স্মৃতির ওজু

190

মূল । চিশু রিয়ু
অনুবাদ । রুদ্র আরিফ

অনুবাদকের নোট
ইয়াসুজিরো ওজু [১২ ডিসেম্বর ১৯০৩–১২ ডিসেম্বর ১৯৬৩]। জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার। অনেকের মতে, ফিল্মমেকারদের ফিল্মমেকার। সিনে-দুনিয়ার অনেক খ্যাতিমান ফিল্মমেকারের কাজে তার প্রভাব টের পাওয়া যায়। ওজুর প্রয়াণের পর এই স্মৃতিচারণ করেছেন তার সিনেমার নিয়মিত মুখ, তুখোড় অভিনেতা চিশু রিয়ু [১৩ মে ১৯০৪–১৬ মার্চ ১৯৯৩]। ওজু-রিয়ু জুটির বিখ্যাত সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘টোকিও স্টোরি’, ‘অ্যান অটাম আফটারনুন’, ‘লেট স্প্রিং’ প্রভৃতি।
এই স্মৃতিকথা প্রথম ছাপা হয় ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ফিল্ম ম্যাগাজিন ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এর স্প্রিং ১৯৬৪ সংখ্যায়। সেটিরই পুনঃপ্রকাশ ম্যাগাজিনটির অনলাইন ভার্সনে আপলোড করা হয়েছে ১৫ মে ২০২০; ‘দেয়ার ওয়াজ অ্যা ফাদার : রিয়ু চিশু রিমেম্বারস ওজু ইয়াসুজিরো’ শিরোনামে। এটি তারই অনুবাদ…


সিনেমার জগতে আমি ঢুকেছি ১৯২৫ সালে। আর ওজু ফিল্মমেকার হয়েছেন ১৯২৭ সালে। নির্বাক সিনেমা দ্য বিউটি’স স্যরো [১৯৩১] ও টকিজ হোয়াট ডিড দ্য লেডি ফরগেট [১৯৩৭] বাদ দিলে, তার প্রায় সব সিনেমাতেই অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছি আমি। শুরুর দিকে আমাকে তিনি একেবারেই ছোটখাট চরিত্রে নিতেন। ১৯৩০ সালে প্রথমবার, আই ফ্লাঙ্কড, বাট…-এর মধ্য দিয়ে তার সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ কোনো চরিত্রে কাজ শুরু আমার। এরপর বিশ্বযুদ্ধ-পূর্বকালে তার বানানো পাঁচটি সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের সৌভাগ্য আমার হয়েছে; এর পাশাপাশি তিনি তার অন্য সিনেমাগুলোতেও আমাকে অল্প কয়েকটি শটের ছোটখাট চরিত্রে হলেও নিয়মিতই নিয়েছেন। বিশ্বযুদ্ধের পর তার প্রায় প্রতিটি সিনেমারই কেন্দ্রীয় চরিত্র করিয়েছেন আমাকে দিয়ে।

টোকিও স্টোরি
কাস্ট । চিশু রিয়ু, সেৎসুকো হারা
ফিল্মমেকার । ইয়াসুজিরো ওজু

ওজুর ডিরেকশনের ধরন ছিল এ রকম : পুরো ছবিটি মাথায় নিয়ে তিনি সেটে আসতেন; ফলে আমরা যারা অভিনেতা, আমরা কীভাবে হাত নাড়ব থেকে শুরু করে কীভাবে চোখের পলক ফেলব– সব ব্যাপারেই তার নির্দেশনা অনুসরণ করতে ছিলাম বাধ্য। এ কারণে অভিনয় নিয়ে আমাদের একদমই দুশ্চিন্তা ছিল না। তার সিনেমায় অভিনয়ের সময় একদিক থেকে আমাদের মনে হতো, যেন বাড়িতেই রয়েছি। কী করছি, কীভাবে শটগুলোকে শেষ পর্যন্ত জোড়া দেওয়া হবে– এর কিছুই জানতাম না; তারপর সিনেমাটির প্রথম প্রদর্শনীর সময় অবাক হয়ে দেখতাম, যতটুকু আশা করেছিলাম, আমার অভিনয় তারচেয়ে অনেক ভালো হয়েছে।

