবসাতেই।

  • এই প্রবণতার বিরুদ্ধে যাওয়াটা কি কঠিন নয়?

কপোলা : : কঠিন তখনই, যখন আপনি দর্শককে তাদের অভ্যস্ততার বিপরীতে নিতে চাইবেন। ইন্ডাস্ট্রি এ রকম ভিন্ন ধারার সব ছবিতে টাকা ঢালবে না। তারা চায় কোকা-কোলার মতো কিছু। যা আপনি কিনবেন, খাবেন, তা-ই তারা বানিয়েই যাবে আর প্রচুর টাকা আসতে থাকবে।

  • শিল্পের প্রতি এই অনাগ্রহের কারণ কী?


সাউন্ড
এসে সব
নষ্ট করে দিলো;
সিনেমা হয়ে গেল নাটক

কপোলা : : এটার শুরু অনেক আগেই। নির্বাক যুগে বার্লিনে আধুনিক সিনেমা ও গল্প বলার ভঙ্গি আসলেই সফিস্টিকেটেড হয়ে উঠেছিল, এবং জার্মানরা ইমেজ দিয়ে গল্প বলার ধরনটা খুব ভালো রপ্ত করছিল। কিন্তু সাউন্ড এসে সব নষ্ট করে দিলো; সিনেমা হয়ে গেল নাটক।

মুরনৌ [এফ. ভি. মুরনৌ; জার্মান ফিল্মমেকার] একবার বলেছিলেন, ‘সাউন্ড অবশ্যম্ভাবীই ছিল; কিন্তু সেটা তবে জলদিই চলে এসেছে। কারণ, তখনো আমরা আসলে কী করে সিনেমা বানাতে হয়– সেটা শিখছিলাম।’ খুব অল্প বয়সেই চলে গেলেও, বেশ কিছু ভালো সিনেমা তিনি বানিয়ে গেছেন।

  • সিনেমার বাণিজ্যিক দিকটাকে যদি আপনি হিসাবে না-ই ধরেন, তাহলে আপনার কাছে সফলতার সংজ্ঞা কী?

কপোলা : : যখন আপনি দশটা মানুষকে খাবারের দাওয়াত দেন, চাইবেন তারা যেন বলে, ‘খুব দারুণ হয়েছে।’ আপনি চাইবেন না লোকে বলুক, ‘তোমার আয়োজন আমার ভালো লাগে নাই, এটা বাজে।’ কিন্তু সিনেমা বাণিজ্যে আপনি বছর ধরে কাজ করতে পারেন, আর লোকে বলবে, ‘এটা বাজে, জঘন্য, স্টুপিড।’ আপনার হৃদয় ভেঙে যাবে যদি লোকে আপনার আয়োজন নিয়ে এই ধরনের রিঅ্যাকশন দেয়। অর্থাৎ, আপনি চাইবেন লোকের এটা ভালো লাগুক; যেহেতু কাজটা করতে পারেন, চাইবেন আপনারও ভালো লাগুক।

কিন্তু সফলতা একটা ধোঁয়াটে ব্যাপার, এটা নির্ভর করছে কারা এটাকে ব্যাখা করছে তার ওপর। হ্যাঁ, টাকাটা বাস্তব; আর এইজন্যই লোকে তা চায়। আমার কপালে ছিল বলেই টাকা কামাতে পেরেছি।

ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা
দ্য গডফাদার
ফিল্মমেকার । ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা
  • আপনার কাজ বক্স অফিস ফ্লপ হলেও কি যথেষ্ট শান্ত থাকতে পারেন?

কপোলা : : বউকে বলেছি, ‘আমাদের অনেক ওয়াইন আছে, যেগুলো আমরা দিনে-রাতে মিলে খেলেও, আমাদের মৃত্যুর একশ বছরেও শেষ হবে না।’ টাকাও এমনই। সম্ভবত আমি প্রতি দেড় বছরে একটা করে সিনেমা বানাতাম, আর সেটা চলতো না। এরকম কয়েকবার করেছি।

  • মোটা অংকের টাকা কি আপনাকে দিয়ে সেই ধরনের সিনেমা বানিয়ে নিতে পারবে, যে ধরনের কাজ নিজে পছন্দ করেন না?

