লিখেছেন । কামরুন্নাহার মুন্নী

সিনেয়াস্টের ডায়েরি
[চলচ্চিত্র সমালোচনা, বক্তৃতা, স্মৃতি ও স্মরণ]
লেখক । বেলায়াত হোসেন মামুন
প্রচ্ছদ । সব্যসাচী হাজরা
পৃষ্ঠাসংখ্যা । ৩২৮
মূল্য । ৫০০ টাকা
প্রকাশক । কথা প্রকাশ, ঢাকা
প্রথম প্রকাশ । ফেব্রুয়ারি ২০২০
বইটার শুরুতেই লেখকের কথা পড়তে গিয়ে আমি একটা নতুন শব্দবন্ধ আবিষ্কার করলাম, ‘চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির আবাদ’ করতে চান তিনি। এই আবাদকারী সিনেয়াস্টের ডায়েরি পড়িয়ে আমার মাথায় যা যা আবাদ করলেন, আমি তাই লিখছি।
শিখা পত্রিকার যে জ্ঞানের ওম, তা কতখানি আমরা পাচ্ছি না-পাচ্ছি– জানি না; তবে এই মানুষটা পাচ্ছেন, নইলে অমন করে কীভাবে ভাবেন আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে “যে ওরকম বিষণ্ণ হয়ে ওনাকে দেখলে বুকের মাঝে কেমন লাগে।” কই আর কাউকে তো শিল্পীর এই বিষণ্ণতা ছুঁয়ে যায়নি! এই শিল্পীর এই শিক্ষকের বিষাদের রঙ আর কেউ কেন লেখকের মতন করে দেখতে পাননি! শহীদ মিনারে শেষবেলায় সর্বপ্রকার সৌজন্যতা পাওয়া ব্যক্তিটি আনোয়ার হোসেনের মতো আমাদের মাঝে আছেন বা থাকেন! তাহলে কী তফাৎ হলো সেদিন ওই দায়িত্বশীল মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনে? ও বেচারা বোধহয় সারাজীবনে এই একটিই দায়িত্ব পালন করেছেন, হায়!
আনোয়ার হোসেন বলতেন, এগুলো তার ভালো কাজের সংগ্রাম; অথচ আজকাল ভালো কাজ বলে যা ঝুলে যায় যুগের নোটিশবোর্ডে, আমি তাই দেখে মেলানোর চেষ্টা করি– শিল্পীতে আর এসব মানুষে কত পার্থক্য!
লেখক এ ক্ষেত্রে দু-তিনটা বাক্য লিখেছিলেন আমাদের ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা, দৈন্য দিয়ে কিংবা আমাদের আটপৌরে গৃহস্থ বাস্তবতায়, মফস্বলীপনায়, মানসিকভাবে বামন হয়ে ধরতে চাইতাম একজন সংস্কারমুক্ত মানুষ, আলোকপ্রাপ্ত শিল্পীর মানসকে। আমার মাথার মধ্যে যখন লেখক আবাদ করছেন, তখন আমার খুব মনে হচ্ছিল, একজন আনোয়ার হোসেন তো চলে গেছেন; যারা আছেন, আমরা আমাদের এই ক্ষুদ্রত্ব দিয়ে তাদের কতটা ধরতে চাই?