সাইট অ্যান্ড সাউন্ড
স্প্রিং ১৯৬৪ সংখ্যা

শুধু অভিনেতাদের পারফরম্যান্সই নয়, স্টেজ সেটিং ও প্রোপার্টিজ– সব কিছুতেই তুখোড় নিয়ন্ত্রণ ছিল তার; এমনকি সেটে ব্যবহার করা দরজাগুলোর রঙ কি হবে, সেটিও নজর এড়াত না। আমার ধারণা, এ কারণেই ওজুর প্রোডাকশনকে তার ‘নিজের হাতে সৃষ্ট’ বলে সমাদর করা হয়।


সিনেমার
শুরু থেকে
শেষ পর্যন্ত নিজের আইডিয়া
নিয়ে কাজ
করতেন
ওজু

অন্যদিকে, ওজুর তুলনায় কেঞ্জি মিজোগুচি ছিলেন একেবারেই উল্টো। তিনি অভিনেতাদের শুধু ‘হিন্টস’ দিতেন, আর সেগুলোর ওপর নির্ভর করে নিজেদের সেরা চেষ্টাটি দেওয়া ব্যাপার ছিল তাদের; অন্যদিকে, সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজের আইডিয়া নিয়ে কাজ করতেন ওজু, প্রতিটি শটেই অভিনেতাদের ঠিকঠাক করে নিতেন।

ওজু খুবই কঠোর ছিলেন; কাজ শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে সন্তুষ্ট দেখাত না। যদিও অভিনেতা হিসেবে আমি খারাপ ছিলাম, আমাকে দেওয়া চরিত্রটিতে কীভাবে অভিনয় করব– প্রায় সময়ই খেই হারিয়ে ফেলতাম; তবু তিনি আমাকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে উৎসাহ দিয়ে যেতেন– যতক্ষণ না তার মনমতো অভিনয়টি করতে পারছি।

টোকিও স্টোরি
টোকিও স্টোরির সেটে
রিয়ু ও হারা’কে দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন ওজু

আমার আনাড়িপনা যেহেতু স্টুডিওজুড়ে সুপরিচিত ছিল, ফলে যখনই আমার অভিনয়ের পালা আসত, সাধারণত সব স্টাফ তখন লাইটের সুইচ বন্ধ করে এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করতেন! সেটে তখন শুধু থাকতাম আমি আর ওজু; তিনি আমাকে অক্লান্তভাবে রিহার্সাল করাতেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাকে সবকিছু ধরে ধরে বুঝিতে দিতেন– যতক্ষণ না তার প্রত্যাশামতো অবস্থায় নিজেকে কোনোমতে নিয়ে যেতে পারি।

এমনকি এরপরও ফাইনাল শটগুলো সবসময় সফল হতো না। স্বভাবতই তখন আমার মন খারাপ হয়ে যেত; তিনি আমাকে আর তার সিনেমায় কখনোই নেবেন না– এই ভয় কাজ করত মনে। কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে, নিজের পরের সিনেমাতেই আবার আমার ডাক পাঠাতেন। আনাড়িপনার জন্য কোনো অভিনেতাকে অন্য কোনো ফিল্মমেকার কখনো ব্যবহারের কথা দ্বিতীয়বার ভাববে বলে আমার মনে হয় না। অথচ [আমার ক্ষেত্রে] তিনি তা করতেন; তাই কী করে তাকে ধন্যবাদ জানাই!


