লিখেছেন । জিম ইসমাইল

সামার উইথ মনিকা
[Sommaren med Monika]
ফিল্মমেকার । ইংমার বারিমন
উৎস-উপন্যাস । সামার উইথ মনিকা/ পার আন্দার্স ফোগেলস্ত্রাম
স্ক্রিনরাইটার । পার আন্দার্স ফোগেলস্ত্রাম
প্রডিউসার । আলান ইকেলুন্দ
সিনেমাটোগ্রাফার । গুন্নার ফিসসার
মিউজিক । এরিক নুর্দগ্রেন; লেস ব্যাক্সটার
কাস্ট [ক্যারেকটার] । হারিয়েত আন্দারসন [মনিকা]; লর্স একবরি [হ্যারি]
রানিংটাইম । ৯৬ মিনিট
ভাষা । সুইডিশ
দেশ । সুইডেন
রিলিজ । ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩
১৯৫৩ সাল। ইঙ্গমার বার্গম্যানের [সুইডিশ ভাষায় প্রকৃত উচ্চারণ ‘ইংমার বারিমন’ বা এর কাছাকাছি; তবে আন্তর্জাতিক বিশ্বে ইংরেজি উচ্চারণ ‘বার্গম্যান’ নামেই বেশি খ্যাত : ফিল্মফ্রি] দ্বাদশতম ছবি সামার উইথ মনিকা মুক্তি পেল। বার্গম্যান তখনো বার্গম্যান হয়ে ওঠেননি। মৃত্যু-নিঃসঙ্গতা-স্বপ্ন-ধর্ম ইত্যাদি বার্গম্যানীয় অভিজ্ঞানগুলো তখনও তাঁর চলচ্চিত্রে প্রকট হয়নি। সামার উইথ মনিকা সেই অর্থে বার্গম্যানের প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি নয়; কিন্তু বলিষ্ঠ ছবি। এই ছবির সাবটেক্সটগুলো আজও আধুনিক। এছাড়া বেশ কিছু অভিনবত্বও দেখা গেল ছবিটাতে।
সামার উইথ মনিকা মুক্তির পরে সাড়া ফেলে দেয়, মনিকা চরিত্রে হ্যারিয়েট অ্যান্ডারসনের [সুইডিশ উচ্চারণ হারিয়েত আন্দারসন] একটি নগ্নদৃশ্যে অভিনয় এবং আরও কিছু খোলামেলা দৃশ্যের জন্য। ছবিটি সেন্সরের মুখোমুখিও হয়। এক আমেরিকান শো-ম্যান, হাওয়ার্ড ক্রোজার বাব্, ছবিটির একটি এডিটেড সংস্করণ ‘মনিকা : একটি দুশ্চরিত্রা মেয়ের কাহিনি’ নামে আমেরিকার বাজারে ছেড়ে দেন। পোস্টারে হ্যারিয়েট অ্যান্ডারসনের উত্তেজক ছবি ব্যবহার করা হয়, তাতে লেখা– শিগগিরি আসছে ‘নটি অ্যান্ড নাইনটিন’। উদ্দেশ্য, যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে হল ভর্তি করা। খোলামেলা দৃশ্যগুলোর ওপর জোর দিতে ছবির এক-তৃতীয়াংশ বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। কম বাজেটের ছবি সামার উইথ মনিকা বাণিজ্যসফল হয়।পাকেচক্রে সুইডিশ ক্রিটিকরা এই ছবির সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলেন না। ছবিটির মূল বিষয়বস্তু এবং সাবটেক্সটগুলো না-ছোঁয়া থেকে গেল।