কপোলা : : সিনেমা বানাবই, কারণ সিনেমাকে ভালোবাসি। এটাতে প্রচুর কাজ। আপনার এমন কিছু নিয়ে সিনেমা বানানো উচিত, যেটা ‘আমি এমন একটা গল্প নিয়ে কাজ করছি, যেটায় কিছু একটা আছে’–এর চেয়েও বেশি কিছু। এবং যখন আপনি টাকার জন্য কাজটা করছেন, তখন সেখান থেকেও আপনার কিছু একটা খুঁজে নিতে হবে। এও অনেকটা ওই প্রস্টিটিউটের মতো, যে কি না স্রেফ একসঙ্গে শুতে হবে বলেই একটা ছেলের মধ্যে তার চুল সুন্দর কি না, কিংবা তার গলার স্বর ভালো কি না– তা খুঁজে নেয়। আপনাকে কিছু একটা খুঁজে নিতে হবেই, যা নিয়ে কাজ করবেন। কিন্তু, তাও যদি না পান, কাজটা আপনাকে টানছে কি না, অন্তত সেটা খুঁজে নিন।

  • আপনাকে কী টানে?

কপোলা : : আমি শিখতে চাই। আপনি কোনো একটা আইডিয়া বুঝলে পারলেন, কিংবা কোনো একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন, এটা আপনাকে আনন্দ দেবে। যখন ছোট ছিলাম, ভাবতাম পৃথিবীর সব প্রশ্নের উত্তর একদিন জেনে যাব। ভাবতাম, একদিন জানতে পারব ঈশ্বর আসলে কে, আর তিনি জানিয়ে দেবেন– কেন আমাকে সৃষ্টি করলেন।

আপনি ধরে নিচ্ছেন, এসব উত্তর আপনি জেনে যাচ্ছেন; অথচ, আপনি আসলে কিছুই জানছেন না!

ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা
অ্যাপোকেলিপস নাউ
ফিল্মনেকার । ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা
  • অ্যাপোকেলিপস নাউ বানিয়ে আপনি কী শিখলেন?

কপোলা : : দ্য গডফাদার-এর সাফল্যে উড়তে থাকা ৩২ বছরের সেই ছোকরাটা যখন ভিয়েতনাম নিয়ে সিনেমা করতে চাইল, কেউ সেটা ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেনি। কোনো স্টুডিও তাকে সাহায্য করে নাই, কোনো অভিনেতা তার সঙ্গে যোগ দেয় নাই; এরপরও সে সিনেমাটা বানাল নিজের টাকা দিয়ে, আর এটা বানানোর দায়ে ভ্যারাইটি [ম্যাগাজিন] তাকেই দোষী বানিয়ে দিলো। অনর্থক! আর, লোকজন কি না প্রশংসা করলো সুপারম্যান-এর, যেখানে একটা লোক একটা আজগুবি জামা পরে উড়ে বেড়াচ্ছে।


আমরা
এমন এক
দুনিয়ায় বেঁচে
আছি যেটা অর্থহীন
সব অসঙ্গতিতে
ভরা

অ্যাপোকেলিপস নাউ সিনেমাটা এ নিয়েই। আর আমি এটাই শিখলাম, আমরা এমন এক দুনিয়ায় বেঁচে আছি যেটা অর্থহীন সব অসঙ্গতিতে ভরা, আর লোকে সেসব মেনেও নিচ্ছে।

আপনি ইন্ডাস্ট্রির দিকে তাকান– কী নিয়ে সিনেমা বানাবেন? কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ই আপনার জন্য বরাদ্দ। যখন কেউ একটু অন্য রকম, নিজের সিনেমা বানাতে চায়, কেউ সেটার দিকে ফিরেও তাকায় না।

  • আপনি এখন অনেক শান্তশিষ্ট; কিন্তু লোকে বলে, কয়েক বছর আগেও নাকি এমন ছিলেন না। বিশেষ করে দ্য গডফাদার-এর পর, যখন আপনি অ্যাপোকেলিপস নাউ-এর শুটিং করছিলেন, নিজেই নাকি এক ধরনের খাপছাড়া ডন কার্লিওনি হয়ে উঠছিলেন?