আমি লেখকের জ্ঞানের ওম পাওয়া নিয়ে আরেকটু আগাতে গিয়ে আমার পরিচয় হয় বাদল রহমানের সঙ্গে। বাদল রহমান তিনি, যিনি বলে ফেলতে পারেন– এসব ছাতা মাথার পড়া দিয়ে কী হবে? স্বপ্ন বোনার জন্য আর স্বপ্নকে মহীরুহ বানাবার জন্য আমার এসব লাগবে না। আর আজকাল তো সার্টিফিকেটের বাইরে খুব কম কিছুই আছে বা থাকে আমাদের রোজকার বিচরণে। বিদেশ যাবার বৃত্তির মুলো ঝুলিয়ে দিলে আর সব বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে নির্দ্বিধায় দেশের মাটি ও মানুষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিতে খুব একটা সমস্যা হবে না– সেই প্রজন্মের সামনে একজন বাদল রহমান ছিলেন, আমার ভাবতেই কেমন গা শিউরে উঠছে। ওইটুকুন বয়সে পুলিশের নজরদারীতে পড়া, খবরাখবর আনা-নেওয়া করা এবং মতিয়া বাহিনী ছেড়ে মেনন গ্রুপে আসা, এরপর সাংকৃতিক কর্মকাণ্ডে প্রবেশ।
আজকাল আমরা একটা কথা খুব বলি, নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রামের কাছে আর সময় কোথায় শিল্পের জন্য তথা দেশের জন্য সংগ্রাম করার। এই মানুষটি লড়েছেন ষাটের দশকে, টিউশন, বাচ্চাদের অনুষ্ঠানের চিত্রনাট্য লেখা। সিনেমার আগে যে ভাবনা ছিল তা হচ্ছে রাজনীতি করা। স্তানিস্লাভস্কির ওই উক্তি মনে পড়ছে, “থিয়েটার করতে এসে যদি তুমি আরও একটু ভালো মানুষ না হও, তবে থিয়েটার ছাড়ো।”
তবুও চারপাশে দেখি তো কত অমানুষ না-মানুষ থিয়েটার করছে। কিন্তু বাদল রহমান রাজনীতি, দেশ, মানুষ বুঝেই সিনেমাতে এসেছিলেন। সিনেমা কেবল তাদের কাছে পেট আর রুজি আর হা-হা করে হেসে উঠা ছিল না। আমি তথ্য দিতে চাই না; তা বইটা পড়লে সবাই পেয়ে যাবে। আমি আমার মনে লেখক যা আবাদ করেছেন, তা কেবল তুলে দিলাম।
বাদল রহমানরা আজন্ম অভিমান পোষেন; ফলে তারা নিভৃতে কাঁদেন, কিন্তু বাইরে থাকেন শক্ত পাথরের মতন। বিভিন্ন পরিকল্পনা, নীতি নির্ধারণে চলচ্চিত্র সংসদের সঙ্গে নয় কেবল, তিনি ছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এইসব লড়াকু মানুষ একুশে পদক পাবেন কেন! যে পদক পায় মেরুদণ্ড বিকি দেওয়া লোকজন।
‘আমার
সিনেমা বিনামূল্যে
দেখতে দেব না’– এটা
বলার মতন সিনেমা
বানাই তো
আমরা,
না?
আমার পরিচয় হয় একজন তারেক মাসুদের সঙ্গে; আমি তার সঙ্গে ঘুরি তখন বইয়ের পাতা ধরে।কেননা, লেখক আমায় তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত করছেন। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলেজে, মাদরাসায় গিয়ে তখন তারেক মাসুদ দর্শকদের ডাকছেন বাংলাদেশের সিনেমা দেখতে। যেটা পরিবেশক বলে দিয়েছেন, হলে চললে নাকি বোমা হামলা হতে পারে। তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে সাংবাদিক, হোমড়াচোমড়া মানুষদেরও দর্শনী ছাড়া ঢুকতে দেননি। ‘আমার সিনেমা বিনামূল্যে দেখতে দেব না’– এটা বলার মতন সিনেমা বানাই তো আমরা, না? কিংবা সেরকম করে বলার শক্তি যেখান থেকে আসে তা আছে আমাদের? কে ভাবেন এভাবে! ‘আমাদের ভালো দর্শক, সমালোচক,হল, সাউন্ড সিস্টেম, মেধাবী নির্মাতা, ভালো ইনস্টিটিউশন সব ভালো লাগবে।’

ফিল্মফ্রি । ৬ ডিসেম্বর ২০১৬