ফিল্মমেকার । ইংমার বারিমন
এরপর ১৯৫৭ সালে বার্গমানের দ্য সেভেন্থ সিল এবং ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ মুক্তি পেল। আন্তর্জাতিক বৃত্তে ‘আধ্যাত্মিক পরিচালক’ হিসেবে বার্গমানের তুমুল খ্যাতি। সেই সময় ১৯৫৮ সালে, গোদার [তখনও তিনি সমালোচক] বার্গমান রেট্রোস্পেকটিভে, সামার উইথ মনিকা ফিরে দেখে বললেন– ‘সবচেয়ে মৌলিক ফিল্মমেকারের বানানো সবচেয়ে মৌলিক সিনেমা।’ তিনি আরও বলেন, ‘ক্ল্যাসিকেল সিনেমায় বার্থ অব অ্যা নেশন, আজকের দিনে এটিও তেমনই সিনেমা।’ এরপর সামার উইথ মনিকা স্বমর্যাদায় আলোচনায় ফিরে আসে।
…
গুন্নার
ফিসসারের
ক্যামেরায় লেগে
থাকে দুই তরুণ-তরুণীর
নবলব্ধ যৌবনের
ঘ্রাণ
…
ছবির শুরুতে, এস্টাবলিশিং শটে, সূর্যোদয়ের আলোকে স্টকহোমের বন্দর এলাকাকে দেখি। কর্মীরা রোজকার কাজে চলেছে। মূলত মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি। এদেরই একজন মনিকা, অন্যজন হ্যারি। এই দুই তরুণ-তরুণী একে অপরের প্রেমে পড়ে। এদের কারোরই শৈশব সুন্দর স্বাভাবিক কাটেনি [বার্গমানের নিজের শৈশবও সুন্দর কাটেনি]। রোজকার একঘেয়ে নিস্তরঙ্গ যাপনে দুজনেই ক্লান্ত।
একটি বেপরোয়া গ্রীষ্ম একসঙ্গে কাটাতে, ছোট্ট মোটরবোটের ডেকে মৎস্যকন্যার মতো মনিকাকে সঙ্গে নিয়ে তার প্রেমিক শহর থেকে দূরে একটি দ্বীপে পাড়ি জমায়, যেখানে ‘আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হ’য়ে আকাশে আকাশে’।ক্যামেরা লঘুছন্দে তাদের অনুসরণ করে। দুজনে আদি মানব-মানবীর মতো পুরো গ্রীষ্মটা কাটায়। গুন্নার ফিসসারের ক্যামেরায় লেগে থাকে দুই তরুণ-তরুণীর নবলব্ধ যৌবনের ঘ্রাণ।হ্যারিকে চুমু দিয়ে মনিকা বলে ওঠে– ‘আমি গর্ভবতী।’

এরপর ধীরে ধীরে ছবির মেজাজ বদলাতে শুরু করে। তাদের খাবার শেষ হয়ে আসে। টাকাও নেই। পেটে নবজাতক। পেটের তাগিদে হ্যারি আর মনিকাকে আলু ও আপেল চুরি করতে যেতে হয়। মনিকা ধরা পড়ে, পালিয়েও আসে। বিপর্যস্ত মনিকা, হ্যারিকে বলে ওঠে– ‘কিছু মানুষেরই ভাগ্য কেন ভালো, বাকিরা যেখানে দুর্দশায় জীবন কাটায়?’ বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার পিঠে একটি চাবুক এসে পড়ে যেন!
দুজনে শহরে ফিরে আসে। গুমোট বাস্তব থেকে মুক্তি পেতে ওরা পাড়ি দিয়েছিল। মোহভঙ্গ হলে ফিরে আসে। কিন্তু এই ছবি শুধু মোহভঙ্গতা বা নিজেকে আবিষ্কারের কাহিনি নয়; এ ছবি আরও চ্যালেঞ্জিং আর বহুমাত্রিক।
ছবির শেষ অংকে ভাঙনের শব্দ শোনা যায়। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের আগমন মনিকার মনে কোনো আন্দোলন তৈরি করে না। হ্যারি যে জানালা দিয়ে সন্তানকে প্রথম দেখে, সেটি লক্ষণীয়ভাবে ছোট।সদ্যজাতকে মেনে নিতে হ্যারিরও কোথাও দ্বিধা রয়েছে; তার মনের জানালাও যে সঙ্কীর্ণ– সেটা বোঝা যায়। কিন্তু হ্যারির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তাৎক্ষণিক।হ্যারি তার স্ত্রী-সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে সামনে এগোতে চায়।মনিকার সঙ্গে কাটানো গ্রীষ্মাবকাশের অভিজ্ঞতা তাকে আরও বাস্তবমুখী আর দায়িত্ববোধসম্পন্ন করে তুলেছে।
…
হ্যারি
যেখানে
গতানুগতিক,
মনিকা সেখানে
উচ্ছ্বল এবং প্রতিস্পর্ধী
…
হ্যারি যেখানে গতানুগতিক, মনিকা সেখানে উচ্ছ্বল এবং প্রতিস্পর্ধী। সে তার ‘স্টেটাস-কো’কে প্রশ্ন করে। জীবন এবং যৌবনের আনন্দ নিতে চায় তার নিজের মতো করে, ‘ঠিক করে দেওয়া’ সামাজিক কাঠামোর মধ্যে থেকে নয়। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, পুরো ছবিজুড়ে মনিকা হয় ধূমপান করছে, নয়তো বিয়ার খাচ্ছে অথবা পুরুষসঙ্গীর চুমু। বোঝা যায়, মনিকা অসম্ভব ইন্দ্রীয়বিলাসিনী। একটি বুদ্ধিদীপ্ত মন্তাজের মাধ্যমে মনিকার মুক্তির [অথবা বন্দিত্বের] সোপান দেখানো হয়, যেখানে পরপর দেখি, অভিজাত দোকানের সুসজ্জিত ডামি-নাইট ক্লাব-ডান্স ক্লাব…।