ওজু
তার সিনেমাগুলোতে
বিভিন্ন রঙ ও অন্য যেসব
ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার করেন,
আমি আসলে তার চেয়ে বেশি কিছু নই

কলেজ ইন অ্যা নাইস প্লেস [১৯৩৬] সিনেমায় আমি একজন কলেজ ছাত্রের চরিত্রে অভিনয় করেছি; এর পরের সিনেমা, দ্য অনলি সন-এ [১৯৩৬] ওজু আমাকে এক বুড়ো লোকের চরিত্রে অভিনয় করতে বললেন। যদিও চরিত্রটিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টাই করেছি, তবু প্রতিটি প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় রূপ নিয়েছিল। সেটে এসে ওজু আমাকে ভেতরে ডাকলেন; আমি যেতেই মেকআপে অল্প কিছু ‘টাচ’ দিলেন; আর মুহূর্তেই আমি হয়ে ওঠলাম দারুণ এক বুড়ো লোক! স্বীকার করছি, সেই দিনগুলোতে আমার সত্যি মনে হয়েছে, ওজু তার সিনেমাগুলোতে বিভিন্ন রঙ ও অন্য যেসব ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার করেন, আমি আসলে তার চেয়ে বেশি কিছু নই!

চিশু রিয়ু
দ্য অনলি সন
কাস্ট । চিশু রিয়ু
ফিল্মমেকার । ইয়াসুজিরো ওজু

একেকটা সিনেমার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর যখন একসঙ্গে ভ্রমণ করতাম কিংবা সাকে [জাপানি মদবিশেষ] খেতাম [সাকের ভীষণ ভক্ত ছিলেন তিনি], আমরা দুজন সমবয়সী হলেও, তখন মনে হতো, তিনি যেন আমার সত্যিকারের বাবা। নাগানো অঞ্চলে নোদা কোগোর কটেজে তার সঙ্গে বসে যখন ওজু কোনো স্ক্রিপ্ট লিখতেন, তখন তাকে দেখে মনে হতো যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। প্রায় চার মাসের প্রচেষ্টায় স্ক্রিপ্ট লেখা শেষ হওয়ামাত্রই, প্রতিটি শটের প্রতিটি ইমেজ তার ঠিকঠাক করা হয়ে যেত; ফলে আমরা যখন সেটে যেতাম, কোনোদিনই কোনো স্ক্রিপ্ট তিনি এতটুকু বদলাননি। প্রতিটি শব্দ এত স্পষ্টভাবে লেখা থাকত, ফলে তিনি আমাদের চুল পরিমাণ ভুল করারও সুযোগ দিতে ছিলেন নারাজ।

ইয়াসুজিরো ওজু
ফিল্মমেকার ইয়াসুজিরো ওজু ও স্ক্রিনরাইটার নোদা কোগো

আমাকে তিনি বলেছিলেন, একটা চিত্রনাট্য লেখা যখন শেষ হয়, তখন নিজেকে সবচেয়ে সুখী মনে হয় তার। ঠাট্টাচ্ছলে আরও বলেছিলেন, অভিনেতা বাছাই করে সেটে যাওয়ার পর সেই ইমেজগুলোর ভেঙে পড়া দেখতে তার খুব খারাপ লাগে। লোকেশন হান্টিংয়ে যেতে সদাপ্রস্তুত এক মানুষ ছিলেন তিনি। সরু রাস্তা ধরে, অলিগলি ধরে সারাদিন হেঁটে বেড়াতেন নিজের [সিনেমার] ইমেজের সঙ্গে সবচেয়ে মানানসই জায়গাগুলো খুঁজে পেতে। দারুণ এক হাঁটাবাজ লোক ছিলেন তিনি। এতটাই উদ্যমী ছিলেন, তার সঙ্গে থাকা ক্যামেরাম্যানরাই আগেভাগে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়তেন!

একটা সিনেমার কাজ শেষ হয়ে গেলে, সেটির অভিনেতাদের পারফরম্যান্স যদি খারাপও হয়ে থাকে, এ নিয়ে আর কোনোদিনই নালিশ তুলতেন না ওজু। এমনকি মনের ভেরত তিনি নালিশ চেপে রেখেছেন– এ ব্যাপারে আমরা যদি নিশ্চিতও হতাম, তবু সব দায়ভার নিজের কাঁধেই তুলে নিতেন, এবং এ নিয়ে কখনো অন্য কারও সঙ্গে আলাপ করতেন না। এ থেকেই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কিছুটা আভাস পাওয়া সম্ভব।

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৩ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here