কে বলতে পারে, দর্শকদের বোঝাতে হবে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন মানে কেবল ফ্রি ফ্রি ভালো সিনেমা দেখানো নয়; কর্মশালা, সেমিনার, আলোচনা, আরও অনেক কিছু। তিনিই তো পারেন, না! আব্বাস কিয়ারোস্তামির সামনে বসে ম্যুভিয়ানাতে ফোন করতে, ‘উনি যদি আসেন পারবা তোমরা এফোর্ড করতে?’ আমি বইটাতে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম, একজন মানুষ কিভাবে এই লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে জেনে যান– এখানে স্বাধীন মানুষ, স্বাধীন সংগঠন এবং স্বাধীন দেশ সবাই পছন্দ করেন না। সবাই পরাধীন করতে চান। লেখক আবাদকারী বলেই হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, ‘একজন তারেক মাসুদ হৃদয়ের মূল্যকে খাটো করে দেখেন না।’
…
দূরে
দাঁড়ানো
শক্ত তাল গাছটার
মতন তিনি কিছুতেই যেন
ভাঙবেন
না
…
আমার একজন খসরু মানে মুহম্মদ খসরুর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। যিনি ছিলেন একলা যোদ্ধা। কখনোই কোথাও ছাড় দেওয়ার বালাই নেই। দূরে দাঁড়ানো শক্ত তাল গাছটার মতন তিনি কিছুতেই যেন ভাঙবেন না। রাষ্ট্রকে যারা চলচ্চিত্র শিল্পের বর্ণমালা শিখিয়েছেন তিনি তাদের একজন। তিনি এমন একজন, যার প্রতিবাদী চরিত্র সমাজ নিতে পারেনি। রাজপথে আন্দোলন নয়, এই আন্দোলন ছিল ঋদ্ধ মানুষের। সেই গুটিকয়েক মানুষ ধরে আনার ক্ষমতা ছিল তার। কেউ হয়তো তার দাবড়ানি চেনেন, কেউ হয়তো চেনেন তার স্নেহের বকুনি।
আমার এই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতেই পরিচয় হলো বীরেন দাশশর্মা নামক একজনের সঙ্গে। ওনাকে জানার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হলো, এখন মানুষের কী বড্ড অভাব, না? চলচ্চিত্র শিক্ষক আবার সামনে শুদ্ধ বিশেষণ দেওয়া… যায় এখন!
সমালোচনাগুলো পড়ার আগে আমি সিনেমাগুলো দেখেছি। দুটো দেখতে পারিনি। এগুলো নিয়ে সাক্ষাতে কথা হবে আমাদের।
মানুষের মানুষ পরিচয় যখন আবারও হারাচ্ছে, তখন আমরা সূর্যোদয় দেখতেও ভাবি। মানুষের শেকল যখন মাথায়, তখন তা কেবল হাত পায়ের শেকল কাটলেই হিসেব চুকে যায় না। আমাদের নির্মাণ তো আমাদের ব্যক্তিজীবনের এক একটি মুক্তা সেঁচার গল্প। আমরা যদি ব্যক্তিজীবনে মুক্তা না সেঁচে কেবল মখমলের গন্ধ চিনি, তা দিয়ে যা নির্মাণ হবে তা সেই অন্ধের হাতি দর্শন হবে আর-কি। যুগে যুগে লিন্ডসে অ্যান্ডারসন, ক্যারল রেইস, টনি রিচার্ডসনরা আসেন বলেই আমি বিশ্বাস করি, আমাদেরও এসেছিলেন আর এখনো আছেন। তাদের চিনে নিতে পারিনি, পারি না– সেই দায়ভার কার?
এখানে আমি একটা উত্তর পেয়েছি। প্রায়ই বলতাম, থিয়েটার আমার হাতিয়ার, আমার লড়বার অস্ত্র। আসলে শিল্প যখন হাতিয়ার হয়, তখনই তার স্বাধীনতা খর্ব হয়; সে বলতে থাকে এক রঙের আলাপ। লেখক আমার মাথায় কিভাবে যেন গেঁড়ে দিলেন আমার মৌলিক চোখ তৈরির জন্য আমার চলচ্চিত্র কিভাবে আমায় প্রশ্ন করায় চারপাশ দেখায় তর্ক হাজির করায়, আমার মানস তখন দুর্নিবার হয়ে কিভাবে ছোটে! মানুষের সৃষ্টিশীল কাজের আগে তার প্রেরণা তো জরুরি। সে যদি প্রেমিককে ‘ভালোবাসি’ বলতে ভয় পায়, রাস্তার পাশে মুত্রত্যাগ করা ব্যক্তিকে ধমক দিতে ভয় পায়, শিক্ষকের অন্যায়ের সামনে প্রতিবাদ করতে ভয় পায়, সে কীভাবে করবে? কই পাবে সেই আগ্রহ?