মনিকা বার্গম্যানের একটি ধ্রুপদী চরিত্র। জেন্ডার আইডেন্টিটির ডিসকোর্সে চরিত্রটি ভাবনার পরিসর তৈরি করে। এতদিনের চলে আসা নারী চরিত্রের চিত্রায়ানকে চ্যালেঞ্জ জানায়। মনিকা নিজেকে অবদমন করে না; দৃঢভাবে নিজের অস্তিত্ব ব্যক্ত করে। সামার উইথ মনিকার মূল সুর গেঁথে থাকে মনিকার মধ্যে।
একসময় মনিকা সমস্ত সামাজিক প্রচ্ছদ ছিঁড়ে ফেলে। স্বামী-সন্তান-সংসার ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে। থিয়েটারের ‘ফোর্থ ওয়াল’ ভেঙ্গে মনিকা সোজাসুজি তাকায় ক্যামেরার দিকে। অথবা অন্ধকারে বসে থাকা দর্শকের দিকে। মনিকা যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়- সমাজ, আসুন পারলে আমার বিচার করুন!

‘ফোর্থ ওয়াল’ ভেঙ্গে দেওয়া এ রকম একটি শট তখনো অবধি বিশ্ব চলচ্চিত্রে অশ্রুত। চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। পর্দাজোড়া মনিকার ক্লোজআপ। লং-শটে মনিকার এই দৃষ্টিপাত পর্দায় ভেসে থাকে প্রায় তিরিশ সেকেন্ড! একটা স্নায়বিক ধাক্কা তৈরি হয়।
এরপর থেকে, দর্শক বার্গম্যানের প্রায় প্রতি ছবিতে, ক্লোজআপে দেখতে পাবেন পর্দাজোড়া মানুষের মুখ।ঠোঁটের নড়াচড়া, চামড়ার ভাঁজ অথবা ভ্রুকুঞ্চন। অনেক পরে অভিনেত্রী লিভ উলমন তার আত্মজৈবনিক চেঞ্জিং বইয়ে লিখেছিলেন– “ক্যামেরাকে ইংমার নিজের চাওয়ামতো ক্লোজ পর্যায়ে যখন নিয়ে আসেন, তখন সেটি কোনো চেহারাকেই কেবল নয়, বরং সেই চেহারার মানুষটি কোন ধরনের জীবনকে দেখেছে– তাও ফুটিয়ে তোলে। [ক্যামেরা তখন] কপাল পেরিয়ে ঢুকে পড়ে চিন্তার জগতে– যে ভাবনার কথা এই চেহারার মানুষটি নিজেও জানত না; অথচ সেটির দেখা পাবেন দর্শক, এবং পারবেন চিনতেও।”
বার্গম্যান বলেছিলেন, তিনি একটি মাত্র ক্লোজআপ শটে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি করতে চান [কোনো পাঠকের মনে পড়ে যেতে পারে আব্বাস কিয়ারোস্তামির শিরিন ছবিটার কথা]।

সামার উইথ মনিকাতে ইতালীয় নয়া বাস্তববাদের প্রভাব সুস্পষ্ট। হলিউডি ছকের বাইরে এসে এই ছবিতে সাধারণ কর্মজীবী মানুষের রোজনামচা উঠে এসেছে। অভিনয় করেছেন সাধারণত অপেশাদার অভিনেতারা। স্টুডিয়োর বাইরে এসে ছবির শ্যুটিং হয়েছে বাস্তব লোকেশনে। ক্যামেরা ঘোরাফেরা করেছে মনিকার ঘুপচি ঘরে, দোকানে, বন্দর এলাকার স্যাঁতসেঁতে পথে-ঘাটে। এছাড়াও স্বাভাবিক আলোর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। ছবির মুড তৈরিতে, কখনো সূর্যোদয়ের আলো, কখনো ভরসন্ধ্যার আলো অথবা সূর্যাস্তের আলো কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে।
শেষদৃশ্যে হ্যারির ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে আসবে সামার উইথ মনিকা। আর ছবি শেষ হলে দর্শকের ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে আসবে মনিকার ক্লোজআপ, তার দীর্ঘ দৃষ্টিপাত– সমাজ, আসুন পারলে আমার বিচার করুন!
স্নায়বিক ধাক্কাটা লেগে থাকে ।
Somaj, asun parle amar bichar korun . Bah ! Monika ra benche thak.