কপোলা : : থিয়েটার আমাকে গড়ে তুলেছে, আর থিয়েটার অনেকটা পরিবারের মতোই। আপনি রিহার্সালে যাচ্ছেন, রিহার্সাল শেষে কফি খেতে যাচ্ছেন, প্রেমে পড়ে যাচ্ছেন গ্রুপেরই কোনো এক নারীর। এখানে সবাই এক; একে অপরের প্রতি মায়া-ভালোবাসাও গড়ে উঠছে।

ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা
দ্য গডফাদার-এর সেটে
ফিল্মমেকার ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা এবং অ্যাকটর মারলন ব্রান্ডো ও আল পাচিনো

ফিল্ম স্কুলে যখন গেলাম, সেখানে দেখলাম সবাই একা; আলাদা। দ্য গডফাদার করে যখন আমি সফলতা পেলাম, সেটা অনেকটা ঐ থিয়েটার মতো হয়ে গিয়েছিল, যেখানে জর্জ লুকাস কিংবা মার্টিন স্করসেজির মতন আমার অনেক ক্রেজি বন্ধুও ছিল। খুব শ্রদ্ধা পেয়েছিলাম। মনে হয় সেটা ওখান থেকেই হয়ে গেছে।

  • ‘সুখ সুখই’– আপনি বলেছিলেন…

কপোলা : : আমার ভাল্লাগে এটা।

  • একদম নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, ত্রিশ বছর আগে আর এখন আপনার কাছে কী সবচেয়ে সুখকর?

কপোলা : : আমার চাচা-চাচী, কাজিনরা যখন বাড়িতে আসত, শৈশবে ওটাই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে সুখের। একসঙ্গে ডিনার করতাম। ওরা ওয়াইন খেত, সঙ্গে থাকত আপেলের জ্যুস– এটাই সুখ আসলে।

সুখকে আমি সবসময়ই পেয়ে এসেছি পরিবারে, একে-অপরের সঙ্গে থাকায়, একা হয়ে যাওয়ায়। এবং এখনো যখন দেখি, সবাই হাসি-খুশি আছে, বাচ্চারা মজা করছে, কেউ কারও উপর ক্ষেপে যাচ্ছে না, মনে হয় এসবই আসলে সুখ।

ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা
অ্যাপোকেলিপস নাউ
  • আপনি কি মনে করেন, ত্রিশ বছর আগের চেয়ে এখন কম তাড়িত হন?

কপোলা : : সফলতার ব্যাপারে আমি উদ্বিগ্ন না। যখন আমার বাচ্চারা ছোট ছিল, তখন উদ্বিগ্ন হতাম। কেননা, তাদেরকে আমার সাপোর্ট দিতে হবে, আর আমি এটা নিয়ে চিন্তিতও ছিলাম। এমনকি আগে লোকে বলত, তোমার সিনেমা তো সফল। অথচ সিনেমাগুলো সাফল্য পায়নি। অ্যাপোকেলিপস নাউ বানাতে সময় লেগেছে অনেক। এটা আমার জন্য একটা দুশ্চিন্তা ছিল। এমনকি ভ্যারাইটিতে দ্য গডফাদার-এর দুর্দান্ত রিভিউ বেরিয়েছিল, যেটা আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার সিনেমাগুলোও ভালো করেছে। দশ বছর পরে এসে লোকজন ভালোও বলছে সেগুলোকে।

  • এই যে ক্রিটিকরা অবশেষে বুঝতে পারছে, আপনার সিনেমাগুলো দুর্দান্ত– এটা কি আপনাকে তৃপ্তি দেয় না?


অপেক্ষা
করার সময় মনে
হয় না আমার হবে

কপোলা : : এসব আমাকে তৃপ্ত করত; কিন্তু তারা তো একই কাজ এখনো করে যাচ্ছে! তাই ভেবে দেখলাম, আরও দশ বছর যদি অপেক্ষা করি, এটাই দেখব– এখন যা করছি, এসবও তখন ওদের কাছে দারুণ মনে হবে। কিন্তু অপেক্ষা করার সময় মনে হয় না আমার হবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here