…
আসলে
শিল্প যখন
হাতিয়ার হয়,
তখনই তার স্বাধীনতা
খর্ব হয়; সে বলতে থাকে
এক রঙের
আলাপ
…
মানুষের বাইরে গিয়ে কোনোদিন কোনো গল্প তার পূর্ণতা পায়নি। তিনি বারবার বলেছেন, গণমানুষের সঙ্গে সংযোগ ব্যাতিরেকে কোনো শিল্পে মুক্তি আসেনি। লেখক বারবার বলতে চেয়েছেন, মুক্তি চাই আর মুক্তির জন্য লড়াইটাতে আমাদের এত অনীহা কেন? মুক্ত চলচ্চিত্র চাইবার আগে আমি ব্যক্তিমানুষকে তো মুক্ত হতে হবে ,নাকি!
নাজির আহমেদ ও আব্দুল জব্বার খানের সঙ্গে আমার বিস্তারিতভাবে পরিচয় হয়েছে। জেনেছি, চলচ্চিত্রের গল্পটার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও কীভাবে জড়িয়ে আছেন। আমি এতদিনের খোঁজা প্রশ্নের উত্তর পেলাম– কেন তত্ত্ব ও কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন।
বাংলাদেশের প্রথম ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সটির ফলে জন্ম নেওয়া দুটি দাবি ছিল–
১। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা।
২। বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার দাবি।
আমি দেখতে পাই একজন প্লেটো আলমগীর কবিরকে, যার শিষ্য তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, মোরশেদুল ইসলাম, মানজারে হাসিন, মাহমুদুল হোসেন, শামীম আখতার, সাজেদুল আওয়ালসহ আরও অনেককে। এইসকল জোনাকপোকা আলো জ্বালায় নিজেদের ক্ষয়ে। তবুও চলচ্চিত্র আমাদের আত্মীয় নয়; অতিথি। আমরা চরিত্র নষ্ট হয়ে গেল বলে শব্দ ছুঁড়ে মারি। কেননা, এখনো সামাজিকীকরণ হয়নি আমাদের চলচ্চিত্রের। হবে তো, না?
পাতা উল্টাতে উল্টাতে আমার কাছে গল্পগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়। কারা করছে রাজত্ব আর কারাই-বা সেনাপতি, মন্ত্রী আর উজির-নাজির– যাদের না আছে চলচ্চিত্রের সঙ্গে নিদেনপক্ষে প্রেমই বলব আমি। এই যে সাত-আটটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র বিভাগ বা সঙ্গে আরও লেজুর– এসবের আদতে লক্ষ্য কী, আমার কিছুটা দুশ্চিন্তাই হলো। কাওরানবাজারের নেগেটিভ স্পেস কই কই ভদ্র পোশাকে ঢুকে যাবে, তাই ভাবছিলাম।
এইসব নেগেটিভ স্পেসের মাঝে আমি খুঁজে পাই একটা অন্য স্পেস, লেখক বারবার বলছেন, ‘আজকের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রযুক্তিগত উন্নতি আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে মানুষের কাছে এখন কেবল শিক্ষাটুকু পৌঁছে দিতে হবে। তাহলে মানুষ তাদের নিজেদের গল্প নিজেদের মতন করে বলতে শুরু করবে।’
শিল্প মানুষকে কীভাবে দৈন্য হারিয়ে, পাইয়ে দেবে মানুষ হবার মূলমন্ত্র– তাই ভেবে পাতা উল্টাই। চলচ্চিত্রের বিশ্ব ইতিহাস আমাদের কী শেখায়? কী লাগে চলচ্চিত্রকে গড়তে?
মন।
মনন।
শ্রম।
আর কি!
পহেলা বৈশাখ চিনতাম আমি, আজ চৈত্র সংক্রান্তি চিনেছি-জেনেছি, নিজেদের পেয়েছি।
লেখক কেন জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্রের দাবি উত্থাপন করছেন, এটা বুঝতে কি খুব বেগ পেতে হয়! এই যে চলচ্চিত্র মানে বিনোদন, আয়কয়, সেন্সর, অমুক-তমুক… কি এগুলো!!! বিশ্বসংস্কৃতির জীবন্ত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ উপাদানরূপে তুলে ধরতে এর আর কী বিকল্প?
সমাজ এবং এফডিসির এই তুলনা আমায় খুব অবাক করেছে। আরে, সত্যিই তো এদের কারও আনন্দ-বেদনায় কারও অংশগ্রহণ নেই। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের চেহারা বদলে যাবার পেছনে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা জড়িত।
তরুণদের এই আস্থার স্পেসটি আসলেই দিতে হবে, নয়তো পৃথিবী হাঁটবে আরো শূন্যতার পথে। আমার তো ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে, এমন একটি জায়গা সত্যিই যদি হতো– যেখানে আলোচনা-সমালোচনা, হাসি-বিষাদ সব চলচ্চিত্র নিয়ে, যেখানে সবাই চলচ্চিত্র প্রিয়জন; কত অভিজ্ঞতা বিনিময় হতো, ইশ! হয়তো হবে কোনো এক ভবিষ্যতে, সেখানে খিচুড়িমার্কা ডিজাইনের মিলনায়তন লেখকের সঙ্গে আমিও চাই না। জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র হবে চলচ্চিত্রের কেন্দ্র। নাচ গান আবৃত্তি সকল কিছুর নয়।
পাতা উল্টাই আর ভাবি, আমাদের অভিভাবক প্রয়োজন; সেই অভিভাবকের প্রজ্ঞা অথবা ত্যাগ স্বীকারের আদর্শ কার আছে? আর কাদের অভিভাবকত্ব করবেন তারা? চলচ্চিত্র মানে হয়ে যায় এক সস্তা বিনোদন, নয়তো নাটিকা– শিক্ষামূলক উপদেশ। এদের বুকের ভেতর চেতনার সেই প্রবাহ না থাকলে কীভাবে করবেন তারা বিষয় নির্বাচন? অনুজদের উচিত সেই সত্তর ও আশির দশকের অগ্রজ নির্মাতার দিকে তাকানো। তারা শখে বা উৎসাহ নিয়ে চলচ্চিত্র বানাননি। তারা বিশ্বকে দেখেছেন এবং দেখিয়েছেন। তারা দেশের প্রতি এবং কাজের প্রতি প্রেম রাখতেন। তারা সমাজ এবং মানুষ বুঝতেন। এগুলো উপেক্ষা করে কোনদিকে হাঁটব আমরা?
আমরা ঋত্বিক বলে যে কীর্তন করি, লেখক সেইদিকটাও এড়িয়ে যাননি। আমরা তো আসলে আল- কোরআন, ভগবত গীতা অথবা বাইবেল ঘরের সবচেয়ে উঁচুতে রেখে দেওয়া জাতি; আমাদের তো ওই জপ করাই কাজ। আমরা কখনো খুলেও দেখব না ওই পবিত্র বলে বইটাতে কি বলা হয়েছে। ও বুকে নিয়ে রাতে ঘুমাতে গেলেই পুণ্য আমাদের। আজব আমরা! প্রেমহীন ঋত্বিকের নির্মাণ দেখেও আমরা বার্তা পাই না আমাদের কি করণীয়? আমরা পাই ওনার নাম জপ করা? সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে শিল্পীকে আমরা খণ্ডন করতে জানি না। আমাদের তো সেই অন্তর্মুখী চেতনা প্রবাহ নেই। কী দিয়ে করব খণ্ডন?

ফিল্মফ্রি । ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০
আমরা সমালোচনা শিখিনি; শিখেছি নিন্দালোচনা। আমরা তর্ক শিখিনি; শিখেছি গলাবাজি। সবকিছুকেই রোমান্টিসাইজ করা আমাদের বদচর্চা। ঋত্বিকচর্চা করুন চোখ বুজে মালা হাতে নয়; চোখ খুলে বুঝে-শুনে।
আচ্ছা, আমারও তো প্রিয় চলচ্চিত্রের গুণগাণ করলে চোখ চিকচিক করে, লেখক কীভাবে জানলেন? লেখক কীভাবে জানলেন ভালো চলচ্চিত্র দেখার পর আমিও অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকি? লেখক কীভাবে জানলেন এখনো তরুণরা নিজ নিজ লড়াই জমা করে? লেখক কীভাবে বুঝে গেছিলেন একটা ম্যুভিয়ানা এভাবে ভাবার জন্য ওম দেবে? লেখক লিখছিলেন, তিনি একজন মুক্তমনা মানুষ পেয়েছিলেন, যিনি জাতীয় অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম। আমার জীবনে যেহেতু আলমগীর কবির, জহির রায়হান, তারেক মাসুদ, মুহম্মদ খসরু, বাদল রহমান পাইনি; সরদার ফজলুল করিমের মতন মুক্তমনা মানুষও আমি পাইনি; আমি একজন বেলায়েত হোসেন মামুন পেয়েছি। আমার এই আজকের চলচ্চিত্রের বোঝাপড়া, আগ্রহ, লড়াই– যাই আছে, সবটুকুন এই মানুষটার জন্য। তিনি আমার চলচ্চিত্র শিক্ষক। আমার দেখা মুক্তমনা একজন।
এইসব সিঁটি বাজানো, সিগারেট ছোঁড়া, কিংবা যা তা শব্দ ছুঁড়ে দেওয়া সময়েও বসে তিনি যদি নিজেকে সংস্কৃতির-চলচ্চিত্রের আবাদকারী হিসেবে ভাবতে পারেন, বলতে পারেন, ‘মানুষ এখনো চলচ্চিত্র দেখে ,প্রতিদিন একটি দেখে, তা যেভাবেই হোক। যে ভাষার যে চলচ্চিত্রই হোক। এই তো আমাদের স্বপ্ন দেখায়’, তাহলে আমাদের কি হয়ে গেল? এই সময়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাহীন কোনো চলচ্চিত্রকার দীর্ঘদিন তার সৃষ্টি ও আদর্শকে রক্ষা করতে পারবেন না, তার জন্য বর্তমান পৃথিবীতে দুটি পথ খোলা নাকি লেখক বলছেন, দাসত্ব নয়তো মৃত্যু…।
সে তো চলচ্চিত্রকারের কথা গেল। কিন্তু আমার নিজের মাথায় তো আসছে অন্যদিক থেকে ভাবনাটা…। দাস হব না মরে যাব– ভাবতে ভাবতে লেখা শেষ হয়ে গেল…!
আমাদের যা স্বভাব, শেষ হলেও আমরা দাঁড়ি টানতে খাবি খেতে থাকি; আমিও তো এসবের বাইরে না, খাচ্ছি। আমি এই বইটা শেষ করার পর পুরোদিন কেমন যেন একটা চুপ হয়ে গেছিলাম! আমার অনেক জায়গা পড়তে গিয়ে কান্না পাচ্ছিল। এইসব লড়াই, এইসব মানুষ যন্ত্রের মতন লড়েননি; ওনাদের কী তীব্র প্রেম ছিল, ভালোবাসা ছিল– তাই ভেবে অমন এলোমেলো ছিলাম সারাদিন। আমরা তো আজকাল ভালোবাসার মানুষের প্রতিও অত প্রেম রাখি না; অত সৎ থাকি না।
আরেকটা বিষয়, বইটা নিয়ে আমি কোনো লেখা পেলাম না কেন বা আমার পরিচিত মহলে কোনো আলাপ পেলাম না কেন? না বইটা ঘরে থাকলেই ঋত্বিকের মতন বেলায়েত হোসেন মামুন জপ হবে, কে জানে?
৮১ পৃষ্ঠার নিচের দিকে একটা ছাপার ভুল আছে প্রশ্রয় এর ‘র’ ফলাটা ভুলে আসেনি।